সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত - ৩১ - ৩২

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১০:৪১:০৬ সকাল



ফেরকাবাজ আলেম ও মুরুব্বিরা ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা স্ব স্ব ফেরকার প্রতিনিধিত্ব করে। সবাই চায় সকল মুসলমান তাদের ফেরকায় আসুক, তাদের মুরুব্বির উম্মত হয়ে যাক। কিন্তু তাদের কেউ মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মত হতে রাজী নয়। এর প্রমাণ হলো, যদি তারা মুহাম্মদ (সা) এর উম্মত হতে চাইত আর ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হত তাহলে এতসব ফেরকায় বিভক্ত হত না। আর ফেরকা থাকলেও ইসলাম ও উম্মাহর স্বার্থে মতভেদ বাদ দিয়ে বা মতভেদসহই ঐক্যবদ্ধ থাকত। তখন এমনিতেই খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত, মুসলিম বিশ্বের একটা কেন্দ্র থাকত, তাহলে আজ ইসলাম ও উম্মাহর এমন পতন ঘটত না। বস্তুত তারা কেউ রাসুলের উম্মত হতে চায় না, চায় স্ব স্ব ফেরকার উম্মত হতে।

কাজেই তারা যখন দেখল হাসান মুসান্নার কারণে তাদের উম্মত কমে যাচ্ছে, তখন তারা বিরোধিতায় নামল। দেওবন্দি মুরুব্বিরা দেখল মাদরাসার ছাত্ররা সব হাসান মুসান্নার ছাত্র হয়ে যাচ্ছে, তাবলীগী মুরুব্বিরা দেখল তাদের সাথিরা মুসান্নার সাথী হয়ে যাচ্ছে, জামাতিরা দেখল তাদের শিবির কর্মিরা মুসান্নার কর্মি হয়ে যাচ্ছে, মাযার পন্থীরা দেখল তাদের যাকের ভাইরা মুসান্নার যাকের হয়ে যাচ্ছে। হাসান মুসান্না যেন একটা মহাসাগর- যে নদী নালার ন্যায় সকল দল ফিরকাকে আপন বুকে টেনে নিচ্ছে। কাজেই মুসান্নার কারণে যখন তারা উম্মত হারানোর আশংখা করল তখনি প্রত্যেক ফিরকার মুরুব্বিরা তার বিরুদ্ধে মাঠে নামল।

আবার মানুষের স্বভাবজাত নিয়ম হল, সে আপন বলয়ে অন্যের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নয় না। যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বি এন পির নেতৃত্ব মানে না, বি এন পি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানে না। আবার উভয় দল থেকে বেড়িয়ে কেউ নতুন দল করতে চাইলে তাকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আলেম সমাজ সাধারণত সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতৃত্ব করার সুযোগ পায় না, তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব শুধু ধর্মীয় বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাজেই হাসান মুসান্না কী চাচ্ছে, ইসলাম ও উম্মাহর জন্য কি করছে সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল না, বরং ধর্মীয় বলয়ে তার উপস্থিতিই তারা নিজেদের নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করল। তখন তাদের মধ্যে হাজারটা বিরোধ থাকলেও, একে অন্যের ছায়া না মারালেও, ইসলাম ও উম্মাহর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না হলেও একটা বিষয়ে তারা একমত হল যে, হাসান মুসান্নাকে ধ্বংস করতে হবে। তার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু করল।

ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে বড় মাদরাসা। মাওলানা মোজাহিদ বিল্লাহ এ মাদরাসার শিক্ষক। সদ্য পাশ করা অবিবাহিত যুবক মানুষ, কোরান হাদীস তাফসীর ফিকহ, আকায়েদ, বালাগাত, মানতেক, কুল-ফন্ন ও যোগ্যতায় সে দেশের দু’চার জন আলেমের মধ্যে একজন। অন্তত ময়মনসিংহে তার জুরি নেই।

কওমী মাদরাসার নিয়ম হল একজন শিক্ষক যত যোগ্যতার অধিকারীই হউক না কেন প্রথমেই তাকে হাদীস পড়ানোর সুযোগ দেয়া হয় না। পড়াতে পড়াতে অভিজ্ঞতা হলে প্রৌঢ় বয়সে তাকে দাওরায় ক্লাশ দেয়া হয়। কিন্তু মাওলানা মোজাহিদকে তার অতুলনীয় যোগ্যতার কারণে প্রথমেই মুসলিম শরীফ পড়াতে দেয়া হল। তার উন্নত পাঠদান পদ্ধতি, বিজ্ঞান ভিত্তিক কোরান হাদীসের প্রতিটা বিষয়ের চুল চেরা বিশ্লেষণ, গভির প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য পূর্ণ আলোচনা, সুবচন ও মধুময় ব্যবহারের কারণে ছাত্র শিক্ষক সবাই তার ভক্ত। তাছাড়া সে মাঝে মধ্যে বেছে বেছে দু’চারটা ওয়াজ মাহফিল করে। শ্রোতারা তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তন্ময় হয়ে শুনে, তারা প্রভাবিত হয়, আলোড়িত হয়, এভাবে সর্বত্রই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে হয়ে উঠে মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক ও সাধারণ জনগণের আস্থাভাজন প্রিয়পাত্র।

এ মাদরাসার প্রৌঢ় শিক্ষক মাওঃ কাসেম আগে মুসলিম শরীফ পড়াতেন। কিন্তু এখন তা মাওঃ মুজাহিদকে দিয়ে তাকে আবু দাউদ শরীফ দেয়া হয়েছে। এ জন্য তিনি তার উপর ক্ষ্যাপা। তারপর যখন থেকে মোজাহিদ হাসান মুসান্নার মজলিসে আনাগুনা শুরু করেছে তখন থেকেই তিনি তাকে জব্দ করার চেষ্টা করছেন কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

তিনি তার নির্ধারিত ঘন্টায় দাওরা ক্লাসে গিয়ে বসলেন, পকেট থেকে পলিথিনে মোড়ানো পানের বস্তা বের করে পান খেলেন। তারপর ছাত্রদের প্রতি একপাক দৃষ্টি বুলিয়ে মুখটা বিকৃত করে বললেন, ‘তোরা সবাই ঐ ভণ্ড লোকটার সভায় যাস, মোজাহিদ সাব তোদের নিয়ে যায়, তাই না? তোদের সাহস কত বড়, যে ব্যক্তি দেওবন্দিদের বিরোধিতা করে, আমাদের মুরুব্বীদের ফিরকাবাজ কাফের ফাসেক ডাকে তোরা তার ভক্ত হয়ে গেছিস, তোদের অবশ্যি বিচার হবে। কিন্তু এ মাদরাসার ছাত্ররা কোন হুমকিতে ভিত নয়। কারণ এখানকার সকল ছাত্র কথিত ভণ্ড লোকটা মানে মুসান্নার অনুসারী। কাজেই ছাত্রদের উপর বাড়াবাড়ি করলে মাদরাসাটাই ভেঙ্গে যাবে।

তখন ছাত্রদের কেউ মাথা নিচু করে কেউ মাথা উচিয়ে হাসছে। এক ছাত্র বলল, তিনিও তো একজন আলেম, তার বাবাও দেওবন্দি আলেম ছিলেন। উস্তাদ খেকিয়ে উঠলেন, কিতাবাদি পড়লেই আলেম হওয়া যায় না। দেখ, আমাদের মুরুব্বীদের কথার বাস্তব প্রমাণ দেখ। মুরুব্বীরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আলিয়া মাদরাসা ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া জায়েয নেই। আর এই লোক মুরুব্বীদের হুকুম লঙ্ঘন করে কওমীর সাথে সাথে আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়েও লেখা পড়া করেছে। সেখানে গিয়ে নিশ্চয়ই শিবিরে যোগ দিয়েছে, আর তখনই ওর মাথাটা বিগড়ে গেছে। কিন্তু তার মুরুব্বী ফুলপুরের পীর সাব তার মাথাটা ঠিক করার জন্য কওমী মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে সে বুখারি শরীফ পড়াত, খুব ভাল একটা উস্তাদ ছিল। কওমী মাদরাসায় থাকলে ছাত্ররা তার থেকে অনেক উপকৃত হতে পারত।

