হাসান ফেরদৌসি - ৬

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ অক্টোবর, ২০১৭, ০৭:৩৭:১১ সকাল

১০

ফেরদৌসির কানে পানি ঢোকার কারণে কান এখনো থমথম করে, স্তব্ধ হয়ে আছে, ঠিক মত শুনতে পায় না। রাতে সকলের খাওয়ার পর নিরিবিলি সময়ে সে তার আব্বাকে বলতে গেল কিন্তু তার কামরার কাছে পৌছতেই মা বাবার অট্টহাসি ও কথাবার্তা তার কানে বাজল। সে থমকে দাঁড়াল। বাবা হাসতে হাসতে বলছেন, ‘আরে ওরা আমার কবুতরের জোড়া, আমার কবুতরের জোড়া---। মা বললেন, এজন্যই তো সবাই ওদেরকে মানিক জোড় ডাকে, ও না থাকলে আজ কী সর্বনাশটাই যে হত, মনে হলেই দম আটকে আসে। সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেচামেচি করছে নাচছে হাততালি দিচ্ছে কিন্তু কেউ আর পানিতে নামল না। হাসান এক পলক দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সবাই বলছে, হাসান সেখানে সাতরে যায়নি উড়ে গেছে। ভাগ্যিস যে সে রাস্তায় ছিল, ঘরে বা মাদরাসায় থাকলে বের হয়ে যেতে যেতেই শেষ হয়ে যেত, কিংবা যদি ধীরে ধীরে যেত তবুও আর মেয়েটাকে বাচানো যেত না। সেই মাঠের মাঝখানে কতটা দূর, আর দুয়েক মিনিট দেরি হলেই মরে যেত।

তারপর মা ইতস্তত করে বললেন, আমি বহু দিন ধরেই আপনের কাছে কথাটা বলব ভাবছি কিন্তু চিন্তা হত আমার সব মেয়ের জামাইরা চাকরিজীবি কিন্তু ছোট মেয়ের জামাই চাকরি করতে পারবে না, এমন কোন সম্পদও নেই যে, সংসার করে খাবে- তখনই মনটা নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু কাল থেকে ভাবছি কেউ নষ্ট হওয়া থেকে কোন জিনিস বাচালে সেই তার হকদার। তাই হাসানই তো হকদার মনে হচ্ছে। কর্তা বললেন, তুমি এত দিনে চিন্তা করছ আমি তো প্রথমেই চিন্তা করে রেখেছি। মনে আছে হাসান প্রথম যেদিন এল ফেরদৌসি বলেছিল তাকে আপুমনি ডাকতে হবে, নইলে সে হাসানকে ভাইয়্যা ডাকবে না। তারপর দেখলাম সে সর্বদা হাসানের সাথে লেগে থাকে, তখনই আমি মনে মনে হাসলাম, ‘ভালই হল ছেলেও আমার মেয়েও আমার। আমিই বরের বাপ আমিই কন্যার বাপ’ বলে দুজনে আবার হাসতে লাগল। কর্ত্রি বললেন, কিন্তু ওরা চলবে কি করে, হাসান তো চাকরি করতে পারবে না। - তুমি একটা আস্ত বোকা। সে যদি অন্য পড়াশুনা নাও করে তবুও সে একটা বড় আলেম হবে, আর বড় আলেমদের ভাতের অভাব হয় না।

তাছাড়া আমি কিছুদিন পর ওকে স্কুলে পরীক্ষা দেওয়াব। তারপর ভার্সিটিতে পড়াব। তখন দেখবে তোমার অন্যান্য জামাইদের চেয়ে সেই অগ্রগণ্য হবে। - কিন্তু এতদিন মেয়ে কোথায় থাকবে? – কোথায় আর থাকবে, ছেলেও আমার মেয়েও আমার, আমার এখানেই থাকবে। আমার সব মেয়েকেই তো বিদায় করে দিচ্ছি, কেউ তো আর বাড়িতে থাকছে না। সবাই চলে গেলে আমরা বুড়া বুড়ি চলব কি করে। আমাদের দেখাশুনা, খায় খেদমত, রান্না বান্না কে করবে। নিজের সন্তান ছাড়া এসব চলে না। ছেলেরা তো ঢাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কাজেই যতদিন বেঁচে থাকব ছোট মেয়েকে আমার কাছেই রাখব। তবে সাবধান, এসব কথা যেন ওরা জানতে না পাড়ে তাহলে নষ্ট হয়ে যাবে। মায়ের চোখ দুটি আনন্দে নেচে উঠে, তার মানিক জোড় তার কাছেই থাকবে কিন্তু সহসা মুখটা বিষ করে বলল, কিন্তু হাসান যদি চাকরি পেয়ে মেয়েকে নিয়ে যেতে চায় তখন কি করবেন? কর্তা ভেংচি কাটলেন, অ্যাঃ নিয়ে যেতে চায়, বলি মেয়েটা কি ওর বাবার নাকি আমার? তখন আমি পেল্লাই এক ধ্মক দিয়ে বলব, খাটাসের বাচ্চা খাটাস, বিয়ে দিয়েছি বলেই কি আমার মেয়ে তোর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি নাকি? আমরা যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমাদের মেয়ে এখানে থাকবে আমরা মরে গেলে তোর যা মন চায় করিস।

