হাসান ফেরদৌসি - ৫

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:২৮:৫৬ দুপুর



পিকনিকের আমেজ কাটতে না কাটতেই আবার উৎসব শুরু হল, বিয়ে উৎসব। ফেরদৌসির পঞ্চম বোন ইসুবিসুর বিয়ে। তাদের চতুর্থ ভগ্নিপতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ্যসিস্টেন্ড ডাইরেক্টর (এডি)। তার অধিনে চাকরি করে ময়মনসিংহের যাকির, এই যাকিরই হল পঞ্চম বর। সে আগেও কয়েক বার এডির সাথে বেড়াতে এসেছে, অত্যন্ত সুন্দর সুদর্শন সুপুরুষ। ফেরদৌসির বোনেরাও সবাই সুন্দর কিন্তু তারা যদি হয় চন্দ্রালোক তবে যাকির সুর্যালোক, অগ্নি শিখার মত উজ্বল। মানিক জোড় আবার মায়ের আঁচল ধরে নাচানাচি শুরু করল তারা গেইট করবে টাকা আদায় করবে কিন্তু বাবার এক কথা গেইট করা যাবে না, করলেও টাকা নেয়া যাবে না। টাকাই না নিতে পারলে গেইট করে লাভ কি। তখন হাসান ফেরদৌসিকে বলল ‘গেইটের চিন্তা বাদ দে, এ তারিখে হাত ধুয়ে পাঁচশ টাকা আদায় করব। তারা এই আশায় শান্ত থাকল।

বিয়ের দিন মেয়েরা পাত্রি সাজাতে বসল, মানিক জোড় পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সাজানোর পর একজন লিপস্টিক দিতে চাইল, আরেকজন বলল, ওর আবার লিপস্টিক কেন, তার তো লিপস্টিক আছেই’ বলে সবাই হাসতে লাগল। অর্থাৎ তারা যাকিরের দিকে ইঙ্গিত করেছে, তার সৌন্দর্যকে লিপস্টিকের সাথে তুলনা করেছে। হাসান ফেরদৌসিকে বাইরে নিয়ে বলল, এই দুলা ভাইয়ের নাম কি জানিস? - কি? - লিপস্টিক দুলা ভাই। সবারই তো একটা করে নাম আছে, যেমন বড় দুলা ভায়ের নাম ভুত দুলাভাই, দ্বিতীয়টা এলিয়েন, তৃতীয়টা গুন্ডা দুলাভাই, চতুর্থটা বুড়া দুলাভাই, আর এটা হল লিপস্টিক দুলাভাই। ব্যস এ নাম তারা সর্বত্র রাষ্ট্র করে দিল।

বর আসল, সে আগে থেকেই হাসানকে চিনে। ঘরে ঢোকার সময় তাকে সামনে পেয়ে কান মলে দিয়ে বলল ‘কি শালা মিঞা, ভাল আছ তো? হাসান মুখে কিছু বলল না কিন্তু মনে মনে বলল, শালা এই কান মলা তোমার জন্য জমা থাকল। খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ে পড়ানো হল, তারপর নিয়মানুযায়ি বরকে নিয়ে গিয়ে বর- কনে এক সাথে পাটিতে বসানো হল। এখন হাত ধোয়ানোর পালা। মানিক জোড় সামনে বসা, হাসান বলল, পাঁচশ টাকার কমে হাত ধুয়াবো না। বর পঞ্চাশ টাকা বের করে দিল। ফেরদৌসি বলল, ছিঃ ছিঃ লিপস্টিক দুলাভাই হার কিপটে, ওর হাত ধোয়ানো যাবে না কিন্তু বর নীরব বসে আছে। হাসান ধমক দিল, ভালয় ভালয় পাঁচশ টাকার নোট বের করেন। লোকটা আসলেই কৃপণ, সে একশ টাকা বের করে বলল, আর টাকা নাই। তখন মহিলারা হাত ধোয়ানোর জন তাদেরকে ধমকাতে লাগল।

হাসান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আর একশ টাকা না দিলে কিন্তু কানমলা খেতে হবে’ বলে হাত ধোয়াল। তারপর গিয়ে বরের পিছনে বসল। সবাই বর কনের দিকে মনোযোগি হল, এই সুযোগে সে বরের পকেটে হাত দিয়ে মানি ব্যাগ বের করে তা থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট রেখে ব্যাগটা আবার পকেটে রাখল। তারপর ফেরদৌসির হাত ধরে দরজায় গিয়ে সবাইকে টাকা দেখিয়ে বলল, হাত ধুয়ে ছয়শ পেলাম। বর দ্রুত পকেট থেকে ব্যাগ বের করে এক নজর দেখেই লাফিয়ে উঠে হাসানকে ধরতে চাইল কিন্তু ততক্ষনে তারা চম্পট।

বিয়েতে ফেরদৌসির নানি এসেছিলেন। কন্যার সাথে নানি ও ফেরদৌসি চলে গেল হাসান আবার একা হয়ে গেল। সে সারাক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে থাকে, ছন্নছাড়ার মত ঘোরাফিরা করে। তিনদিন পর ফেরদৌসি আসল আর তার মুখে হাসি ফুটল। বিচ্ছেদের পর সাথী পেয়ে দু’জনই খুব আনন্দিত, ফেরদৌসি অবিরাম হাসছে আর বিয়ে বাড়ির আলাপ করছে। সেখানে থাকা খাওয়ার সমস্যা হয়েছিল ইত্যাদি আলাপ করল, মানে হালকা বদনাম করল। তাদের বাড়ির কাছে সাগর দীঘি নামে একটা দীঘি আছে - দুলা ভাইয়ের বোনকে নিয়ে সেখানে বেড়াতে যেত, ইত্যাদি আলাপ করতে করতে তারা বিকাল থেকে রাত অবধি কাটিয়ে দিল।

রাতে খাওয়ার সময় নানি বললেন, আমি কাল চলে যাব ফেরদৌসি যাবি আমার সাথে? সে লাফিয়ে উঠল ‘হ যামু। কিন্তু পরক্ষনেই একটু বিষণ্ণ হয়ে চিন্তা করল, হাসানকে রেখে যেতে তার মন চাচ্ছে না। তারপর তার রুমে গিয়ে বলল, ভাইয়্যা চল নানু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি’। হাসান জিজ্ঞেস করল ‘তুই যাবি? - আমি তো যেতেই চাই, তুই না গেলে যামু না। - আমি যাব, খুশিতে তার চোখ চকচক করে উঠে। - তাহলে চল আম্মাকে গিয়ে বলি। মাকে বলার পর তিনি হ্যাঁ না কিছু না বলে শুধু ইতস্তত করলেন। তারপর মাস্টারকে গিয়ে বললেন, ওরা দু’জন যে আম্মার সাথে যেতে চায় কি বলেন? মাষ্টার বই থেকে মাথা তুলে চশমার মোটা ফ্রেমের উপর দিয়ে হাসানের দিকে তাকালেন, একটু চিন্তা করে বললেন ‘যাক, ওতো কোনদিন তোমাদের বাড়ি দেখেনি, একটু বেড়িয়ে আসুক। কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে। মা বললেন, ঠিক আছে, আম্মাকে বলব যেন তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেয়।পরদিন সকালে মা নিজ হাতে দু’জনের কাপড় চোপড় ধুয়ে দিলেন। তারপর ভাল করে সাজিয়ে গুজিয়ে দুপুরে তাদেরকে বিদায় করলেন।

ফেরদৌসির নানা ছিলেন জমিদারের পি এস, আগে থেকেই বেশ ধনি। কিন্তু নানা মারা যাওয়ার পর তার ছেলেরা আরো অনেক উন্নতি করেছে। আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি, সামনে ফুল বাগান, বিভিন্ন জাতের ফল ফুলের সমাহার। বাগানে দোলনা ও বিভিন্ন খেলনা সামগ্রি আছে। তাছাড়া অদুরেই নদীর ধারে আলাদা বাগান বাড়ি আছে, নদীতে ঘোরে বেড়ানোর নৌকা আছে। ফেরদৌসির সমবয়সী দুই মামার দুইটা মেয়ে আছে, সে গিয়েই তাদের সাথে মিশে গেল। তিনজন হৈ চৈ করে গিয়ে বাগানে খেলায় মেতে উঠল। কিন্তু মামাত ভাই আছে তিনজন, একজন বড় বাকী দুইজন হাসানের সমবয়সী, তাদের কেউ তার সাথে মিশলও না কথাও বলল না।

