হাসান ফেরদৌসি - ৮

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ অক্টোবর, ২০১৭, ০৮:৪৯:৫৩ রাত

১৪

মেধাবী ছাত্র হিসাবে সর্বত্র হাসানের সুনাম সুখ্যাতি। কিন্তু সে পড়া লেখার পেছনে সময় ব্যয় করে খুবই কম। রাত্রে দুয়েক ঘণ্টা কিন্তু সকালে বসেই না। কখনো সংসারী কাজ কর্ম করে, কখনো ফেরদৌসির সাথে খোঁচাখোঁচি করে, কখনো বা ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। এরপরেও সে সব সময় ফার্স্ট বয় এবং সকল ছাত্রের ঈর্ষার পাত্র। এসব দেখে মা ক্ষেপে গেলেন। একদিন তাকে আচ্ছা করে ঝেড়ে বললেন, তোর মতিগতি আমি দেখতেছি, তুই কয় ঘণ্টা পড়স, সারা সকাল ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরস, আজ থেকে ঠিকমত না পড়লে আর কপালে ভাত জোটবে না। হাসান হেসে বলল, কেন আমি কি কারো চেয়ে পড়া কম পারি নাকি, খোঁজ নিয়ে দেখেন। মা বুঝলেন সে প্রকৃতই মেধাবী, কম পড়লেও হয়ে যায়। তাই তিনি সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় বললেন, শুন তোর বাপের ইচ্ছা ছিল, তোকে মাদরাসায় পড়ার সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত করবেন। স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। এখনই উপযুক্ত সময়, তুই স্কুলে ভর্তি হ। হাসান বলল, কেন, পড়তেই তো আছি আর কত।

এরপর থেকে মা ভর্তি হবার তাকীদ দেয় আর সে বলে, আমি এত পড়তে পারব না। মায়ের কথা সে কানেই তুলে না। মা বুঝলেন এর মধ্যে তার পূর্ব পুরুষের রক্ত প্রবাহিত, লেখা পড়ায় অনিহা। তার বাবাও নাকি খুব মেধাবী ছিলেন কিন্তু পড়া লেখায় আগ্রহ ছিল না। অগত্যা একদিন তিনি ফেরদৌসিকে পাঠিয়ে মাদরাসার বড় হুজুরকে ডাকিয়ে আনলেন। যেহেতু মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাষ্টার বিধায় ছাত্র শিক্ষিকরা তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। হুজুর আসার পর মা হাসানের ইতিহাস বর্ণনা করে বললেন, ‘সে আমার পেটের ছেলে না হলেও ছোট বেলা থেকে আমিই লালন পালন করেছি, এখন আমিই ওর মা। কাজেই আমি চাই না আমার ছেলে শিক্ষা দীক্ষায় কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকুক। সে আসার পর আমরা দুজনে পরামর্শ করে তাকে মাদরাসায় ভর্তি করেছিলাম এই শর্তে যে, সে দুই লাইনের লেখা পড়া একসাথে চালিয়ে যাবে। এখন সময় হয়েছে, সে মেধাবী দুটাই একসাথে চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হল কতদিন ধরে আমি তাকে স্কুলে ভর্তি হবার কথা বলছি কিন্তু সে আমার কথা শুনছে না। এজন্যই আপনাকে ডেকেছি, আপনি একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে ভর্তিটা করিয়ে দেন।

বড় হুজুর বললেন, কী দরকার, সে ভাল ছাত্র, বড় একটা আলেম হবে, এসবের আমি কোন প্রয়োজন মনে করি না। মা বললেন, দরকার আছে, সে যেমন আমার ছেলে তেমনি জামাতাও, আগে থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত ফেরদৌসিকে ওর সাথে বিয়ে দিব। আমার অন্যান্য জামাইরা সবাই আধুনিক শিক্ষিত ও সরকারি চাকুরে। কাজেই আমার ছোট জামাই কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকবে, চাকরি বাকরি করবে না, এটা আমি মেনে নিতে পারব না। আমার ইচ্ছা, সে সকলের চেয়ে অগ্রগণ্য থাকবে। কাজেই আপনি ওকে শাষিয়ে ভর্তির ব্যবস্থাটা করে দিন। হুজুর বললেন, ঠিক আছে, এস এস সি ও দাখিল সমমান, দুইটার একটা দিলেই হল। আর দাখিল পরীক্ষা দিলে সে ভাল করতে পারবে, যেহেতু আরবি বিষয়গুলি তার ভাল জানা আছে। আমার ছোট ভাই আলতাফ একটা দাখিল মাদরাসার সুপার, তাকে বলে আমি ব্যবস্থা করব ইংশাল্লাহ’ বলে তিনি সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