তারপর ওদের বাচ্চা কাচ্চা হবে, তখন আমরা বুড়া বুড়ি আর কি করব সারাদিন ওদের বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করব, ঘোরা ফিরা করব, মারামারি করব। এভাবেই আমাদের নিস্কর্মা সময় কেটে যাবে। মা উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন, তিনি হাসতে হাসতে বললেন, এই দুইটা যে কি দুষ্টামি আর শয়তানি করে আপনি তো জানেন না, এদের জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। তার উপর ওদের পোলাপানের জ্বালা শুরু হলে তো আমাকে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাতে হবে’ বলে তিনি একেবারে হেসে কুটিকুটি। কর্তা হেসে বললেন, আরে আহাম্মক ওরা জ্বালাতন করার সুযোগ পাবে কখন বরং আমরাই ওদেরকে জ্বালাতন করব, ইভটিজিং করব। আমি ওদের মেয়ের সাথে প্রেম করব আর তুমি ওদের ছেলের সাথে প্রেম করবে। বুড়া বুড়ি দেখে ওরা রাজি না হলে জোর করে প্রেম করব, ইভটিজিং করব, ওদেরকে সর্বদা জ্বালাতন করব, তখন আমাদের উপর ইভটিজিংয়ের মামলাও করতে...... কথা শেষ হল না, বুড়া বুড়ি হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

তারপর মাষ্টার উঠে বসে স্ত্রীর প্রতি হাত জোড় করে যেন সিরিয়াস ভাবে বলল, দেখ বাপু তোমাকে হাত জোড় করে মিনতি করছি, নতুন মানুষের সাথে প্রেম করে আবার এই পুরান বুড়াটাকে ফেলে ভেগে যেয়ো না যেন। বুড়ি দুই হাতে তার পিঠে কিলাতে লাগল আর হাসতে হাসতে উভয়ের দম বন্ধ হবার উপক্রম। এবার বুড়ি বলল, প্রেম টেম কাকে বলে বুঝি তো না আমি বরং এক কাজ করব, ওদের পোলাপানকে কামলা খাটাব। ওদের ছেলের কান ধরে বলব ‘আমার জন্য বাজার সওদা করে আন গিয়ে। আর মেয়ের চুলের মুঠি ধরে বলব ‘আমার জন্য ভাত রান্না কর গিয়ে। মাষ্টার বলল, কেন কেন, প্রেম করবে না কেন, আশরাফের সাথে তো খুব পিড়িতে মজেছিলে। বুড়ি আবার হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে কিলাতে লাগল। মাষ্টারও হাসতে হাসতে বলল, আরে আরে মার কেন মার কেন, আশরাফের সাথে পীড়িতির কথা মনে নেই বুঝি?

আসলে ফেরদৌসির মায়ের বিয়ে হয়ে ছিল সাত বছর বয়সে। প্রথম রাত শাশুড়ির সাথে মানে ফেরদৌসির দাদির সাথে থাকল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খেলনাপাতি ও খেলার সাথীদের জন্য কান্না কাটি শুরু করল, শ্বাশুড়ি অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারলেন না। অগত্যা মাস্টারের চাচাত ভাই পাশের ঘরের ছয় বছরের ছেলে আশরাফকে ডেকে এনে বললেন ‘আশরাফ তুই বউমার সাথে খেলাধুলা কর। খেলার সাথী পেয়ে বেচারি শান্ত হল। তারপর দু’জনে সারাদিন খেলায় মেতে থাকত। মাষ্টার এ ঘটনা বলেই স্ত্রীকে খোচা দিতে লাগল।