কিন্তু সে পয়সার লোভে আলিয়া মাদরাসায় চলে গেল। সেখানে গিয়ে নিশ্চয় জামাত শিবির করেছে। তখন তার মাথায় কওমী, আলিয়া ও জামাত- এই তিন চিন্তা ধারা টক্কর খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে ময়মনসিংহে এসে পাগলামি শুরু করেছে। পাগলামি থাকবে না, ওকে পিটিয়ে শহর ছাড়া করা হবে। আরে সে তো তার বাপের মুখেও চুনকালি দিচ্ছে। তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত আলেম, দেওবন্দ থেকে মুফতি হয়ে এসেছিলেন। আর সে হল আলেমের ঘরের যালেম। নূহ (আঃ) এর ছেলে কিনানের ন্যায় কাফের। তোরা আর কেউ ওখানে যেতে পারবি না, সে আসলে জামাতের দালাল।

আরেক ছাত্র বলল, ‘তিনি কারো দালাল নয়, সকল ফেরকার বিরুদ্ধেই কথা বলেন, আর যা বলেন কোরান হাদীসের ভিত্তিতেই বলেন। আপনি নিজেও তো একবার গিয়ে যাচাই করে আসতে পারেন। উস্তাদের গায়ে যেন কেউ গরম তেল ছিটিয়ে দিল, তিনি লাফিয়ে উঠলেন, ‘কী তোদের এত বড় আস্পর্ধা, আমাকেও ঐ ভণ্ডের কাছে যাওয়ার দাওয়াত দিচ্ছিস। রাখ আজ আমি এর একটা বিহিত করে তবেই ছাড়ব’ বলে তিনি ঝড়ের বেগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। গিয়েই অধ্যক্ষের উপর হামলে পড়লেন, ‘আপনি কিসের মুহতামিম, একটা ভণ্ড সবকিছু উলটপালট করে দিচ্ছে। অথচ আপনার মাদরাসার শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে তার দলে যোগ দিয়েছে কিন্তু আপনি কিছুই করছেন না, হয় ঐ ভণ্ডকে শহর ছাড়া করেন নয়তো নিজের ছাত্র সামলান।

মুহতামিম বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে বুঝিয়েছি কিন্তু সে যা বলে সত্যই বলে, কোরান হাদীসের আলোকেই বলে। কাজেই আমার আর করার কিছুই নাই। কাসেম সাব খেকিয়ে উঠলেন, ‘করার তো আছেই কিন্তু করবেন না। কারণ আপনি তো ঐ ভণ্ডের বাবার ছাত্র। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না, যা করার আমরাই করব। বেটা ভণ্ড নিজের নাম দিয়েছে উস্তাদজি গুরুজি। এবার ওর গুরুগিরি বার করব। পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে শহর ছাড়া করব, আর যেসব ছাত্র সেখানে যায় তাদের নাম কেটে বের করে দেব। আরেক শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখেন যেন আবার ছাত্ররা আপনার হাত পা ভেঙ্গে শহর ছাড়া না করে বসে। ব্যস শুরু হয়ে যায় ঝগড়া, ভীষণ ঝগড়া।

ময়মনসিংহের মহিলা মাদরাসা। রাতের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। দাওরা ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী হুমায়রা তাবাসসুম মাত্র বাড়ি থেকে আসল, তাড়াতাড়ি বোরকা ছেড়ে গিয়ে ক্লাসে বসল। পঁচিশ ত্রিশজন ছাত্রী। উস্তাদের তেপায়ার সামনে পর্দা দেয়া। পুরুষ শিক্ষক হলে পর্দার আড়াল থেকে পড়ান আর মহিলা শিক্ষিকা হলে সামনা সামনি বসে পড়ান। এখনো কিতাব শুরু হয়নি। পর্দার আড়াল থেকে হুজুর অন্য একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তিনি রিতিমত গর্জে উঠলেন, ‘আমি শুনেছি আমাদের অনেক ছাত্রী ঐ ভন্ডটার মজলিসে যায়, ওরা কারা আমি ওদের তালিকা চাই। তার রুক্ষ কণ্ঠ চতুষ্কোণ কামরাটিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। ছাত্রিদের কেউ কেউ দম বন্ধ করে বসে আছে, কেউ মাথা নিচু করে, কেউ বা প্রফুল্ল বদনে মাথা উঁচু করে আছে। হুমায়রার ঘনিষ্ঠ বান্ধবি তামান্না আবার ঘনিষ্ঠ শত্রুও বটে। কারণ এক রোলটা নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে টানাহেচড়া, কখনো হুমায়রা এক হয় কখনো তামান্না। এজন্য দু’জনে বান্ধবি হওয়া সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে তোষের আগুন জ্বলে। সুযোগ পেলেই একে অন্যকে বাঁশ দেয়।

তামান্না মাথা নিচু করে বসে আছে, হুমায়রা জানে সে মুসান্নার মজলিসে যায়। তাই তাকে খোঁচা দেয়ার জন্য বলল, ‘হুজুর আমাদের এখান থেকে কে কে যায় আমি জানি না, তবে বুঝতে পারি অনেকেই যায়। হুজুর গর্জে উঠলেন, ‘তুই খোঁজে খোঁজে ওদের নামের তালিকা করে আমার কাছে দে, তারপর দেখ কি বিচারটা করি। ঐ ভন্ড প্রচার করছে কওমী মাদরাসায় পড়া জায়েয নাই, আমাদের মুরুব্বিরা নাকি ফিরকাবাজ কাফের। উহঃ কাঁহা তক শয়তান, আমাদের মুরুব্বিদেরকে কাফের বলে। অথচ এমন একটা বদমাইশের মাহফিলে তোরা যাবি আর মনে করেছিস আমরা তোদেরকে ছেড়ে দেব? এর কঠিন বিচার হবে।

হুমায়রা বলল, ‘হুজুর শুনেছি ঐ লোকটা নাকি আলেম, তাহলে এমন কথা বলে কেমনে? সে নাকি বলে, কওমী শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে উপমহাদেশের সকল আলিয়া ও কওমি মাদরাসা এক করে দিবে। হুজুর ছিটিয়ে উঠলেন, ‘উহঃ তুলে দিবে, মাদরাসাগুলি যেন তার বাপ দাদার তালুক, যা ইচ্ছা তাই করবে। শুন আসল দোষ তো ঐ ভণ্ডটার নয় আমাদের। মাদরাসার ছাত্ররা গিয়েই ওর সাহসটা বাড়িয়ে তুলেছে। এখন তোকে দায়িত্ব দিলাম যারা যায় ওদের নামের তালিকা কর, ওদের মাথা মুন্ডিয়ে মুখে চুনকালি মেখে মাদরাসা থেকে বের করে দেব। তারপর তিনি কিতাব পড়ানো শুরু করলেন।

কেন্দ্রীয় মারকাজ মসজিদ। মুরুব্বীদের একটা পরামর্শ সভা হল। তাদের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রত্যেক মুসলিম নর নারীকে কিভাবে তাবলীগের সাথে যুক্ত করা যায়, কিভাবে প্রত্যেক মুসলমানকে ন্যুনতম তিন চিল্লা দেয়ানো যায়। স্বচ্ছল ও ধনী তাবলীগিরা দরিদ্র লোকদেরকে কিছুটা আর্থিক সাহায্য দিয়ে কিভাবে তাবলীগে পাঠানো যায়। বিশেষ গুরুত্বের বিষয় হল ছাত্র সমাজ। দাওরা পাশ ছাত্রদের সাল চিল্লায় পাঠানো বাধ্যতা মূলক। আলিয়া মাদরাসায় তাবলীগের কাজ করা হয় না, সেখানে পোরোদমে কাজ করতে হবে, কামিল পাশ ছাত্রদের সাল চিল্লায় পাঠাতে হবে। অধিকন্তু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাবলীগের কাজ দুর্বল, এই সুযোগে ধার্মিক ছেলেদেরকে শিবিরে ঢুকিয়ে ওদের ঈমান আমল নষ্ট করা হচ্ছে। মওদুদীবাদের বিকৃত ইসলামকে প্রকৃত ইসলাম বলে বুঝিয়ে ওদের ইহকাল পরকাল ধ্বংস করা হচ্ছে। কাজেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করতে হবে, প্রত্যেকটা ছেলেকে তাবলীগের দায়ী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।