হাসান বিষণ্ণ হয়ে একাকি ঘোরে বেড়াতে লাগল। রাত্রে মামাত ভাইদের সাথে হাসানের থাকার ব্যবস্থা হল। এক রুমে দুই খাট, এক খাটে থাকে তাদের সকলের বড় ভাই আমজাদ, অপর খাটে থাকে দুইজন। নানী হাসানকে নিয়ে এসে আমজাদকে বললেন ‘ও তোর সাথে থাকবে। হাসান খাটের কিনারে জড়সড় হয়ে বসে রইল। তারা জানে হাসান একটা ছিন্নমূল অনাথ ছেলে, চৌদ্দপুরিতে তার কেউ নাই, কোন সম্পদ বা আশ্রয় নাই। তাদের ফুফা পূর্ব আত্মীয়তার সম্পর্কে অনুগ্রহ করে লালন পালন করছে। কাজেই এমন একটা বাস্তুহিন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করা, আলাপ সালাপ করা, নিজেদের সমমর্যাদায় টেনে নেয়া তারা হীনতা মনে করল। এজন্যই কেউ তার সাথে কথা বলল না নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়ে গেল। তাদের আলোচ্য বিষয় হল- ভাল খেলোয়ার কোথায় পাওয়া যাবে, যত টাকা লাগে ভাল খেলোয়াড় হায়ার করে আনতে হবে। একেক জন একেক খেলোয়াড়ের নাম বলল, তন্মধ্যে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে তারা শুইতে গেল। আমজাদ হাসানকে বলল, এই ছেলে তুমি ওপাশে যাও, বাসেত তুই আমার সাথে আয়। হাসান পাশের খাটে গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল।

গত শতকের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত ক্রিকেট খেলা ব্যাপকতা লাভ করেনি। গ্রাম বাংলায় তখনো মহা সমারোহে হা ডু ডু, দাড়িয়া বান্দা, ফুটবল, গোল্লা ছুট ইত্যাদি দেশীয় খেলার জয়জয়কার। গ্রামে গ্রামে এসব খেলার প্রতিযোগীতার আসর বসে। আমজাদ হল তাদের একালার যুব সমাজের লিডার। প্রতি বছর তাদের গ্রামের সাথে পার্শ্ববর্তি গ্রামের হা ডু ডু খেলার প্রতিযোগিতা হয়। এবারও খেলা চলছে, তিনদিন পর ফাইনাল খেলা। প্রত্যেকবার তারা হারে বিধায় এ বছর ফাইনালের জন্য বাহির থেকে কয়েক জন ভাল খেলোয়াড় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকী খেলোয়াড় গ্রাম থেকে বাছাইয়ের জন্য প্রতিদিন দুপুর থেকেই খেলার প্র্যাকটিস চলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মামাত ভাইয়েরা গ্রামের দিকে চলে গেল। হাসান একাকি বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে, ঘোরাফিরা করে। তাকে দেখে ফেরদৌসি কষ্ট পায়। সে বুঝতে পারে মামাত ভাইয়েরা তাকে অবজ্ঞা করছে, ইয়াতিম বলে হেয় জ্ঞান করছে। তখন সে হাসানকে সময় দেয়, তাকে নিয়ে বাগানে ও নদীতে ঘোরাফিরা করে। হাসান বলে আমার ভাল্লাগছেনা, চল বাড়িতে যাইগা। ফেরদৌসি বলে ‘আসলাম তো মাত্র আর কয়েক দিন থাকি। ওদের সাথে যাওয়ার দরকার নাই, ওরা তোকে দাম দেয় না, আমাদের সাথে থাক, অর্থাৎ মামাত বোনদের কথা বলল। আমরা এক সাথে বাগানে খেলাধুলা করব, নৌকায় চড়ে নদীতে ঘোরে বেড়াব। অনেক মজা হবে। হাসান বলল, নাঃ মেয়েদেরকে আমার শরম লাগে, তুই থাক আমি কাল চলে যাব। ফেরদৌসি বিষণ্ণ হয়ে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ দিনটা দেখ যদি ভাল না লাগে তাহলে চলেই যাব আর কি।

দুপুরে গ্রামের মাঠে হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল, হা ডু ডু খেলার আসর জমে উঠেছে। হাসান একাকি গজেন্দ্র গমনে গিয়ে বিরস বদনে একটা আলে বসল। গ্রামের ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়া সবাই খেলা দেখছে, হৈ চৈ করছে হাততালি দিচ্ছে আনন্দ করছে কিন্তু হাসান একাকি বিষণ্ণ হয়ে খেলা দেখছে। সে বারবার উত্তেজিত হয়ে উঠছে, তার দেহটা স্ফীত হয়ে উঠছে। কারণ একটা ছেলে ডাক দিল, তখন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় হাত দিয়ে তার পায়ে একটা বাড়ি মারল আর এমনি সে কলাগাছের মত ধুম করে মাটিতে পড়ে গেল। আরেকটা ছেলে ডাক দেয়ার সময় হাত বাড়াল, প্রতিপক্ষের একজন তার কব্জিতে ধরতেই সে পড়ে গেল। আর সবাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে চিড়া চ্যাপ্টা বানিয়ে দিল। আরেক ছেলে ডাক দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় একজন পেছন থেকে এসে লেং মারল সে পড়ে গেল। হাসান এসব দেখছে আর বারবার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এদেরকে তার কাছে খেলোয়াড় বলেই মনে হল না। তাদের গায়ে একটু টোকা লাগতেই কলাগাছের মত ধপাস করে পড়ে যায়, যেন গায়ে কোন শক্তি নাই। হা ডু ডু খেলায় যে ডাক দেয় তার দেহে হাতির মত শক্তি থাকতে হয়, যাতে একজন কেন পাঁচজনে ধরলেও টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে। সে খেলোয়াড়দের প্রতি নাক সিটকিয়ে চলে গেল।

রাতে শোয়ার সময় আবার খেলার আলাপ শুরু হয়েছে। আমজাদ তার ভাইদেরকে বলল, শুন ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকা হালুয়াঘাটে দুইজন গারো খেলোয়াড় আছে, ওরা নাকি খুব ভাল খেলে। বাসেত তুই মিজান ও বুলবুলের সাথে গিয়ে যত টাকাই লাগুক ওদেরকে সাথে নিয়ে আসবি। আরো অন্যান্য জায়গা থেকে অন্তত চার জন খেলোয়াড় আনতে হবে। আমাদের গ্রামে তো কোন ভাল খেলোয়াড় নাই, বাহির থেকেই আনতে হবে। পরপর তিন বছর ধরে হারছি আর কত, এ বছর লন্ডন থেকে খেলোয়াড় এনে হলেও কাপ আমাদের চাইই, চাই। তারপর আর কোথায় কোথায় ভাল খেলোয়াড় আছে, কিভাবে আনা যায়- সেসব নিয়ে তারা আলোচনায় মত্ত হল। তারা হাসানকে অবজ্ঞা করে কথা বলে না, হাসানও বুঝে তাই সেও কথা বলে না। কিন্তু এখন খেলা ও খেলোয়াড়ের অবস্থা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে বলল, এসব কোন খেলোয়াড় হল, এমন খেলায় আমি একাই কাপ এনে দিতে পারি। শুনে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, কেমন খেলোয়াড়, কয়টা খেলা খেলেছ, কয়টা কাপ জিতেছ’ ইত্যাদি বলে তারা ব্যাঙ্গ করতে লাগল। হাসান রেগে গিয়ে বলল, এত হাসি মশকরার তো কিছু নাই, একবার পরীক্ষা করেই দেখ না। হা ডু ডু খেলায় আমার এলাকার পোলাপান আমার সাথে পারত না।

