হাসান ফেরদৌসি - ১১

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ০৪:০৬:২৯ বিকাল

১৭

ফেরদৌসি সব সময় হাসানের পিছু লেগে থাকে আর ঘ্যান ঘ্যান করে ‘আম্মাকে গিয়ে বিয়ের কথা বল, পরীক্ষা শেষ হয়েছে কবে এখন আর দেরি কেন, এভাবে আমার আর ভাল্লেগেনা। আসলে তখন সে স্বামীর বাহুবন্ধনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছে। হাসান বলে, ‘আমি পারব না, আমার শরম করে, তুই ক গিয়ে। ফেরদৌসি ঝংকার কাটে, আরে বোকা মেয়েরা কখনো বিয়ের কথা কয় নাকি, ছেলেদের বলতে হয়, তুই যা। কিন্তু হাসান রাজি হয় না, লজ্বা পায়, ইতস্তত করে। ফেরদৌসি সাহস যোগায় ‘তুই যা, আমি তোর সাথে থাকব। তবুও সে সাহস পায় না, যাই যাব করতে করতে সময় গড়াতে থাকে। এর মধ্যে একদিন ইঞ্জিনিয়ারের অফিসের গাড়ি হাকিয়ে মাজেদা ও নুরানী বাপের বাড়ি এল। তারা খুব হাসি খুশি প্রানোচ্ছল। আগে থেকেই তারা হাসানকে দেখতে পারত না, কথা বলত না, চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকত। হাসানও তাদেরকে ভয় পেত, যথা সম্ভব তাদের থেকে অন্তত পাঁচশ গজ দূরত্ব বজায় রেখে চলত। কিন্তু এ তারিখে তারা হাসানের সাথে মধুর ব্যবহার করল। মাজেদা তাকে ডেকে হাসি মুখে বলল, ‘হাসান ভাইয়্যা তোমার সংসার কেমন চলছে? নুরানী বলল, আমাদের হাসান আসলেই খুব ভাল ছেলে, দেখ কত সুন্দর সংসার চালাচ্ছে, উন্নতি করছে। সে না থাকলে এত সুন্দর করে কে সংসার চালাত। তারপর দু’জন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। হাসান লজ্বায় মাথা নত করল।

মাজেদা মাকে বলল, একটা অনুষ্ঠান আছে চল, তোমাদেরকে নিতে এসেছি। অনুষ্ঠানের কথা শুনেই ফেরদৌসি আনন্দে লাফিয়ে উঠল, ‘আমি যাব’। তারা দু’জন মুখ টিপে হাসল। কারণ তারা তো তাকেই নিতে এসেছে। নূরানি মনে মনে বলল ‘হারামজাদী, আমাদেরকে অপমান করার পরিণতিটা এবার ভোগ করবি, তোকে সতিনের ঘর করিয়ে ছাড়ব। ফেরদৌসির ইচ্ছা ছিল হাসানকে নিয়ে যাবে, আনন্দ করবে কিন্তু খালী বাড়ি, তাছাড়া তার বোনেরা এটা মেনে নিবে না। তাই সে নিভৃতে হাসানকে বলল, তুই থাক আমরা কাল অথবা পরশু ভোরেই চলে আসব। তারা বিকালে রওয়ানা হয়ে গেল। পরদিন বিকালে হাসান অভ্যাস মত বাইরে না গিয়ে তার রুমে মনমরা হয়ে বসে আছে। তার রুমটা সর্ব দক্ষিণে, বাহির থেকে আসলে এ রুমের দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকতে হয়। হঠাৎ তারা উপস্থিত। মা আগে ঢুকলেন পেছনে ফেরদৌসি, সে নেকাবটা টেনে কটাক্ষে হাসানের দিকে তাকিয়ে অগ্নি দৃষ্টি হেনে হাত পা নাচিয়ে ভীতরে চলে গেল। বুঝাই যাচ্ছে সে রাগে অগ্নিবৎ উত্তপ্ত হয়ে আছে। ঘরে গিয়ে বোরকাটা খুলেই বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগল আর মাকে ঝেংড়াতে লাগল ‘তুমি আমাকে নিয়ে গেলে কেন, ওরা কি চায়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমাকে পাবে না, আমি গলায় দড়ি দিব। এরপর সে মাজেদা নূরানী ও তাদের জামাইদের অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। তারপর কখনো মাকে বকে, কখনো হাসানকে বোকা ভিতু কাপুরুষ ইত্যাদি বলে বকতে থাকে।

