কুরআনের সুরমাধুর্য

লিখেছেন লিখেছেন REZAUL HAQUE ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০১:২৯:১৬ রাত




গিলেস গিলবার্ট নামে এক ফরাসী ব্যক্তির সাথে আমার একবার পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল ; যিনি রুচি , প্রকৃতি, এবং পেশায় ছিলেন একজন সুরকার এবং সংগীতবিদ।

তার মতে একজন ব্যক্তি অথবা জাতির সংস্কৃতি , কৃষ্টি অথবা সভ্যতার বিকাশের শুদ্ধ এবং একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে সংগীতের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা। মানুষের সভ্যতা বিচারের তার এই অদভুত মানদণ্ড আমাকে অভিভূত করে।

হঠাৎ করেই তিনি একদিন এক মুসলিম কারীর কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলেন , আর শুনেই তিনি একেবারে মুগ্ধ। তার কাছে মনে হচ্ছিলো এ যেন এক উচ্চ মার্গের সঙ্গীত। তিনি আরো অভিভূত হলেন যখন তাকে বলা হলো যে কুরআন আসলে কোনো কাব্যিক ছন্দে লেখা নয়, এটা বরঞ্চ একটা গদ্য।

তিনি গবেষণা শুরু করলেন। পদ্য যে কোনো ভাষাতেই সুরেলা এবং ছন্দময় - যার পরিমাপ এবং ছন্দোবিশ্লেষন করা সম্ভব। কিন্তু গদ্যেতো সেটা সম্ভব নয়। তাহলে আরবী ভাষায় এর ব্যতিক্রম কেন?

তিনি আরবী স্ক্রীপ্ট শিখে ফেললেন এবং নিজেই এই পবিত্র গ্রন্থ পড়তে শুরু করলেন। একটা পকেট সাইজের কুরআন কিনে সবসময় তিনি সাথে রাখতেন ।

তিনি এবার ছোট ছোট সূরা গুলো মুখস্ত করতে শুরু কোরলেন এবং অবশেষে এক বৃহৎ পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন - অর্থাৎ তিনি আব্দুল্লাহ গিলবার্ট এ রূপান্তরিত হলেন।

প্রায় ৪০ বছর আগে ইস্তাম্বুলে তার সাথে আমার প্রথম দেখা এবং পরে বন্ধুত্ব। সেই থেকে প্রায়ই তিনি আমাকে তার তত্ত্ব এবং আবিষ্কারের কথা বোঝাতে চাইতেন। যেমন, কবিতার ছন্দোবিশ্লেষণ যে কোনো ভাষাতেই গাণিতিক নিয়মে নির্ভুলভাবে নিরুপন করা সম্ভব কিন্তু গদ্য সাহিত্যের বেলায় সেটা সম্ভব নয়, হোকনা তা শাস্ত্রীয় অথবা আধুনিক । তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে আরবী ভাষা ; এবং আরবী ভাষাতেও একমাত্র শুধু কুরআনে।

সুতরাং কুরআন মানুষের উৎপত্তি হতে পারেনা। কুরআনের এই বিশেষ শব্দ চয়ন একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব। কেননা এর প্রতিটি আয়াতের ছন্দবিন্যাস কাব্যিক ধারাবাহিকতার (syllables of a poetic Hemistich) অনুসারী , এবং তা এতই নিখুঁত ও গাণিতিক যে একটি অক্ষরের হেরফের হলে তা তিলাওয়াত শুনেই তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলা সম্ভব।

যদিও তার আবিষ্কার এবং ব্যাখ্যায় আমি মুগ্ধ , কিন্তু নিজে সংগীতানুরাগী না হওয়ায় এব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিলোনা।

একদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। কিন্তু তাকে কেমন যেন উত্তেজিত, হতবুদ্ধি ও বিহ্বল মনে হচ্ছিল। তিনি রীতিমত কাঁপছিলেন। তিনি বললেন , আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিশ্চয়ই কুরআনের কিছু আয়াত হারিয়ে ফেলেছে। কেননা সূরা ১১০ - সূরা আল নাসর কারীরা যে ভাবে লিখে এবং তিলাওয়াত করে তা হলো - আফওয়াজা , ফাসাব্বিহ ; এই দুই শব্দের মাঝে সামান্য বিরতি ও পরের আয়াতে 'ফাসাব্বিহ' দিয়ে শুরু হয়। সংগীতের সুরের বিধান অনুযায়ী (musically ) এমনটি একেবারেই অসম্ভব।