তখন আমজাদ বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি দাঁড়াও, বাসেত তুই ওর পায়ে ধর। বাসেত ধরল আর হাসান টেনে নিয়ে যেতে লাগল যেন তার পায়ে একটা ইট বাধা- অবলিলায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এবার দুইজনে ধরল, তার মনে হল পায়ে দুইটা ইট বাঁধা, সে অনায়াসে টেনে নিয়ে গিয়ে খাটের কিনারে বসল। আমজাদ কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল, এবার তোরা দুইজন ওকে দু’পাশ থেকে ঝাপটে ধর। তারা শক্ত করে ধরল আর হাসান বৃষ্টি ভিজা প্রাণীর পানি নিংড়ানোর মত করে শরীরটা একটা ঝাড়া দিল। সাথে সাথে দু’জন ছিটকে গিয়ে বাসেত খাটের উপর পড়ল, আর রাকিব দেয়ালে মাথা ঠুকে পড়ে গেল। সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ‘উহঃ মরে গেছি’ আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। একটু কাঁদল, তারপর বলল ‘ও মানুষ না বাঘ। আমাদের বাহির থেকে খেলোয়াড় আনার দরকার পড়বে না, ও একাই কাপ এনে দিতে পারবে। এবার তারা হাসানের সাথে বিভিন্ন আলাপে মশগুল হল।

পরদিন তারা হাসানের সাথে উপযাচক হয়ে খাতির জমাতে লাগল, দুপুরে প্র্যাকটিসের জন্য খেলার মাঠে নিয়ে গেল। তিনদিন পর্যন্ত প্র্যাকটিস চলল, খেলোয়াড়রা চেষ্টা করল তাকে মাটিতে ফেলে উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিড়া চ্যাপ্টা বানিয়ে দিতে কিন্তু একবারের জন্যও তাকে মাটি ছোয়াতে পারল না। হাসান তালগাছের মত সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকে তখন আট দশটা ছেলে তাকে চারপাশ থেকে ঝাপটে ধরে। সে কখনো প্রচণ্ড একটা গা ঝাড়া মারে আর ওরা ছিটকে পড়ে, কখনো তাদেরকে নিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিজের কোর্টে চলে যায়। কিন্তু সে শুধু ডাকের খেলোয়াড় ধরতে পারে না। আর ডাকের খেলোয়াড় দুই ধরনের হতে পারে- হালকা পাতলা সুক্ষ্ম কৌশলী- যে প্রতিপক্ষকে ছোয়ে লাফিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে পারে। আরেক প্রকার হল শক্তিশালী- যাকে কয়েকজন ধরলেও আটকে রাখতে পারে না। হাসান হল এই দ্বিতীয় প্রকারের খেলোয়াড়। সে হয়ে উঠল সমগ্র এলাকার আলোচিত মূল্যবান বস্তু, সবাই তাকে সমিহ করে। মামাত ভাইরা তাকে মাথায় তুলে রাখে। তা দেখে ফেরদৌসিও খুব আনন্দিত। আয়োজকদের সিদ্ধান্ত হল- যে দুইজন গারো খেলোয়াড়কে অগ্রিম টাকা দেয়া হয়েছিল- টাকা মার যাবে বিধায় শুধু তাদেরকে আনা হবে। অন্য কোন হায়ারের খেলোয়াড় আনার দরকার নাই, হাসান একাই যথেষ্ট। তবে সে ধরবে না, শুধু ডাক দিবে।অন্যান্য খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেয়া হল, তাদের প্রধান কাজ হাসানকে হেফাজত করা। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় যখন ডাক নিয়ে আসবে তখন তারা এগিয়ে গিয়ে ধরবে বা তাড়িয়ে দিবে- যাতে হাসানকে ছোঁতে না পারে। আর হাসান নিরাপদে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকবে, সে শুধু ডাক দিবে।

বিশাল মাঠে খেলার আয়োজন। মাঠের চার পাশে বাঁশ পুতে সুতলি বেঁধে বেড়া দেয়া হয়েছে- যাতে দর্শকরা মুল মাঠে প্রবেশ করতে না পারে। এক পাশে মঞ্চ তৈরি করে বিচারকরা আসন গ্রহণ করেছে। মাইকে খেলোয়াড়দের পরিচয় ও খেলার নিয়ম কানুন ঘোষিত হচ্ছে। সারা এলাকার মানুষ উপছে পড়েছে, মাঠ লোকে লোকারণ্য। ফেরদৌসি তার মামাত বোনদের সাথে পিড়ি নিয়ে এসে কোমর পুতে বসেছে। মাঠের মাঝখানে চতুর্ভুজ আকারে খেলার দায়ের বা কোর্ট তৈরি করা হয়েছে। একেক পাশে সাত নয় বা এগার জন পর্যন্ত খেলোয়াড় থাকার নিয়ম আছে। ডাকদাতা কাউকে ছোঁয়ে দিলে বা ডাকদাতাকে দম থাকা পর্যন্ত নিজের কোর্টে ধরে রাখতে পারলে সে মরে গেল, আর খেলতে পারবে না। রেফারি এসে বাঁশি ফুৎকার দিল, খেলোয়াড়রা একে একে এসে কোর্টের এক মোঠ মাটি নিয়ে বুকে ও কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে কি জানি বলছে, তারপর নিজ নিজ স্থানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এলাকার সকলের দৃষ্টি হাসানের দিকে, সে সাধারণ ভাবে এসে বিসমিল্লাহ বলে তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। রেফারি বাঁশি ফুকল, খেলা শুরু হল।

প্রতিপক্ষের একজন ডাক নিয়ে এল, তাকে ধরার ভঙ্গিমায় এ পক্ষ এগিয়ে গেল, হাসান পূর্ব নির্দেশ অনুসারে কোণায় চুপ মেরে বসে রইল। তারপর কয়েক ডাক চলে গেল কেউ মরল না। এবার এ পক্ষের হায়ার করা গারো খেলোয়াড় দম নিয়ে গেল, একজন তার কাঁধ ধরে টান মেরে উপোর করে ফেলে দিল আর সাথে সাথে নয়জন খেলোয়াড় তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের নীচ থেকে একটা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এল। রেফারি দৌড়ে গিয়ে তাকে টেনে তুলল, কিন্তু সে দাঁড়াতে পারল না, পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে আছে আর আর্তনাদ করছে, তার পাজরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। মঞ্চে ডাক্তার আছে, তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হল। এ পক্ষের একজন মরল, প্রতিপক্ষ ডাক দিতে এসে একজনকে ছোয়ে গেল- সেও মরে কোর্ট ত্যাগ করে গেল। দেখতে দেখতে এ পক্ষের পাঁচ জন খেলোয়ার মরে মাঠ ত্যাগ করল। অবস্থা বেগতিক দেখে আমজাদ দৌড়ে এসে হাসানকে বলল, ‘এবার তুমি উঠ, ডাক দাও, সাবধান থেক, ওদের ডাকের সময় তুমি একদম পিছনে থাকবে’ বলে সে চলে গেল।

এটা যুবকদের খেলা, খেলোয়াড়দের মধ্যে হাসানই সবচাইতে কম বয়স্ক তরুণ। সে ডাক দেয়ার জন্য মধ্যদাগে পা দিয়ে দাঁড়াল। প্রতিপক্ষের মুখে হাসি ফুটে উঠল, তারা ভাবল- এ ছোকরাকে এক হাতে ধরে মাথার উপর তুলে একটা থ্যাকনা দিলেই জন্মের মত খেলার সাধ মিটে যাবে। সে ডাক দিল ‘ হৈ বার হাত বোল্লা তের হাত বিচি ধা তিং তিং, ধা তিং তিং ... সে ছোতে গেল এমনি কয়েক জন তাকে ঝাপটে ধরল, মাটিতে ফেলে দিতে চাইল কিন্তু বুঝতে পারল এটা দৃঢ়মূল তালগাছ। তখন সবাই তাকে চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। সে প্রচণ্ড একটা ঝাকি মারল আর সবাই ঝড়ের মুখে খড় কোটার ন্যায় উড়ে গিয়ে দূরে ছিটকে পড়ল। আর সাথে সাথে সমগ্র মাঠে বিজয়ধ্বনি উঠল, ছেলেরা নাচতে লাগল। বিপক্ষের ডাকের সময় আরেক জনকে ছোয়ে গেল। এবার এ পক্ষে থাকল মাত্র তিন জন আর ওরা থাকল আট জন, হাসানের মাথা ঘুরিয়ে গেল। সে ডাক দেয় কিন্তু চূড়ান্ত সতর্ক থাকে, যেন তাকে মাটিতে ফেলতে না পারে। তাহলে সবগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে হাড় গোড় ভেঙ্গে দিবে, যে কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে সে তাদের শত্রু হয়ে গেছে। হাসান বেপরোয়া ভাবে একজনকে গিয়ে ছোয়ে দিল আর সাথে সাথে সবাই তাকে ঘিরে ঝাপটে ধরল। সে টেনে হেঁচড়ে নিজের ঘরে চলে এল। আবার চারিদিকে হর্ষধ্বনি উঠল।