তিনি বললেন, আরে বাপরে বাপ কি পীড়িতি, নাওয়া খাওয়া নাই দুজনে সারাদিন খেলা আর ঘোরাঘুরি। একদিন দুপুর পর্যন্ত কোন খবর নাই, মা বললেন, দেখতো বউ কোথায় গেছে। আমি বাড়ি শুদ্ধু খুঁজলাম, কোথাও নাই। অবশেষে ঘরে এসে দুটি শিশুর ঝগড়া শুনতে পেলাম। একজন বলছে, এটা আমার বড়, আরেকজন বলছে এটা আমার কনে। আমি খোঁজে পেতে গিয়ে দেখি দুই ঘরের ছিপায় দুইটা পুতুল নিয়ে দু’জনে কাড়াকাড়ি চলছে। আমি আনতে চাইলাম ওমা কি রাগ, আসবে না। মাকে গিয়ে বললাম। তখন মা গিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে আদর করে, কোলে করে নিয়ে এলেন। আমি মনে মনে হাসতাম ‘হারামজাদা আশরাফটা আমার বউটাকে দখল করে বসল, কবে জানি আস্ত বউটাকেই উধাও করে দেয়। মনে আছে তোমার এসব’ বলে আবার দু’জনে হাসিতে ফেটে পড়ল।

মাষ্টার আবার বলতে লাগল, একদিন আমি দাঁড়িয়ে আছি, ওমা আমার সামনে দিয়ে দৌড়, শুধু হাফ প্যান্ট পড়া জামা নাই। মাঠে কয়েকটা পোলাপান খেলা করছে, ওদের সাথে গিয়ে গোল্লাছুট খেলায় মাতল। আমি মাকে ডেকে এনে বললাম, ঐ যে দেখেন আপনার গুনধর পুত্রবধূ, খালী গায়ে ছেলেদের সাথে মাঠে খেলা করছে। মা দেখে মাথায় হাত দিয়ে চোখ কপালে তুললেন, ‘কী সর্বনাশ মান ইজ্জত আর থাকল না, বাড়ির বউ ছেলেদের সাথে মাঠে খেলা করে। আরে যা যা এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ওকে ধরে নিয়ে আয়। আমি বললাম, ভালই বলেছেন, একদিন ধরে আনতে চাইছিলাম তখন আমার হাতে কামড় মেরে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। অগত্যা মা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে গেলেন কিন্তু ধরতে পারেন না। অবশেষে ছেলেদেরকে বলে কয়ে ধরিয়ে আনলেন। মা কোলে নিয়ে দৌড়। তখন একবারে লঙ্কাকাণ্ড। মাকে কামড়িয়ে খামছিয়ে চুলে ধরে টেনে একেবারে নাস্তানাবুদ আর চিৎকার, আমাকে ছাড়েন, আমি খেলব। চিৎকার শুনে বাড়ির মানুষ বেরিয়ে এসে মুখ টিপে হাসতে লাগল। মা তোমাকে ঘরে এনে দরজা দিলেন আর সাথে সাথে কামলাকে তোমার বাপের কাছে পাঠালেন।

তিনি বড়লোক মানুষ পালকি করে এলেন। বাবাকে দেখেই মেয়ে লাফিয়ে তার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে নালিশ শুরু করল ‘আব্বু আমাকে নিয়ে যাও, আমি এখানে থাকব না, ওরা খুব খারাপ মানুষ, আমাকে খেলতে দেয় না, মারে। আমাকে দেখিয়ে বললে, এই বেটাটা খুব খারাপ, আমি খেলতে গেলেই ধরে নিয়ে আসে। এজন্যই ওর হাতে দিয়েছিলাম এক কামড়’ বলে খিলখিল করে কি হাসি। তারপর বললে, ঐ মহিলাটাও খারাপ আমাকে খেলতে দেয় না, না না এত খারাপ না, সে আমাকে গোসল করিয়ে দেয়, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তবে এই বেটাটাই বেশি খারাপ, ওকে আমি দেখতে পারি না, দেখলেই ভয় লাগে, আমি বাড়িতে চলে যাব। মেয়ের বক্তব্য আর তার খেলার বিবরন শুনে হাসতে হাসতে শ্বশুর মশাইয়ের দম বন্ধ হবার অবস্থা। অবশেষে মা বললেন, বিয়াই আপনার মেয়েকে নিয়ে যান, তিন বছর পর আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন, মা মাঝে মধ্যে যেতেন কিন্তু আমার সাথে কোন যোগাযোগ নাই। তিন বছর পর মা গিয়ে নিয়ে আসলেন আর সেইদিন রাতেই আমার প্রথম... কথা শেষ হবার আগেই বুড়ি এক হাতে বুড়ার মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে কিলাতে লাগল। তারপর তারা একটা একটা করে কথা বলে আর একে অন্যকে কিল মারে, গুতা মারে এবং হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে।