গ্রামাঞ্চলে কিছু দাখিল মাদরাসা আছে ছাত্র পায় না। তখন কওমি মাদরাসা ও স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া ছাত্রদের ধরে এনে নিজ খরচে পরীক্ষা দেওয়ায়। এভাবে মাদরাসা টিকিয়ে রাখে। আলতাফ সাবের মাদ্রাসাও এ পর্যায়ের। হাসানের মত মেধাবী ছাত্রের কথা শুনে দু’দিন পরই তিনি এসে হাজির হলেন। হাসানকে বললেন, তুমি শুধু ফটো ও বায়োডাটা লিখে দাও, আর কিছুই লাগবে না। হাসান সেগুলি দিল। তখনকার দিনে শুধু ফরম ফিলাপ করেই পরীক্ষা দেয়া যেত, অগ্রিম রেজিট্রেশনের প্রয়োজন ছিল না। তিন মাস পর পরীক্ষা। আলতাফ সাবের বাড়ি মাত্র দুই মাইল দূরে। মা তাকে বললেন, হাসান তো ক্লাস করেনি পরীক্ষা প্রস্তুতি কেমনে নিতে হয় তাও জানে না। আপনি সপ্তাহে দুই তিন দিন এসে ওকে দেখিয়ে দিয়ে যাবেন, আমি আপনাকে চা নাস্তার খরচ দিব। ‘টাকা লাগবে না’ বলে আলতাফ সাব আসতে লাগলেন। মা হাসানকে বই কিনে আনার জন্য তাকীদ দিতে লাগলেন কিন্তু তার কথা সে গায়েই মাখে না। অগত্যা সুপার সাব কিছু পুরাতন বই দিলেন। তিনি কয়েকদিন এসেই বুঝলেন এতো ছাত্র নয় আগুন, প্রশ্ন করতে গেলে ছাত্রের সামনে নিজেই ধরা খেয়ে যান। কাজেই পরীক্ষায় কি কি প্রশ্ন আসতে পারে, আর পরীক্ষা প্রস্তুতির কৌশল ইত্যাদি দেখিয়ে দিলেন। তারপর মাকে ডেকে বললেন, অংক ইংরেজি ছাড়া বাকী সাবজেক্টে সে সর্বোচ্চ রেজাল্ট করবে। আপনি অংক ইংরেজির জন্য একজন মাষ্টার রেখে দেন’ বলে তিনি বিদায় নিলেন।

মা ফকির বাড়িরই কলেজ পড়োয়া একটা ছেলেকে নিয়োগ দিলেন। ফেরদৌসি মায়ের আড়ালে হাসানকে বলল, আমি তোকে অংক ইংরেজি পড়াব- তখন সে নিউ টেনে পড়ে, অর্থাৎ হাসানের পরের বছর পরীক্ষা দিবে। হাসান মুখে বলল, ‘ঠিক আছে পড়া, মনে মনে বলল, তোর কাছে পড়লে তো আমার মুখ পোড়া যাবে, মান ইজ্জত গঙ্গার জলে ভাসবে। সারা জীবন আমার উপর দাদাগিরি করবি আর খোটা দিবি তুই আমার উস্তাদ, তোর উস্তাদগিরি বের করছি। তারপর ফেরদৌসি যে চ্যাপ্টারটা পড়াবে- আগেই সে তা ভাল করে দেখে রাখে। পড়ানোর সময় আজে বাজে প্রশ্ন করে আটকে দেয় আর অপমান করে। এভাবে কয়েক দিন অপমানিত হয়ে একদিন সে হাসানের গালে ঠুক্কর মেরে বলল, ‘তোকে পড়াবে- দুনিয়ায় এমন কোন বাপের পোলা নাই। অগত্যা বেচারি উস্তাদের পদে ইস্তফা দিল।

