হাসান ফেরদৌসি - ১২

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৯ অক্টোবর, ২০১৭, ০৬:১৭:৩১ সন্ধ্যা

১৯

যামিনির তৃতীয় যাম অতিক্রান্ত। ফেরদৌসি মাটিতে পড়ে আছে, তার বিশাল কেশগুচ্ছ পিঠে ও মাথার চার পাশে মাটিতে ছড়িয়ে আছে। শাড়িটা ধুলি বালিতে ধুসর হয়ে গেছে। মেঘের আবরনে পূর্ণিমা শশীর ন্যায় তার গোলাপরাঙ্গা মুখটা বিষাদের কালিমাচ্ছাদিত হয়ে আছে। চোখের নীচে মাটি ভিজা, চোখের কোণে এক ফোটা অশ্রু জমে আছে, আরেক ফোটা নাকের অর্ধেক এসে শুকিয়ে গেছে। তার বেদনা বিধুর মুখখানি জানান দিচ্ছে সে কতটা মজলুম, কতটা অসহায়। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেল, নিজেকে মাটিতে দেখে চমকে উঠে বসল। ঘটনা মনে হতেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠল, তারপর দৌড়ে হাসানের রুমে গিয়ে দেখল মহিউদ্দিরা ঘুমাচ্ছে। আবার দৌড়ে এসে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধানে ডেকে তুলল। তারপর দু’জন এগিয়ে গেল। হাসানকে মাটিতে বসিয়ে কোমর থেকে উর্ধ্বাংশ দড়ি দিয়ে পেছিয়ে পেছিয়ে খামের সাথে বাঁধা হয়েছে। পা লম্বা হয়ে আছে। হাঁটুর ব্যাথা ও কষে বাধার কারনে সে কোকাচ্ছে, মাথাটা নেতিয়ে পড়েছে।

ফেরদৌসি গিয়ে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। মহাসমুদ্রের তরঙ্গের মত দুর্দম কান্না তার গলা পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠল, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তা দমন করল কিন্তু মুখটা হা করে উঠল- যেন একটা আগুনের হলকা বেড়িয়ে গেল। মা তাড়াতাড়ি খোলার জন্য ইঙ্গিত করছেন। সে দ্রুত হাত চালিয়ে বাঁধন খুলল। হাসান দাঁড়াতে চাইল কিন্তু পারল না। ফেরদৌসি তার হাতটা নিজের কাঁধে নিয়ে টেনে দাড় করাল কিন্তু অনেকক্ষন জোড় হাত পিছন মোড়া বাঁধা থাকার কারণে হাত জ্যাম হয়ে গেছে, ব্যাথায় ককিয়ে উঠল। ভয়ে যেন ফেরদৌসির রক্ত জমে গেল, তাড়াতাড়ি হাসানের মুখ চেপে ধরল। কিন্তু না, ভয়ের কারণ নাই, সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কয়েক পা যাওয়ার পর হাসান নিজেই হাঁটতে লাগল। উঠানে গিয়ে মা বললেন, তুই আর দেরি না করে তোর দেশে চলে যা, এখানে থাকলে ওরা তোর জীবনটা নষ্ট করে ফেলবে। তারা রান্না ঘরের পিছনে জঙ্গলের পথ ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ফেরদৌসি বলল, ‘কিন্তু আমরা যাব কেমনে, টাকা তো নাই’ বলে সে দৌড়ে ঘরে গেল, এক মুঠ টাকা এনে হাসানের পকেটে রাখল। সংসারের টাকা পয়সা সব সময় ফেরদৌসির কাছেই জমা থাকত।