ফেরদৌসির অবস্থা কাহিল। পাশের রুম থেকে মা বাবার গপ্প শুনে হাসিতে তার পেট ফেটে যাচ্ছে। হাসি নিবারন করতে মুখে ওড়না গুজতে গুজতে অর্ধেকটা গুজে ফেলেছে। এবার বেয়ারা হাসি বিস্ফোরোন্মুখ হল। লজ্বা থেকে বাচতে সে দৌড়ে উঠানে গিয়ে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। কেউ দেখে ফেলে কিনা ভয়ে রান্না ঘরের পিছনে গিয়ে বেদম হাসতে লাগল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে কাঁঠাল গাছে হেলান দিয়ে হাসতে লাগল। এত হাসির কারণ কি, এ হাসির উৎস কোথায়। শুধুই মা বাবার চুটকি গপ্প নাকি অন্য কিছু। হ্যাঁ হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে ফুয়ারার মত উৎসারিত এ হাসির উৎস অন্য কোথা, অন্য কোন খানে। পাথরে খোদাই করা মুর্তির মত যে মুর্তি তার হৃদয় মুকুরে গ্রথিত হয়ে আছে- যাকে নিয়ে সে শুধু স্বপ্ন দেখছে, অনিশ্চিত স্বপ্ন কিন্তু আজ বাবা মা সেই অনিশ্চয়তাকে নিশ্চিত করল- সেই প্রতিমাই হল এই হাসির উৎস। যাকে নিয়ে সে ঘর বাধবে, ছোট্ট একটা ঘর, টোনাটোনির ঘর, হংস- মিথুনের নীড়- যেখানে থাকবে মান- অভিমান, রাগ- অনুরাগ, ঝগড়া- বিবাদ, হাসি- কান্না, বাদ- বিসম্বাদ কিন্তু সব কিছুর উর্ধ্বে থাকবে সিমাহীন ভালবাসা আর অন্তহীন আবেগ ।

তার চোখ দুটি স্বপ্লিল হয়ে উঠে, তার ভুবন হয়ে উঠে স্বপ্নময় ও ছন্দময়। সারারাত সে ঘুমায়নি, স্বপ্নের পাখায় ভর করে অনন্ত আকাশে উড়ে বেরিয়েছে, ঘোরে বেরিয়েছে কত নদী সরোবর, কত উদ্যান কানন, নিকুঞ্জ বন, কত মরু বিয়াবান আর কত বিচিত্র কল্পলোক। তবে একা নয় তার সাথে হাসান, তার স্বপ্নের রাজকুমার হাসান। ফেরদৌসির পেটের ভাত হজম হয় না, পেটের কথাটা হাসানকে না বলা পর্যন্ত হজম হবে না। সে সকালে বলার চেষ্টা করল কিন্তু সুযোগ পেল না, দুপুরেও সুযোগ পেল না। তারপর ভাবল বিকালে হাসান যখন ঘোরতে বের হয় তখন বলবে। বিকাল বেলা সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। হাসান যখন রাস্তায় উঠল সে মাথা নাড়িয়ে ডাকল। তারপর দুজন গিয়ে পশ্চিমের ভিটায় একটা আম গাছের আড়ালে বসল। বসেই সে হাসতে লাগল, উচ্চসিত হাসি, হাসির তোড়ে সে কথা বলতে পারছে না।

হাসান ধমক দিল, কি পাগলির মত হাসি শুরু করেছিস, যা কইতে চাস ক। অবশেষে সে হাসানের কাছে ঘেসে বসল, কাঁধে মাথা রাখল। তারপর মা বাবার আলাপ প্রতিকথন করল। দুয়েক কথা বলে আর হাসে, হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ে। কথা শেষ করে হাসানের দিকে অন্তহীন তৃষিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কবে আমরা ঘর বাধব? হাসান কোন কথা বলতে পারল না। সে হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে কোন অজানা ভুবনে। ক্ষণকাল ফেরদৌসির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তার গোলাপ- রাঙ্গা কপোল দেশে ওষ্ঠাধর চেপে ধরল। ফেরদৌসি শিহরিত হল, কি এক অপার্থিব অনুভুতিতে তার চোখ দুটি বোজে এল।