সভা শেষে প্রধান মুরুব্বীসহ কয়েকজন বসলেন, হোটেল থেকে নাস্তা এনে তারা খাওয়া ও খোশ গল্পে মশগুল হলেন। একজন বলল, ‘আমরা চেষ্টা করে কি হবে। একজনই তো আমাদের সকল প্রচেষ্টা পন্ড করে দিচ্ছে। আরেকজন বলল, ‘ঐ ভণ্ডটার কথা বলছেন, সে আমাদেরকে মুসলমান হিসাবেই গণ্য করে না। অন্যজন বলল, আচ্ছা সে বলে কি? আরেক মুরুব্বী বলল, সে বলে তাবলীগ জায়েয নেই, তাবলীগিরা মুসলমান নয়। আমরা নাকি ইলিয়াস (রঃ) কে নবী মানি, রাসূল (সাঃ) কে মানি না। আরেক জন বলল, আচ্ছা সে নিজে আলেম হয়ে এ ধরনের কথা বলে কেমনে? আগের জন উত্তর দিলেন, ‘আরে শুনেন, ঐ লোক আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দেসি করত, তখনই সম্ভবত সে জামাত শিবিরে যোগ দিয়েছে। আর এ জন্যই তাবলীগের বিরোধিতা করে। আসলে সে জামাতের দালাল।

জেলা আমীর গলা খাকারি দিয়ে বললেন, শুনেন অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই দুর্বলতা আমাদের। ঐ ব্যক্তি দাওরা করার পর যদি তাকে বলে কয়ে সাল চিল্লায় পাঠানো যেত তাহলে আজ এ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। এখন আমার পরামর্শ হল আপনারা তার কাছে যান, গিয়ে তার প্রশংসা করে বলুন, আপনার বাবা ছিলেন বিখ্যাত আলেম, আপনিও ভাল আলেম। কিন্তু সাল চিল্লা না দেয়ার কারণে আপনার মধ্যে গুমরাহি দেখা দিয়েছে। এ জন্যই আমাদের মুরুব্বীরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আলেমদের সাল চিল্লা বাধ্যতামূলক। কাজেই মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আপনি সাল চিল্লায় যান, পারলে জীবন চিল্লা দেন। তারপর আমীর সাব বললেন, আপনারা যেভাবেই হউক চেষ্টা করে তাকে চিল্লায় পাঠান। জীবন চিল্লায় পাঠাতে পারলে উত্তম। আর তার খরচা পাতি আপনারা বহন করার চেষ্টা করবেন। এই সিদ্ধান্তের উপর সভা ভঙ্গ হল।

সময়টা ছিল জামাতের জন্য কঠিন দুঃসময়। তাদের উপর সরকারি ধর পাকড় চলছে, সেই সাথে গুম, হত্যা, জেল, জুলুম, নির্যাতনের ভয়াবহ স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে মিটিং মিছিল ও সভা সমিতি করতে পারে না। অগত্যা ময়মনসিংহ শহর জামাতের নীতি নির্ধারক কয়েক জন নেতা সন্ধ্যার পর এক আমিরের বাসায় গোপন বৈঠকে বসলেন। তাদের এজেন্ডা হল বর্তমান পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ এবং জামাতের ছাত্র সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধিকরণ। বক্তাগণ বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, বি এন পি-এর সাথে জামাতের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং বি এন পির অভ্যন্তরে জামাত বিরোধি চক্রকে কোণঠাসা করতে হবে, দলীয় চেয়ার পার্সনের আস্থা অর্জন করতে হবে। সর্বোপরি আওয়ামি লীগের সাথে দুরত্ব কমিয়ে যথা সম্ভব ঘনিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও এমন বক্তব্য দিল না এমনকি চিন্তাও করল না যে, আমরা একটা ইসলামী দল, কাজেই অন্যান্য ইসলামী দলের সাথে দুরত্ব কমিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইকামতে দ্বীনের কাজ করব।

আবার ছাত্র সংগঠনের শক্তি বর্ধন সম্পর্কে আলোচনা হল, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সর্বস্তরের ছাত্রদের কাছে শিবিরের দাওয়াত পৌছাতে হবে। এমনকি কওমী মাদরাসার ভাল ছাত্র এবং বড় বড় হুজুরদের ছেলেদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে। তারা এই সিদ্ধান্ত দিল যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির ভর্তি কার্যক্রমের সময় নবিন বরন অনুষ্ঠান করতে হবে, নতুন ছাত্ররা ভর্তির সময় নতুন পরিবেশে এসে দিশেহারা ও ভিতগ্রস্থ অবস্থায় থাকে। তখন তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ছাত্ররা শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট হবে। বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে, কোন ছাত্র যেন তাবলীগে যোগ দিতে না পারে। কারণ কোরানে বলা হয়েছে ‘যারা আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, ফাসেক, জালেম। অথচ তাবলীগিরা ইক্বামতে দ্বীন বা খিলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুধু বাদই দেয়নি বরং এটাকে জায়েযই মনে করে না। তারা শুধু পোটলা পাটলি নিয়ে মসজিদে মসজিদে দৌড়া দৌড়ি করে, আর প্রচার করে এটাই একমাত্র নবীওয়ালা কাজ।

তদুপরি তারা জিহাদের নসগুলিকে অপব্যাখ্যা করে তাবলীগের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। এক কথায় তারা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলেছে। কাজেই এরা কিভাবে মুসলমান গণ্য হবে তা আমাদের বুঝে আসে না। এজন্যই তাবলীগ করার চেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করা ভাল। কারণ এরা দুনিয়ার স্বার্থে রাজনীতি করে তবে ইসলামকে বিকৃত করে না। কিন্তু তাবলীগ ইসলামের নামে ইসলাম বিকৃত করে চলেছে। কাজেই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রত্যেকটা ছাত্রকে শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট করা। যারা শিবিরে আসবে না তারা যেন কোন ভাবেই তাবলীগে যোগ দিয়ে ঈমান খুইয়ে না বসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাবলীগের চেয়ে বরং ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ, ছাত্র দলে যোগ দেয়া অনেক ভাল।

একজন বলল, আমরা চাইছি মুনাফা কিন্তু আমাদের তো মূলধনই খোয়া যেতে বসেছে। আপনারা অবশ্যি জানেন, শহরে মুসান্না নামের একটা ভন্ডের আবির্ভাব ঘটেছে। সে শিবিরের ছেলেদেরকে নিজের দিকে ঝুকিয়ে নিয়েছে। শুধু শিবির কেন সর্বস্তরের ছাত্র সমাজ ও যুব সমাজ তার খুব ভক্ত এমনকি কওমী মাদরাসার ছাত্র- যারা কোন দিন কওমী গন্ডির বাইরে যায় না এরাও কিনা এই ভন্ডের ভক্ত হয়ে গেছে। ভক্ত বলা ভুল হবে একেবারে উম্মত হয়ে গেছে। এই ব্যাক্তি ঔদ্ধত্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সে আমাদেরকে ফিরকাবাজ কাফের বলে, আমরা নাকি রাসূল (সাঃ) কে নবী মানি না, মওদুদী (রঃ) কে নবী মানি। ওকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে শহর থেকে বের করে দেয়া উচিত। আরেকজন বলল, কিন্তু তাতো পারবেন না, আমাদের শিবিরের ছেলেরাই তখন আমাদের হাত পা ভেঙ্গে দেবে। এরাও ঐ ভন্ডের উম্মত হয়ে গেছে।

সভাপতি বলল, ‘শুনেন এসব বাজে বিষয় নিয়ে মাতামাতি করার দরকার নাই। মানুষ নিজের নাম ফাটানোর জন্য, পেট চালানোর জন্য কত কিছুই তো করে। এ লোকটা আগে শিক্ষকতা করত, তার চাকরিটা চলে গেছে বা ছেড়ে দিয়েছে। এখন পেট চালানোর জন্য ও নিজেকে জাহির করার জন্য এ পথ বেছে নিয়েছে, বাদ দেন এসব ফাও বিষয়। সে শুধু আমাদেরকে কাফের বলে না সবাইকে বলে। দেওবন্দি ধারাকেও কাফের বলে। আর ওদেরকে কাফের বলা মানে ঘুমন্ত সিংহের পাছায় আঙ্গুল দেয়া। ওরা যখন জেগে উঠবে তখন এই ভন্ড হাওয়া হয়ে যাবে। কাজেই ঐ ভন্ডের উপর আমাদের কিছুই করার দরকার নাই, যা করার কওমী হুজুররাই করবে। আমাদের করনীয় হল সংগঠনের ছেলেদের প্রতি মনোযোগি হওয়া ওরা যাতে ঐ লোকের ধারে কাছেও না যায়। এ বিষয়ে আরো কিছু আলোচনার পর মজলিস ভঙ্গ হল।