এদিকে নিয়োগ প্রাপ্ত মাষ্টার ছেলেটা হল হাসানের সমবয়সী এবং বন্ধু। কাজেই সে পড়ার চেয়ে মাষ্টারের সাথে গপ্প ও আড্ডা মেরে সময় কাটাতে লাগল। মাষ্টার জোর জার করে দুয়েকটা অংক দেখায়, কিছু ইংরেজি দেখায়। ব্যস ঐ পর্যন্তই, হাসান এ পড়া আর রিভিশন করে না, পরদিন মাষ্টার এলে সে ভাবেই পড়া দেয়। এতে সে মাঝে মধ্যে আটকে যায়। মা কয়েক দিন ধরে দেখতেছেন কিন্তু কিছু না বলে ভিতরে ভিতরে বেলুনের মত ফুলতেছেন। একদিন একটা বাশের কঞ্চি নিয়ে এসে সামনে বসলেন। দেখে তো হাসানের গলা শুকাল। সে মাষ্টারের কাছে পড়া দেয়, যতবার আটকে তিন চারটা করে বাড়ি খায়। এভাবে দু’তিন দিন যাওয়ার পর মা বললেন ‘আমি শুধু তোর ভাব দেখতেছি কিছু বলতেছি না। পরীক্ষার সময় মানুষ পড়তে পড়তে আধমরা হয়ে যায় আর তুই একটা অক্ষর পড়িস না। ঠিক আছে না পড়, আমিও দেখব তোর পিঠে কত কুলায়। এরপর সে প্রমাদ গুনল, ‘তালিবালি কয় দিন ধরা পড়বি একদিন। মার আর কত খাবে, অগত্যা বেচারা পড়তে বসল। যাকে বলে কোমর বেঁধে লাগা বা আদাজল খেয়ে লাগা।

সে ভাল করেই পরীক্ষা প্রস্তুতি নিল, পরীক্ষা দিল। তিনমাস পর রেজাল্ট হল, বিকালে স্বয়ং সুপার আলতাফ হুসেন রেজাল্ট নিয়ে বাড়িতে এলেন, হাসান বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে। পরিবারে তিনজন সদস্য, আর তিনজনের অনুভতি তিন রকম। হাসান বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে, এটা কি খুশীর সংবাদ নাকি দুঃখের সংবাদ এমন কোন অভিব্যক্তি তার মধ্যে দেখা গেল না। সুপার সাব এসেছে, তাই ভিতর থেকে হালকা নাস্তা তার সামনে দিয়ে সে গতানুগতিক অন্য সময়ের মত বাইরে বেরিয়ে গেল। আর ফেরদৌসির অবস্থা হল, তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কি করবে না করবে কোন হুস পাচ্ছে না। শালিক পাখির মত লাফাচ্ছে। তার ভাব গতিকে মনে হচ্ছে যেন কোন মনি- মুক্তার খনি পেয়ে গেছে।

আর মায়ের অবস্থা হল, তিনি রেজাল্ট শুনেই আশপাশের ঘরে দৌড় লাগিয়েছেন, একে তাকে ডেকে বলছেন ‘আপা শুনছেন, অমুক শুনছ তমুক শুনছ আমার হাসান বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে। দুয়েক ঘরে সংবাদটা জানিয়ে তিনি মিষ্টি আনানোর জন্য দৌড়ে ঘরে গেলেন কিন্তু হাসান নাই। ফেরদৌসিকে জিগালেন ‘হাসান কইরে? সে বলল, ঐ যে মাঠে খেলছে। মা বললেন, তাড়াতাড়ি ডেকে আন। সে গিয়ে ডেকে আনল। মা বললেন, তাড়াতাড়ি বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আয় গিয়ে। হাসানের বিস্ময় ‘কিসের মিষ্টি? - কিসের মিষ্টি জানস না, রেজাল্টের মিষ্টি। হাসান ঠোঁট উল্টে বলল, বা চমৎকার। এত কষ্ট করে পড়লাম, কষ্ট করে পরীক্ষা দিলাম, ভাল রেজাল্ট করলাম। এখন কোথায় না সবাই আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে, তা না- ভুতের উল্টো পায়ে চলার মত আমাকেই মিষ্টি খাওয়াতে হবে। এসব ভৌতিক কর্ম- কাণ্ডে আমি নাই’ বলে সে আবার বেরিয়ে গেল।