১১

উবাইদুল্লাহ মাষ্টার আগে কিছুটা কুজো হয়ে হাঁটতেন, তার চেহারা সব সময় বিষণ্ণ ও চিন্তাক্লিষ্ট থাকত। এর কারণ হল, তার আটটি মেয়ে। এতগুলি মেয়ের কন্যা দায়গ্রস্থতার হিমালয় সমান চাপে তিনি কুজো হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েগুলির ভবিষ্যৎ কি, ভাল বিয়ে হয় কিনা- এসব চিন্তায় তিনি সর্বদা বিষণ্ণ ও গম্ভীর হয়ে থাকতেন। কিন্তু এখন ভালয় ভালয় পাঁচটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, জামাইরা সবাই শিক্ষিত, চাকরিজীবী ও ধার্মিক, সবাই তাবলীগ করে। এখন আর তিন মেয়ে বিয়ের বাকি আছে, এই তিনজনের জন্য তার কোন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নাই। কারণ শুধু তার মেয়েদের মধ্যেই নয় অত্র এলাকার মধ্যে এ তিনজনই হল শ্রেষ্ঠ সুন্দরী, ছাত্রী হিসাবেও ভাল। কাজেই আর কোন চিন্তার কারণ নাই।

তদুপরি ষষ্ঠ মেয়ে নুরানির রুপ সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে। জামালপুর জেলায় তার মত সর্বগুনে গুনান্বিতা মেয়ে দুর্লভ। এখনি তার জন্য ভাল ভাল ঘর আসছে। তন্মধ্যে পাশের বাড়ির তার আপন ভাতিজাই অগ্রগণ্য, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তারা মা ছেলে বিয়ের জন্য খুব পিড়াপিড়ি করছে কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলছেন না। কারণ সদ্য পঞ্চম মেয়ে বিয়ে দিলেন, এখন একটু বিশ্রাম ও বিরতির প্রয়োজন আছে। তাছাড়া টাকা পয়সার ব্যাপার আছে। তাই তার সিদ্ধান্ত কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে তারপর নুরানির বিয়ের চিন্তা করবেন। আবার সপ্তম মেয়েও সুন্দরি তার জন্যও চিন্তা নাই। আর অষ্টম মেয়ে ফেরদৌসির তো ব্যবস্থা হয়েই আছে। হাসান ফেরদৌসি তার নয়নের আলো, কলিজার টুকরা। এদেরকে দেখলে তার চক্ষু জোড়ায়। তার সিদ্ধান্ত বড় দুই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পরপরই হাসান ফেরদৌসির বিয়ে দিবেন। এরপর তাদেরকে নিয়েই হেসে খেলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। তাছাড়া হাসানটা তার সন্তানের মতই কালাতিপাত করছে। সে ভাল ছাত্র, ভালভাবে লেখাপড়াও করছে। আগামি বছর তাকে স্কুলে ভর্তি করাবেন, যাতে হাসান ফেরদৌসি উভয়েই একসাথে এস এস সি পরীক্ষা দিতে পারে।

ওদিকে বড় ছেলেটা অনার্স শেষ না করেই ব্যবসায় লেগেছে, ঢাকায় ব্যবসা করছে। ছোট ছেলেটা তার বাসায় থেকে লেখা পড়া করে। কাজেই ছেলেদের জন্যও কোন চিন্তা নাই, ইত্যাদি কারণে তিনি যৎপরোনাস্তি খুশি। তার দেহের ক্বুজোভাব ছেড়ে গেছে, চেহারার বিষণ্ণভাব কেটে গিয়ে মুখমণ্ডল চাঁদের মত দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। আবার কিছুটা জোয়ানিও ফিরে এসেছে, এখন তিনি সুস্থ সুন্দর সবল। আগের গাম্ভির্য ভাব আর নাই, এখন তিনি বালখাল্লা সুলভ চপল হয়ে উঠেছেন। আগে সব সময় গাম্ভির হয়ে থাকতেন, কারো সাথে কথা বলতেন না। কিন্তু এখন রাস্তা ঘাটে সমবয়সীদের সাথে বা মসজিদের মুসুল্লিদের সাথে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেন, হাসি তামাশা করেন। গৃহকর্ত্রী রান্না বান্না করার সময় রান্না ঘরে গিয়ে স্ত্রীর সাথে খুনসুটি করেন, নব দাম্পত্যের ন্যায় খূচাখুচি করেন আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। মাঝে মধ্যে মেয়েদের সাথে বসেও কৌতুক করেন, আড্ডায় মেতে উঠেন, তার মধ্যে হাসানও বাদ যায় না। এভাবে হাসি খুশি ও আনন্দ স্ফুর্তিতে তার সময় যাচ্ছে। যে কেউ তাকে দেখলে বুঝবে পৃথিবীর একজন বিজয়ী যোদ্ধা, স্বার্থক সংসারি, সর্বময় খুশি একজন মানুষ।