ময়মনসিংহ শহরের প্রান্তে এক খাজা বাবার বাড়ি, সেখানে ওরস চলছে। এক বক্তা মঞ্চে উঠেই ষাঁড়ের মত গলা ছাড়ল, ‘ভাইয়েরা আমার, নিশ্চয়ই আপনারা শুনেছেন, শহরে এক প্রতারক এসেছে। সে ঘোষণা দিয়েছে মাযারগুলি শিরক বিদাতের আখরা, মানুষ এসে মাজারে সেজদা করে চুমু খায়, আবার মাজারে বা পীর বাবার কাছে সন্তান চায়, চাকরি ব্যবসা বানিজ্য প্রেমে সফলতা চায়, এগুলি নাকি শিরক। আবার রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে কোন মাজার ছিল না বিধায় মাজার রাখা যাবে না, এগুলি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আবার সে গান গাঁয়, ‘দয়াল বাবা, কেবলা কাবা আয়নার কারিগর, আয়না বসাইয়্যা দে বাবারে কলবের ভিতর’। সে বলে দয়াল বাবারা নাকি শুধু মেয়েদের কলবে আয়না বসানোর কারিগর, পুরুষের কলবে আয়না বসায় না।

তারপর সে বাঘের মত গর্জন শুরু করল, ‘এই ভণ্ড ওয়াহাবি দেওবন্দি, সে ওয়াহাবিদের দালাল। এই সব কথা বলে মাযারের অবমাননা করেছে। পীর দরবেশ গউস কুতুব ওলী আবদালদের অপমান করেছে। আব্দুল কাদের জিলানি, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, শাহ জালালদের (রঃ) অপমান করেছে। এই দেশ ওলী আওলিয়ার দেশ, মাযারের দেশ। সে বা যারা অলিদের অপমান করবে তাদের এই দেশে ঠাই হবে না। আমরা কোন হাঙ্গামা করতে চাই না, সরকারের কাছে আমাদের আবেদন খুব শীঘ্রই এই ভণ্ডকে ফাসি দিতে হবে, নইলে দেশের দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আগুন জ্বলে উঠবে। আমরা খুব শীঘ্রই আন্দোলন কর্মসুচি ঘোষণা করব, আপনারা এই আন্দোলনে থাকবেন তো? শ্রোতারা সবাই হাত তুলে নারায়ে তাকবির বলে সম্মতি জানাল। তারপর বক্তা আন্দোলনের কি কি কর্মসূচী দিবে তার একটা ফিরিস্তি দিয়ে বক্তব্য শেষ করল।

শহরের কামিল মাদরাসা। শিক্ষক মিলনায়তনে আলোচনার ঝড় উঠল, ‘এক ভণ্ড প্রচার করছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা নাকি আলিয়া মাদরাসা। এখানকার শিক্ষকরা নিজের রুটিনের কিতাবটা রিডিং পর্যন্ত পড়তে পারে না। এরা জাতির সাথে প্রতারণা করছে, ধর্ম শিক্ষার নামে ব্যবসা করছে।। আলিয়ার ছাত্ররা কামিল পাশ করেও কামিল শব্দের অর্থ জানে না, সুরা ফাতেহাটা পর্যন্ত শুদ্ধরুপে পড়তে পারে না, অর্থ জানে না। এজন্য এ শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে’। কাজেই শিক্ষকরা সবাই ক্ষ্যাপা, তারা আলোচনা করছে ‘এই ব্যক্তি আলিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করার কারণ হচ্ছে সে কওমীর দালাল। সে কওমী মাদরাসার ছাত্র ছিল, কাজেই একে প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু তারা নিজেদের ছাত্রদের ব্যাপারে আশংখা বোধ করল।

এইভাবে বিষয়টা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। বি এন পি কার্যালয়ে আলোচনা হল, তারা জানে মাদরাসা এবং জামাত হল তাদের ভোট ব্যাংক। এরা কখনো আওয়ামি লীগে ভোট দেয় না। এজন্য তারা চায় এই হুজুররা পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ না করে মিলে মিশে থাকুক। কারণ তাদের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে আওয়ামী লীগ হাত মারবে। আর তখন বি এন পির ভোটে টান পড়বে। কাজেই সেখানে উপস্তিত বি এন পির এক সাবেক মন্ত্রী মন্তব্য করল, ‘আরে শুন, এসব মোল্লা মুন্সিরা কখনো জ্ঞান- বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করে না, দেশের উন্নতি অগ্রগতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, আবিষ্কার, উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা করে না। খেয়ে দেয়ে ওদের তো কোন কাজ নেই বিধায় একটা কাজই তারা সুচারুরুপে আঞ্জাম দেয়, একে অন্যের পাছায় আঙ্গুল দেয় আর খোঁচাখুঁচি করে। এরা আসলেই ইতর। এদের কথা বাদ দাও, আসলে এই লোক আওয়ামি লীগের দালাল। সাথে সাথে সবাই হুজুরদের প্রতি উৎকট ঘৃণা প্রকাশ করল। তখন অন্যান্য নেতারা বলল, তবে যাই হউক চিন্তার কারণ নাই, তার সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর বাসা। মন্ত্রীবর মোসাহেব পরিবেষ্টিত হয়ে হাসতে হাসতে চেয়ারে এলিয়ে পড়ছেন, ‘উচিত শিক্ষা উচিত শিক্ষা, এই হারামজাদা মোল্লা মুন্সিরা আমাদেরকে ভোট দেয় না, ওরা কুত্তার মত কামরা কামড়ি করে মরুক। ঐ উস্তাদজি নামের ভণ্ডটা সবাইকে কাফের বলছে তোরা তো শুধু এটুকু সংবাদ দিলে কিন্তু মারামারি করে কয়েকশ মরেছে এমন সংবাদ দিতে পারলেই তো প্রকৃত খুশির সংবাদ হত। এক প্রফেসর মন্ত্রীর ক্লাসমেট এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে তিরস্কার করল, ‘মিনিস্টার, এই লোক কে, কি বলে, কেন বলে, কিছুই না জেনে এই আতেলগুলির কথায় তুমি দেখছি একেবারে খুশিতে আটখানা হয়ে গেছ। চেন এই লোককে?

আমি মাঝে মাঝে যাই, ওর কথা ভাল লাগে, সে একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, একটা বিচ্ছু। সবাইকে সে কাফের বলে না, শুধু প্রত্যেক ফেরকার প্রধান দু’চারটা মুরুব্বিকে কাফের বলে। তার লক্ষ্য প্রত্যেক ফেরকার নেতা বা মুরুব্বীদের ধ্বংস করে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। সে যুব সমাজের মাঝে প্রচার করছে ১৯২৪ সালে তুর্কি খিলাফত উৎখাত করা হয়, এখন ২০২৪ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তজ্জন্য ঐক্য প্রয়োজন, ঐক্যের স্বার্থে ফিরকাবাজদের ধ্বংস করতে হবে। যুব সমাজকে সে যে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাচ্ছে আর তারা যেভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে- আমার মনে হয় শীঘ্রই লোকটা তার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে যাবে। খিলাফতের কথা শুনে মন্ত্রীর মুখের হাসিটা আটকে গিয়ে চেহারাটা কেমন বিকৃত হয়ে গেল। সে বিড়বিড় করল, লোকটা কি আইসিস, জে এম বি, হুজি, নাকি বি এন পি- এর দালাল। তার মাথার পিছনে চিনচিনে ব্যথা উঠল। প্রফেসর বলল, তবে চিন্তার কারণ নাই, তার সাথে আমাদের দলের সমঝোতা হয়েছে।

এই ভাবে কথিত ভণ্ড লোকটার মিশন সম্পর্কে সর্বত্র আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল। মানুষও বিতর্কে মেতে থাকার ইস্যু পেয়ে গেল। এক লোক সবাইকে কাফের বলছে অথচ যুব সমাজ তার দিকে পতঙ্গের ন্যায় ঝুঁকছে। গিন্নির রান্না ঘর থেকে নিয়ে অফিস আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চায়ের আড্ডা সর্বত্র একই আলোচনা। এটা টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হল।



মাওঃ মোজাহিদ তার প্রিয় ছাত্র জামালকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার তো এক বোন বিয়ের বাকি আছে, না? জামাল বলল, জ্বী। - কি করে? – মহিলা মাদরাসায় পড়ে। - দেখতে কেমন, তোমার মত হবে? – আমার চেয়েও ভাল। -ওর নাম কি? –ফাতেমা। -আচ্ছা তুমি হাজি শরীয়তুল্লাহকে চেন? - জ্বি। - তার কয় তলা বাসা জান? –পাঁচ তলা। - কী করে? – শুনেছি অনেক বড় ব্যবসায়ী। -তার কয় ছেলে জান? – না। - ঠিক আছে শুন, তার দুই ছেলে, এক ছেলে কলেজের প্রফেসর, আরেক ছেলে ভাল আলেম হয়েছে, ঢাকায় এক মাদরাসায় পড়ায়। ছেলের নাম মাওঃ যুবায়ের। তার জন্য পাত্রী খুজতেছে কিন্তু পাচ্ছে না। তাদের চাহিদা হল সুন্দরী, লম্বা ও আলেমা মেয়ে হতে হবে। আমি তোমার বোনের কথা বলেছি। এশার নামাযে হাজ্বি সাব আসবেন, তখন তোমার সাথে আলাপ করাব।