মাগরিবের পর হাসান তার রুমে বসে পড়ছে, ফেরদৌসি ধীরে ধীরে এসে তার খাটের পাশে বসল। তারপর মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সহসা সূর্যকিরনের ন্যায় বিষণ্ণ মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ব্যঙ্গ সুরে বলল, ‘কিগো মহামান্য বীর বাহাদুর, বেশ তো সুখেই আছেন দেখছি। আপনার বউকে আরেক জন নিয়ে যাচ্ছে, আপনার তো খুশি হবারই কথা, তাই না? আর আমার তো আরো ভাল, বড় লোক জামাই পাব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বউ হব, বাহঃ কত সুখ কত আনন্দ, একেবারে সম্রাজ্ঞি। তোর মত একটা ছিন্নমূল ছন্নছাড়া রাস্তার ছেলেকে বিয়ে করব কেন? তারপর বাঘিনীর মত লাফিয়ে উঠে গিয়ে হাসানের চুল ধরে প্রচণ্ড টান মারল। সে পড়তে পড়তে টাল সামলে বসল। তখন ফেরদৌসি তার মাথা ঘাড় ও পিঠে দু’হাতে অনবরত কিলাতে লাগল আর বিলাপ শুরু করল, ‘তোরা আমাকে কি পেয়েছিস, আমি কি মানুষ না, আমার কি মন নাই, আমার মনের দাম নাই, একবার একজনকে মন দিব আরেক বার আরেক জনকে, আমি কি বাজারি বেশ্যা’ বলে অন্তহীন দুঃখে তার মুখটা হা করে উঠল, দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। তারপর মাতম শুরু করল ‘ওরা আমাকে বড় লোক দেখে বিয়ে দিবে, একটা দেহ কেটে দুই টুকরা করে আমার দেহটা অন্যকে দিয়ে দিবে, আত্নাটা মেরে দেহটা কুকুরে টেনে নিয়ে যাবে’ ইত্যাদি বিলাপ করতে করতে সে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।

একটা গরম লৌহ শলাকা যেন হাসানের বুকটা এপোর ওপোর করে দিয়েছে, সে নির্বাক, নিস্পন্দ, পাথরের মুর্তির মত জড়বৎ বসে আছে। কান্না শুনে মা দৌড়ে এলেন, কি হয়েছে? ফেরদৌসি ঝংকার দিয়ে উঠল, কি হয়েছে তুমি জান না, ন্যাকামি কর? হাসান ভাবল ‘এই সুযোগে কথাটা বলে ফেলা দরকার। সে বলল, ও ও--- সাহস পাচ্ছে না। মা বললেন হা কি? সে বলে ফেলল, ও বিয়ের কথা বলছে। মা গম্ভীর হলেন, কিছুক্ষণ নির্বাক বসে থাকলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বিয়ের কথা তো আমিও ভাবছি কিন্তু কি করব বল, মাজেদা নূরানী ও তাদের জামাইরা তোকে দেখতে পারে না। এ ছাড়া নূরানীর জামাইকে বিয়ের দিনেই তুই রাগিয়ে তুলেছিস। ওরা চায় না তোদের বিয়ে হউক। নূরানীর জামাই ঢাকা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে, ছেলে ডক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, অনেক বড় লোক। সে দুইদিন আগে জামালপুর এসেছে মেয়ে দেখতে। আর তাকে দেখানোর জন্যই কৌশলে কাল আমাদেরকে নিয়ে গেছে। এরপর কৌশলে মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করল অথচ আমরা কিছুই টের পাইনি। ফেরদৌসি যখন টের পেল তখন সে বোরকা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল। সবাই থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু সে একদম রোডে এসে দাঁড়াল, তখন আমিও চলে আসলাম।