মাষ্টার খাওয়া দাওয়ার পর স্কুলে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে ডেকে বললেন, শুন স্কুলের পরীক্ষা এসে গেছে, প্রশ্ন আনার জন্য আমাকে জামালপুর যেতে হবে। যদি সন্ধ্যা হয়ে যায় তাহলে আজ আর বাড়ি ফিরব না, ফিরতে ফিরতে কাল বিকাল নাগাদ। আর কি জানি সওদার কথা বলেছিলে হাসানকে দিয়ে আনিয়ে নিও। তারপর হাসানের রুমে গিয়ে বললেন, বাজান তোমার মায়ের কি কি জানি সওদা লাগবে, বিকালে বাজার থেকে এনে দিও’ বলে তিনি সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন। এটাই ছিল পরিবারের সাথে তার শেষ কথা। তিনি স্কুল থেকে সোজা জামালপুর টাউনে চলে গেলেন। সেখানে প্রশ্ন সংগ্রহ করা ও অন্যান্য কিনা কাটা করতে করতে সন্ধ্যা লেগে গেল। এখন বাড়ি ফিরা সম্ভব নয় বিধায় বড় মেয়ের বাসায় চলে গেলেন।

মাগরিবের পর মাজেদা বাবাকে একটা কিছু নাস্তা দিতে চাইল কিন্তু ঘরে কিছুই নাই, তার স্বামী বাজার সওদা করে না। ক্ষোভে দুঃখে সে বাবার কাছে গিয়ে বসল, তারপর অভিযোগ শুরু করল ‘তোমাদের জামাই একটা কিচ্ছু করে না, বাজার সওদা করে না, মার্কেট করে না, সংসারের দিকে ফিরেও তাকায় না। এসব করলে নাকি তার মান- সম্মান বন্যায় ভেসে যাবে। মাস শেষে শুধু আমার হাতে টাকাটা দেয়, এই হল তার কাজ। এখন বল এই সংসারটা আমি কেমনে চালাব, তোমার কাছে ছেলেটাকে চাইলাম তাও দিলে না। তুমিই বল এখন আমি কি করব? তুমি রাজি থাক আর না থাক আমি কিন্তু হাসানকে নিয়ে আসব, ওকে ছাড়া আমার আর চলছে না। লেখা পড়া করাতে হয় আমিই করাব বলে ঘ্যান ঘ্যান করে কান্না জুড়ে দিল। এ মহিলা আবার ছিচ কাঁদুনে।

মাষ্টার দেখলেন তার মেয়ে এখনো হাসানের কথা ভুলেনি। দুনিয়া শুদ্ধু কত কাজের লোক পড়ে আছে, অথচ অন্য কাউকে না খোঁজে সে এখনো হাসানের পিছু লেগে আছে। তাকে কাজের ছেলে বানাবে। সে নিজে চাচ্ছে হাসানকে জামাই বানাতে আর তার মেয়ে চাচ্ছে কাজের লোক বানাতে। কথাটা মনে হতেই তার মাথাটা চক্বর মারল, মাথায় রক্ত উঠে গেছে। আগে থেকেই তার প্রেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ ছিল। তিনি কিছু না বলে ব্যাগটা টান দিয়ে নিয়ে সোজা ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। মেয়ে পিছু পিছু ডাকতে লাগল, ‘আব্বা কই যাও, এই রাত্রে তুমি বাড়িতে যেতে পারবে না, রিকশা পাবে না, খেয়া ঘাটে নৌকা পাবে না। তাহলে যাবে কেমনে, এখন যেয়ো না, কাল ভোরেই না হয় যেও’ ইত্যাদি বলে সে চেচাতে লাগল। কিন্তু মাষ্টার মেয়েকে কিছুই বললেন না, পিছনে ফিরেও তাকালেন না, সোজা চলে গেলেন। রিকশা পেতে সমস্যা হল। কাচা রাস্তা, তাও রাত্রি বেলা কেউ যেতে রাজি হয় না, অবশেষে ডবল ভাড়া দিয়ে একটা রিকশা কোন রকম রাজি করালেন।

