ইসলামী শিক্ষাচার: প্রসঙ্গ হাই -হাঁচি ও পানাহার

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৩ আগস্ট, ২০১৭, ০২:৩১:৫০ রাত

ইসলাম এমন একটি ধর্ম যাতে রয়েছে পূর্নাাঙ্গ জীবন-ব‌্যবস্থা। একজন সত্যিকারের মুসলমান সব সময় ইসলামের বিধানের উপরই অটল থাকবে! মুসলমান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে কোনো জাতির কাছে মুখাপেক্ষী নয় বা সংস্কৃতিতে দেউলিয়া নয়। আমাদের রয়েছে উন্নত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মৌলিক কৃষ্টি। আমরা কখনো কারো কাছ থেকে ধার-দেনা করে নিজেদের সংস্কৃতির ভান্ডার গড়ি না বরং আমাদের শিক্ষা ও কৃষ্টি (মহান প্রভুর পক্ষ থেকে বলেই) সবদিক দিয়ে সম্মৃদ্ধ!!



ইসলামী শিক্ষাচার: প্রসঙ্গ হাই ও হাঁচি

একজন মুসলমান সব সময় আদাব বা শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রাখবে। কেননা আচার-আচরণ বা ব্যবহারেই মানুষের আসল পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। কথায় আছে-" ব্যবহারেই বংশের পরিচয়"

একাকী বা (ব্যক্তিগতভাবে গোপনীয়) ঘরের আচার ও জনসম্মুখের আচরণ কখনো এক নয়। যা "দৃষ্টিকটু বা রূচিহীন" এমন কাজ কখনো কোনো সভ্যলোক জনসম্মুখে করতে পারে না। হাই তোলার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা বা যথা সম্ভব চেপে রাখাই ইসলামী শিষ্টাচার। এমনই ভাবে হাঁচির সময়ও হাত দিয়ে (রুমাল বা যে কোনো জিনিস দিয়েও করা যায়) মুখ ঢেকে রাখা আদাব এবং সাস্থ্য সম্মত।

আফসোস! অনেক (আলেম ও শিক্ষিত) "দায়ী বা "বক্তা"কে দেখি মানুষের সামনে বিশাল হা করে হাই তুলছে, উচ্চশব্দে হাচি দিচ্ছে। এতে তার ব্যক্তিত্ব কতটুকু যে কমছে সে ব্যাপারে তার ধারণাই নেই।



হাদীস:

১.আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হাঁচি আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আর হাই তোলা শাইতানের পক্ষ থেকে। সুতরাং তোমাদের মাঝে কেউ হাই তুললে সে যেন মুখের উপর হাত রাখে। আর সে যখন আহ্ আহ্ বলে, তখন শয়তান তার ভিতর হতে হাসতে থাকে। আল্লাহ তা’আলা হাচিকে পছন্দ করেন এবং হাই তোলাকে অপছন্দ করেন। কাজেই কেউ যখন আহ আহ শব্দে হাই তোলে, তখন শাইতান তার ভিতর হতে হাসতে থাকে। (তিরমিযী:২৭৪৬)

২. আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ হাই তুলবে, তখন সে যেন আপন হাত দিয়ে নিজ মুখ চেপে ধরে রাখে। কেননা, শয়তান (মুখে) প্রবেশ করে থাকে।’’ (মুসলিম, দ্রষ্টব্য: রিয়াদুস সালেহীন:৮৮৯)

৩. আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হাঁচতেন তখন নিজ হাত অথবা কাপড় মুখে রাখতেন এবং তার মাধ্যমে শব্দ কম করতেন।’ (তিরমিযী: ২৭৪৫, আবূ দাউদ: ৫০২৯, আহমাদ: ৯৩৭০, রিয়াদুস সালেহীন: ৮৮৭)



৪. আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যখন তোমাদের কেউ হাঁচবে, তখন সে যেন বলে, اَلحَمْدُ للهِ ‘আলহামদু লিল্লাহ।’ (তা শুনে) তার ভাই বা সাথীর বলা উচিত, يَرْحَمُكَ الله ‘ইয়্যারহামুকাল্লাহ।’ সুতরাং যখন জবাবে ‘য়্যারহামুকাল্লাহ’ বলবে, তখন যে (হাঁচি দিয়েছে) সে বলবে, يَهْدِيكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ ‘য়্যাহদীকুমুকাল্লাহু অ য়্যুস্লিহু বালাকুম।’ (অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদেরকে সুপথ দেখান ও তোমাদের অন্তর সংশোধন করে দেন।)’’

(বুখারী: ৬২২৪, আবূ দাউদ: ৫০৩৩, আহমাদ: ৮৪১৭, রিয়াদুস সালেহীন:৮৮৪)