বিপক্ষের ডাকের সময় হাসানকে বাঁচাতে গিয়ে বাকি দুই খেলোয়াড়ও চলে গেল। এখন সে একা থাকল আর প্রতিপক্ষে আছে তিনজন। আমজাদের মাথায় বাজ পড়ল, সে দৌড়ে এসে মরিয়া হয়ে চিৎকার করল ‘হাসান সাবধান, ওদের ডাকের সময় যেভাবেই হউক আত্মরক্ষা করবে, তুমি মরে গেলে সব শেষ, তুমি আমাদেরকে বাচাও’ বলে সে কেঁদে ফেলার উপক্রম হল। রেফারি তাড়া দিল আর সে চলে গেল। এবার বিপক্ষ ডাক দিতে এল, তার মুখে বিজয়ির হাসি ফুটে উঠছে, কারণ সে জানে হাসান ধরতে পারে না, ছোঁয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। তাছাড়া তাদের প্লেয়ার এখনো তিনজন কাজেই বিজয় তাদেরই। হাসান কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সে শিকার ধরার মত ভঙ্গিমা দেখাচ্ছে, কিন্তু প্রতিপক্ষের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি, কারণ তার জানা আছে হাসান ধরতে পারে না। সে ছোয়ার জন্য এগিয়ে আসছে হাসান পিছিয়ে যাচ্ছে। দায়েরের শেষ প্রান্তে এসে গেছে। প্লেয়ারটা তাকে কোর্টের এক কোণা থেকে আরেক কোণায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিচ্ছে। হাসান ঘামছে আর দোয়া পড়ছে, তার শরীর কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে এখানেই সব শেষ। এ পক্ষের দর্শকরা সবাই দম বন্ধ করে তাকিয়ে আছে, আর বিপক্ষরা আশার আলো দেখছে। সহসা প্লেয়ারটা তাকে ছোয়ে দিয়ে লাফ দিল, আর হাসান চোখের পলকে মাটিতে হাত মেরে কোমরটা ঘোরিয়ে দু’পা শুন্যে উঠিয়ে তার পায়ে লেং মারল, প্লেয়ারটা মুখ থুবড়ে পড়ল। সে ছিটিয়ে গিয়ে তাকে কাঁধে তুলে দর্শকদের প্রতি তাকিয়ে চিৎকার করল ‘দিব নাকি আছাড় একখান? সাথে সাথে মাঠের চার ধারে এমন চিৎকার উঠল যেন বজ্রপাত হচ্ছে, ছেলেরা নাচতে লাগল। ফেরদৌসি পাগলের মত উঠছে আর বসছে, তার হুস নাই।

হাসান ডাক দিল তখন দু’জনের একজন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাকেই নিয়ে যাও তোমাকে তো ধরে রাখা যাবে না। হাসান তার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসল। আবার চতুর্পাশ্বে চিৎকার উঠল। এবার বিপক্ষের ডাকের পালা। এ পক্ষের সকলের দম বন্ধ হল। আমজাদ চিৎকার করতে করতে এল ‘হাসান, হাসান তুই আমার ভাই আমার মায়ের পেটের ভাই, তুই যা চাইবি আমি সব দিব, আমার সব কিছু তোকে দিয়ে দিব। তুই আমাদেরকে বাঁচা, আজ তিনটা বছর ধরে হারছি, তুই আমাদের এলাকার মান সম্মান রক্ষা কর’ সে কাছে এসে হাসানের দিকে জোরহাত করে কেঁদে ফেলল। দেখে হাসানের মায়া হল। ততক্ষণে প্রতিপক্ষ ডাক নিয়ে এসে গেছে কিন্তু এই খেলোয়াড়টা তেমন পাকা নয়, ভালগুলি আগেই বিদায় নিয়েছে। হাসান মুখ ভেংচে চোখ বড় বড় করে প্লেয়ারটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। যদিও আশংখায় সে নিজেই কাঁপছে কিন্তু বিপক্ষকে বুঝাতে চাইছে যে, ওকে ধরে মাথার উপর তোলে থ্যাকনা মারবে। বিপক্ষও ভয় পাচ্ছে হাসানও ভয় পাচ্ছে। বিপক্ষ নিজেকে নিরাপদ রেখে তাকে ছোতে চাচ্ছে আর হাসান ধরে ফেলার ভয় দেখিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাচ্ছে। প্লেয়ারটা তাকে কোণায় কোণায় তাড়িয়ে নিচ্ছে, দুজনে ধাপাধাপি করছে, কিন্তু হাসানের এক দম কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। দর্শকরা উৎকণ্ঠায় দম বন্ধ করে আছে, ফেরদৌসির নড়াচড়া নেই, সে অপলক তাকিয়ে আছে। আমজাদের আত্মা ঢিবঢিব করছে, সে খেলার প্রতি তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছে, পশ্চাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দর্শকদের মাঝে একটা বজ্রধ্বনি উঠল, সবাই চার পাশের বেড়া ভেঙ্গে দৌড়ে খেলার কাছে ছুটল।

আমজাদ পিছন ফিরে দেখেই হর্ষধ্বনি তোলে দৌড় দিল। কারণ প্রতিপক্ষ প্লেয়ারের দম শেষ, সে নিজ কোর্টে চলে গেছে। এখন এ পক্ষের বিজয় নিশ্চিত। হাসান ডাক দিতে যাচ্ছে, প্লেয়ারটা মরার জন্য হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসান ডাক মুখে নিয়েই তাকে চুম্বন করল, তারপর কাঁধে তুলে নিজের কোর্টে গিয়ে নাচতে লাগল। আমজাদ দৌড়ে এসে কাঁধ থেকে প্লেয়ারটাকে নামিয়ে হাসানকে নিজের কাঁধে তুলে নিল। তারপর শুরু হল নৃত্য, উদ্দাম নৃত্য আর ব্জ্রধ্বনির মত চিৎকার হৈ হোল্লুর। তিন বছর পর এ এলাকার লোকেরা বিজয়ের মুখ দেখছে, আর তা একমাত্র হাসানের কল্যাণেই দেখছে। তাই তারা তাকে নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভাসতে লাগল। আমজাদ তাকে কাঁধে নিয়ে মাঠের চার পাশে ঘুরছে, এলাকাবাসী তার পিছনে নাচতে নাচতে যাচ্ছে আর শ্লোগান দিচ্ছে ‘পিক পিক হুররে হাসান ভাই হাসান ভাই’ ইত্যাদি। ঢোল বাজছে আর সমগ্র মাঠটা যেন নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়েছে।

ফেরদৌসি যেন জমে গেছে, সে মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে হাসানের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আনন্দাতিশয্যে সে এতটাই উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে যে, বুঝতেই পারছে না তার চোখ থেকে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার মামাত বোনেরা একে অন্যকে দেখিয়ে হাঁসছে ‘দেখ দেখ ও কাদতেছে। ফেরদৌসি সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ মুছে স্থির হয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে হাসান গণ অভ্যর্থনা থেকে মুক্তি পেয়ে ফেরদৌসিকে খুঁজতে লাগল। অবশেষে আবিস্কার করে তার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলল, তুই খুশি? ফেরদৌসি কোন কথা বলতে পারল না, কিছুক্ষণ শুধু তার মুখের দিকে নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকল, তারপর ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। হাসান বুঝল ফেরদৌসি আত্মহারা হয়ে গেছে, সে হাসল। তারপর বলল, চল তুই নিজ হাতে পুরুস্কার নিবি। প্রধান খেলোয়াড় হিসাবে আমাকেও পুরুস্কার দিবে। সে বলল, না আমি যাব না। - আরে চল তোর হাতে পুরুস্কার নিলে আমি খুব শান্তি পাব’ বলে তাকে টেনে নিয়ে চলল। ফেরদৌসি হাত ছাড়িয়ে বলল, তুই পাগল হয়েছিস, এত মানুষের সামনে আমি যাব কেমনে? আব্বা শুনলে একদম মেরে ফেলবে। হাসান স্তম্ভিত হল, ঠিকই কইছস, তোর যাওয়া চলে না, আমিই গিয়ে নিয়ে আসি।