কিন্তু খেয়া ঘাটে পৌঁছে দেখলেন নৌকা নাই। অগত্যা অনেক দূরে মাঝির বাড়ি গিয়ে তাকে ডেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নদী পাড় হলেন। তারপর অসুস্থ শরীর নিয়ে টলতে টলতে হাটা শুরু করলেন। তার প্রেসার তখন সীমালঙ্ঘন করেছে। বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে মধ্যরাত পাড় হয়ে গেল। দরজায় টোকা দিলেন। কর্ত্রী এসে দরজা খোললেন। তিনি ঘরে ঢোকে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়েই স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, শুন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুন, আর সুযোগ পাব না। বড় মেয়ে দুটিকে দেখে শুনে বিয়ে দিও। ফেরদৌসিকে হাসানের সাথে বিয়ে দিও। আর হাসানকে মাজেদার কবল থেকে দূরে রেখ। সে হাসানকে ----- কথা শেষ হল না, কর্ত্রী স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলেন ‘হায় আল্লাহ একী অবস্থা, কী হয়েছে আপনার’ বলে চিৎকার করতে করতে পাশের বাড়ির লোকদের ডাকতে গেলেন। তারা এল কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। চলে গেলেন, চলে গেলেন একজন আদর্শ মানব, একজন আদর্শবান পিতা, আদর্শবান স্বামী, আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ ভাই, আদর্শ আশ্রয়দাতা, আল্লাহ্‌র আদর্শ বান্দা, খাটি বান্দা। তিনি জীবনে কারো নিষ্ট ব্যতিত অনিষ্ট করেননি, উপকার ব্যতিত অপকার করেননি, আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন।

স্বামীর চির প্রয়ান দেখে কর্ত্রি চিৎকার করে তার দেহের উপর গড়িয়ে পড়ল। মায়ের চিৎকার ও মাতম শুনে হাসান ও মেয়েরা দৌড়ে এলো। তারপর কেউ বাবার দেহের উপর, কেউ খাটে, কেউ মাটিতে পড়ে জবাই করা মুরগীর মত ধাপড়াতে লাগল। মধ্যরাতে বাড়িটাতে কারবালার মাতম উঠল। হাসানের মনে হল সে ঠিকানাহীন ঝড়ের পাখির মত উড়তে উড়তে একটা গাছে এসে বাধা বেধে ছিল। কিন্তু কাল বৈশাখী সেই গাছটিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। মা বাবা হারিয়ে সে বাবা পেয়ে ছিল, আশ্রয় পেয়েছিল, বাসা পেয়েছিল কিন্তু আজ তার সেই আশার বাসা ভেঙ্গে গেল। এখন আবার সে ঝড়ের পাখির মত নিরুদ্দেশ ঠিকানায় উড়বে, লাওয়ারিশ কুকুরের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে কিন্তু কেউ তার প্রতি ফিরেও তাকাবে না। হাসান কিছুক্ষন শবদেহের উপর পড়ে কাঁদল, তারপর মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগল। এক সময় ফেরদৌসী এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, দুজনে জড়াজড়ি করে কাঁদল। ততক্ষণে বাড়ির লোকজন এসে তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিজ নিজ বিছানায় নিতে লাগল। মেয়েদের মধ্যে কেউ মাটিতে পড়ে বিলাপ করছে, কেউ চূল ছিঁড়ছে, কেউ পাগলের মত আচরণ করছে।

লোকেরা হাসানকে ধরে তার ঘরে নিয়ে গেল। সে বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষন পড় ফেরদৌসী এসে তাকে শান্তনা দিল। সে শান্ত হল কিন্তু এবার ফেরদৌসী কান্না শুরু করল, তখন হাসান শান্তনা ছিল। এরপর কখনো উভয়েই জড়াজড়ি করে কাঁদে, কখনো একজন কাঁদলে অন্যজন শান্তনা দেয়, এভাবে তারা বিছানায় পড়ে কাঁদতে লাগল। ওদিকে মেয়েরা কেউ বিছানায় পড়ে চিৎকার করছে, কেউ মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে, কেউ পাগলের মত নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে। মা স্বামীর মরদেহের পায়ের কাছে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে, এভাবেই রাত্রি পোহাল। সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আধমরার মত কেউ মাটিতে কেউ বিছানায় পড়ে আছে, একেক জনের অক্ষিযুগল চুল্লির মত লাল হয়ে ফুলে আছে। পরদিন আত্নীয়- স্বজন সবাই এল, বিকাল নাগাদ দাফন সম্পন্ন হল।

