হাসান ফেরদৌসি - ৭

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ অক্টোবর, ২০১৭, ০৪:৫৩:৩৪ বিকাল

১২

নুরানি বাস্তবেও ছিল নুরের মত উজ্বল ও জ্যোতির্ময়। ফেরদৌসিদের পুরা খান্দানের মধ্যে দৈহিক সৌন্দর্য্য, কথা- বার্তা, আছার আচরন, জ্ঞান- বুদ্ধি সর্বদিক দিয়ে সে ছিল অন্যন্যা। কাঁচা হলুদ, কাঁচা সোনা বা দুধে আলতা মিশানো রঙ্গের কোন মানুষ হয়? যদি হয় তাহলে সে নূরানি। পদ্মলোচন, মৃগাক্ষি, ময়ূরাক্ষী যদি হয়- তবে সে নূরানি। আজানু বিলম্বিত কেশ, গোলাপের পাপড়ির মত গণ্ড, রক্তজবার মত ওষ্ঠাধর, বিল্বের মত বক্ষোজ যদি নারী থাকে- তবে সে নূরানি। কবি সাহিত্যিকদের চিত্রিত ও রুপায়িত নারী সৌন্দর্যের যদি বাস্তব আইকন থাকে- তবে সে নূরানি। একটি যুগ একটি এলাকা এমন মেয়ে খুব কমই জন্মায়। আল্লাহ এ মেয়েটিকে মর্তের মাটিতে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর মানুষ যেন বেহেশতি হুর সম্পর্কে আন্দাজ নিতে পারে। তার কণ্ঠ ছিল এমনই মোহময়- যা শুনলে তেষ্টা মিটে যায়। এমন নারী পৃথিবীর যে কোন রাজা মহারাজার কাম্য।

মাষ্টারের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই নুরানির জন্য বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত বিয়ের ঘর আসতে থাকে। অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ধনী বড় লোক। তন্মধ্যে ফেরদৌসির আপন এক চাচাত ভাই অগ্রগণ্য, সে বি এস সি ইঞ্জিনিয়ার। তার সাথে নূরানির সরাসরি প্রেম না থাকলেও অন্তত মনঃগত একটা ব্যাপার ছিল। সঙ্গত কারনেই সে পাণি প্রার্থি হ্য়। কিন্তু বড় দুলা ভাই ও তার বউ মাজেদা বিয়ে দিবে না, বরিশালি পটেটোর কাছে বিয়ে দিবে। বেচারা অসহায় হয়ে এসে ধরল এডিকে। এডি খুব চেষ্টা করল কিন্তু মাজেদাকে টলাতে পারল না। অবশেষে অপারগ হয়ে বরিশালি পটেটোকে বলল, মেয়ের তো চাচাত ভাইয়ের সাথে প্রেম, আপনি পিছিয়ে যান। কিন্তু পটেটো নূরানির রূপ দেখে পাগল হয়ে গেছে। সে তাবলীগ করে, বড় দুলা ভাইও তাবলীগ করে। কাজেই তেল মবিল মেরে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করেই ছাড়ল।

পটেটোর পরিচয় হল- তার বাড়ি বরিশাল। দরিদ্র অশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। স্থানীয় কলেজে অনার্স করেই অর্থাভাবে একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে জামালপুর আসে। লোকটা কালো, বেটে, অসম্ভব মোটা। মুখে নিষ্ঠুরতা ও কাঠিন্যের ছাপ, বুঝা যায় অতিরিক্ত কাঠিন্যতার কারণে দাড়ি গোফ গজাতে পারেনি, দু’চার গাছ দাড়ি ঝুলছে। তার কণ্ঠস্বর ছিল হিজড়াদের মত ফ্যাস- ফ্যাসে, অনেকটা যেন ভৌতিক নাটক সিনেমার নারী কণ্ঠের ন্যায়। বুকের পাটা জাহাজের পাটাতনের মত চওড়া, কোন পশম নেই, এ জাতীয় মানুষকে গ্রামাঞ্চলে শিমার (হযরত হুসাইন হত্যাকারি) বলা হয়, এটা নাকি নিষ্ঠুরতার আলামত। দেখেই বুঝা যায়, এ লোকটা সন্ত্রাসী, মাস্তানি বা দুঃসাহসিক কাজে ভাল জস করতে পারত। সে আগে সর্বহারা করত, কয়েকবার জেলও খেটেছে। তার আসল নাম খবির খাঁ, তবে সে নিজের নামের সাথে তালুকদার লিখে। এ জন্য তাবলিগিরা তাকে তালুকদার ডাকে কিন্তু অন্যরা পটেটো বা গোল আলু ডাকে। লম্বায়- চৌড়ায় সমান হওয়ার কারণে সে এই উপাধি পেয়েছিল। সব মিলিয়ে লোকটার আকৃতি যেমন কুৎসিত তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কুৎসিত ছিল তার স্বভাব প্রকৃতি। কিন্তু তার ভাগ্যের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। সে তার চেয়েও বহুগুণ যোগ্য পাত্রকে টেক্কা মেরে নূরানির মত স্ত্রী জুটিয়েছিল- যে ছিল নারী সৌন্দর্যের বিমুর্ত উপমা, মর্তের মাটিতে বেহেশতের হুর। বস্তুত নূরানির স্বামী হওয়ার মত কোন যোগ্যতাই তার ছিল না। কারণ তখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ আর নূরানির সতের বছর। আবার মেধাগত দিক থেকেও তার চেয়ে নূরানি ছিল উর্ধ্বে। কারণ এ মেয়েকে লেখা পড়া করালে মেডিকেলে যেতে পারত। এ জন্যই পটেটো পরবর্তিতে মাস্টার্সটা করে নেয়।