তখন হাসানের মাষ্টার ছেলেটা খুশীর সংবাদে ভাগ বসাতে এসেছে। মা তাকে দিয়েই কয়েক কেজি মিষ্টি আনিয়ে বাড়ি শুদ্ধু বিলালেন। আর সাথে সাথে এ সংবাদটাও বিলালেন, আমার হাসান স্ট্যান্ড করেছে। এরপর কয়েক দিন পর্যন্ত তিনি ফরয হিসাবে একটা ডিউটিই পালন করলেন, যাকে যেখানে পেয়েছেন ‘তোমরা খবর শুনেছ, আমার হাসান বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে। এবার শুরু হল কলেজে ভর্তি নিয়ে বাদ বিসংবাদ। রেজাল্ট হওয়ার পর থেকেই মা বারবার তাকাদা দিচ্ছেন, কলেজে ভর্তি হ, দূরে যাওয়ার দরকার নাই, বাজারে কলেজ আছে, সেখানেই ভর্তি হ। দূরে গেলে সংসার দেখবে কে? উল্লেখ্য যে, ফেরদৌসিদের স্কুলের পাশেই কলেজ। কিন্তু মায়ের কথায় হাসান হু হাঁও করে না, গায়েও মাখে না। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় মা বললেন, এতদিন ধরে বলতেছি তোর কানে কথা ঢোকে না, কালকের মধ্যে ভর্তি হবি। হাসান বলল, এস এস সি তো পাশ করলামই আর কত। মায়ের হঠাৎ রাগ উঠে গেল, ঢাস ঢাস করে তার গালে দুইটা চড় মারলেন ‘মেট্রিক দিয়েই মনে করেছিস বিদ্যাসাগর হয়ে গেছিস, তোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে।

হাসান রাগে ভাতের থালা ঠেলা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। মা দৌড়ে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ালেন ‘ভাত খা, না খেয়ে যেতে পারবি না। হাসান কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা খেতে বসল। মা কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে বললেন, ‘কাল গিয়ে ভর্তিটা হয়ে যা, জীবনটা নষ্ট করিস না। হাসানের ভীতরে বাস্পটা জমে আছে, সে মাথা নিচু করে খাওয়া শেষ করেই বাইরে গিয়ে চেঁচাল, আমি জীবনেও ভর্তি হব না। ফেরদৌসি জানালা দিয়ে দেখছে আর হাসছে, হাসান ঘরে ঢুকতেই বলল, কিরে হনুমান কেমন প্যাদানিটা খেলি? সে দু’পা এগিয়ে গিয়ে ‘যাঃ ভটকি’ বলে তার তুলতুলে গালে একটা ঠোক্কর মেরে চলে গেল। ফেরদৌসি ক্ষেপে গেল, তবে ঠোক্কর দেয়ার জন্য নয় তাকে ভটকি বলার জন্য রেগে গেছে। সে পিছু পিছু হাসানের কামরায় গিয়ে বলল, না না কলেজে ভর্তি হওয়ার দরকার নাই। এত লেখাপড়া করে কি হবে, চাকরি করেই কি হবে? তার চেয়ে তুই বরং একটা হেয়ার কাটিং সেলুন দিবি, তখন দু’জনে মিলে মানুষের চুল কাটব’ বলে নাক মুখ চোখ কুচকে বানরের মত একটা ভেংচি কেটে রাগে গড়গড় করতে করতে চলে গেল।