এরপর তিনি বললেন ‘এখন কি করব বল, মেয়ে ও মেয়ের জামাইদের ছাড়া তোদের বিয়েটা আমি কেমনে দেই। তখন ফেরদৌসি চেঁচিয়ে উঠল, কেন, তাদের কি দরকার। আমরা কি তাদের ভাত খাই, নাকি তাদের কথায় চলি। ওরা আমার কেউ না, আমার শত্রু, তুমি দুই দিনের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করবে, নইলে কিন্তু পড়ে পস্তাবে’ বলে সে গড়গড় করে চলে গেল। মা কিছুক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে বসে থেকে ‘আচ্ছা দেখি কি করা যায়’ বলে চলে গেলেন।

বিকালে হাসান ঘোরাফিরা করে। অভ্যাস অনুযায়ি বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাচ্ছে। উত্তর দিকে তাকাল, মাঠের মাঝখানে ফেরদৌসির মত কে যেন একজন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ভিটার দিকে ইঙ্গিত করছে। হাসান মন্থর গতিতে ভিটায় গেল, ততক্ষণে ফেরদৌসিও কাছে এসে গেছে। দু’জন গিয়ে আম গাছের আড়ালে গাছের শিকড়ে পাশাপাশি বসল। ফেরদৌসি গম্ভীর বিষণ্ণ, তার মুখটা ব্যাথা ভারাক্রান্ত। হাসান মায়ামাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিরে তোর কি হয়েছে, এমন দেখাচ্ছে কেন? সে কোন কথা বলল না, সহসা হাসানের হাতটা নিয়ে নিজের মাথায় চেপে ধরে করুন সুরে বলল, ‘ওয়াদা কর, আমাদের সন্তানাদি হলে যদি আমি মরে যাই তাহলে তুই আর বিয়ে করবি না, আমার বাচ্চাদের মায়ের আদর দিয়ে লালন পালন করবি। হাসান হাত টেনে নিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। আরে বিয়ের খবর নাই আগেই বাচ্চা লালন পালনের চিন্তা। তাছাড়া তুই মরলে--- একেবারে ডুকরে কেঁদে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল ‘তুই মরে গেলে আমি কি নিয়ে বাচব, কেন বাঁচব, কাকে নিয়ে বাঁচব। ফেরদৌসিও তার কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, ‘তুই আমাদের সন্তানদের নিয়ে বাঁচবি, তাদের জন্য বাঁচবি। তারপর জড়াজড়ি করে দু’জনে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ হাসান তার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে হাসতে লাগল, তুই আসলেই একটা পাগল, হঠাৎ কোন প্রসঙ্গ নাই উপলক্ষ নাই একটা ফাও আলাপ ফেদে বসেছিস আর আমিও হাদারাম বউ হারানোর কান্না জুড়ে দিয়েছি।

ফেরদৌসি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ফাও আলাপ না, ডেলিবারির সময় উত্তর পাড়ার রশিদের বউ মারা গেছে, আমি সেখান থেকেই আসলাম। রসীদ তার মেয়ে দু’টিকে কোলে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে ‘আমি আর বিয়ে করব না, আমার বাচ্চাদের আমি নিজ হাতে লালন পালন করব, নিজে রেধে বেড়ে খাওয়াব, নিজে গোসল করাব, নিজে ঘুম পারাব। আমিই ওদের মা, মায়ের আদর দিয়ে ওদেরকে আমি মানুষ করব। তার কান্না দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি, আমিও কেদেছি। তারপর সহসা হাসানের হাত টেনে নিয়ে আবার তার মাথায় চেপে ধরে বলল, শপথ কর আমি মরে গেলে তুই আমার বাচ্চাদের মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করবি। সহসা হাসানের বুকে সাত সাগরের জোস উঠল, সে অন্তহীন আবেগ নিয়ে ফেরদৌসির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তার ঠোঁট কাঁপছে, নাক ফুলে ফুলে উঠছে, শরীরটা কাঁপছে, টপটপ করে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ প্রিয়ার মাথায় হাত রেখে সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল, ‘এমন যদি কখনো হয়--- এমন যদি হয়--- তাহলে কথা দিলাম, তোর সাথে আমিও মরব, তুই না থাকলে আমি বেঁচে থাকব না’ বলে লাফিয়ে উঠে হনহন করে চলে গেল।