এমন অপাত্রে নূরানিকে বিসর্জন দেয়ার কারণে সর্বত্র আলোচনা সমালোচনা চলতে লাগল। হাসান অন্যদের কথোপকথন শুনে, ফেরদৌসিও আলাপ করে। আসল ঘটনা হল- বড় জামাই ইঞ্জিনিয়ার নূরানীর রুপে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তার সামনে ছিল মরণ সংকট। কারণ, প্রথমত স্ত্রী কয়েকটা সন্তান ও সংসারের চিন্তা, দ্বিতীয়ত কলঙ্কের ভয়, তৃতীয়ত সে ছিল ধার্মিক, তাবলীগ করত। কাজেই সবকিছু ত্যাগ করে নূরানীকে বিয়ে করলে তার ইহকাল প্রকাল দুটোই যাবে। এ অবস্থা দেখে মাজেদা স্বামিকে বলল, নূরানীকে এতদুরে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে কোন দিন তার মুখ দেখতে না হয়। আর এ মর্মে তাকে বাধ্য করল। তখন ইঞ্জিনিয়ার সংযমের পরাকাস্টা দেখিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে বরিশালি পটেটোকেই নির্বাচন করল। এভাবে সে মহাকলংক থেকে মুক্তি পেল বটে কিন্তু নূরানির রুপ যৌবনের আগুনে তারই কপাল পোড়ল। তবে সে ছিল মহিয়সি নারী, পটেটোর মত অযোগ্যকে সে স্বামী হিসাবে মেনে নিল।

যাই হউক, বিয়ের তারীখ দেয়া হল। তখন ব্যর্থ প্রেমিক ফেরদৌসির চাচাত ভাই সজল নয়নে বাড়ি ত্যাগ করল। এদিকে মানিক জোড়ের ধান্ধা তো একটাই, বিয়ের সময় টাকা আদায় করা। তারা গেইট বানানোর জন্য মায়ের কাছে গিয়ে টাকা চাইল। মা কয়টা টাকা দিয়ে শর্ত দিলেন, গেইট করে টাকা নিতে পারবে না। হাসান সম্মতি দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। বাইরে গিয়ে ফেরদৌসি বলল, এই বোকা টাকা না নিলে এত কষ্ট করে, পয়সা খরচ করে লাভ কি? হাসান তার গালে ঠোক্কর মেরে বলল, তুই একটা গাধা, মুখে বলেছি টাকা নিব না কিন্তু ঠিকই টাকা আদায় করে ছাড়ব। তারপর তারা কাজে লেগে গেল। সমবয়সি বাড়ির অনেক ছেলে মেয়েই তাদের সাথে যোগ দিতে চাইল কিন্তু তারা দুজন পরামর্শ করল, বেশি লোক নিলে টাকার বণ্টন বেশি হবে, ভাগে কম পড়বে। কাজেই তাদের অনুগত দুইটি ছেলেকে নিয়ে বাকিদের না করে দিল। শুরু হল তাদের কর্মব্যস্ততা। মাটি গর্ত করে কলাগাছ পুতল, বাঁশ পুতল, বাজার থেকে রঙ্গিন কাগজ এনে এক বড় ভাইকে দিয়ে তা কাটাল, জঙ্গল থেকে ফুল, গাছের কচি কচি ডাল ইত্যাদি তুলে আনল। তিনদিন নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম করে তারা মনের মত করে গেইটটা সাজাল। তাদের অনেক আশা, হাসান একটা সাইকেল কিনবে, ফেরদৌসি লাল টুকটুকে একটা শাড়ি কিনবে, ইত্যাদি তাদের অপুর্ন আশাগুলি পূরণ করবে।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। ভাল দুইটা টেবিল এনে গেইটের মাঝখানে স্থাপন করল, কারুকাজ করা টেবিল ক্লথ বিছাল, ফুলের তোড়া, রঙ্গিন পানির বোতল ইত্যাদি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজাল। বাড়ি থেকে পান জর্দা এনে পানদানে সাজিয়ে রাখল। তারপর তারা দুইজন ভাল করে সাজ গুজ করে দুইটা চেয়ার এনে রাজা রানীর মত বা বর কনের মত টেবিলের সামনে বসল। আর বিদূষক দুজন তাদের দু’পাশে দারোয়ানের মত দাঁড়িয়ে আছে। তারা সকলের দৃষ্টি আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল। বাড়ির সবাই আশা যাওয়া করে, তাদেরকে দেখে আর হাসে। বড় ছেলে মেয়েরা অন্যদের বলে ‘দেখ দেখ, এরা আসলেই মানিক জোড়, কত সুন্দর লাগছে। যেন রাজকুমার ও রাজকুমারী, অপুর্ব জুটি, মন চাচ্ছে এখনি ওদের বিয়ে দিয়ে দেই।

কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী আসল। গেইটের দু’পাশের ফাকা জায়গাগুলি রঙ্গিন সুতা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে, গেইটের ভিতর দিয়েই বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। বরযাত্রী গেইটের সামনে আটকা পড়ল। তখন বাড়ির যুবকরা ‘বর এসেছে বর এসেছে’ বলে হৈ চৈ করে গেইটের চারপাশ ঘিরে ধরল। বর যাত্রীরা পান খেয়ে বলল, গেইট ছাড়তে তোমাদের দাবী কি? হাসান ফেরদৌসি উচ্চ মূল্য হাকল। শুনে তো বর বেচারা জিবে কামড় দিয়ে গাড়িতেই বসে পড়ল। কারণ লোকটা যেমন কিপটে তেমনি সংকীর্নমনা। বরপক্ষ অতি ক্ষুদ্র একটা এমাউন্ট দিতে রাজি হল। মানিক জোড় অস্বিকৃতি জানাল। নিয়মানুযায়ি বাড়ির যুবকরা মানিক জোড়ের পক্ষ নিল। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে দর কষাকষি, সেখান থেকে চাপাচাপি, সেখান থেকে হৈ চৈ বাক বিতন্ডা। হট্টগোল শুনে বড় জামাই ইঞ্জিনিয়ার সেখানে ছুটে গেল, মাষ্টার না থাকায় এখন সেই কর্তা। তাকে দেখেই বাড়ির যুবকরা সটকে পড়ল, কারণ সে হিংস্র প্রকৃতির লোক, সবাই তাকে ভয় পায়। তিনি হাসান ফেরদৌসিকে ধমক দিয়ে বললেন, কিরে তোদেরকে বলা হয় নাই, সম্মানের জন্য গেইট করতে পারবি কিন্তু টাকা নিতে পারবি না, এটা জায়েয নাই, যা এখান থেকে। সে তাদেরকে ধমক দিয়ে আবার কাজে চলে গেল।