রাতে খাওয়ার সময় মা অনুনয়ের সুরে বললেন, ভর্তিটা হয়ে যা, ঐ বাড়ির রমজান কবেই ভর্তি হয়ে গেছে, আর নাকি সময় নাই। কালই গিয়ে ভর্তি হ, কি বলিস? হাসান মাথা নিচু করে খাওয়া চালিয়ে গেল কোন কথা বলল না। মা বুঝলেন, ও জেদি গোয়ার, জোর করে বাধ্য করে কোন কাজ করানো যাবে না, যা করার বুঝিয়ে শুনিয়ে করাতে হবে। হাসান খাওয়া শেষ করে চলে গেল। মা এবার ফন্দি আটলেন, লোভ দেখানোর ফন্দি। তবে মা হয়ে তিনি কথাটা বলবেন কেমনে, তার লজ্বা পাচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে, কিন্তু না বলে উপায় কি? দ্বিধা সঙ্কোচ নিয়ে তিনি হাসানের রুমে গেলেন। সে চেয়ারে বসে আছে। তিনি খাটের পাশে বসে বললেন, দেখ তোর দুলা ভাইরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত, চাকরি করে। তুই তাদের কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকবি এটা তো আমার কাছে ভাল লাগবে না। এবার তিনি মাথা নিচু করে লজ্বিত কণ্ঠে বললেন, তাছাড়া আগে থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত ফেরদৌসিকে তোর সাথে বিয়ে দিব। ওর এস এস সি পরীক্ষার পরেই তোদের বিয়ে দিব। তোদের বাচ্চা কাচ্চা হবে, তখন চাকরি না করলে বউ বাচ্চা নিয়ে চলবি কেমনে। তাছাড়া সব জামাইরা চাকরি করে আর তুই চাকরি না করলে তো ফেরদৌসির মনটাও ছোট থাকবে। এজন্যই বলছি কাল গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে যা, কি বলিস?

হাসানের অবস্থা কাহিল, সে জানে ফেরদৌসির সাথে তার বিয়ে হবে কিন্তু অভিভাবকদের কাছে এ পর্যন্ত শুনেনি। এখন মায়ের মুখে তা শুনে বেচারা যেন লজ্বায় মিইয়ে গেল। তার রক্ত সঞ্চালন গতি বেড়ে গেছে, বুক ঢিবঢিব করছে, মাথা ঝুকে আছে। সে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। মা হাসি মুখে উঠে রওয়ানা হলেন। আর সাথে সাথে পাশের রুম থেকে কেউ দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসল। মা ঘর থকে বেরিয়ে খাওয়ার জন্য রান্না ঘরে চলে গেলেন। হাসানের সাথে বিয়ের কথা শুনলেই ফেরদৌসির দেহটা যেন পাট কাঠির মত পাতলা হয়ে যায়, হাত দুটি পাখা হয়ে যায়, মন ময়ুরি পাখনা মেলে। তখন সে মুক্ত বিহঙ্গের মত অনন্ত আকাশের নীলিমায় উড়ে বেড়ায়।

সে আনন্দাতিশয্যে যেন উচ্ছাসের পাখায় ভর করে হাসানের রুমে চলে গেল। তার চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। হাসান বলল, দাঁত বের করে হাসছিস কেন? ফেরদৌসি ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের বিয়ের প্রস্তাব, হাসানের কলেজে ভর্তি হওয়ার সম্মতি সব কথাই শুনেছে। খুশীর আধিক্যে ‘তোকে একটা উপহার দিব’ বলে পায়ের কাছে বসে সেলাম করল। হাসান বলল, সেলাম করলি কেন? - একদিন তো করতেই হবে, তাই অগ্রিম করে রাখলাম। হাসান আবেগাপ্লুত হয়। ফেরদৌসি হাসানের উরুর উপর মাথা রেখে অন্তহীন মমতায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোকে বড়াপা (মাজেদা) নূরানি আপা ও তাদের দুই জামাই দেখতে পারে না। তারা চায় না আমাদের বিয়ে হউক। এ জন্যই তোর কাছে আমার দাবী, তুই অনেক বড় শিক্ষিত হবি, অনেক বড় চাকরি করবি, ওদেরকে গোলাম বানাবি। তুই অনেক মেধাবী, তুই তা পারবি।