এশার পর তিনজন একসাথে বসল। তারপর মোজাহিদ বলল, এর বোনের কথাই বলছিলাম। হাজ্বি সাব কথা না বলে খালী চোখেই অণুবীক্ষণ পর্যবেক্ষনের মত কিছুক্ষণ জামালকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন। তারপর মোজাহিদের কানে কানে বললেন ‘এর বোন যদি এর মতই সুন্দর আর লম্বা চওড়া হয় তাহলে এ মেয়ে আমি আনব। জামালকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার বোন দেখতে কেমন? সে বলল, ‘আমার মতই তবে রং আরো উজ্বল। হাজ্বী সাব আনন্দিত হয়ে আলাপ শুরু করল। তার বাবার মৃত্যু, জমা জমি কেমন আছে, সংসার কেমনে চলে ইত্যাদি আলাপান্তে বললেন, দেখ বাবা তোমরা শহীদ সন্তান, তোমার বাবা দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছেন। এদিক দিয়ে তোমরা আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তোমরা আমাদের সম্মানের হক্বদার। কাজেই তোমাদের কি আছে না আছে তা আমি দেখবে না, মেয়েটা যদি পসন্দ হয় ব্যস আল- হামদুলিল্লাহ। তারপর তিনি আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে আগামি শুক্রবার কন্যা দেখার তারিখ দিয়ে চলে গেলেন।

উত্তেজনায় জামালের শরীর কাঁপছে, তার মন বলছে বিয়েটা হয়ে যাবে। এত বড় লোক ঘরে তার বোনের বিয়ে – সে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা মসজিদে চলে গেল, দুরাকাত নামায পড়ে হাত উঠাল ‘ইয়া মালিকাল মূলক, ওয়া তুয়িযযু মাং তাশাউ ওয়া তুযিল্লু মাং তাশাউ। রহমান ও রহীম ওগো, তুমিই মানুষকে বিপদে ফেল তুমিই উদ্ধার কর। তুমিই আমাদেরকে ইয়াতিম বানিয়েছ, তুমিই অনুগ্রহের সাথে আমাদের প্রতিপালন করছ। মালিক আমার, এই ঘরে আমার বোনের বিয়েটা লিপিবদ্ধ করে দাও। সে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মোজাহিদের ঘরে গিয়ে বলল, হুজুর আপনাকে তো আর আমার দাওয়াত দেয়ার দরকার নাই- আপনি তো যাবেনই। কিন্তু এই সুযোগে আমি উস্তাদজীকে নিতে চাই। আমাদের গরীব খানায় উনার পদধূলি পড়লে আমার মনের আশাটা পূর্ণ হত। মোজাহিদ হাসল, আরে বোকা উস্তাদজীকে কোনদিন কোথাও যেতে দেখেছ? উনি কোথাও যান না। এরপরেও আমি চেষ্টা করে দেখব যদি নেয়া যায়।

বৃহস্পতিবার জামাল বাড়িতে গিয়ে পাত্র পক্ষকে আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিতে লাগল। ওরা বড় লোক মানুষ, আর বড় লোক আপ্যায়নের খাদ্য পানীয় যত উপাদান লাগে সব সে প্রস্তুত করল। শুক্রবার জুমার পর মোজাহিদসহ ছয়জন মেহমান এসে হাজির হল। হালকা নাস্তা পর্ব শেষ করে ছেলে ও তার বাবা পাত্রী দেখতে ঘরে গেল। হাজ্বি সাব মেয়েকে ভাল করে দেখে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর মেয়ের হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলেন। হাসতে হাসতে গিয়ে মোজাহিদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, মাওলানা এ পর্যন্ত আমি পঞ্চাশটা মেয়ে দেখেছি কিন্তু এমন মেয়ে একটাও দেখিনি। আমার আশ্চর্য্য লাগছে যে, এই গাও গেরামেও এত সুন্দরী মেয়ে আছে। এই মেয়ে আমি সোনার ওজনে কিতে নিতে রাজী। মোজাহিদ বলল, শুনেছি এদের বাবা মা দু’জনই সুদর্শন। এজন্যই ছেলে মেয়েরা সুদর্শন হয়েছে। তারপর দুজনে আলাপে মত্ত হল।

কিন্তু পাত্রী দর্শন থেকে ছেলে আর উঠল না। মেয়ের গায়ের রং কাচা সোনা বা কাচা হলুদের মত। চেহারা মণ্ডল গোলগাল, মৃদু হাসলেই কপোলে টোল ধরে, হস্ত পদ প্রকোস্ট গোলাকার। কটি অতিক্রান্ত চিকুরদাম, চওড়া কাঁধ, মরাল গ্রীবা তাকে করে তুলেছে সুন্দরীদের মধ্যে অপ্সরী। পাত্রীর রুপ দেখে ছেলে আত্মহারা হয়ে গেছে, সে হবু বধুর সাথে পীড়িতের আলাপ জুড়ে বসেছে।

ওদিকে পাত্র ও পাত্রী পক্ষ এক সাথে বসল। কিছুক্ষণ আলাপের পর ছেলের বাবা বলল, মেয়ে আমার পযন্দ হয়েছে, ইংশাআল্লাহ এই বিয়ে আমি করাব। আপনাদের কিছু দিতে হবে না, আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন, অলংকারাদি সব কিছু আমিই দিব। জামালকে সম্ভোধন করে বললেন, বাবা জামাল তোমার কোন খরচা পাতি করতে হবে না, তুমি শুধু আমরা যা কয়েকজন আসব তাদের জন্য চারটে ডাল ভাতের ব্যবস্থা করলেই যথেষ্ট’ বলে তিনি হাসলেন। জামালও হাসল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তারপর ছেলেকে ঘর থেকে ডেকে বের করে সবাই মিলে খাওয়া- দাওয়া করল এবং মাস শেষের শুক্রবার বিয়ের তারিখ দিয়ে তারা চলে গেল।

জামাল খুশিতে আত্মহারা, তার পা যেন মাটিতে পড়ে না, চঞ্চল হয়ে উঠেছে। য্য়নবের বিয়ে হয়েছে সে রাণীর হালতে আছে, এখন ফাতেমার বিয়ে, শেষ বিয়ে। তার কল্পনাতিত বড় লোক ঘরে বিয়ে, সেও রাণীর মত সুখি হবে। কাজেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বিয়েতে সব কিছু করবে, অলংকারাদি ফার্নিচার ও অন্যান্য আসবাব পত্র যা দেয়ার সব দিবে। বোনদের সুখেই তার সুখ, বোনেরা সুখি হলে সে রাস্তায় বা বৃক্ষ তলায় পড়ে থাকলেও তার কোন দুঃখ থাকবে না। বাবা থাকলে যে দায়িত্ব পালন করত সে তার চেয়েও তিনগুন দায়িত্ব পালন করবে। বাবা না থাকার আফসোস ও দুঃখ যেন তার বোনদের মনে উদয় না হয়। প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে হলেও সে তার বোনদের মুখে হাসি ফুটাবে।

ইতিমধ্যে ব্যাংকে তার যথেষ্ট টাকা জমা হয়েছিল, সব টাকা উঠিয়ে নিয়ে এল। এক সেট স্বর্ণালংকার গড়াল, ফার্নিচার কিনল, অন্যান্য আসবাব পত্র সব কিনল। তারপর মেহমান আপ্যায়নের জন্য দুইটা গরু, তিনটা খাসী ও শ খানেক মুরগি কিনল। গ্রামবাসী ও আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিল, তাদের মসজিদের সাবেক ইমাম সাবকেও দাওয়াত দিল। বিয়ের দিন পাত্র পক্ষ অনেক গুলি মাইক্রোবাস যোগে এল, এক বাক্স স্বর্ণালংকার নিয়ে এল, অন্যান্য সামগ্রি দেখে সকলের চোখ ধাধিয়ে গেল। পাত্রীকে অলংকার পরানো হল, তার রুপের আভায় সোনার আভা ম্লান হয়ে গেল। আত্মীয় স্বজন গ্রামবাসী সকলেরই খাওয়া দাওয়া ঠিক মত হল, সবাই খুশি। মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল।