বরযাত্রীরা সুযোগ পেয়ে গেল, বাড়ির যুবকরাও সেখানে নাই। তারা গেইটের মুখ থেকে টেবিল সরিয়ে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মানিক জোড় ফিরাতে চাইল কিন্তু বানের মুখে খড় কুটোর ন্যায় ভেসে গেল। এই অবস্থা দেখে ক্ষোভে দুঃখে হাসান বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ফেরদৌসি কেঁদে উঠে বলল ‘আগেই তো বলেছিলাম টাকা নেয়া যাবে না, এখন এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে কি লাভ হল? তার দিকে তাকিয়ে হাসানের খুব মায়া হয়, সে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিল ‘কান্দিস না, তুই দেখিস টাকা আমি আদায় করেই ছাড়ব। তারপর তারা বাড়িতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর হাসান ভাবল, যাই দেখি যে টাকাটা দিতে চেয়েছিল তাই নিয়ে আসি গিয়ে। বরযাত্রীদের নেতা হল বরের ভগ্নিপতি। লোকটা কাঠ কুট্টা সাইজের মানুষ, যেমন কালো, তেমনি শুকনা, তালগাছের মত লম্বা। সে লোকটাকে ঘর থেকে ডেকে বাইরে এনে বলল, আমার বউ- না মানে আমার বোন কাদতেছে, যে টাকাটা দিতে চেয়েছিলেন দেন। লোকটা অট্টহাসি দিয়ে উঠল ‘শালা, বোনকে বউ বানাতে চাও। তারপর হেসে বলল, ‘ছি ছি গেইটের টাকা নেয়া জায়েয নাই, শুননি, যাও’ বলে সে আবার ঘরে ঢুকে গেল। হাসান বিমর্ষ হয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।

ফেরদৌসি তাকে দেখে দৌড়ে এসে তার হাত ধরে হাসি মুখে বলল, টাকা দিয়েছে? – না। সে মুখটা কালো করে চলে গেল। হাসানের মনটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল, ফেরদৌসির গুমরাহ মুখ সে দেখতে পারে না। অন্য সময় হলে আপুমণি ডেকে বা অন্যভাবে মান ভঞ্জন করায় কিন্তু এখন তো টাকা ছাড়া খুশি হবে না। হাসান আবার যায় কিন্তু টাকা চাওয়ার মত কোন সুযোগ নাই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পাশের ঘরের একজন বড় ভাই আসল। হাসান তাকে ঘটনা বলল। বড় ভাই আবার বরের ভগ্নিপতিকে ডেকে এনে বলল, পোলাপান এত কষ্ট করল কয়টা টাকা দিচ্ছেন না কেন? লোকটা ‘বাড়ির কর্তা নিষেধ করেছে শুনেন নাই’ বলে ভিতরে চলে গেল। হাসান নিরাশ হয়ে বিষণ্ণ মনে ঘুরতে লাগল। অনেকক্ষণ পর ফেরদৌসি এসে বলল, ওরা কি টাকা দিবে না? - না। - তাহলে আমরা এত পরিশ্রম করলাম কেন, আমি কি কিছুই কিনতে পারব না? তার চোখ টলমল করছে। হাসান অসহায় হয়ে গেল, সে তার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বলল, ‘রাখ, আমি আরেক বার চেষ্টা করে দেখি’ বলে বাইরে চলে গেল।

কারো বউ গাল ফুলিয়ে থাকলে স্বামী যেমন অস্থির হয়ে যায় কি করে মান ভঞ্জন করবে- হাসানেরও সেই অবস্থা। টাকা পায়নি বলে তার নিজের কোন কষ্ট নাই কিন্তু ফেরদৌসির অবস্থা দেখে সে খুব দুঃখিত ও ব্যথিত। যে করেই হউক তাকে খুশি করতে চাইছে। অবশেষে স্থির করল সরাসরি বরের কাছে টাকা চাইবে। ততক্ষনে খাওয়া পর্ব শেষ হয়েছে এখন বিয়ে পড়ানো হবে। বড় অজু করার জন্য একটা বদনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসানকে দেখেই বলল, ‘এই ছেলে একটু পানি আন তো। হাসান ভাবল এই তো সুযোগ, পানিটা এনে দিয়ে টাকা চাইবে। পানি নিয়ে এসে বলল, গেইটে যে টাকাটা দিতে চেয়েছিলেন, সেটা দেন আমার বোন কাঁদতেছে। বর খেকিয়ে উঠল ‘কিসের টাকা, গেইটে টাকা নেয় হিন্দুরা, তুমি হিন্দু নাকি, যাও। এখানেই সে ভুলটা করল, কয়টা টাকার জন্য বিচ্ছুর গায়ে খোচা দিয়ে দিল, তজ্জন্য তাকে কড়া মাসুল দিতে হয়েছিল। অনেকেই এ ভুলটা করে, ছোটদের মনের কথা বোঝে না, বুঝতে চায় না। যেখানে সামান্য কোন জিনিস বা কয়েকটা টাকা দিলেই তারা আনন্দে মেতে উঠে- সেখানে তা না করে বড় বড় বিপত্তি ডেকে আনে।