হাসান হবু স্ত্রীর ভালবাসায় নিসিক্ত হয়ে যায়, সে অন্তহীন মমতায় তার মাথা ও মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, হাঁ আমাকে অনেক বড় হতে হবে, অনেক। তারপর ওর থুতনি ধরে মুখটা তুলে গভীর আবেগে হবুবধুর কমলগণ্ডে চুম্বনবৃত্ত এটে দিল। ফেরদৌসি লজ্বায় লাল হয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পরদিন হাসান গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল।

তখন সময়টা চলছিল ব্যামো সিজন। সর্বত্র রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। ঘরে ঘরে দুয়েক জন সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছে। হাসান সকালে খেতে গেল, ভাত বেড়ে দিলেন মা কিন্তু তার কাছে এটা ভাল লাগল না। কারণ দীর্ঘ দিন ধরে তাদের নিয়ম চলে আসছিল- সকালে ফেরদৌসি ভাত বেড়ে দিত, দুজন এক সাথে খাওয়া দাওয়া করত, হাসি কৌতুক করত। দুপুরে ফেরদৌসি সাধারণত স্কুলে থাকত, আর রাতের বেলা দুজনের এক্ত্র হওয়ার অনুমতি ছিল না। তখন মা ভাত বেড়ে দিতেন। কাজেই সকালে ফেরদৌসিকে না পেয়ে হাসান মনঃক্ষুন্ন হল। সে মাথা ঘুরিয়ে এদিক সেদিক খুজল কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেল না, আবার মাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও লজ্বাবোধ করল। খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে গিয়ে দেখল সে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। হাসান টান দিয়ে মুখের উপর থেকে কাথা সরিয়ে বলল, কিরে শুয়ে আছিস কেন। সে হাসানের দিকে তাকাল- চোখ দুটি লাল টকটক করছে, চাহনিটা কেমন মায়াময়, অসহায় ভাব। সে কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল ‘অ্যা, শরীর তো জ্বরে পোড়ে যাচ্ছে, আমাকে আগে বলিসনি কেন, কখন জ্বর উঠল? ফেরদৌসি ‘রাত থেকে’ বলে আবার কাথা মুরি দিল। হাসান মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। তারপর সে বাজারে চলে গেল।

মা বৃদ্ধ এবং কিছুটা অসুস্থ, তার মেয়েলি একটা রোগে কাবু হয়ে গেছেন। সুতরাং স্ব গরজেই হাসান ফেরদৌসির দায়িত্ব গ্রহণ করল। রাত একটা দুইটা পর্যন্ত ফেরদৌসির কাছে বারবার আনাগুনা করে, কখনো মাথায় পানি দেয়, কখনো ঔষধ খাওয়ায়, কখনো শিয়রের ধারে বসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এভাবে আটদিন চলে গেল, জ্বর সর্দি কাশি বেরেই চলেছে, উন্নতির লক্ষণ নাই। বেচারি খুব দুর্বল হয়ে গেছে, কথা বলে আনুনাসিক ক্ষীণ কণ্ঠে। আট দিন পর দুপুরে সে হাসানের হাত ধরে করুন সুরে বলল, আমাকে তোর পাশের রুমে নিয়ে যা, তোর কাছাকাছি থাকলে আমি তাড়াতাড়ি সেরে উঠব। তার চোখে জল, কণ্ঠে মিনতি ঝড়ে পড়ছে। হাসানের মায়া হল। সে মাকে বলল, আম্মা ওকে আমার পাশের রুমে নিয়ে যাই, তাহলে সব সময় দেখা শুনা করতে আমার সিবিধা হবে। মা জানেন, তিনি কোন দায়িত্ব পালন করছেন না, যা করার সব হাসানই করছে, তবুও কর্তব্যের খাতিরে জিজ্ঞেস করলেন, তুই দেখাশুনা করতে পারবি তো? হাসান ‘পারব’ বলে তার প্রিয়জনকে কাছে নিয়ে গেল।