কিন্তু জামালের হাতের সম্বল যা ছিল সব শেষ, এতে তার কোন দুঃখ নাই বরং খুশি। এবার সে মুক্ত, একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ। তার কাঁধ থেকে পাহাড়ের বোঝা নেমে গেছে। বাবার মৃত্যুর পর সে একবারের জন্যও নিজের চিন্তা করেনি। তার চিন্তা আবর্তিত হত শুধু দুটি বোন নিয়ে। এখন দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে, উভয়েই বড় লোক। তারা সুখি, মহাসুখি। কাজেই সেও সুখি, এই পৃথিবীতে তার আর কিছু চাওয়া পাওয়ার নাই। এখন যদি সে গাছ তলায় পড়ে থাকে আর দিন মুজুরি করেও খায় তবুও তার কোন দুঃখ নাই। এখন তার মন চায় মুক্ত বিহঙ্গের মত নিঃসীম আকাশের অনন্ত নীলিমায় ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াতে। সে অনেক দর্শনীয় স্থানের নাম শুনেছে, কিন্তু কোন দিন যায়নি। এমনকি জানেও না সেগুলি কোথায়। কক্সবাজার বাংলাদেশে এটা জানে কিন্তু জাফলং কোয়াকাটা, দার্জিলিং ইত্যাদি কোথায় জানে না। তাজমলহল ভারতে জানে কিন্তু কোন জায়গায় সেটা জানে না। ঐসব জায়গায় তার উড়ে যেতে মন চায় কিন্তু কিভাবে সম্ভব।

একটি ঘর, একটি শিকল, একটি বন্ধন, দুটি পেলব বাহু যে তাকে চুম্বকের মত তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। এখন সংসারে তার আর কোন দায়িত্ব নাই, বোনদের জন্য পিছুটান নাই, কাজেই এখন সে নিজের চিন্তায় নিজের মধ্যে হারিয়ে গেল। বছর দুই সে জামিলাকে দেখে না কিন্তু ব্যাগ কাঁধে কলেজে যাওয়ার পথে যে মেয়েটি তার হৃদয়ে ঝড় তুলত সেই মুর্তি তার হৃদয় মুকুরে পাথরে খোদাই করা মুর্তির মত খুদিত হয়ে গেছে। সে আপন মনে তার সাথে কথা বলে, মনের চোখে তাকে দেখে। তার চোখ দুটি স্বপ্নময় হয়ে উঠে। সে সিদ্ধান্ত নিল বিষয়টা আর লোকুচুরি না করে মায়ের সাথে আলাপ করবে।

মা শুনেই আল হামদুলিল্লাহ বলে লাফিয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, তোকে কতবার বলেছি ওদের এত বড় সর্বনাশ করিস না। কাউকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেয়ে মেরে ফেলা ভাল। কিন্তু আমার কথা তো শুনলি না, ওরা কত ভাল মানুষ ছিল, জমিলা ও তার মা আমার কাছ থেকে কাপড় বানিয়ে নিত। ইয়াতিম পরিবার দেখে নির্দিষ্ট মুজুরির চেয়েও বেশি টাকা দিত। জমিলাটা কত ভাল শান্ত শিষ্ট মেয়ে। যাই হউক অবশেষে তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস এটাই আল্লাহ্‌র দরবারে শুকরিয়া। জামাল বলল, আসলে দোষটা আমারও নয় ওদেরও নয়। আসল দোষী হল ফেরকাবাজ আলেমরা। ওরাই স্ব স্ব অনুসারীদেরকে এভাবে তৈরি করছে, একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিচ্ছে। তারপর আমরা মুসলমান ভাই ভাই কুকুরের মত কামড়া কামড়িতে লিপ্ত হই, তখন কাফেররা এসে আমাদেরকে ধ্বংস করে। কিন্তু আশা করি আর পারবে না। জাতির ত্রানকর্তার আবির্ভাব ঘটেছে, হাসান মুসান্না শীঘ্রই সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যের মঞ্চে টেনে নিয়ে আসবেন।

কিন্তু আমি অজ্ঞাতসারে যে অন্যায় করেছি এখন তার মাসুল দিতে প্রস্তুত। একটা হতদরীদ্র পরিবারের মেয়ে বিয়ে করে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্য করব। মা বললেন, প্রায়শ্চিত্য কিরে, জমিলাকে তো আগে থেকেই আমার পসন্দ, ওর মত ভাল মেয়ে হয় নাকি। আমার আশা ছিল তোকে বিয়ে করাব কিন্তু তখন তোর বিয়ের বয়স হয়নি, আবার ঘরে বিবাহযোগ্য দুটি মেয়ে। তাছাড়া ওরা ধনি আমরা গরীব, হয়ত বিয়ে দিবে না, এই আশংখায় কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু এখন দেখছি আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করতেছেন, আল হামদুলিল্লাহ।

মা আনন্দাতিশয্যে দৌড়ে গিয়ে আলমারি খোলে একটা গহনার বাক্স নিয়ে এলেন। বাক্স থেকে একটা কণ্ঠহার ও একটা প্রকোষ্ঠ কাকন বের করে জামালের হাতে দিয়ে বললেন, এগুলি আমার বিয়ের অলংকার, কত অভাব অনটন গেছে কিন্তু কোনদিন বিক্রির চিন্তা করিনি, দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে তাদেরকেও দেইনি। এগুলি শুধু তোর বিয়ের জন্য আমি লুকিয়ে রেখেছি। আমার একটা ছেলে, একমাত্র পুত্রবধূকে এগুলি আমি উপহার দিব –এই ছিল আশা। এখন আমার সাধ পুর্ণ হতে যাচ্ছে, জমিলার গায়ে এগুলি তুলে দিতে পারলে আমার আশা পূরণ হবে। জামাল অলংকার গুলি হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করছে আর ভাবছে ‘আমার বিয়ের জোগার আয়োজন তো প্রস্তুতই আছে। আনন্দে তার মুখটা উজ্বল হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ সে মাকে বলল, আম্মা ছমির চাচাকে জমিলার বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি বলেছিলেন ‘তোমার মাকে নিয়ে এসো। তিনি এসে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে যাক। তখন আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে যাব। কাজেই চল যাই, এই অলংকার গুলি তুমি নিজ হাতে জমিলাকে পরিয়ে দিলে ওরা খুব খুশি হবে। আর এমনিতেও বিয়ের আলাপের জন্য অভিভাবক হিসাবে তোমাকে তো যেতেই হবে। মা বললেন, বিয়ে কবে?- বিয়ে আরো কিছু দিন দেরি হবে। - বিয়ের আগেই অলংকার দিবি?- সমস্যা কি? আরো কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি করে মা রাজী হলেন, আগামি শুক্রবারে যাওয়ার তারীখ নির্ধারিত হল।

জামাল ছমির মণ্ডলের মোবাইল নম্বর নিয়ে এসেছিল। কল করে বলল, চাচাজান, আপনার সাথে আলাপের জন্য আম্মাকে নিয়ে আগামি শুক্রবারে আসতেছি। আপনি একটু রেডি হয়ে থাকেন যেন। আর একটা কথা, আপনার অবস্থা আমি জানি, আর এসব তো আমার জন্যই হয়েছে। কাজেই আমাদের জন্য আপনার কোন বোঝা বা খরচ হউক তা আমি চাই না। আপনি শুধু চারটে ভাত পাকাবেন, মাছ গোশত ও মসলাদি আমি নিয়ে আসব। ওপার থেকে হাসি মাখা কণ্ঠ ভেসে এল, এ তুমি কেমন অদ্ভুত কথা শুনাচ্ছ, মেহমান আসবে আর বাড়ি থেকে খানা পিনা নিয়ে আসবে’ বলে তিনি অবজ্ঞায় হাসতে লাগলেন। জামাল দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আপনি রাজী থাকেন বা না থাকেন আমি নিয়ে আসব। কাজেই আমার অনুরোধ, আমাদের জন্য একটি পয়সাও খরচ করবেন না। আস- সালামু আলাইকুম’ বলে সে কল কেটে দিল।