হাসানের মনটা ভেঙ্গে গেছে, কান্নার উপক্রম। ফেরদৌসির উদ্দেশ্যে বাড়ির ভিতরে রওয়ানা হল। কিন্তু সে দেউরির মুখে দাঁড়িয়ে আছে, বরের কথা শুনেছে, তার চোখ টলমল করছে। হাসান আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল, গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিল। তারপর ঠোঁট কামড়ে বলল, দেখিস আমি এর কঠিন বদলা নেব। ইতিমধ্যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হল, এখন বরকে ভিতরে নিবে, বর কনে একসাথে পাটিতে বসিয়ে মেয়ে মহলের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে। হাসান ঘুরছে আর ভাবছে কি করবে, কিভাবে বদলা নিবে, কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। তখন বর ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তার পেশাবের বেগ পেয়েছে। হাসানকে সামনে পেয়ে বলল, একটু পানি এনে দাও তো। ‘পারব না’ বলে ভেংচি কেটে সে সরে গেল। তখনি বড় জামাইরা এসে বলল, চলেন বউয়ের কাছে যাবেন। বর বলল, এস্তেঞ্জাটা করে আসি। তারা বলল, আরে কতক্ষন আর লাগবে, পড়ে এসে করবেন। বর ইতস্তত করতে করতে তাদের সাথে চলল।

বর কনে একসাথে বসানো হল, উভয়ের জামার কোনা আর শাড়ীর কোণায় গিট্টু দেয়া হল। হাসান ফেরদৌসি বড় হয়ে গেছে, তারা আর হাত ধোঁয়াতে পারবে না। কাজেই ফেরদৌসির ছোট ভাই বরের হাত ধোয়াল। জামাই নববধূর মুখে মিষ্টি তুলে দিল। তারপর শুরু হল মেয়ে মহলের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা। হাসান এখনো কিছু করতে পারছে না বলে দুঃখিত। সে ভিতরে গিয়ে বরের পিছনে বসল আর তখনি মাথায় চিন্তাটা ঢুকল। তাদের ঘরে একটা বুড়ো ও হিংস্র হুলো মার্জার ছিল। সে ফেরদৌসিকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বাইরে গিয়ে বলল, তুই আমাদের বিড়ালটা নিয়ে আয়, জামাইয়ের পেছনে আমি যেখানে বসে থাকব সেখানে নিয়ে আসবি। তবে সাবধান কেউ যেন দেখতে না পায়, ওড়না দিয়ে ঢেকে আনবি। বিড়ালটা হিংস্র হলেও তার একটা অভ্যাস ছিল কেউ কোলে নিলে বা মাথায় হাত বুলালে আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।

হাসান একটু সুতলি নিয়ে গিয়ে বরের পিছনে বসল, ফেরদৌসি বিড়াল নিয়ে এসে দুজন পাশাপাশি বসল। সে ফেরদৌসির কানে কানে বলল, বিড়ালের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখ আর ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখ। বরের জামার এককোনা শাড়ীর আঁচলে বাধা, সে অপর কোণা হাতে নিয়ে বিড়ালের লেজের গোড়ায় ভাল করে গিরা দিল, কারণ পিছলা লেজের মাঝখানে গিরা দিলে দ্রুত সরে যাবে। তারপর কাপড়ের উপর সুতলিটা পেচিয়ে শক্ত করে বাধল। কেউ দেখতে পেল না, কারণ ফেরদৌসির ওড়না দিয়ে ঢাকা। সবাই বর কনের প্রতি মনোযোগি হয়ে উদ্দাম হাসিতে একে অন্যের উপর ভেঙ্গে পড়ছে। পেশাবের চাপে বর বেচারার তলপেট ফেটে যাচ্ছে, সে তাড়াতাড়ি উঠতে চাইছে কিন্তু মেয়েদের কাজও শেষ হয় না সে উঠতেও পারে না। হাসান ফেরদৌসিকে ইশারা দিয়ে সটকে পড়ল। তারা বাইরে গেল মাত্র অমনি ঘরের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। সবাই হাসতে হাসতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরক্ষনেই বরের চিৎকার শুনা গেল ‘আরে বাপরে খাইয়া ফালাইছে, ও বাবারে মাইর‍্যা ফালাইছে।

মার্জার বেঁধে হাসান যখন বাইরে চলে গেল তখন বিড়ালটা এত মানুষ দেখে ভয় পেল। সে বেড়িয়ে যেতে চাইল আর তখনি লেজে টান পড়ল। সে কয়েকটা টান দিল, অর্ধ চন্দ্রাকারে কয়েকটা চক্কর দিল কিন্তু লেজ ছাড়াতে পারল না। এরপর ধাপাধাপি ও লাফালাফি শুরু করল তবুও লেজ ছুটল না। তখন বিড়ালটা পাগল হয়ে উঠেছে, সে লাফ দিয়ে দরজায় যেতে চায় কিন্তু টান লেগে ফিরে আসে। সে মনে করে পটেটো তার লেজ ধরে রেখেছে বা বেঁধে রেখেছে। তখন পটেটোর উপর হামলে পড়ে, পায়ে ও শরীরে কামরাতে থাকে। কিন্তু ভাগ্যিস যে কাপড় ও মোজার জন্য গায়ে দাঁত ফুটাতে পারে না। ভীষণ দর্শন হিংস্র মার্জার সত্যিই পাগল হয়ে উঠেছে। লাফিয়ে দরজায় যায় আবার লাফিয়ে এসে কামড়ায়। আবার যায়, টান লেগে আবার এসে কামড়ায়। পটেটো প্রকৃতিগত ভাবেই ভীতু, সে এমনিতেই বিড়াল ভয় পায়। এখন এ অবস্থায় এমন ভীমাকার বিড়ালের কামড়ে তার ধরে আর প্রাণ নাই। সে পাগলের মত চিৎকার করছে ‘ও বাবারে খাওয়্যা ফালাইছে, ও মারে খাইয়্যা ফালাইছে, আরে বাপরে গেলাম গেলাম, আমাকে বাচাও বাচাও--- সে মাতম জুড়ে দিয়েছে।