খেলায় দুটি পুরুস্কার দেয়া হল, বিজয়ী দল এবং প্রধান খেলোয়ারকে। বিজয়ী দলের প্রধান আয়োজক হিসাবে আমজাদ গোল্ডেন কাপ গ্রহণ করল। তখন শুধু মঞ্চের লোকেরা হাততালি দিল অন্যরা নীরব। তারপর প্রধান খেলোয়াড় হিসাবে মাইকে হাসানের নাম ঘোষণা করা হল। সে মন্থর গতিতে লাজুক ভঙ্গিতে জীবনের প্রথম পুরুস্কার গ্রহণ করতে গেল। বিচারক মণ্ডলীর প্রধান তার গলায় সোনার চেইন পরিয়ে দিল। আর সাথে সাথে হর্ষধ্বনি তুলে মানুষ হাসানের উপর আঁচড়ে পড়ল, তাকে কাঁধে নিয়ে বিজয়ধ্বনি ও শ্লোগান দিতে দিতে বাড়ির দিকে চলল। সামনে বাজার, তাকে কাঁধে নিয়ে তারা বাজারে কয়েক চক্কর দিয়ে উদ্দাম উর্মিমালার মত শ্লোগান দিতে দিতে বাড়িতে পৌঁছে দিল। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়িতে চা নাস্তা আনন্দ স্ফুর্তি চলল। আমজাদ সগর্বে কিছুক্ষণ পরপর সকলের সামনে পরিচয় তুলে ধরল ‘হাসান আমার আপন ফুফাত ভাই। বাড়ির মহিলারাও হাসানকে নিয়ে আনন্দে মাতল। হাসান তাদের হাত থেকে নিস্কৃতি পেয়ে নিরিবিলি সময়ে ফেরদৌসির গলায় চেইনটা পরিয়ে দিয়ে বলল, এটা তোর। ফেরদৌসি গলায় ঝুলানো চেইনের উপর হাত বুলিয়ে শুধু হাসল কিছু বলল না।

এক সপ্তাহ হয়ে গেল হাসান যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কিন্তু মামাত ভাইরা যেতে দেয় না। তাকে নিয়ে সারা দিন পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে, বাজারে গিয়ে আড্ডা দেয় আর সকলের সাথে ফুফাত ভাই পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করে। সবাই তাকে বিজয়ীর অভ্যর্থনা জানায়। বুড়া পোলা জোয়ান সকলের মুখে হাসানের জয় জয়কার। দশ দিন পর সে ফেরদৌসিকে বলল, চল যাই গা, নইলে আব্বা বকবে। সে বলল, কাল চলে যামু।

যমুনার পশ্চিম পাড়েই নানির বাপের বাড়ি। তার পরিবার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খান্দানি পরিবার। তার একমাত্র ভাইয়ের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম জুয়েল মেয়ের নাম জেনিয়াস। জেনিয়াসের বিয়ে, তাই জুয়েল এসেছে ফুফুকে নিয়ে যেতে। ত্রিশ বছরের যুবক জুয়েল এলাকায় বড় মাপের নেতা এবং মিশুক প্রকৃতির লোক। তাকে দেখেই বাড়ির ছেলে মেয়েরা ‘জুয়েল মামা’ এসেছে বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। কারণ সে আসলে আনন্দের বাজার গরম হয়ে উঠে। কিন্তু জুয়েল মামা এসেই ঘোষণা দিলেন ‘যারা যারা যাবে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হও, সময় নাই আমি এখনি চলে যাব। তখন ভাই বোনেরা সবাই প্রস্তুত হল। ফেরদৌসিও প্রস্তুত কিন্তু হাসান যাবে না, সে বাড়িতে চলে যাবে। মামাত ভাইয়েরা মামাকে বলল, জুয়েল মামা ওকে চেন, সে কিন্তু জামালপুরের শ্রেষ্ঠ বীর এবং অপ্রতিদ্ধন্ধি খেলোয়াড়, ওকে নিয়ে চল। জুয়েল মামা হেসে বললেন, ‘ভাগ্নে তাড়াতাড়ি উঠ, তুমি কত বড় বীর তা আমি পরীক্ষা না করে ছাড়ছি না। অগত্যা তাকেও যেতে হল।

সেখানে গিয়ে মামাত ভাইয়েরা সব সময় হাসানের প্রশংসা করে। তখন জুয়েল মামা বলল, ভাগ্নে উঠ আজ আমার কাছে তোমার বীরত্ব পরীক্ষা দিতে হবে। তখন দুজনেই বিছানায় কনুই রেখে একে অন্যের অঞ্জুলি ধরল। পরীক্ষা হবে কে কার হাত বিছানায় ফেলতে পারে। মামা প্রথমেই একটা ঝাকুনি দিয়ে হাসানের হাত কাত করে ফেলল। তারপর হাসান ঝাঁকি মেরে মামার হাত ফেলে দিল। মামা হেসে বললেন, না না এটা হয়নি, এটা আমি বুঝতেই পারিনি, আবার। আবার ধরল মামা হারল, আবার ধরল, হারল। এভাবে দশবার হারের পর মামা বলল, তুই সত্যিই বীর। এবার তোর কুস্তি খেলা হবে। তারপর এলাকার কয়েকটা ছেলের সাথে কুস্তি ধরাল, হাসান প্রথম টানেই প্রতিপক্ষকে কাঁধে নিয়ে নাচতে থাকে। অবশেষে মামা তার পিঠ চাপড়ে বললেন, তুই সত্যিকারের বীর, আমি তোকে আমার বডি গার্ড বানাব। তোকে দিয়ে ভোট কেন্দ্র দখল করে এম পি হব, তারপর তোকেও এম পি বানাব। মামা তাকে খুব সমীহ করতে লাগলেন, সব সময় কাছে রাখেন।

হঠাৎ মাষ্টার এসে উপস্থিত। দুই সপ্তাহ হয়ে গেল হাসান ফেরদৌসির খবর নাই দেখে তিনি শ্বশুর বাড়ি গেছেন, তারপর এখানে ছুটে এসেছেন। মামাত ভাইয়েরা ফুফার সাথে হাসানের কীর্তির বয়ান দিতে লাগল। শুনে তিনি বললেন, তার পুর্ব পুরুষরা যোদ্ধা ছিল, বীর ছিল, এজন্যই তারা জমিদারী পেয়েছিল। আর বীরের বংশেই বীর জন্মায়। এরপর তিনিও দুইদিন থেকে বিয়ে উৎসবের পর তাদেরকে নিয়ে চলে গেলেন।