শুক্রবার সকালে জামাল মুক্তাগাছা টাউনে গেল, কিছুক্ষণ পর ভরা ব্যাগ নিয়ে ফিরল। মা জিজ্ঞেস করলেন ‘এগুলি কিরে? – মিষ্টি ও মণ্ডা আনলাম। দেশ বিখ্যাত মণ্ডা তো আর সরিষাবাড়িতে পাওয়া যায় না, তাই নিয়ে এলাম। - এই ব্যাগ ভর্তি মিষ্টি? – ওরা পাঁচটি পরিবার একসাথে থাকে। আপনি যাবেন, শুনে সবাই আসবে তখন মিষ্টি দিতে হবে না। এজন্যই বেশি করে নিয়ে এলাম। আসলে ব্যাগের উপরে দুই প্যাকেট মিষ্টি ও মণ্ডা। আর নিচে মাছ গোশত ও অন্যান্য মসলা। তারা জুম্মার পর গিয়ে ছমির মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছল। জামাল বাইরের উঠানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে সালাম দিল আর তার মা ভিতরে চলে গেল। মণ্ডল হাসিমুখে বেড়িয়ে এল। জামাল তার সাথে মোসাফাহা করে ফিসফিসিয়ে বলল, চাচা ব্যাগের নিচে মাছ গোশত আছে আম্মা যেন না দেখে ।

মণ্ডল রাগত স্বরে বলল, তুমি কি আমাকে এতই ফকির মনে কর যে, তোমাদের পাতে চারটে ডাল ভাত দেয়ার মত সামর্থও আমার নাই। জামাল বলল, আসল ব্যাপারটা হল, আমি চাই না আমাদের জন্য আপনার একটি পয়সা খরচ হউক। দ্বিতীয়ত একজন বাবা তার মেয়েকে লালন করে অন্যের হাতে তুলে দেয়। কাজেই পাত্রদের উচিত মেয়ের লালন পালনের খরচটা তার বাবাকে দিয়ে দেয়া। অন্তত বিয়ের খরচটা পাত্রের বহন করা উচিত কিন্তু কেউ তা করে না, তবে আমি করব। আমার বিয়েতে আপনার একটি পয়সাও খরচ হবে না। মণ্ডল বলল, কেন আমার কি সাধ আহলাদ নাই, বাবা হিসাবে আমার মেয়ের বিয়েতে আমি খরচ করব না- এ কেমন কথা বলছ’ সে যেন আসলেই রেগে গেল। জামাল হেসে বলল ‘আচ্ছা যান, এ নিয়ে আমরা পরে তর্ক করব। তারপর মণ্ডল তাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল এবং মেয়েদের থাকার রুমে বসতে দিল।

জামালের মা ও জমিলার মা যেন দুই বান্ধবি, তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে আলাপে মত্ত হল। জামালের মা অনুনয় করে বলল, জামাল না বুঝে তাদের হুজুরদের কথায় এইসব ফিরকাবাজীর কাজে হাত দিয়েছে, এতে তো আপনাদের খুব ক্ষতি হল, ওকে মাফ করে দেন। জমিলার মা তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, মাফ না করে উপায় কি বলুন, মেয়ের জামাইকে তো আর অভিশাপ দিতে পারব না। তারপর দুই বিয়ান হাসি ঠাট্টায় মশগুল হল। মেহমানদের নাস্তা পর্ব শেষ করে জমিলার মা তাকে হালকা সাজ গোজ করিয়ে নিয়ে এল। জামাল মুরুব্বীদের সামনে লজ্বায় তাকাতে পারল না, শুধু কটাক্ষে একনজর দেখল। তার ভিতরটা তোলপাড় করে যাচ্ছে। এই সেই তার মনের রাণী যাকে নিয়ে সে বহু দিন ধরে স্বপ্ন দেখছে। তার ইহকাল পরকালের একমাত্র সাথী, সুখ দুঃখের একমাত্র অংশিদার। অন্তহীন ভালবাসায় তার মনটা উথলে উঠল।

সে আরেক বার গভীরভাবে তাকিয়ে দেখল। জমিলা আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে, তার রুপের জ্যোতি ম্লান হয়ে গেছে। মেঘ ঢাকা চন্দ্রের ন্যায় তার চাঁদ বদন খানি যেন বিষাদের কালিমা ঢেকে রেখেছে, মুখটা মলিন দেখাচ্ছে। জামাল বুঝল, তাদের উপর যে ধকল বয়ে গেছে, তার উপর দারিদ্রতার করাল গ্রাস এবং এতদিন ধরে বিয়ে আটকে থাকার কারণেই জমিলার এই অবস্থা হয়েছে। তার মধ্যে অপরাধ বোধ জেগে উঠল, তার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে অতি কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল, চোখের কোণায় অশ্রু জমে উঠেছে। সে মনে মনে শপথ নিল, যে ফিরকাবাজীর বিষ মানুষকে পশু বানিয়ে তোলে সেই ফিরকাবাজীর বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করবে। পৃথিবীতে ফিরকার অস্তিত্ব রাখবে না। সেই সাথে সিদ্ধান্ত নিল, সে জামিলাকে মাথায় রাখবে, সারা জীবন মনের মণিকোঠায় ভরে রাখবে, তার কষ্ট ভুলিয়ে দিবে। বুকে চেপে ধরে বলবে, জীবন আমার অতীত ভুলে যাও, এখন তুমি শুধু আমাকে দেখ আর আমি তোমাকে দেখি। তাছাড়া এই পাঁচটি পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে সে জীবন বাজী রেখে অন্তত কিছুটা হলেও উসুল করার চেষ্টা করবে, সম্ভব হলে আবার দেশে ফিরিয়ে নিবে। এভাবেই তার পাপের প্রায়শ্চিত্য করবে।

জামালের মা কিছুক্ষণ আলাপ সালাপ করে ছেলেকে বললেন, নে তুই এগুলি পরিয়ে দে। জামাল বলল, আপনি পরান। তখন মা কণ্ঠহার ও বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, এখন শুধু নাক কান বাকি থাকল, এগুলি বিয়ের দিন পাঠিয়ে দিব ইংশাল্লাহ। তারপর তারা উঠে চলে গেল, জামাল একা বসে রইল। কিন্তু তার তৃপ্তি মিটল না, অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে মনে মনে মা ও শাশুড়িকে তিরস্কার করল, আসলে বুড়া হলে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি আর বিবেচনা বলতে কিছুই থাকে না। ওরা এটুকু বুঝল না যে, যুবক মানুষ কি চায়। আমার বউটা নিরিবিলি আমার কাছে আসবে, দুজনে মনের কথা বলব, হাসব আনন্দ করব, খুনসুটি করব, হাতাহাতি করব, তখন মনটা ভরে উঠবে। কিন্তু না, তারা নিয়ে এলেন আবার সাথে করে নিয়ে গেলেন। ধুত্তুরি ছাই, ভাল করে দেখতেও পারলাম না। আমার আসাটাই মাটি হয়ে গেল।

সে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকল, তারপর দরজার কাছে গিয়ে উকি দিল, ইচ্ছা যে একটু ভাল করে দেখবে। জামালের মা অতিশয় আন্তরিকতা নিয়ে বিয়ানের সাথে গিয়ে রান্না ঘরে বসল। জমিলা থাকার ঘর থেকে রান্নার জোগার আয়োজন এনে দিচ্ছে, বারবার উঠান দিয়ে আসা যাওয়া করছে। জামাল এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে, তার নিঃশ্বাস গভির হচ্ছে, বিংশতি বর্ষীয়া উর্বশি যৌবনা যুবতি, প্রভাকরোজ্জ্বল দীপ্ত আনন চকচক করছে। উন্নত নাসিকা, রক্ত জবার মত পুরুস্ট ওষ্ঠাধর, কুসুমবৎ গণ্ড। চওড়া কাঁধ, অজানু লজ্বিত কেশগুচ্ছ, রক্তিমাভ কপোল দেশে ক’গাছি অলক খেলা করছে, ভাদ্রের ভরা নদীর ন্যায় দেহ লতায় উদ্দাম যৌবন ঢেউ খেলছে। জামালের গরম নিশ্বাস পড়ছে আর ডান হাতে বুক ঘষছে। ‘ওকে একটু এ ঘরে আনতেই হবে’ বলে সে সোজা দরজার দিকে সরে দাঁড়াল। জমিলা রান্না ঘর থেকে যাওয়ার সময় এক পলক এদিকে তাকাল আর সাথে সাথে সে হাতছানি দিল। জমিলা লজ্বায় ওড়না টেনে লম্বা ঘোমটা দিল।