ফেরদৌসিদের পাশের ঘরের চাচাত ভাই ফারুক সরকারি চাকুরে, জামালপুর টাউনেই থাকে। তার দৃষ্টিতে হাসান ফেরদৌসি একটা আদর্শ জুটি, মানিক জোড়, সে চায় ওদের বিয়ে হউক। কিন্তু বিয়ে নিয়ে গণ্ডগোল চলছে তা সে জানে, এজন্য গোপনে খুঁজ খবর নেয়। সে বাড়িতে এসেছে। সন্ধ্যার পর ফেরদৌসিদের ঘরে এসে তার মাকে বলল, চাচী কিছু খবর রাখেন? মা বললেন ‘কোন খবর? ফারুক বলল, ফেরদৌসির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আগামি পনের তারিখ শুক্রবারে বিয়ে। মা চমকে উঠলেন, এটা কি করে সম্ভব, আমাকে না জানিয়ে ওরা তারিখ দেয় কেমনে? - আপনাকে জানালে তো বিয়েই হবে না, আর তারা তো আপনাকে কর্তা মনে করে না। আমি গোপনে জানতে পেরেছি, তাদের সিদ্ধান্ত হল- হাসানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে, তারপর ঐ ভার্সিটির শিক্ষকের সাথে বিয়ে দিবে। সংবাদটা শুনেই ফেরদৌসি বিছানায় গড়িয়ে পড়ল, শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। ফারুক বলল, এখন আপনি যদি ওদের বিয়ে দিতে চান, তাহলে আমার পরামর্শ হল, তাদেরকে না জানিয়ে গোপনে দুয়েক দিনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দেন। সে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে ও পরামর্শ দিয়ে চলে গেল আর ফেরদৌসি শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল।

হাসান তার ঘরে বসে পড়ছে। ফেরদৌসি এসে হঠাৎ তার চেয়ারে ধাক্বা মেরে বলল, উঠ। হাসান পেছন ফিরে তাকাল, তার চোখ ফোলা, লাল হয়ে আছে- কান্নার আলামত। হাসান ‘কি হয়েছে’ বলে উঠে দাঁড়াল। ফেরদৌসি তার হাত ধরে বলল ‘গাধা এখনো বসে আছিস আর ওরা বিয়ের তারিখ দিয়ে দিয়েছে, পনের তারিখ নাকি বিয়ে। এখন চল আম্মাকে গিয়ে বলবি ‘এক্ষন, এ মুহুর্তে আমাদের বিয়ে দিতে। তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। মা রান্না ঘরে, হাসান গিয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়াল কিন্তু কথা বলছে না, সাহস পাচ্ছে না, ফেরদৌসি তার পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠে গুতাচ্ছে। হাসান বসল সেও তার পাশে বসল। তারপর বলল, আম্মা পনের তারিখ নাকি ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে আপনি আজই আমাদের বিয়ে দিন’ বলে সে মাথা নিচু করে বসে রইল। ফেরদৌসি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কিছু না বলে চুলার আগুনটা হালকা করে দিয়ে উঠে বললেন, আয় আমার সাথে।

ঘরে গিয়ে তিন জন পাশাপাশি বসল। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে মা বললেন, এভাবে তো আর বিয়ে হবে না, তুই কাল সকালে টাউনে যা, তোর জামা কাপড় জুতা, ওর জন্য শাড়ি জুতা নাকফুল, একটা পাটি ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আয়। অলংকার তো আমার আছেই। কাল রাতেই তোদের বিয়ে দিব ইংশাল্লাহ। টাকা কত আছে দেখ, কম থাকলে ধান বিক্রি কর। টাকার হিসাব ফেরদৌসির কাছে থাকে, সে বলল ছয় হাজার টাকা আছে, ধান বেচতে হবে না। মা আরো দু’চার কথা বলে রান্না ঘরে চলে গেল। ফেরদৌসি বিছানায় শুয়ে পড়ল, ওড়নায় মুখ ঢেকে আছে। হাসান উচ্ছাসের পাখায় ভর করে অনন্ত আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, তার অন্ধকারময় পৃথিবীতে যেন সহসা সূর্যোদয় ঘটল। সব কিছুই আলোকোদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, তার আজন্মের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। সে ফেরদৌসির দিকে তাকাল, শিহরণ অনুভব করল, ভিতরটা তোলপাড় করে যাছে, রোমাঞ্চিত হচ্ছে। কারণ এখন এই আস্ত মানুষটা তার, এই শরীরটা তার, শুধুই তার, তার অর্ধাংশ। সে আস্তে আস্তে স্ত্রীর মুখের উপর উপোর হল, মুখ থেকে ওড়না সরাল। ফেরদৌসি তার দিকে কৃতজ্ঞ কুকুরের মত তাকিয়ে আছে, চোখে অশ্রু, এই অশ্রু বেদনার নয় খুশির, হারানোর নয় প্রাপ্তির, যাতনার নয় উচ্ছাসের। হাসান একটা চুম্বন দিয়ে চলে গেল।