হেদায়াত ও উপদেশ গ্রহণ ও আমলের জন্য উপরের চারটি হাদীসই যথেষ্ট।

প্রসঙ্গ জনসম্মুখে পানাহার: জনসম্মুখে পান করতে চাইলে যথা সম্ভব গ্লাস ব্যবহার করুন, বোতলে বা পানপাত্রে মুখ দিয়ে কখনো পান করবেন না। পানাহারের সময় মুখ দিয়ে যেন অবাঞ্চিত শব্দ বের না হয় (বা কম বের হয়!)শব্দ করে পানাহার করা রূচিহীন ও অসাস্থ্যকর।

ইসলাম সব সময় অপচয় ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। তাই যথা সম্ভব পানাহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হৌন। তারপরও সবার খাবার গ্রহণ সমান নয়, সুতরাং আপনি যদি বেশি খাবার গ্রহণ করতে চান, জনসম্মুখে তা এড়িয়ে চলুন। একত্রে পানাহারের ক্ষেত্রে "পাত্রে" আপনি পরিমাণের চেয়ে বেশি না নিয়ে বরং কয়েকবার পাত্রে খাবার নিতে পারেন।

এমনভাবে খাবার গ্রহণ করুন যাতে আশে-পাশের মানুষ আপনাকে রূচিহীন বা অসভ্য না ভাবে।



হাদীস:

১. জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘‘কোন ব্যক্তি যখন নিজ বাড়ি প্রবেশের সময় ও আহারের সময় আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে; অর্থাৎ (‘বিসমিল্লাহ’ বলে) তখন শয়তান তার অনুচরদেরকে বলে, ‘আজ না তোমরা এ ঘরে রাত্রি যাপন করতে পারবে, আর না খাবার পাবে।’ অন্যথা যখন সে প্রবেশ কালে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে না (অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে না), তখন শয়তান বলে, ‘তোমরা রাত্রি যাপন করার স্থান পেলে।’ আর যখন আহার কালেও আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে না (অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে না), তখন সে তার চেলাদেরকে বলে, ‘তোমরা রাত্রিযাপন স্থল ও নৈশভোজ উভয়ই পেয়ে গেলে।’’ (মুসলিম: ২০১৮, আবূ দাউদ: ৩৭৬৫, রিয়াদুস সালেহীন: ৭৩৪)

২. ‘আয ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আহার শেষে এই দো‘আ পড়বেঃ-الحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أطْعَمَنِي هَذَا، وَرَزَقنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوَّةٍ،

‘আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্ব্আমানী হা-যা অরাযাক্বানীহি মিন গাইরি হাওলিম মিন্নী অলা ক্বুউওয়াহ।’ (অর্থাৎ সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এ খাওয়ালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন চেষ্টা ও সামর্থ্য ছাড়াই) সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত (ছোট) পাপ মোচন করে দেওয়া হবে।’’ (আবূ দাউদ: ৪২০৩, তিরমিযী: ৩৪৫৮ দারেমী: ২৬৯০, ইবনে মাজাহ:৩২৮৫, রিয়াদুস সালেহীন:৭৩৯)

৩. আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দু’জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট।’’ (বুখারী ও মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন: ৭৫৯)

৪. আবূ ক্বাতাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী:৫৩০৭, মুসলিম ২৬৭, রিয়া: ৭৬৩)

৫. আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মশকের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে বারণ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম, রিয়া:৭৬৭)

৬.আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানীয় পানকালে তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। একটি লোক নিবেদন করল, ‘পানপাত্রে (যদি) আমি খড়কুটো দেখতে পাই?’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তা ঢেলে ফেলে দাও।’’ সে নিবেদন করল, ‘এক শ্বাসে পানি পান করে আমার তৃপ্তি হয় না।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তুমি পেয়ালা মুখ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণ করো।’’ (তিরমিযী: ১৮৮৭, আবূ দাউদ: ৩৭২২, রিয়া:৭৬৯)

৬. উম্মে সালামাহ্ রাদিয়াল্লাহু‘‘আনহা হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি রূপার পাত্রে পান করে, সে আসলে নিজ উদরে জাহান্নামের আগুন ঢক্‌ঢক্ করে পান করে।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি সোনা-রূপার পাত্রে পানাহার করে...।’’ তাঁর অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি সোনা অথবা রূপার পাত্রে পান করে, সে আসলে নিজ উদরে জাহান্নামের আগুন ঢক্‌ঢক্ করে পান করে।’’ (দ্রষ্টব্য: রিয়াদুস সালেহীন:৭৮২)

আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং কবুলকৃত আমলের তাওফিক দান করুন। আমীন!!

সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল আলম দোয়েল

বিষয়: সাহিত্য

৮৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File