মা বললেন, দেরি করিস না তাড়াতাড়ি যা, ওরা জেগে উঠলে বিপদ হবে। তারা দুজন হাত ধরাধরি করে রওয়ানা হল। অমনি মা ফেরদৌসির হাত টেনে ধরে বললেন ‘তুই কোথায় যাস। সে বলল, ‘আমিও যাব ওর সাথে। তিনি বললেন, তুই কোথায় যাবি, ওর কি বাড়ি ঘর আছে। হাসান বলল ‘ওকে ছাড়া আমি যাব না। মা বললেন ‘আরে বোকা, ওকে তুই কোথায় নিয়ে রাখবি, তোর কি বাড়ি ঘর আছে, নাকি মা বাপ আছে, নাকি আত্মীয় স্বজন আছে। তোর বাড়ি ঘর থাকলে তো আমিই ওকে তোর সাথে দিয়ে দিতাম। ওকে রাখার মত তো তোর কোন আশ্রয় নাই। তাছাড়া এই রাতের বেলা এমন জোয়ান মেয়েকে সাথে নিয়ে যাবি কেমনে, এতে তো আরো বেশি বিপদের সম্ভাবনা, তুই একাই যা। তোদের এলাকায় গিয়ে কোন প্রতিবেশি বা আত্মীয়ের বাড়িতে থাক গিয়ে। লেখা পড়া বন্ধ করিস না। এ দিককার ঝামেলা শেষ হলে আমি তোকে খবর দিয়ে নিয়ে আসব। হাসান কেঁদে উঠল ‘গিয়ে লাভ নেই, আমি চলে গেলে পটেটোরা ওকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন আমি এমনিতেই মরে যাব, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

মা গম্ভীর সুরে বললেন, ‘না, পারবে না, আমি আমার ভাইদের খবর দিয়ে এনে ওদের বিয়ের আলাপ ভেঙ্গে দিব। তাও যদি ব্যর্থ হই তাহলে ফেরদৌসিকে নিয়ে বাপের বাড়ি বা বোনের বাড়ি বা অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিব। আমি বেঁচে থাকতে তারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দিতে পারবে না। তুই নিশ্চিন্তে যা, আমি কথা দিলাম, এখানকার ঝামেলা শেষ করে তোকে খবর দিয়ে নিয়ে আসব। আর দেরি করিস না যা। তারা দু’জনে হাত ধরাধরি করে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে সর্বরিক্তের মত কাঁদতে লাগল। মা তাদের হাতের বন্ধন ছাড়িয়ে হাসানকে ধাক্কা দিলেন, যা, ওরা জেগে উঠলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অসহায় দুটি যুবক যুবতি একে অন্যের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল, মনে হচ্ছে যেন একক একটা দেহ কেটে পৃথক হয়ে যাচ্ছে অথবা দেহ থেকে কলিজা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাছে। হাসান এক পা অগ্রসর হল, অমনি পেছন থেকে খপ করে ফেরদৌসি তার হাত ধরে বলল, কোথায় যাবি আমায় বলে যা। - জানি না কোথায় যাব।

ফেরদৌসি সহসা তার হাতটা নিজের মাথায় চেপে ধরে শিশুর মত কেঁদে উঠল, ‘যেখানেই যাস, ওয়াদা দিয়ে যা আমাকে ভুলে যাবি না, কয়েক দিন পর আবার ফিরে আসবি। সহসা মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার মত বিষাদের উর্মি- তরঙ্গে হাসানের ভিতরটা চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেল, সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ফেরদৌসিকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল ‘মানুষ কি নিজের আত্মাকে ভুলে যেতে পারে, নিজের কলিজা হাত পা চোখ, নিজের দেহ কি ভুলে যেতে পারে? তুই কেন এমন প্রশ্ন করলি? কেন করলি, আমি মরে যাব, তোকে ছাড়া আমি যাব না, কোথাও যাব না--- সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মা এসে ধমক দিলেন, দুইজনকে ছাড়িয়ে বললেন, ‘হায় আল্লাহ তোরা সর্বনাশ না করে ছাড়বি না। হাসান দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি যাব না। মাও রুক্ষস্বরে বললেন, ঠিক আছে তাহলে জেলে যা। মহিউদ্দিরা যে হিংস্র, কাল ভোরেই তোকে পুলিশে দিবে, তখন জেলে পরে পরে পচবি, তোদের দু’জনের জীবনটাই নষ্ট হবে। কাজেই বাবা না, তোর জীবনটা বাঁচা, ফেরদৌসির জীবনটাও বাঁচা আমাকেও বাঁচা। কয়েকদিন পর আমি তোকে ডেকে নিয়ে আসব। তারপর তিনি হাসানের নাকে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন আর ‘বাবা না বাবা না যা’ বলে ধাক্কা দিয়ে দুই পা এগিয়ে দিলেন।

তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। হাসান এক পা যায় পিছন ফিরে তাকায় আর কাঁদে। এভাবে কয়েক পা যাওয়ার পর দ্রুত পিছন ফিরে এল। এসেই ফেরদৌসির হাত ধরে গালে ছেপে ধরে একেবারে অসহায় হয়ে কেঁদে উঠল, ‘আমি তোকে না দেখে থাকতে পারি না, কয়েক দিনের জন্য তুই কোথাও গেলে আমার খুব কষ্ট হত। এখন এতদিন না দেখে কিভাবে থাকব। তোর হাতের আংটিটা আমায় দিবি? এটা দেখে দেখে তোকে না দেখার যন্ত্রনা আমি ভুলে থাকব। ফেরদৌসি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, সে হাসানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মুখে আঁচল গুজে বুক চিড়ে ফেড়ে বেড়িয়ে আসা কান্না দমানোর চেষ্টা করছে, তার শরীর কাঁপছে। মা তাড়া দিলেন, সে দ্রুত আংটি খোলে হাসানের কনিষ্ঠাঙ্গুলিতে পরাল। তারপর হাতটা নিজের মুখে চেপে ধরে পাগলের মত চুমুতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। মা আবার হাসানকে ধাক্কিয়ে এগিয়ে দিলেন। সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে, পিছন ফিরে তাকায় আর কাঁদে।

অনেকক্ষন যাওয়ার পর তার কানে ‘হাসান’ ফেরদৌসির ডাক ভেসে এল। সে থমকে দাড়াল। ফেরদৌসি মুখে আঁচল গুজে দ্রুত এগিয়ে আসছে। দু’জন মুখোমুখি দাঁড়াল, চারটি চোখ পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে আছে। মুখে ভাষা নেই কিন্তু চারটি চোখের অন্তহীন ভাষা বরফের মত গলে গলে নদীর ধারা ছুটছে। ফেরদৌসি আস্তে আস্তে আচলটা মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানল। তারপর ধীরে ধীরে বসল, তারপর স্বামীকে সেলাম করল। কিন্তু উঠল না, পা ধরে বসে আছে, তার শরীরটা কাঁপছে, ভীষণ ভাবে কাঁপছে। পায়ের পাতার উপর ফোটা ফোটা অশ্রু পড়ছে। হঠাৎ সে স্বামীর পায়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে জবাই করা মুরগীর মত ধাপড়াতে লাগল। হাসানের বুকে কাল বৈশাখির ঝড় উঠল। সে অন্তহীন যন্ত্রণায় দু’হাতে মাথা চেপে ধরল, তার মুখটা বিকট হা করে উঠেছে। একটা তীব্র আর্তনাদ করে ফেরদৌসির উপর গড়িয়ে পড়ল। তারপর একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। তাদের কান্নায় স্তব্ধ প্রকৃতি, স্তব্ধ চরাচর। অসহায় দুটি যুবক যুবতির কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে, রাতের প্রকৃতি গুমরে গুমরে কাঁদে, বাতাস শো শো শব্দে কেঁদে ফিরে, বাস্তু চরাচর শোকে মুহ্যমান।