এখন সারাক্ষণ সে ফেরদৌসির কাছে থাকে, সেবা শ্রশ্রুসা করে, মাথায় পানি দেয়, কিছুক্ষণ পরপর কপালের জলপট্টি বদল করে দেয়। কাপুনি উঠলে জড়িয়ে ধরে শরীরের চাপ দিয়ে রাখে। রাত্রে কখনো তার কাছে খাটের এক পার্শ্বে শুয়ে ঘুমায়। বারদিন কেটে গেল, দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। শুকিয়ে মুখটা ছোট হয়ে গেছে, বুকের হাড় ভেসে উঠেছে, চোখ দুটি জ্বালাময়, শূন্য, যেন দুনিয়ার হতাশা ও নৈরাশ্য সেখানে বাসা বেধেছে। খাওয়া প্রায় বন্ধ, কখনো সেলাইন দেয়া হয়, কখনো জোরজার করে তরল জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়। বেচারি এত দুর্বল হয়েছে যে, কথা বলতে পারে না, কথা হয় অস্পষ্ট, ঠোঁটে বেজে থাকে। শুয়ে থাকলে মনে হয় যেন একটা কংকাল বা শবদেহ পড়ে আছে। হাসান তার দিকে তাকাতে পারে না, বুকটা হাহাকার করে উঠে, নিজেকে অসহায় বোধ করে, সে নিভৃতে চোখ মুছে। কি করবে ভেবে পায় না, সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করছে, দুয়েক দিন পরপর ভিজিট দিয়ে ডাক্তার বাড়িতে ডেকে আনছে। তবুও অবস্থার উন্নতি নাই।

মেয়ের অবস্থা দেখে মা শিয়রে বসে বসে কাঁদে, জায়নামাজে পড়ে পড়ে কাঁদে। ফেরদৌসি কিছুক্ষণ পরপর উঠা বসা করে, আবার একটু পরপর তার মাথায় পানি দিতে হয়, ললাটের জলপট্টি পরিবর্তন করে দিতে হয়। এসব খেদমত করতে করতে রাত বারটার দিকে হাসান ক্লান্ত হয়ে এল, তার ঘুম পাচ্ছে, সে উঠে গিয়ে নিজের রুমে শুয়ে পড়ল। দুশ্চিন্তার সময় ঘুম হালকা হয়। ঘণ্টা দুয়েক পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে আস্তে আস্তে গিয়ে পাশের রুমে দাঁড়াল। ফেরদৌসি এক দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে, নিস্পলক, নিস্পন্দ, নির্বাক, কোন নাড়াচাড়া নেই, যেন একটা মৃত কঙ্কাল পড়ে আছে। হাসান চমকে উঠে ডাকল, ফেরদৌসি ফেরদৌসি’ কিন্তু কোন সারা নেই। মরে গেল কিনা আশংখায় সে আর্তনাদ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কাঁধ ধরে ঝাকি দিয়ে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। ফেরদৌসি ঝাকি খেয়ে চেতনা ফিরে পেল, হাসানের দিকে তাকাল, তার হাতটা নিজের হাতে নিল, কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর অন্তিম যাত্রির মত ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ভাইয়্যা আমি মনে হয় আর বাঁচব না, আমাকে মাফ করে দিস। আবার কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল, ‘আব্বা আম্মার আশা ছিল তোর সাথে আমার বিয়ে দিবে ..... তারপর সে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল, কান্নার দুরন্ত ঢেউ আটকাতে গিয়ে তার শরীরটা কাঁপছে। মৃদু সুরে বলল, আমাদের বুঝি আর সংসার করা হল না’ বলে গুমরে কেঁদে উঠল। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, চোখের কোন বেয়ে ঝড় ঝড় করে অশ্রুর ফোটা গড়িয়ে পড়ছে।