সে কাঁদছে, চিৎকার করছে, বিড়ালের সাথে ধাফাধাফি করছে। দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে চাইছে কিন্তু জামা শাড়ির গিরার কারণে যেতে পারছে না। শাড়িতে টান লেগে নববধূ দাঁড়িয়ে উঠেছে। তখন হঠাৎ পটেটো দৌড় মারল আর জামার সাথে শাড়ির টান লেগে নববধূর উর্ধাঙ্গের শাড়ি খুলে নিম্নাংশ খুলতে যাচ্ছে, তখনি নববধূ মুঠি মেরে কোমরের কাপড় ধরে দিগম্বরন থেকে রক্ষা পেল। বিড়ালের উপর্যোপরি কামড়ে পটেটো দিগ্বিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে কনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে, স্নায়ু ঢিলা হয়ে গেছে, সে মুতে দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিড়ালের লেজ ফসকাল আর সে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। বর স্ত্রীর উপর পড়েই মুতে দিয়েছে, ফলে নববধূর শরীর ও কাপড় ভিজে গেছে। দীর্ঘ সময়ে প্রচুর মুত্র জমেছিল আর এই দুর্গন্ধ মুত্র বর কনের দেহ ভিজে গড়িয়ে গিয়ে অর্ধেক পাটি ভিজে গেছে, পাটির নীচে জমা হয়ে আছে। এখন জামাই বাবাজি একেবারে নীরব নিথর শান্ত সুবোধ, কোন নড়াচড়া নেই। স্ত্রীর ঘাড়ের পেছনে মাথা লুকিয়ে কাঁদছে। জীবনে কোন দিন সে এমন লজ্বার মুখে পড়েনি। সে এতটাই লজ্বিত হল যে, এ মুহুর্তে তার মন চাচ্ছে আত্মহত্যা করতে।

বিড়াল চলে গেছে দেখে মহিলারা আবার ঘরে আসতে লাগল। কিন্তু মুত্র দেখে ও দুর্গন্ধে তারা মুখে কাপড় গুজে হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে গিয়ে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। মহুর্তের মধ্যে এই হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল বিশাল বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। সমস্ত বাড়িটা যেন হাস্যপুরীতে পরিণত হল। জোয়ান বুড়া পোলা নারী পুরুষ সবাই হাসছে, হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ছে। কেউ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে, কেউ হাসতে হাসতে বসে পড়ছে, কেউ একে অন্যের উপর গড়িয়ে পড়ছে, বিছানায় লুটিয়ে পড়ছে। জিবরাঈল হাসির বাক্স নিয়ে এসে বাড়িটাতে খোলে দিয়ে গেছেন। হাঁসি পর্ব শেষ করে তারা ক্লান্ত হয়ে গেল। তারপর প্রশ্ন উঠল, এমন অদ্ভুত কাণ্ড কে করেছে? গবেষণায় উত্তর আসতে বিলম্ব হল না, মালিক জোড় ছাড়া এমন কাণ্ড আর কেউ করেনি, করতে পারবেও না। তারপর প্রশ্ন উঠল, তারা এমন কাজ কেন করল? তখন গবেষণায় বেরিয়ে আসল, বরপক্ষ তাদেরকে গেইটের টাকা দেয়নি এজন্য তারা প্রতিশোধ নিয়েছে। তখন সবাই আবার হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল ‘উত্তম প্রতিশোধ, উত্তম প্রতিশোধ। মুরুব্বিরা হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলল, ছেলে মেয়ে দুইটা আসলে একটু বেশি দুষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘটনার জন্য পটেটো হাসানের জানের দুষমনে পরিণত হল।

বিয়ের পর ফিরতি নায়রে নুরানি বাড়িতে গেল। তাদের ও পাণি প্রার্থি চাচাত ভাইয়ের ঘর ছিল পাশাপাশি, একই উঠান। নববধু আনা গুনা করছে, তার রুপের সুধা পান করার জন্য পাণি প্রার্থি চাচাত ভাই ঘরের দরজায় এসে বসল। উর্বশি যৌবনা অপ্সরী, দৃষ্টি বিনিময় হয়, চাওয়া চাওয়ি হয়। হঠাৎ একবার চার চোখের মিলন হতেই উভয়েই হেসে উঠল। আর তখন একজন ব্যর্থ প্রেমিকের কলিজায় যে কৃঞ্চ গহ্ববের সৃষ্টি হল তা নূরানিও জানল না আর অন্য কেউ অনুভবও করল না যে- মৃত্যুর আগে সেই গহ্বর ভরাট হবার নয়। এরপর বেচারা চিরকুমার থাকল।

১৩

নূরানির বিয়ে হয়ে গেছে, এখন সম্পূর্ণ সংসারী দায়িত্ব বর্তেছে হাসানের উপর। মা হলেন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। সংসারী ঝামেলায় তিনি জড়াতে চান না, তিনি সম্পুর্নরুপে হাসানের উপর নির্ভরশীল। আবার ফেরদৌসির অবিবাহিত সপ্তম বোনটাও মায়ের মতই সাদা সিধা সরল প্রাণ। সে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে, এখন তার কাজ হল- খাওয়া দাওয়া করবে, ইবাদাত বন্দেগী করবে আর অবসর সময়টা এ ঘর ও ঘর ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরবে কিন্তু কোন কাজ করবে না। সে একটু অলস ও অকর্মন্য প্রকৃতির লোক। যদি কোন ঝামেলা দেখে অমনি দৌড়ে গিয়ে কোরান শরীফ নিয়ে বসবে, যদি কোন কাজ দেখে অমনি গিয়ে নামাযে দাঁড়াবে। তার বদামি দেখে হাসান ফেরদৌসি পরামর্শ সভায় বসল, তার একটা নামকরণ করতে হবে। ফেরদৌসি প্রস্তাব করল তার নাম হবে বদের হাড্ডি অথবা পাজির পা ঝাড়া। হাসান প্রত্যাখ্যান করে বলল, না না, এগুলি ওল্ড মডেলের নাম। নতুন কারুকার্যময় আধুনিক ডিজাইনের নাম উপহার দিতে হবে- যা তার কর্মের সাথে মিলবে এবং সেও মেনে নিবে। - তাহলে তার নাম হউক রাবেয়া বসরি। হাসান বলল, আরে না, এত ভাল নাম দেয়া যাবে না। আমার প্রস্তাব হল, তার নাম হবে বিড়াল তপস্বী। ফেরদৌসি হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক, এ নামটা তার জন্য জুতসই হবে। এরপর থেকে বেচারির নাম হয়ে গেল বিড়াল তপস্বি ওরফে তাপসী।