শৈশব থেকে যে দুটি শিশু একে অন্যকে দেখছে চিনছে, একে অন্যের সাথে থেকেছে খেলেছে হেসেছে গেয়েছে। তারা নিজের অজান্তেই একে অন্যের সাথে মিশে গেছে, দুটি আত্মা এক হয়ে গেছে, দুটি দেহ একাকার হয়ে গেছে, দুটি স্বপ্ন একটি নীড় রচনা করেছে। কিন্তু আজ সে নীড়টি ভেঙ্গে যাচ্ছে। একাকার দুটি দেহ পৃথক হয়ে যাচ্ছে, একক দুটি আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের এই বিচ্ছেদ কি চির বিচ্ছেদ, তারা কি ইহজন্মের তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্মে কি আর তারা একে অপরকে পাবে না। ফেরদৌসি কি অন্যের হয়ে যাবে, সে কি হাসানকে পাবে না। হাসান কি ফেরদৌসিকে পাবে না, তারা কি জন্মের মত একে অন্য থেকে চিরবিদায় নিতে যাচ্ছে? এ হল সেই কান্না, সর্বস্ব হারানোর কান্না, আজন্মের সাধ আহলাদ আশা আকাঙ্ক্ষা হারানোর কান্না, দেহ রেখে আত্মা হারানোর কান্না, মৃত্যুর আগে মরে যাওয়ার কান্না। এরা একে অন্যের চোখের তারা- যা দিয়ে এই পৃথিবীকে তারা সুন্দর দেখে, স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের জাল বুনে, আজ যে সেই চোখের তারা হারিয়ে যাচ্ছে, চোখের আলো নিভে যাচ্ছে, দুটি প্রাণী অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাদের চোখ এই পৃথিবীতে আর কোন কিছু সুন্দর দেখবে না। এই কান্না সেই কান্না, সর্বস্ব হারানোর কান্না। কাঁদে দুটি অসহায় নর- নারী, দু’টি হতভাগ্য যুবক যুবতি, আকুল হয়ে কাঁদে, জারজার হয়ে কাঁদতে থাকে। তাদের কান্নায় কাঁদে জীব জগৎ, কাঁদে জড় জগৎ। তাদের কান্নায় মা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনিও দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

হায়রে অবুঝ মন, হায় নিষ্ঠুর পৃথিবী, হায়রে ভাগ্যাহত যুবক যুবতি। তারা তো কারো অন্যায় করেনি, কারো অধিকারে নাক গলায়নি, কারো সীমায় ঢুকেনি, কোন সীমালঙ্ঘন করেনি। তারা তো শুধু নিজেদের অধিকারটুকু চেয়েছে, প্রকৃতির নিয়মে দুজন দুজনার হতে চেয়েছে, দুটি প্রাণ এক হতে চেয়েছে- যাতে রয়েছে কর্তৃপক্ষের সম্মতি আর অন্যদের সমর্থন। কিন্তু হায় মানবতা, পৃথিবীর হিংস্র পশুশক্তি কাল সাপের মত ফণা তুলেছে, তাদের চোখের মনি ছিনিয়ে নিতে চায়, তাদের স্বপ্নের নীড় ভেঙ্গে দিতে চায়, তাদের সাধের বাগান বিরান করে দিতে চায়। দেহ থেকে আত্মা কেড়ে নিতে চায়। এভাবেই যুগে যুগে কালে কালে পশু শক্তিরা কত চোখের আলো নিভিয়ে দিয়েছে, কত স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে, কত ঘর বিরান করে দিয়েছে। এদের কারণে কত নিষ্পাপ জীবন ঝড়ে গেছে। এরা পৃথিবীর অভিশাপ, মানবতার দুষমন, মানুষ নামের কলঙ্ক, দু’পেয়ে হায়েনা, যুগে যুগে এরাই পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলে। এদের ধ্বংস কাম্য।

অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর হঠাৎ মায়ের সম্বিত ফিরে এল। ‘হায় সর্বনাশ’ তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন, তারপর টেনে হেঁচড়ে পরস্পরের গলা থেকে একে অন্যের বাহু বন্ধন ছাড়িয়ে হাসানকে টেনে তুলে ‘আর এক মুহুর্ত দেরি না, তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে’ বলে তাকে ধাক্বিয়ে ধাক্বিয়ে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে গেলেন। তারপর ফেরদৌসিকে টেনে তুললেন। দু’জন এক দৃষ্টে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এক সময় মখমল মোলায়েম কুজঝটিকা গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। ফেরদৌসি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। মা শান্তনা দিচ্ছেন, কাঁদিস না, আমি তো বলেছি তোদের বিয়ে আমি দিবই। তারপর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘরের দিকে রওয়ানা হলেন।

হাসান খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে, হাটার কারণে হাঁটুর ব্যাথা আরো বেড়ে গেছে, পা ফুলে গেছে। কষ্টে তার দম আটকে আসছে। দুঃখ ব্যাথায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। চিন্তা করছে, একদিন সে সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় হয়ে এখানে এসেছিল। এখানে মা বাবা, ভাই বোন, আশ্রয় সহায় সবই পেয়েছিল। আর পেয়েছিল তার জীবন, তার বেঁচে থাকার অবলম্বন, তার আত্মার নিধি ফেরদৌসিকে। কিন্তু আজ সব কিছু ত্যাগ করে তাকে সেভাবেই রিক্ত হস্তে চলে যেতে হচ্ছে- যেভাবে শূন্য হাতে এসেছিল। কিন্তু কোথায় যাবে, তার তো কোন আশ্রয় নাই অবলম্বন নাই, ঠিকানা নাই। ঠিকানা তো সে পশ্চাতে ফেলে চলে যাচ্ছে। এখন সে ঝড়ের পাখি, নীরহারা ঝড়ের পাখির মত এই পৃথিবীর আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াবে, কোথাও একটু মাথা গুজার ঠাই পাবে না।

সহসা সে উর্ধ্বে তাকিয়ে চিৎকার করল, সে মহাবিশ্বের মালিক, আমাদের মত হতভাগাদের দুনিয়াতে না পাঠালে কি তোমার খোদায়িত্বের বিকাশ ঘটত না, কেন এমন হতভাগাদের পাঠাও। আমাদের যন্ত্রনার আহ কি তোমার আরশ কাঁপিয়ে তুলে না, তোমার পৃথিবী বিষাক্ত করে না? মালিক আমার, তোমার এই বিশাল উন্মুক্ত অবারিত পৃথিবী। তোমার কত নায নিয়ামত ও সম্পদে ভরপুর এই দুনিয়া। অথচ আমার পা রাখার মত, মাথা গুজার মতও একটু ঠাই নাই। তুমিই মহাব্যবস্থাপক, আমার কোন ব্যবস্থা করে দাও। আমার আত্মা, আমার কলিজা আমার ফেরদৌসিকে তোমার হাতে ন্যস্ত করলাম, আমার যক্ষের ধন আমার হাতে ফিরিয়ে দিও, অনের হস্তগত করে দিও না। আর সে যদি আমার ভাগ্যে না থাকে, অন্যের সম্পদ হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে আমাকে উঠিয়ে নিও। কারণ তাকে ছাড়া আমার জীবন হয়ে উঠবে অভিশপ্ত, তাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না। বেঁচে থাকার কোন সাধও নাই দরকারও নাই’ সে আকুল হয়ে কাঁদছে, দোয়া করছে আর খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