কুরআনের শব্দের উচ্চারণ এবং তিলাওয়াতের নিয়মাবলী ( tajweed and psalmody ) সম্বন্ধে আমার যৎকিঞ্চিৎ সাধারণ যা ধারণা ছিল তাই দিয়ে তাকে বললাম , তুমি যা শুনেছ সেটাই একমাত্র বিধান নয়। তিলাওয়াত আরো একভাবে করা হয় - তাহলো ' আফওয়াজান ফাসাব্বিহ '; অর্থাৎ আফওয়াজার পরে একটা 'ন ' জুড়ে দিয়ে এবং আফওয়াজান ও ফাসাব্বিহ একই সাথে বিরতি ছাড়া তিলাওয়াত ও করা হয় । ( ভিডিওতে ৪ মি:৩৮ সে: এই নিয়মের তিলায়াতটি শোনা যাবে)।

আমার কথা শুনে আব্দুল্লাহ যেন প্রাণ ফিরে পেলো। মহাখুশী হয়ে সে বললো , তাহলে সব ঠিকই আছে। কোনো আয়াতই হারানো যায়নি। আব্দুল্লাহ তার হারানো বিশ্বাস আবার ফিরে পেলো।

আব্দুল্লাহর কাছে কুরআন শুধুমাত্র সংগীত ( অথবা প্রার্থনা সংগীত) ছাড়া কিছু নয়। এমনকি এর ব্যাকরণের ব্যাপারেও তার কোনো প্রশ্ন বা মতবাদ ছিলোনা। তুর্কীদেরকে সে ভালোবাসতো, এবং যখনই সে প্যারিসে আসতো জুমআর দিনে সে তুর্কীদের মসজিদেই যেত।

একদিন এক তুর্কি বন্ধু এসে আমাকে জানালেন যে আবদুল্লাহ খুব অসুস্থ। ব্যস্ততার কারণে বহুদিন তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়ায় এ খবরটা আমার জানা ছিলোনা। তাই তৎক্ষণাৎ আমার সেই বন্ধুকে সাথে নিয়ে আব্দুল্লাহর বোনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম যেখানে তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় যে আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি। আব্দুল্লাহ নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে অজ্ঞান অবস্থাতেই দুই দিন পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো । ঈশ্বর তাঁর আশীর্বাদ ও রহমত তার উপর বর্ষণ করুন।

কুরআনের বহুবিধ বৈশিষ্ট সমূহের মূল্যায়ন বিভিন্ন ভাবেই করা যেতে পারে । তবে এর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এর স্ক্রীপ্ট এবং সুরবিন্যাস (script and psalmody) ।

আরবী স্ক্রীপ্ট এর উৎপত্তি হয়েছিল পবিত্র কুরআনের সঠিক উচ্চারণের জন্য ; আর তাজুইদ (tajweed ) এর সূচনা কুরআন তিলাওয়াতকে সুরেলা ও মাধুর্যমণ্ডিত করার জন্য।

**

মূল : The Melody Of Quran - Dr Mohammad Hamidullah

বংগানুবাদঃ রেজাউল হক

( ড. মুহাম্মাদ হামিদুল্লাহ D .Phil, D.Litt,HI., (১৯০৮-২০০২) একজন উপমহাদেশীয় পন্ডিত এবং একাডেমিক লেখক যিনি ২৫০ টির ও উপরে বই লিখেছেন। তিনি ২২ টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং ৮৪ বছর বয়সে থাই ভাষা শিখেন। ইসলামের ইতিহাস, বিজ্ঞান ,সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপরে তিনি হাজার হাজার প্রবন্ধ লিখেছেন যা বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশ হয়েছে।

তার লেখা এই প্রবন্ধটি আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে আরব আমিরাতের দৈনিক পত্রিকা Khaleej Times এ প্রথম পড়ার সুযোগ হয়েছিল )

mrhaque২০০০@hotmail.com

Toronto , Canada

বিষয়: বিবিধ

৪৬০৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381043
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Jajakallah
381055
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৪৯
কুয়েত থেকে লিখেছেন : আল্ কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশ্বয়কর সৃষ্টি যা মহা নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা(সাঃ)এর জন্য জীবন্ত মোজেযা ক্বেয়ামতের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত। বিশ্ব মানবতেকে শান্তি পেতে হলে অাস্তে হবে আল্ কুরআনের কাছ। ভালো লাগলো আপনাকে ধন্যবাদ
381069
০১ জানুয়ারি ২০১৭ রাত ০২:২৭
REZAUL HAQUE লিখেছেন : আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File