যাই হউক, সঙ্গত কারণেই সাংসারিক সর্বময় দায়িত্ব হাসানের কাঁধে বর্তিল। জমি যিরাত দেখবাল করা, বর্গাদার বাছাই করা, ধান গোলাজাত করা, অন্যান্য সম্পদ হেফাযত করা, ধান ফল ফলাদি শাক সবজি ইত্যাদি বিক্রয় করা, বাজার সওদা করা, পরিবারস্ত সকলের কাপড় চোপড়, ঔষধ পত্তর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সরবরাহ করা, ইত্যাদি অনেক দায়িত্ব। এসবই তাকে একা করতে হয়, কোন সহযোগি নাই। মেয়েরা, মেয়ের জামাইরা, ভাইয়েরা ফিরেও তাকায় না, কোন খোজ খবরও রাখে না। তারা হাসানের উপর নির্ভরশীল এবং আস্থাশীল। কাজেই হাসান ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। সে এখন পুরা দস্তুর গৃহস্ত, সম্পূর্ণ সংসারী। তার উপর নিজের লেখাপড়া ও ফেরদৌসির লেখাপড়ার দায়িত্ব তো আছেই। এতসব দায়িত্ব সে সুন্দর ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। কেউ সহযোগিতা না করলেও ফেরদৌসি ভেতর থেকে সহযোগিতা করে। কি কি বাজার সওদা লাগবে, কোন কাজটা কিভাবে করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে ফেরদৌসির পরামর্শ নিয়েই হাসান কাজ করে। অর্থাৎ তারা স্বামী স্ত্রীর মত সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা পরস্পরের মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠ হয়, একাকার হয়ে যায়। তারা সুখি মহাসুখি।

কিন্তু আলবার্টের ভাই মহিউদ্দিন ওরফে মইখ্যা তাদের সুখের কুসুমকলিতে কাটা হয়ে বিধতে লাগল। নিয়মানুযায়ী গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই বিয়ে শাদি করেছে, সাংসারিক দায়িত্ব কাঁধে চেপেছে। বউয়ের কামড়ে ও রুটি রুজির সন্ধানে সবাই ব্যস্ত। কেউ চাকরিতে ঢুকেছে, কেউ ব্যবসায়, কেউ কৃষিতে লেগে গেছে। আলবার্টও দুটি বাচ্চা রেখে মারা গেছে। এখন পুরাতন গ্যাং পার্টি ভেঙ্গে গেছে। তবে নতুন প্রজন্ম মাঠে নামছে। যদিও তারা এখনো সংগঠিত হয়নি তবে প্রাকৃতিকভাবে তাদের দল গড়ে উঠছে। আলবার্ট মারা যাওয়ার পর মহিউদ্দি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। নেতার ভাই নেতাই হয়। আলামতে বুঝা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের গ্যাং পার্টীর নেতা হবে মহিউদ্দি। তবে সে আলবার্টের মত ভদ্র ও নীতিবান ছিল না, সে ছিল উগ্র এবং বদ চরিত্রের ছেলে।

ফেরদৌসি কৌশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পন করেছে। ধীরে ধীরে তার রুপ লাবন্য চন্দ্রকলার মত পূর্ণতায় পৌঁছতে থাকে আর তার প্রতি মহিউদ্দির রুপের পিয়াস বাড়তে থাকে। সে এটা সহ্য করতে পারে না যে, হাসানের মত একটা ছিন্নমূল পরবাসি ছেলে ফেরদৌসির সাথে চলে ফেরে উঠে বসে খায়, শীঘ্রই তাদের বিয়ে হবে। যখনি তার মনে হত ফেরদৌসি হাসানের বউ হবে অথচ চাচাত ভাই হয়েও সে তাকে পাবে না, তখনি সে উম্মত্ত হয়ে উঠত, পাগল হয়ে যেত। ফেরদৌসির রুপের নেশা তার কোষে কোষে পশে গিয়ে তাকে মাতাল করে তুলেছে। সে ফেরদৌসির পিছু নেয়, স্কুলে যাওয়া আসার পথে অনুনয় বিনয় করে, প্রেম নিবেদন করে, এটা ওটা খেতে সাধে কিন্তু সে পাত্তা দেয় না। যতদিন রাস্তায় মইখ্যা তাকে ত্যক্ত বিরক্ত করে ততদিন সে এসে হাসানকে জানায়। আর এ নিয়ে হাসান মইখ্যার মধ্যে কয়েক দিন পর পর ঝগড়া হয়, বহু দিন মারামারি হয়েছে। উভয়ের দৈহিক গড়ন পেশিবহুল, বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী কিন্তু শক্তিতে হাসানের সাথে মইখ্যার তুলনা ছিল না। প্রতিবার হাসান তাকে মেরে বিড়ালের মত নাক মুখ থেতলে দিয়েছে কিন্তু সে বেহায়া নেড়ি কুত্তার মত ফেরদৌসির পিছনে লেগেই আছে, তার রুপ লাবন্য দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে না।