ফেরদৌসিদের পশ্চিম ভিটায় অনেক আম গাছ, পাড়ার লোকেরা আম পেরে নিয়ে যায়। দুপুরে খাওয়ার পর সে বলল, ভাইয়্যা চল ভিটার আমগুলি নিয়ে আসি, মাইনসে পেরে নিয়ে যাচ্ছে। হাসান গাছে উঠার জন্য একটা মই ও কোটা (বাঁশ) নিল আর ফেরদৌসি বস্তা নিয়ে রওয়ানা হল। সে গাছে উঠে ঝাকি দিয়ে, কোটা দিয়ে গুতিয়ে আম পারে আর ফেরদৌসি কুড়ায়। অনেকগুলি গাছ বেয়ে সে ক্লান্ত হয়ে গেল, নৈদাঘ জ্যৈষ্ঠের তাপদাহে ঘামে নেয়ে গেছে, লুঙ্গি পর্যন্ত ভিজে গেছে। একটা গাছের নিচে বসে সে বিশ্রাম করছে আর ফেরদৌসির আম কুড়ানো দেখছে। সহসা তার দৃষ্টি গেল ফেরদৌসির দেহের উপর। সে অবাক চোখে দেখছে - ফেরদৌসি এখন আর ছোট্ট খুকী নয়। শৈশবের মোটা শরীর ভেঙ্গে রিফর্ম হয়েছে। সে এখন স্লীম দীর্ঘাঙ্গি, বর্ষার কলমি লতার মত লতিয়ে উঠছে, বলিষ্ঠ অবয়ব নিয়ে লাউ ডগার মত দ্রুত বেড়ে উঠছে, এখন সে তরুণী। নবোত্থিত পেয়ারাকৃতি উরোজের উপর উত্তরীয় ঢাকনি পড়েছে। দর্পনস্থিত ধুলিবালির ন্যায় শৈশবের মলিনতা কেটে নির্মল লাবন্য ফিরে আসছে। চন্দ্রকলার ন্যায় ধীরে ধীরে রুপ কৌমুদি পুর্নেন্দু প্রভায় উদ্ভাসিত হচ্ছে। প্রমত্তা তটিনীর উদ্দাম তরঙ্গ মালার মত ঢেউ খেলানো বিশাল চিকুরদাম পেঁজা তুলার ন্যায় পৃষ্টোপরি ছড়িয়ে আছে। শৈশবে দেহ ছিল চঞ্চল আখি যুগল স্থির কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে গেছে, দেহ হয়েছে স্থির আখি হয়ে উঠেছে চঞ্চল। হাসানের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দেয়, এতদিন সে ছিল ক্লীব- লিঙ্গভেদ জানত না, এই প্রথম জানল তারা এক জাতীয় নয় বিপরিত লিঙ্গের প্রাণী।

আম কুড়ানো শেষ করে ফেরদৌসি বস্তাটা তুলে ওজনটা আন্দাজ করল। তারপর বলল, ভাইয়্যা আয় দুইজনে নিতে হবে, অনেক ওজন একা নেয়া যাবে না। সে বস্তার একপাশে ধরে আছে, হাসান এসে অপর পাশে ধরল। দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, প্রচণ্ড গরমে ফেরদৌসির গাল রক্ত জবার মত লাল টকটক করছে, যেন টোকা দিলে রক্ত ঝড়বে। মিহির প্রতিফলিত মুখমণ্ডল চতুর্দশি কৌমুদির স্নিগ্ধ আভা চড়াচ্ছে। কপোলোপরি ঘর্ম বিন্দু মুক্তার মত চিকচিক করছে, তাতে কয়েক গাছি অলক জড়িয়ে আছে। সে লোভ সংবরণ করতে পারল না, চুমু মারল। ফেরদৌসি ‘যাঃ শয়তান’ বলে ছিটিয়ে সরে গেল। গণ্ডে হাত দিয়ে বঙ্কিম ভঙ্গিতে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণায় সলজ্ব হাসি ফুটে উঠেছে। হাসান আত্মনিয়ন্ত্রনহীন এ কর্মটার জন্য লজ্বা পেয়ে গেল, আবার আশংকা করল যদি বাড়িতে বলে দেয়। তাই সে তাড়াতাড়ি বস্তার মুখ পেছিয়ে বলল, দে আমার মাথায় তুলে দে, দু’জনে নেয়ার দরকার নাই। হাসান আমের বস্তা মাথায় নিয়ে যাচ্ছে আর ফেরদৌসি পিছু পিছু যাচ্ছে।

চুমুটা যেন তার দেহমনে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে গেল। বারবার তার তনু- মন রোমাঞ্চিত হচ্ছে, গা কাটা দিয়ে উঠছে। এ এক অনন্য অনুভুতি, নতুন অভিজ্ঞতা, কুমারী মনে নতুন শিহরন, অব্যক্ত জাগরণ। সে পেছন থেকে একদৃষ্টে হাসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রশস্ত পিঠ, চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল বাহু যুগল, মাংশল পায়ের গোছা, সব কিছুই সে নিরীক্ষণ করে, সব কিছুই অদ্ভুত সুন্দর, দুর্বার আকর্ষন, দুরন্ত কামনা, সে অবাক চোখে দেখে যেন নতুন দেখছে। এ মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সুন্দর আর মনোহর তার মধ্যে এই বুঝি শ্রেষ্ঠ। তারুণ্যের উদ্দাম ভাললাগা আর ভালবাসা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে যায়। সর্বাঙ্গে শিহরন, আখি যুগল নির্মিলিত, দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। সে হাসানের পিছু পিছু যায় আর ভাবে, এ কে, হাসান, তার খেলার সাথী হাসান? কিন্তু হাসানকে দেখে তো এমন অনুভুতি কখনো হয়নি, হৃদয় সরোবরে এমন ঝড় উঠেনি। এর সাথে তার সম্পর্ক কি শুধুই খেলার, খেলার সাথী? না, এখন সেই সম্পর্ক অন্য কোথা, অন্য কোনখানে গড়িয়ে যাচ্ছে। এতদিন সে উভয়ের লৈঙ্গিক পার্থক্য বুঝত না, আজ বুঝল। এতদিন সে অন্য ছেলেদের লজ্বা পেত তবে হাসানকে লজ্বা পেত না, কিন্তু এখন তাকে লজ্বা পায়। তবে এই লজ্বা সেই লজ্বা নয়, এই লজ্বায় আছে শুধু শিহরণ ও রোমাঞ্চন।

নতুন বয়সে পদার্পিত দুটি তরুণ তরুণী রঙ্গিন ভুবনে পৌঁছে গেছে, তারা একে অন্যকে নিয়ে ভাবে, স্বপ্ন দেখে। হাসান বাহির থেকে এসে ফেরদৌসিকে না পেলে তার চোখ আতিপাতি করে খুঁজে, ফেরদৌসি স্কুল থেকে এসে হাসানকে না পেলে তার চোখ ব্যথিত হয়, মন আনচান করে। তাদের দৃষ্টি পরস্পরকে খুঁজে বেড়ায়, একে অন্যকে দেখে মুগ্ধ নয়নে, দিব্য চক্ষে, কটাক্ষে, আড়চোখে। দৃষ্টি বিনিময় হয়, শিহরিত হয়, খোদার সৃষ্টি জগতের মধ্যে পরস্পরকে শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর সৃষ্টি প্রতিভাত হয়। একে অন্যের কণ্ঠ শুনতে তারা উৎসুক থাকে, ফেরদৌসি কথা বললে হাসান উৎকর্ন হয়, হাসান কথা বললে ফেরদৌসি উৎকর্ন হয়। পরস্পরের কথা তাদের কানে মধু বর্ষণ করে, যেন বিমুর্ত সঙ্গিতের মুর্ছনা ইথার তরঙ্গে ঢেউ তুলে তাদের কর্ণ কুহরে অমিয় সুধা বর্ষন করে। তারা অচিন দেশের রঙ্গিন ভুবনে হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় একে অন্যের মধ্যে। তাদের পৃথিবী এখন রঙ্গিন, স্বপ্নময়, সঙ্গিতময়। আগে হাসান খেতে আসলে ফেরদৌসিকে বলে কয়েও মা ভাত বাড়াতে পারতেন না, কিন্তু এখন হাসানের আহট পেলেই সে দৌড়ে গিয়ে ভাত বেড়ে দেয়। উনুনের ধারে বসে হাসানের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে থাকে। হাসান কেউ আসছে কিনা বাইরে তাকিয়ে দেখে ফেরদৌসির মুখে লোকমা তুলে দেয়। দুজনের বাকযন্ত্র থাকে নির্বাক কিন্তু হৃদযন্ত্র সবাক। তারা মনের ভাষায় কথা বলে।

হাসান থাকে সর্বদক্ষিনের রুমে। মাঝখানে কয়েক রুমের ব্যবধান। কিন্তু তারা শুয়ে শুয়ে দুরত্ব অনুভব করে না বরং নৈকট্য অনুভব করে, সান্নিধ্যের উত্তাপ অনুভব করে। তারা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের জাল বুনে, কল্পলোকের আকাশে উড়ে বেড়ায়, ঐ দূর আকাশের নীল দিগন্তে ঘুরে বেড়ায়। তারপর স্বপ্নের ঝিলে নেমে আসে, হংসমিথুন ডানা ঝাপটায়, একে অন্যের গ্রীবায় চঞ্চু বুলিয়ে সুরসুরি দেয়, সোহাগ দেয়। তারপর চলে যায় নদীর ওপারে, যেখানে আছে কাশবন, ঘাসবন আর মধুবন। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে মধ্যরাতে দুটি তরুণ তরুণী স্বপ্নময় চোখে ঘুমিয়ে পড়ে।