হাসান পাথরের মত জমে গেছে, মৃন্ময় প্রতিমার মত তার দুটি চোখ নিশ্চল নিথর। সেখানে অশ্রু নেই, ভাষা নেই, আবেগ নেই, কান্না নেই- আছে শুধু গাঢ় অন্ধকার, হতাশা আর নৈরাশ্য। সে কোন কথা বলল না, আস্তে আস্তে উঠে গেল। টিউবওয়েল চেপে অজু করে এসে নামাযে দাঁড়াল। নামাযের পর হাত উঠাল, তার কণ্ঠে যেন ভাষা যোগাল না, জার জার হয়ে কাঁদতে লাগল। শুধু বলতে পারল, ‘মালিক আমার, বাল্যকাল থেকে দুটি প্রাণী একসাথে হেসে খেলে বড় হয়েছি, একে অন্যের সাথে মিশে গেছি, দুটি জীবন এক হয়ে গেছি। এখন তুমি একটি জীবন কেড়ে নিলে অপর জীবনটা পঙ্গু হয়ে যাবে, অভিশপ্ত হয়ে যাবে। জীবন মৃত্যুর মালিক ওগো, তুমি ওকে আমার জীবন থেকে কেড়ে নিও না। আমার মত এক নিঃস্ব অসহায় ইয়াতিম বালকের জন্য ওর জীবনটা আমাকে ভিক্ষে দাও। তোমার কলমের ফয়সালা হয়ে গেলে দু’জনকে একসাথে উঠিয়ে নাও, আর বাঁচিয়ে রাখলে দুজনকে একসাথেই বাঁচিয়ে রাখ। ওকে ছাড়া আমার জীবন অভিশপ্ত। রহমান ও রহিম ওগো, এমন একটা নিঃসহায় ইয়াতিম বালককে তুমি অভিশপ্ত করো না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না’। সে আর কথা বলতে পারল না, তার হৃদয় সিন্ধুতে বিষাদের টর্নেডো আঘাত হানল, এর উত্তাল উর্মিমালা আঁচড়ে পড়ে বুকের পাজর যেন ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। কষ্টাতিশয্যে সে আর বসে থাকতে পারল না, জায়নামাজে গড়িয়ে পড়ল, তারপর শুধু কোকানো আর গোঙ্গানোর শব্দ পাওয়া গেল।

ফেরদৌসি পাশের রুম থেকে সব শুনছে, সে মরার মত টলতে টলতে উঠে এসে হাসানের উপর গড়িয়ে পড়ল। তাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে রিক্তের মত মাতম শুরু করল, আর কাদিস না, তুই এভাবে কাদলে আমি মরে যাব। উঠ, আর কান্দিস না’ সে হাসানের বাহুতে মাথা ঠুকছে আর বিলাপ করছে ‘আর কাঁদিস না, আমি ভাল হয়ে যাব, এই যে দেখ আমি ভাল হয়ে গেছি। হাসান সহসা সম্বিত ফিরে পেল, ফেরদৌসিকে দেখে চমকে উঠল, ‘তুই এখানে কেন, কিভাবে এলি? তারপর তাকে ধরে নিয়ে পাশের রুমের বিছানায় শুইয়ে দিল। ফেরদৌসি জানত হাসান তাকে ভালবাসে কিন্তু কতটুকু ভালবাসে তা জানত না, আজ বুঝল। তার চোখ দুটি বাস্পায়িত হয়ে উঠে, স্বপ্নময় হয়ে উঠে, তনুমন আপ্লুত হয়, সে বাঁচতে চায়, হাসানের জন্য বাঁচতে চায়। হাঁ সে বাচবে, শুধুই হাসানের জন্য বাচবে। কারণ তাকে ছাড়া যে হাসান বাচবে না।

হাসানের ভালবাসা তার মনে শক্তি এনে দেয়। মৃত বাসন্তী বিটপীর পত্র পল্লবের ন্যায় তার দেহটা সজিব হয়ে উঠতে থাকে। তিন দিন পর সে বিছানা ছেড়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করল কিন্তু খুবই দুর্বল। হাসান আনন্দ উল্লাসে গ্রামময় ঘুরে ঘোরে ডিম কিনে আনল, দুধ রোজিনা করে দিল। তারপর ফেরদৌসিকে ধমকাল, ঠিকমত খেয়ে দেয়ে স্বাস্থ্যটা ঠিক কর, একদম ছোট বেলার মত ভটকি হয়ে যাবি। সামনে তোর পরীক্ষা এসে গেছে।

বিষয়: সাহিত্য

৭৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File