ফেরদৌসি স্কুল থেকে এসে হাসানকে খুজল কিন্তু পেল না। অগত্যা কোন রকম চারটে খেয়ে বইয়ের পিছা থেকে একটা কাগজের টুকরা হাতে নিয়ে হাসানের রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। তার মুখটা খুবই গম্ভীর এবং বিষণ্ণ। বিকালে হাসান রুমে এসে দেখল, ফেরদৌসি কাঁদছে, সে ললাটে ও মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কিরে কী হইছে অসুখ? সে কিছু বলল না, শুধু হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরাটা এগিয়ে দিল। হাসান হাতে নিয়ে দেখল ‘ফেরদৌসি তোকে ছাড়া আমি বাচব না’ ব্যস এটুকুই লেখা। হাসানের চোখ দু’টি চিতার চোখের মত জ্বলে উঠল। জিজ্ঞেস করল কে দিয়েছে, মইখ্যা? সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতিসূচক উত্তর দিল। সাথে সাথে হাসান লাফ মেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আশপাশে খুজল কোথাও পেল না। ভাবল, অবশ্যি দোকানের কাছে পাওয়া যাবে। বাড়ির পুর্ব প্রান্তে রাস্তার পাশে দোকান। দোকানের পিছনে ও দুই পার্শ্বে অনেক গুলি বাঁশ নির্মিত বেঞ্চ। এখানেই গ্যাংরা ও অন্যরা আড্ডা দেয়।

দোকানের পেছনের একটা বেঞ্চে মহিউদ্দি বসে আছে, অন্য কেউ নেই। হাসান গিয়েই সোজা তার নাকের ডগায় কাগজটা ধরে বলল, এটা কে দিয়েছে? মহিউদ্দি লাফিয়ে দাঁড়িয়ে খেকিয়ে উঠল, যেই দেউক, তাতে তোর কি, সে তো তোর কেউ না, আমার চাচাত বোন- যা বুঝার আমি বুঝব। ‘হারামজাদা শুয়ার, আমার বোনকে উত্যক্ত করবি আবার বলবি আমার কেউ না’ বলেই একটা ঘুষি মারল। সে বেঞ্চের উপর দিয়ে উল্টে গিয়ে ওপাশে পড়ল। তারপর উঠে লাফিয়ে এসে হাসানকে ঝাপটে ধরল কিন্তু গায়ে গতরে উভয়ে সমান হলেও শক্তিতে হাসান ছিল তার চেয়ে বহুগুন। সে এলোপাতারি কিল ঘুষি ও লাথি মারতে লাগল। তার হাত পা চরকার মত ঘুরছে আর হাতুড়ির মত মইখ্যার নাকে মুখে বুকে কোমরে আঘাত হানছে। কেউ দেখলে মনে করবে সে বুঝি কারাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। আসলে কিছুই না, এটা তার প্রাকৃতিক অভ্যাস। মারামারি লাগলে তার হস্ত পদ সমাল চলে।

দোকানের একটু পেছনেই গভীর খাদ, রাস্তায় মাটি তোলার গর্ত। হাসান তাকে মারতে মারতে খাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পেটে জোরে এক লাথি মারল আর সে ছিটকে গিয়ে খাদের কিনারে পড়ল। তারপর গড়াতে গড়াতে একদম খাদের নীচে। সেখানে উঠে বসে আহত সিংহের মত হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ অস্তগামী সূর্যের লাল। নাক থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। হাসান কিনারে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠল, ঐ শুয়োরের বাচ্চা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন, উঠে আয়, আজ জন্মের মত তোর প্রেমের সাধ মিটিয়ে দিব। কিন্তু সে উঠার সাহস পেল না। হাসান আবার তাকে ধরার জন্য নামতে গেল, ততক্ষণে দোকানদার এসে পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল ‘হয়েছে হয়েছে অনেক হয়েছে বাবা, আরো মারলে ও মরে যাবে, মাফ করে দাও’ বলে তাকে শান্তনা দিতে দিতে টেনে নিয়ে গেল। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বিদায় করল। হাসানও মুরুব্বী মানুষের কথা মেনে মহিউদ্দির দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, কুত্তার বাচ্চা আরেক দিন যদি ফেরদৌসির দিকে চোখ তুলে তাকাবি, তাহলে তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলব’ বলে হনহন করে চলে গেল।

এর পরদিন থেকে মহিউদ্দি ভাল হয়ে গেল। কারণ এ পর্যন্ত ফেরদৌসির জন্য সে বহুবার মার খেয়েছে, তার দেহের অনেক রক্ত ঝড়েছে, আর কত। অগত্যা সে ফেরদৌসির পিছু ছেড়ে দিল। সবাই ভাবল ছেলেটা ভাল হয়ে গেছে। আসলে হায়েনার মত জেদি ছেলেটা মনে মনে শপথ করেছে, সে হাসানের উপর প্রতিশোধ নিবে। সে নিজে ফেরদৌসির পাণি গ্রহণ করতে পারুক আর না পারুক তার জীবন থাকতে হাসানের সাথে বিয়ে হতে দিবে না। প্রয়োজনে সে হাসানকে হত্যা পর্যন্ত করতে প্রস্তুত। সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এইভাবে হাসানের শত্রুসংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।

নূরানির বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক হয়ে গেল। একদিন মাজেদা আসল তার সপ্তম বোনকে নিয়ে যেতে। ফেরদৌসি এসে হাসানের কানে কানে বলল, এবার বিড়াল তাপসির বিয়ে হয়ে যাবে, জামাই নাকি কলেজ শিক্ষক, বড়াপার বাসায় বিয়ে হবে। পরদিন মা তাকে ডেকে বললেন ‘তোর বোনের বিয়ের একটা আলাপ চলছে, আমরা সবাই যাচ্ছি। খালী বাড়ি রেখে তুই যেতে পারবি না, তোর চাচির ঘরে চাল ডাল দিয়ে গেছি, সেখানে খাওয়া দাওয়া করিস। আর সন্ধ্যায় খেয়াল করে হাঁস মুরগিগুলি খোয়াড়ে তুলিস। আরো কিছু উপদেশ দিয়ে তারা রওয়ানা হল। মাজেদা চোখ পাকিয়ে বলল, এই ছেমড়া কোন কিছু ক্ষতি হয় না যেন, সব কিছু লক্ষ্য রাখিস। হাসান তাকে ভয় পায়, জ্বি আচ্ছা’ বলে সম্মতি জানাল। তারা রওয়ানা হল আর হাসানও সাথে সাথে গেল, রাস্তায় উঠে তাদেরকে রিকশায় তুলে দিল। তারপর ফেরদৌসির বাহুতে একটা গোপন চিমটি দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাল।