আষাঢ় মাস। কয়েক দিন যাবত প্রবল বারিবর্ষণ হচ্ছে। যমুনা সীমালঙ্ঘন করল- দুকুল ছাপিয়ে তার অতুল বারিভাণ্ডার দিগ্বিদিকে উগলে দিয়েছে। শুরু হল বন্যা, মাঠ ঘাট অথৈ জলে তলিয়ে গেছে। রাস্তাগুলি যেন বিশাল বারিধি বক্ষে আনাকোন্ডার মত একবেকে স্থির হয়ে আছে। আর বাড়িগুলি ধুসর মরুতে মরুদ্যানের মত জেগে আছে। বন্যার সময় ছেলে মেয়েরা ভেলা বানিয়ে মাঠের পানিতে ভেসে বেড়ায়, এ বাড়ি ও বাড়ি যায়, কেউ কেউ গ্যাং পার্টীর সাথে বন্যা দুর্গতদের উদ্দার কাজে সাহায্য করে। ফেরদৌসিদের বাড়ির দক্ষিণের মাঠে পোলাপানেরা সারাদিন ভেলা ভাসিয়ে খেলা করে। তা দেখে সেও আবেগে মাতল, তাকে ভেলা বানিয়ে দিতে হবে, দুদিন ধরে হাসানের পিছু লেগে আছে কিন্তু হাসান তার কথা গায়ে মাখে না। তৃতীয় দিন খাওয়ার সময় রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত পা ছোড়ে নাচানাচি শুরু করল ‘ভাইয়্যা আজ আমাকে ভেলা বানিয়ে দিতেই হবে, নইলে তোকে যেতে দিব না’।

তার যত আবদার ও আশা আকাঙ্ক্ষা সব হাসানের কাছে। অন্য কাউকে বলেও না বলবেও না, হাসানকেই করতে হবে। তার নাচানাচি দেখে অবশেষে মা বললেন ‘যা না, ওকে একটা ভেলা বানিয়ে দে, সবাই খেলছে সেও কিছু খেলুক। হাসান একটা দা নিয়ে গিয়ে রাস্তার ধার থেকে ফেরদৌসিদের ঝাড়ের চারটা কলা গাছ কাটল। চার কলাগাছের ভেলা যথেষ্ট বড়। তারপর বাঁশ কেটে টুকরা করল, কলাগাছে ঢুকিয়ে ভেলা বানাবে। ফেরদৌসিকে বলল, আমি বাঁশ ধরি তুই মুগুর দিয়ে বাড়ি দে কিন্তু সে বাড়ি দিতে পারে না। তাকে দিল বাঁশ ধরতে, হাসান বাড়ি দিবে কিন্তু সে ধরতেও পারে না। হাসান রাগ দেখিয়ে বলল, তোর দ্বারা দুনিয়ার কোন কাজ হবে না তবে একটা কাজ খুব সুন্দর পারবি। - কি কাজ? – বউ হওয়ার কাজ, সুন্দর বউ হতে পারবি। ফেরদৌসি রোমাঞ্চিত হয়, সে আরো স্পষ্ট শুনতে চায়, কার বউ? – কার আবার, আমার মত গাধা ছাড়া তোর মত অকর্মা ভেটকিকে কোন হালায় বিয়ে করতে যাবে। যদিও ফেরদৌসি ছোটবেলার মত মোটা নয়, এখন তার শরীর ভেঙ্গে স্বর্ণ লতিকার মত লতিয়ে উঠেছে। তবুও খোচা দেওয়ার সময় হাসান তাকে ভেটকি বলে।

অন্য সময় ভটকি ডাকলে এতক্ষণে হাসানের খবর হয়ে যেত। কিন্তু এখন ফেরদৌসি রোমাঞ্চিত হয়, সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে উঠে, মুখটা কৃত্রিম রোষায়িত করে বলল, যাঃ আমি মরে গেলেও তোর বউ হব না, তুই আমারে মারস, খোচাস। - আরে বোকা মরে কেউ বউ হয় নাকি, বউ হবি মরার আগে। আর যখন বউ হবি তখন মারবও না খোচাবও না, শুধু সারাদিন কোলে নিয়ে আদর করব, চুমু দিব। ফেরদৌসি মাথায় ওড়না টেনে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, গালে যেন ছোপ ছোপ রক্ত জমে গেছে, কেন? হয়ত লজায় অথবা আনন্দাতিশয্যে। এভাবে দুটি তরুন তরুণী আবেগঘন চুটকি কেটে ভেলার কাজ শেষ করে একটা লগি বানাল। তারপর দুজন উঠে লগি মারল, নতুন ভেলা স্পীড বোটের মত চলতে লাগল। হাসান ‘হুররে’ চিৎকার করছে আর আনন্দে নাচছে। বড় ভেলা হেলেও না দুলেও না। ফেরদৌসিও হর্ষধ্বনি করছে আর হাত উঠিয়ে ভেলায় চড়া অন্যান্য মেয়েদের সাথে আনন্দ শেয়ার করছে। তারা লগি মেরে মেরে মাঠের মাঝ বরাবর পৌঁছে গেছে।

হঠাৎ হাসান বলল, তুই ওড়নায় ঘোমটা দিয়ে ভেলার মাঝে চুপ করে বস। - কেন? – দরকার আছে। - কী দরকার আগে ক। - তুই এখনি আমার কথা মানিস না বউ হলে তো আরো মানবি না। অন্য সময় হলে ফেরদৌসি তার কথা তো মানতই না বরং তর্ক শুরু করত। কিন্তু এখন ভেলা বানিয়ে দেয়ার জন্য সে ছিল হাসানের প্রতি কৃতজ্ঞ, তার উপর বউ হবার দুরন্ত স্বপ্ন। তাই সে আর কোন কথা না বলে ওড়নায় ঘোমটা টেনে চুপ করে বসল। হাসান বলল, এটা হল নতুন বউয়ের নায়র। তুই নতুন বউ আমি তোর বর। তোকে আমি নৌকা করে বাপের বাড়ি থেকে আমার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ফেরদৌসি ঘোমটা খুলে হেসে বলল, না না, আমি নৌকা দিয়ে যাব না, এমনিতেই আমি সাঁতার জানি না, পড়ে গেলে মরে যাব। - না না, পড়বি না, পড়লেও আমি তুলব। - যদি না তুলতে পারিস তাহলে তো মরেই যাব, আমি মরলে তুই কাঁদবি না?

হাসান ক্ষনেক নীরব থাকল, তারপর হাসি চেপে বলল, না এক ফোটাও না। - কী আসলেও কাঁদবি না? – না। মেয়েটা সহসা মুখে ওড়না গুজে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল ‘আমার প্রতি তোর কোন মায়া নাই, আমি শুধু শুধুই তোর জন্য পাগলামি করি। হাসান আবেগাপ্লুত হয়, তার সামনে গিয়ে বসে বলল, এজন্যই তো তোকে আমি ভটকী ডাকি। এখন তোর শরীরটা ভটকি না হলেও তোর মাথাটা ভটকি, আরে বোকা মানুষ বেঁচে থাকলে তো কাঁদে, তুই মরে গেলে আমি বেঁচে থাকব নাকি, তোর সাথে অবশ্যি আমিও মরব’ বলে সে লগি মারতে লাগল। হাঁ, সম্ভবত এই কথাটা উর্ধ্বলোকে তার ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফেরদৌসি বিস্ফারিত নেত্রে অপলক চোখে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে, দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামছে। সেই দৃষ্টিতে যুগপৎ ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য ঝড়ে পড়ছে। অন্তহীন মমতায় তার মনটা ভরে উঠল।