সকালে হাসান মার্কেট করতে চলে গেল। মা আলমারি খুলে হিরণ্ময় কারুকার্য খচিত একটা ছোট বাক্স বের করলেন। তারপর ফেরদৌসিকে ডেকে নিয়ে বসলেন। বাক্স খোলে একটা কণ্ঠহার বের করলেন। প্রাচীন ডিজাইনের স্থুল কারুকার্যময় অনেক বড় কণ্ঠহার, বর্তমানে এটা ভেঙ্গে পাঁচ সাতটা হার বানানো যাবে। যথেষ্ট মোটা সোটা দুইটা বালা ও কানের দুল বের করলেন। দেখেই বুঝা যায় এগুলি প্রাচীন নকশা ও পুরাতন আমলে গড়া। মোটা কারুকার্য, একেকটায় যেন স্বর্ণের স্তুপ। বর্তমান যুগানুপাতে এগুলি ভেঙ্গে কয়েক সেট অলংকার গড়া যাবে। মা সেগুলি বের করে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন আর ফেরদৌসি হাতে নিয়ে উল্টা পাল্টা করে দেখতে লাগল। তারপর তিনি ফেরদৌসিকে একটা একটা করে অলংকার পড়াতে লাগলেন আর শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন ‘এই অলংকার গুলি হাসানের বাপে আমার বিয়েতে উপহার দিয়েছিল। তার সেই উপহার আজ সঠিক কাজে লাগল। সে বেঁচে থাকলে নিজ হাতে তার পুত্র বধূর গলায় অলংকার পরিয়ে দিত। সে নাই, কাজেই আমার হাতে আজ তার পুত্র বধূর গলায় তারই দেয়া অলঙ্কারগুলি পরিয়ে দিলাম। উসমান ভাই বেঁচে থাকলে আজ কত যে খুশি হত, তার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে আমরাও কত খুশি হতাম, আনন্দ করতাম, উৎসব করতাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, হাসানেরও ভাগ্য মন্দ তোরও ভাগ্য মন্দ- এমন একজন মহান মানুষকে শ্বশুর হিসাবে পেলি কিন্তু তার মুখটা দেখার ভাগ্যও হল না’ বলে তিনি জারজার হয়ে কাঁদতে লাগলেন। আর লোকান্তরিত শ্বশুরের মায়ায় ফেরদৌসিও কাঁদতে লাগল।

তারপর মা আশপাশ ঘরে ফেরদৌসির চাচা ও চাচাত ভাইদের গিয়ে বলল, ফেরদৌসির বাবার আগে থেকেই নিয়ত ছিল হাসানের সাথে ওর বিয়ে দিবেন কিন্তু হায়াত নাই। মরার সময় আমাকে অসিয়্যত করে গেছেন ওদের বিয়ে দিতে। কিন্তু আমার মেয়েরা ও মেয়ের জামাইরা এটা হতে দিচ্ছে না। তাই আমি কাউকে না জানিয়ে একাই ওদের বিয়ে দিব। আপনারা রাত্রে উপস্থিত থেকে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করে দিবেন। তারপর মাদরাসার বড় হুজুরকে ডেকে এনে সব কিছু জানিয়ে বললেন, রাত্রে আপনি বিয়ে পড়াবেন আর কাজি আনার দায়িত্বও আপনার উপর থাকল। এদিক দিয়ে মোটামোটি সব প্রস্তুত করলেন। হাসান মার্কেট করে ফিরার সময় পটেটো তাকে রিকশায় দেখল। সাথে ব্যাগ ও অন্যান্য আসবাব পত্রও দেখল কিন্তু হাসান তাকে দেখতে পায়নি। বিকালে বাড়িতে ফিরে সে আবার বিভিন্ন সওদার জন্য বাজারে দৌড়াল।