এক সপ্তাহ পর তারা এল, বিয়ে হয়ে গেছে। ব্যস, এখন নিরিবিলি নির্ঝঞ্জাট সংসার। তিন জনের সংসার। স্বামী স্ত্রী ও সন্তান। স্বামীটার নাম হাসান, স্ত্রীর নাম ফেরদৌসি আর সন্তান হল তাদের মা। সন্তান যেমন খায় আর দুষ্টামি করে, বড় হলে মা বাবার খেদমত করে- তদ্রুপ এ সন্তানটিও খায় আর তাদের খেদমত করে, মানে রান্না বান্না ও অন্যান্য কাজ কর্ম করে। সন্তান দুষ্টামি করলে মা বাবা যেমন ধমক দেয় তদ্রুপ মা উল্টা পাল্টা কোন কিছু করলে বা বললে কখনো হাসান কখনো ফেরদৌসি ধমক দেয়, আর তখন তিনি বাচ্চাদের মত চুপসে যান। তাদের সংসার সুখে স্বাচ্ছন্দে ভালই চলছে। তারা আদর্শ দম্পতি। একে অন্যের পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করে না। একটা ভাত পড়লেও ফেরদৌসি হাসানকে জানায়, চাল ডাল তেল মরিচ লবণ ইত্যাদি কতটুকু লাগে, অন্যান্য হিসাব কিতাব সব হাসানকে জানায়। হাসানও কোন জমি কাকে বর্গা দিবে, কোন ক্ষেতে কি ধান করবে, ধান গোলাজাত করবে নাকি বিক্রি করবে, কতটুকু খোরাক বাবদ সেদ্ধ করবে, কাপড় চোপড় বাজার সওদা ইত্যাদি সব কিছু হবু স্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া করে না। এছাড়া একে অন্যের লেখাপড়ার প্রতি তারা খুবই সজাগ।

এভাবে তারা সত্যিকার অর্থেই স্বামী স্ত্রীর অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এখন তারা একে অন্যের সাথে কথা না বলে, পরামর্শ না করে, না দেখে থাকতে পারে না। হাসান বাহির থেকে এলে তার দৃষ্টি সাথীকে খুঁজে, ফেরদৌসির চলন বলন ভাব ভঙ্গি তার কাছে স্বপ্নময় ও ছন্দময় লাগে, তার কথা কর্ণ কুহরে রিনিঝিনি সঙ্গীত তুলে, তার হাসি হৃদয় বীণার তারে ঝংকার তোলে। ফেরদৌসি তার চোখের আলো, তার হৃদয় সিংহাসনের রাণী। ফেরদৌসি স্কুল থেকে এসে হাসানকে না পেলে মাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না বটে কিন্তু তার দুটি চোখ সাত সাহারার তৃষা নিয়ে প্রিয়জনের পথ পানে তাকিয়ে থাকে। হাসান আসলেই সে চঞ্চল হয়ে উঠে, চাদের ন্যায় চেহারা ঝকমক করে উঠে, মুখে হাসি ফুটে উঠে। তখন সে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে থাকে আর অনর্গল হাসতে থাকে। সেই হাসির সুধা হাসান পান করে, আকণ্ঠ পান করে। এভাবে তারা দুজন দুজনার মধ্যে হারিয়ে যায়।

দিনের বেলা তারা যতই স্বামী স্ত্রীর মত অভিনয় করুক না কেন কিন্তু রাতের বেলা তারা পৃথক প্রকোষ্ঠে কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মা এমনিতে দুনিয়াদারী কিছু বুঝুক আর না বুঝুক কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি খড়গ হস্ত, একেবারে জল্লাদ। দিনের বেলা ছেলে মেয়ে দুটিকে শাসন করেন না, তারা কথা বার্তা বলে, হাসি তামাশা করে, খুনসুটি করে, এসব তার কাছে ভালই লাগে, তিনিও উপভোগ করেন। কিন্তু যেই না রাত্রি নামল অমনি তিনি সতর্ক, ফেরদৌসিকে পড়ার টেবিলে না দেখলে ব্যস্ত হয়ে এক দৌড়ে যাবেন হাসানের রুমে। সেখানে না থাকলে ব্যস, তিনি শান্ত। কখনো ফেরদৌসি আসতে চাইলে তিনি ধমক দেন, এই কোথায় যাস, রাত্রে ওর রুমে যাওয়া যাবে না। কখনো যদি শুনেন দু’জনে আলাপ করছে তখন দৌড়ে গিয়ে হাজির হবেন, তারপর সাথে নিয়ে আসবেন। দিনের বেলা সাধারণত ফেরদৌসি হাসানকে ভাত বেড়ে দেয় কিন্তু রাতে এই অনুমতি নাই, রাতে মা নিজে ভাত বাড়েন। কারণ এরা এখন যুবক যুবতি, শীঘ্রই তাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে। কাজেই এ অবস্থায় তিনি তাদের বিশ্বাস করেন না, আর করা উচিতও নয়। কারণ অঘটন ঘটন পটিয়সি শয়তান বেটা কখন এসে কোন ঘটনা ঘটিয়ে বসে কে জানে। তাই রাতের বেলা তিনি ছেলে মেয়ে দুটির ক্ষেত্রে একেবারে কাঠকুট্টা কঠোর।

বিষয়: সাহিত্য

৯২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File