এরপর থেকে ফেরদৌসি ভেলার খেলায় মেতে উঠল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ভেলায় যায়। কিন্তু বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আসে। কারণ মেয়েদের ব্যাপারে তিনি অতিশয় রক্ষণশীল, মেয়ে ভেলায় চড়ে ঘুরলে অন্য ছেলেরা দেখবে কথা বলবে এটা তিনি মানতে পারেন না। কিন্তু হাসানও যে অন্য ছেলে, তার সাথে মেয়ে সারাদিন ভেউ ভেউ করে ঘোরে বেড়ায় - এটা তিনি বেমালুম ভুলে যান বা ভুলে থাকতে চান, এ যেন তিনি দেখেও দেখেন না। বাবার ভয়ে ফেরদৌসি আগে ভাগেই স্কুল থেকে এসে খেয়ে বা না খেয়ে দৌড়ে গিয়ে ভেলায় চড়ে। হাসানকে সামনে পেলে সাথে নেয় অন্যথায় একাই যায়।

বিকালে হাসান মাদরাসা থেকে বাড়িতে আসছে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখল ফেরদৌসি ভেলা চালিয়ে যাচ্ছে। সে আপন মনে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর রাস্তায় পোলাপানের হৈ চৈ শুনতে পেল। তারা মাঠের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। হাসান কী ঘটেছে দেখার জন্য মাঠের দিকে তাকাল আর চোখের পলকে জামাটা খুলে নিক্ষেপ করে পানিতে ঝাপ দিল। সে উল্কার বেগে ছুটতে চাইছে কিন্তু পারছে না। কখনো সাঁতরাচ্ছে কিন্তু মনমত হচ্ছে না, কখনো বুক পানি বা গলা পানি ভেঙ্গে দৌড়তে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না, তখন মরিয়া হয়ে সাঁতরাচ্ছে। বিশাল ফকির বাড়িতে একটা আশ্চর্য জনক বিষয় হল, এ বাড়িতে কোন পুকুর নাই, নারী পুরুষ সবাই বাথরুমে গোসল করে, ফেরদৌসিরাও বাথরুমে গোসল করে। কিন্তু উবায়দুল্লাহ মাস্টারের ভুল হল তিনি তার মেয়েদের সাঁতার শিক্ষা দেননি। ফেরদৌসি ভেলা চালিয়ে যেখানে পৌঁছেছে সেখানে একটি পগার বা ছোট পুকুর ছিল, সে লগি মারার জন্য যখনি লগিতে বল প্রয়োগ করল তখন লগি মাটি তা না পাওয়ার কারণে সে মুখ থুবড়ে পানিতে পড়ল আর পায়ের ধাক্কায় ভেলাটা দূরে সরে গেল। সে পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল।

বিপদের সময় মানুষের শক্তি অসার হয়ে যায়, হাত পা বিকল হয়ে আসে, হাসানেরও সেই অবস্থা। সে নিমিষে ফেরদৌসির কাছে পৌঁছতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। অস্তিত্বের সকল শক্তি প্রয়োগ করে সাতরাচ্ছে, ছোটছে। ফেরদৌসি মাঠের প্রায় মাঝামাঝিতে ছিল। অবশেষে গিয়ে ঝাপটে ধরল, মাথাটা তার কাঁধে রেখে শরীরটা জড়িয়ে ধরে সাঁতরে কোন রকম পুকুর পাড়ে এল। তারপর কাঁধে নিয়ে ভেলার কাছে গেল। অবশ শরীর অসম্ভব ভারী অনেক কষ্ট করে ভেলায় তুলে শুয়াল। কিন্তু ফেরদৌসি বেহুশ। সে মরিয়া হয়ে ডাকল কিন্তু সাড়া মিলল না। সহসা তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে চিৎকার করল, ‘ফেরদৌসি বোন আমার কথা ক, কথা ক’ কিন্তু সাড়া নেই। সে পাগলের মত মুখে মাথায় হাত মারতে লাগল আর ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। সহসা মনে হতেই পেটে চাপ দিল আর ভরভর করে পানি বেরিয়ে এল। তারপর মরিয়া হয়ে ভেলা ধাক্বিয়ে তির বেগে বাড়ির দিকে ছুটল।

রাস্তার ছেলেরা চিৎকার করতে করতে বাড়িতে গিয়ে বলল, ফেরদৌসি পানিতে পড়েছে। মা শুনেই পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিলেন। যে মহিলা বোরকা ছাড়া কখনো ঘরের বাইরে পা রাখেন না এখন গায়ে মাথায় ঠিক মত কাপড় নাই- পাগল হয়ে দৌড়ে গেলেন। ততক্ষণে হাসান কাছাকাছি এসে গেছে। রাস্তার ধারে পৌছতেই মা বললেন, তাড়াতাড়ি কাঁধে নে। তারপর দুজনে ধরাধরি করে হাসান কাধে নিল। এবার কাঁধের চাপে পেটের অবশিষ্ট পানি বেরিয়ে গেল। হাসান নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়াল। দুজনেই ‘ফেরদৌসি ফেরদৌসি’ বলে ডাকছে আর কাঁদছে। ততক্ষণে ফেরদৌসি হাত পা নাড়ানো শুরু করেছে। এবার মায়ের বুকে দম ফিরে এল আর হাসানের মুখে হাসি ফুটল। এতক্ষণে মায়ের হুস হল, ভিজা কাপড় মেয়ের গায়ে সেটে আছে দেখে তিনি লজ্বা পেলেন, হাসানকে বললেন তুই যা আমি ওর কাপড় বদলে দেই। মাষ্টার রাস্তায় শুনেই দৌড়ে এসে মেয়ের অবস্থা দেখে আবার বাজারে ছুটল ডাক্তার ডাকতে।

পরদিন সকালে খাওয়া দাওয়ার পর হাসান ভাবল একটু ফেরদৌসিকে দেখে যাই। সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, হাসান তার পাশে বসতে বসতে বলল, কিরে শাখামৃগি কাল আমি না থাকলে তো এতক্ষণে তুই অক্বাপুরি গিয়ে লঙ্কাপুরী রাবনের বউ হয়ে যেতি। আরো আমার সাথে খোচাখোচি করবি? ফেরদৌসি সকাল থেকে হাসানকে পায়নি, সে সানন্দে উঠে বসল। তারপর অতি আবেগে কী বলবে না বলবে দিশা না পেয়ে বলল, ‘তুইই তো আমাকে ধাক্বা মেরে ফেলে দিয়েছিস। -কি আমি তোকে ফেলেছি। - হ তুই ফেলেছিস। -আরে ভটকি আমি না থাকলে তো তুই মরে ভুত হয়ে যেতি, এখন কৃতজ্ঞতা না করে আবার খোচাখোচি শুরু করেছিস। ততক্ষণে মা ঘরে এসে গেছেন। ফেরদৌসি বলল, আম্মা শুনলে শুনলে, ও আবার আমাকে ভটকী বলেছে। আমি কিন্তু ওর মাথাটা চিবিয়ে খাব। মা তাদের নিষ্পাপ খোচাখোচি খুবই উপভোগ করেন, মুখে যদিও ধমক দেন কিন্তু মনে মনে তার ভাল লাগে।

এবার তিনি নিজেই অংশগ্রহণ করে বললেন, না না মাথা খাইস না, মাথায় খালী হাড় হাড্ডি। তোর দাঁতগুলি ভেঙ্গে ঝুর ঝুর করে পড়ে যাবে। মায়ের উপস্থিতিতে জমবে না ভেবে হাসান বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় ফেরদৌসির পাশে টিনের বেড়ায় টোকা দিয়ে বলল, কিরে ভটকি ভেলায় চড়বি না’ বলে সে চলে গেল। ফেরদৌসি চেঁচিয়ে উঠল, আম্মা শুনলে তো আবার ভটকি ডাকল, আমি কিন্তু ওর কিলিজাটা খেয়ে ফেলব। মা হাসি চেপে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে তোর বাপকে বলব বাজার থেকে কলিজা কিনে আনতে। ফেরদৌসির মাথা খারাপ হয়ে গেল, সে চাচ্ছিল হাসান কিছুক্ষণ থাকবে, আলাপ করবে কিন্তু চলে গেল। সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য, তারপর হাসান গিয়ে তুলে আনল। ভেলা বানানোর দিন সে বলেছিল, তুই মরে গেলে আমি বেঁচে থাকব নাকি, তোর সাথে আমিও মরব। সে তার কথা প্রমাণ করেছে। হাসানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসায় তার মনটা ভরে উঠল। তার চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু বালিশে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

বিষয়: সাহিত্য

১০৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File