কয়েকদিন পর্যন্ত বাড়িতে শোক চলল। সবাই নিজ নিজ বিছানায় মরার মত পড়ে আছে, কোন কথা বার্তা নাই, আলাপ আলোচনা নাই, রান্না বান্না বন্ধ, যেন এক নিথর মৃত্যুপুরি। পাশের ঘরের চাচী কখনো নিজের রান্না থেকে, কখনো ফেরদৌসিদের ঘর থেকে চাল ডাল নিয়ে রান্না করে নিয়ে আসে। তারপর বাড়ির অন্যান্য মহিলাদেরকে নিয়ে সবাইকে বিছানা থেকে টেনে তুলে জোর জার করে খাওয়ায়। ছেলে মেয়েরা সবাই বাড়িতেই অবস্থান করছে। কয়েকদিন পর মৃতের রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া অনুষ্ঠান হল, অনেক বড় অনুষ্ঠান। তাতে বাড়ির মানুষ, মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক, আত্মীয় স্বজন ও দরিদ্র মানুষকে খাওয়ানো হল। অনুষ্ঠানের পর মেয়েরা একে কেকে স্বামীর সাথে চলে গেল। কিন্তু বড় ছেলে ফরহাদ থাকল। তার চিন্তা হল, সে ঢাকায় যে ব্যবসা জুড়িয়ে বসেছে তা ছেড়ে আসবে না আর আশা সম্ভবও নয়। আবার ভাই বোনদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে সংসার দেখাশুনা করবে। এখন একমাত্র ভরসা হল হাসান। কাজেই তার সিদ্ধান্ত হল, কয়েকদিন থেকে সংসারের নিয়ম কানুন ও হিসাব কিতাব তাকে বুঝিয়ে দিয়ে সে দায়িত্ব মুক্ত হয়ে ঢাকায় চলে যাবে। এই চিন্তার পিছনে অবশ্য একটা মৌলিক কারণ আছে। ইতিমধ্যেই সে জানতে পেরেছে তার বাবা মা হাসান ফেরদৌসির বিয়ের ফয়সালা করেছেন। তারা বাড়িতেই থাকবে। অর্থাৎ দুদিন পর তারাই সংসারের মালিক হবে। কাজেই এখন তার দায়িত্ব হল মালিক মালিকানকে তাদের সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া। তারপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে ঢাকায় পড়ে থাকবে, বাড়ির জন্য কোন পিছুটান থাকবে না।

বস্তুত ফেরদৌসির বড় ভাই হল একজন কৌতুক প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন প্রকৃতির মানুষ। সে হল সেই লৌহ পাজরার মানুষ- যারা মহাবিপদেও স্থির থাকে, মহাদুঃখেও হাসে। একদিন বিকালে সে হাসানের ঘরে বসে দুজনে আলাপ করছে। তখন মা এসে বললেন ‘তোর আর ঢাকা থাকার দরকার নাই, বাড়িতে এসে সংসার দেখা শুনা কর। তোর বাপ নাই সংসার চালাবে কে? সে হাসিমুখে বলল, কেন হাসান ভাইয়্যা থাকতে তোমার ভরসা (চিন্তা) কি? কি বল ভায়া, সংসার চালাতে পারবে না? হাসান কোন কথা বলল না। সে অট্টহাসি দিয়ে বলল, আরে চিন্তা কি তোমার বউ তো আছেই। জামাই বউ দুইজনে মিলে সংসার চালাবে, পারবে না? আরে সংসার তো তোমাদেরই। তারপর সে ফেরদৌসিকে ডাকতে লাগল। মা বুঝলেন তার ছেলে এখন কৌতুক শুরু করবে তাই তিনি উঠে গেলেন। ফেরদৌসি এসে হাঁসি মুখে দাঁড়াল। সে বলল, তোদের সংসার তোদের উপরই দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। কি বলিস, তোরা মিয়া বিবি দু’জনে মিলে সংসার চালাতে পারবি না? ফেরদৌসি লজ্বায় ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘যাঃ শয়তান, দাদুটা যে কি, শরম বরম নাই যা মুখে আসে তাই কয়’ বলে সে লজ্বায় লাল হয়ে চলে গেল।

দুইদিন পর বড় ভাই ঢাকায় চলে গেল, সে বাড়িতে আসবে না। মা হলেন একজন প্রাচিন যুগের সহজ সরল সাদা মাটা মানুষ। সারা জীবন তিনি স্বামী সন্তানের খেদমত করেছেন, সংসারের দিকে ফিরেও তাকাননি। সংসারের কিছু তিনি জানেনও না বুঝেন না বুজতে চানও না। কাজেই তার পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব না। আবার তিন মেয়ের মধ্যে নুরানী সকলের বড়, সে সকলের চেয়ে চালাক চতুর বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান। সঙ্গত কারনে তার উপরই সংসারের দায়িত্ব ন্যস্ত হল। সে বাড়িতে থেকে সব কিছুই খোজ খবর নেয়, হিসাব কিতাব রাখে। হাসান বাজার সওদা করে, জমি জমার খোজ নেয়, বর্গাদারদের পাত্তা লাগায়। এভাবে হাসান বাইরে আর নুরানী ভিতর থেকে সংসার চালায়। সুখে সাচ্ছন্দে ও নির্বিঘ্নে তাদের সংসার চলে যাচ্ছে।

বিষয়: সাহিত্য

৮২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File