জামাল দাঁড়িয়ে আছে, সে বারবার হাতছানি দেয় কিন্তু জমিলা লজ্বায় লাল হয়ে উঠে, হাত জোড় করে ক্ষমা চায় অক্ষমতা প্রকাশ করে, তার লজ্বা মিশ্রিত হাসিতে যেন মুক্তা ঝড়ে, জামাল অহসায় বোধ করে কিন্তু জমিলা আসল না। অবশেষে সে নিরাশ হয়ে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পর তার মা এসে বলল, হে রে জামাল, তোর শাশুড়ি বলছে এখন বিয়ে পড়িয়ে রাখতে, পরবর্তিতে আমাদের সুযোগ সুবিধা মত যে কোণ সময় মেয়ে উঠিয়ে নেয়া যাবে, তুই কি বলিস? জামাল যদিও আবেগাপ্লুত হল কিন্তু একটু চিন্তা করে বলল ‘এখন কিভাবে সম্ভব, আমার পরিক্ষার আছে মাত্র মাস দেড়েক, তাছাড়া টাকা পয়সা নাই। তুমি তাদেরকে বুঝিয়ে বল যে, কয়দিন আগে আমার মেয়ে বিয়ে দিয়ে খালী হাত হয়ে গেছি। আবার ছেলের পরিক্ষাও সামনে। পরীক্ষার পর আমরা বিয়ের কাজ শেষ করব। মা গিয়ে তাই বললেন।

এ বিয়েতে ছমির মণ্ডল যেন আকাশের চাঁদ নাগাল পেয়েছে। জামালের সবকিছুই তার জানা। এক বাপের এক ছেলে, যথেষ্ট জমা জমি আছে, পিশারি আছে, পরিবারটাও ভাল, ছেলেও মেধাবী, ভাল আলেম হয়েছে। তাছাড়া এমন সুদর্শন ছেলে হাজারে একটাও পাওয়া যায় না। যেমনি সুন্দর তেমনি লম্বা, স্বাস্থ্যবান। তার এমন দুঃসময়ে এত ভাল ছেলে পাওয়া কল্পনাতিত। তার সন্দেহ, জামাল অনুশোচনায় প্রায়শ্চিত্য করতে এসেছে, অনুশোচনা কেটে গেলে যদি পিছিয়ে পড়ে, তাহলে তার পোড়া কপালে মেয়েটার কপাল চিরতরে পোড়ে যাবে। তাই সে চেষ্টা করছে আজই বিয়ের কাজটা শেষ হয়ে যাক।

জামালের মা পর্দা করে বিধায় সে বাড়ির বাইরে অবস্থান করছে। দেউড়ির কাছে এসে স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি খবর? স্ত্রী বলল, ছেলের পরীক্ষা সামনে, দুই তিন মাস পরের কথা বলছে। মণ্ডল বলল, তুমি গিয়ে বুঝাও যে, ছোট মেয়ের জন্য ভাল ভাল বিয়ের ঘর আসছে কিন্তু বড় মেয়ের জন্য আমরা কিছু করতে পারছি না। আপনারা বিয়েটা পরিয়ে রাখেন, না হয় অন্তত কাবিন করে রাখেন, তাহলে আমরা ছোট মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতে পারব। তারপর স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেন, দুই মেয়ে না হয় আমরা এক অনুষ্ঠানে এক সাথে উঠিয়ে দিব, তাহলে আমাদের খরচও বাচবে। তাছাড়া এই ছেলে যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে না, যাও চেষ্টা কর গিয়ে। জমিলার মা গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে বললেন, ছোট মেয়ের বিয়ের দোহাই দিলেন। তখন জামাল কাবিনের জন্য রাজি হল। মণ্ডল আনন্দচিত্তে বাজার থেকে কাজি এনে কাবিন করাল। জামালের কাছে টাকা নাই বিধায় মণ্ডল নিজেই কাজির টাকা দিয়ে বিদায় করল।

এখন তাদের বিদায়ের পালা, কিন্তু জামালের মন আনছান করছে, নিজের স্ত্রীকে একটু ভাল করে দেখতেও পারল না, কথাও বলতে পারল না। সে লজ্বায় মিইয়ে গিয়ে মাকে বলল, জমিলাকে একটু পাঠিয়ে দেন, দুইটা কথা বলে যাই। মা চলে গেল। একটু পর জমিলা দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে ঘরের মেঝেতে এসে দাঁড়াল, লজ্বায় লম্বা ঘোমটা টেনে আছে। জামালের বুকটা ধক করে উঠল, তার শরীর কাঁপছে। দণ্ডায়মান যুবতি তার কে হয়, কি হয়? এ তার নতুন অভিজ্ঞতা। সে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে এসে খপ করে জড়িয়ে ধরে বলল, এত ডাকলাম আসলে না এখন যাবে কোথায়? জমিলা মোচড়া মোচড়ি করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, অপারগ হয়ে স্বামীর বুকে নিজেকে সমর্পন করে দিল।

তারপর বিছানার পাশে বসে দুজনে মধুর আলাপ শুরু হল। আলাপ বলতে শুধু জামাল বলছে আর জমিলা স্বামীর বাহু বেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে অসার হয়ে শুনছে। জামাল বলল, এই তো মাত্র কয়েকটা দিন, পরীক্ষাটা দিয়েই একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে তোমাকে নিয়ে যাব। তখন আর এক মুহুর্তের জন্যও তোমাকে দৃষ্টির আড়াল হতে দেব না। সব সময় এভাবে বুকে জড়িয়ে রাখব। তারপর আমাদের সংসার হবে, সন্তান হবে, মুক্তাগাছা টাউনে একটা বাসা করব--- ইত্যাদি, তারা কল্পালোকের স্বপ্ন জাল বুনতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তার মা বাহির থেকে তাড়া দিলেন ‘কিরে জামাল সন্ধ্যা তো হয়ে গেল, কখন যাবি? এই যে আসছি’ বলে সে স্ত্রীকে গভির একটা চুম্বন দিয়ে বিদায় জানাল। জমিলা স্বামিকে সেলাম করে চলে গেল। তারপর জামাল শ্বশুর শাশুড়ির কদমবুচি করে সকলের দোয়া নিয়ে বিদায় হল।

জমিলা গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। সে এক দৃষ্টে জামালের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে টপটপ করে ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার অশ্রু ঝড়ে পড়ছে। তার সামনে আদিগন্ত বিশাল মাঠ, এই মাঠটি আগে ছিল উষর মরু, ধু ধু মরু, প্রতিদিন অর্কের অগ্নি কণিকাগুলি এই মাঠটি পোড়িয়ে পোড়িয়ে অঙ্গার করে দিয়েছিল। এই মাঠটার নাম নিয়তি, তার নিয়তি তার দুনিয়া। কিন্তু আজ তা মরুদ্যানে রুপান্তরিত হয়ে গেছে, খর্জুর বীথিকা, দ্রাক্ষা বন, আপেল নাশপাতির উদ্যানে পুর্ন হয়ে গেছে, শস্য শ্যামল হয়ে উঠেছে, ভরে গেছে ফুলে ফলে। সেখানে পরস্পর হাত ধরাধরি করে হাঁটছে দুটি যুবক যুবতি, তারা জামাল জমিলা জুটি। তাদের চারপাশ ঘিরে কয়েকটা কিচির মিচির কলরব করছে। তাদেরকে সে জানে কিন্তু চিনে না। কারণ এখনো যে তারা পৃথিবীতে আসেনি, তাদের সোনামুখগুলি এখনো তার দেখা হয়নি। হতভাগিনী বালিকা জানালার পাটে মাথা ঠেকিয়ে আপন মনে সুখের নীড় রচনা করতে থাকে, হারিয়ে যায় সে সংসার নামক আনন্দ উচ্ছ্বাসের অনন্ত সরোবরে।

জামাল একদিন গিয়ে নিরিবিলিতে হাসান মুসান্নাকে বলল, উস্তাদজী আমি আপনার কাছে থাকতে চাই, পরীক্ষার পর আমাকে ময়মনসিংহ শহরেই একটা মসজিদ মাদরাসার ব্যবস্থা করে দেন। তারপর পরীক্ষার শেষ দিন মোজাহিদ তাকে ডেকে বলল, তুমি নাকি উস্তাদজীর কাছে গিয়েছিলে, আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু শহরে কোন ব্যবস্থা করতে পারি নাই। নদীর ওপারে শম্ভুগঞ্জে একটা ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে একটা মসজিদে ইমামতি করবে আর পাশের মাদরাসায় পড়াবে। পরবর্তিতে টাউনে কোন মসজিদ খালী হলে তোমাকে নিয়ে আসব। জামাল সেখানে চলে গেল আর বিয়ের জন্য কিছু টাকা পয়সা জমানোর চেষ্টা করতে লাগল।

বিষয়: বিবিধ

৯৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File