বিশাল বাড়িতে বিয়ের কোন খবর নাই কিন্তু এই ঘরটাতে বিয়ের আমেজ উথলে উঠছে। ভয় দ্বিধা ও আশংখার মধ্যেও সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিয়ের বারোয়ারি সানাই বেজে উঠেছে। দুটি যুবক যুবতি আনন্দ সরোবরে অবগাহন করছে। মা খোঁয়াড়ের দুইটা মোরগ ধরেছেন, অন্তত কিছু মেহমান তো থাকবে, তাদের আপ্যায়নের জন্য গোশত পোলাও সেমাই লাচ্চা ইত্যাদি রান্না বান্নায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। দু’পাশের ঘরের বৌ ঝিয়েরা এসেছে, বড়রা মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে আর মেয়েরা ফেরদৌসিকে নিয়ে মেতে উঠেছে। সন্ধার পর মেয়েরা বর কনেকে গোসল করাতে নিয়ে গেল। ফেরদৌসিকে বাথরুমে আর হাসানকে কলপাড়ে গোসল করানো হচ্ছে। ললনারা ফেরদৌসির গায়ে হলুদ মাখছে আর গীত গাইছে, ‘লিলাবালি লিলাবালি লীলা যুবতি সই গো কি দিয়া সাজাইমু তরে---

আবার বনিতারা ‘দুলহানের গায়ে সাবান নেই’ বলে হাসানের গায়ে প্যাক কাদা মাখছে। কম বয়সি বর, সেও আনন্দে মেতে উঠেছে, কখনো মেয়েদের গায়ে প্যাক কাদা দেয়, কখনো পানি দেয়, কখনো বাথরুমে দৌড়ে গিয়ে ‘কই আমার নতুন বউ’ বলে কনের গায়ে কাদা মাখিয়ে দেয়, কখনো বাটা হলুদ মুখে পোরে দেয়।এভাবে আনন্দ করছে আর মেয়েরা হাসাহাসি হৈ হুল্লোর করছে। একবার হাসান পাশের ঘরের এক ভাবীকে কাদা দেয়ার জন্য দৌড়াল, ভাবী এক লাফে রান্না ঘরে গিয়ে মায়ের পিছনে দাঁড়াল, হাসান সেখানেই কাদা নিয়ে গেল। মা দেখেই একটা চেলা কাঠ নিয়ে মারতে এলেন। পাশের ঘরের চাচী লাফিয়ে উঠে গিয়ে তার হাত ধরলেন, ‘আরে আরে কর কি কর কি, বিয়ের দিন মারতে নেই’। মা ঝংকার দিয়ে উঠলেন, মারব না তো কি করব, দেখেন না দুই ঘণ্টা ধরে কি আবিল্লিটা করতেছে। তারপর হাসানকে তাড়া দিয়ে বললেন, যা তাড়াতাড়ি গোসল শেষ কর। এবার সবাই শান্ত হয়ে গোসলে মনোযোগ দিল।

অবশেষে গোসলের কাজ শেষ করে তাদেরকে সাজানোর জন্য একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হল। বর কনে এক ঘরে, তারা একে অন্যের প্রতি কটাক্ষে তাকায়, চার চোখের মিলন হলেই লজ্বা পায়, চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েরা প্রথমে হাসানকে বরের পোশাক পরাল, তারপর তার থাকার কামরা- সর্বদক্ষিনের রুমে গিয়ে রেখে আসল। এরপর ফেরদৌসিকে সাজাতে বসল, লাল টুকটুকে শাড়ি পরাল। তারপর মায়ের অলঙ্কারগুলি নিয়ে বসল, কণ্ঠহার প্রকোস্ট কাকন কানের দুল টিকলি ইত্যাদি সবই পরাল, তারপর মেকাপ মার্জন করে ফুল কুমারির মত সাজিয়ে গোজিয়ে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল, ঠিক যেন অপ্সরী বা পরীস্থানের পরী অথবা জান্নাতী হুর, সে লজ্বায় ঘোমটা টানল। তারপর তাকে এনে মায়ের রুমে পাটিতে বসাল। এখন তাদের শুধু ইজাব কবুলের প্রতিক্ষা। কিন্তু হাসে অন্তরযামি বসে নিভৃত হিয়ার অন্তরালে।

বিষয়: সাহিত্য

৯৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File