শীঘ্রই বাজারে পৌঁছল, মানুষ জনের চিহ্ন নাই, বাজার খাঁ খাঁ করছে। সে রাস্তার পাশে একটা চা স্টলের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। বিশ্রাম করছে আর স্মৃতি রোমন্থন করছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল ওরা যদি তাকে খুঁজতে আসে তাহলে তো বাজারের মুখেই পেয়ে যাবে, তখন অনেক বিপদ হবে। কাজেই বাজার বা এর আশপাশে থাকা যাবে না। তাদের দেশ পূর্ব দিকে, সে সিদ্ধান্ত নিল পূর্বমুখি রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকবে। সকালে রিকশা গাড়ি যা পাবে তাতেই চড়ে বসবে। সে উঠতে চাইল কিন্তু হাঁটুর ব্যাথায় ককিয়ে উঠল, বুঝতে পারল সাহায্য ছাড়া হাটা সম্ভব নয়। স্টলের পাশে লাকড়ি রাখা, সেখানে হাতরিয়ে একটা বাশের লাঠি বের করে তাতে ঢেস দিয়ে হাঁটতে লাগল। দুয়েক পা যায়, পিছন ফিরে তাকায়। আবার যায় আবার পিছনে তাকায়। অতীতের স্মৃতিগুলি তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল।

মনে পড়ল, এ বাজারের লোকগুলি তার কত আপনজন, এদের থেকে সে কত বাজার সওদা করেছে, হাঁসি কৌতুক করেছে। মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের মুখগুলি মনে পড়ল। ফকির বাড়ির লোকজনের সাথে তার কত মধুর সম্পর্ক, ইদানিং মহিউদ্দি ও তার অনুসারীরা শত্রু হয়ে গেছে কিন্তু আগে তারা বন্ধু ছিল। মনে পড়ল বাবা মা ও ফেরদৌসির কথা, প্রিয়ার কমল স্নিগ্ধ মুখখানা তার হৃদয় দর্পনে ভাসতে লাগল। ঐ তো দেখা যায় স্টুডিওটা, এখানে ফটো করার দিন সাথে কয়েকটা ছাত্রি ছিল। তাদেরকে নিয়ে হাঁসি মশকরা করছিল। তাকে দুলা ভাই ডাকত, আর ফেরদৌসি লজ্বায় লাল হয়ে ছাত্রিদের গালে ঠোক্কর মারত এবং মুখ টিপে হাসত। সেই হাঁসি খুশি উজ্বল সুচন্দ্র মুখখানা আজ বিষণ্ণ মলিন হয়ে পাখির খাচার ন্যায় ঘরে আটকে আছে আর সে সর্বশান্ত হয়ে রাস্তায় নেমেছে। ফেরদৌসি এখানে পড়ে থাকবে আর সে অজানার উদেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। তারা কি একে অন্যের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে? সে আর চিন্তা করতে পারল না, ডুকরে কেঁদে উঠল। তার কলিজাটা যেন পোড়ে যাচ্ছে, সর্বাঙ্গে বিষ, ব্যাথায় নীল কণ্ঠ।

গ্রামের পথ ধরে সে এগিয়ে যাচ্ছে। নীরবতা পৃথিবী গ্রাস করে নিয়েছে, কোন সাড়া শব্দ নেই। প্রাণী জগত নিদ্রা দেবীর কোলে নিজেকে সপে দিয়েছে। জন মানবের চিহ্ন নাই, দুয়েকটা কুকুর ঘুরছে, বুভুক্ষু নিশাচরেরা এদিক সেদিক বিক্ষিপ্ত ঘোরে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি বিষণ্ণ নিথর। বিষণ্ণ প্রকৃতি তার তনুমন বিষায়িত করে তুলেছে, সর্ব অঙ্গে বিষ, নাগ নাগ জ্বালা। দুঃখ ও কষ্টের সময় মানুষ গান গাঁয়, ব্যথার তীব্রতা তার গলায় সুর তুলে দেয়, কণ্ঠে বেজে উঠে বিষাদের রাগিণী। পথে ঘাটে শুনা একটা গান তার কণ্ঠে সুর তুলল। হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে দু’পাশে তর্জনি নাড়িয়ে নাড়িয়ে গাইল, ‘এমন তো কথা ছিল না, জীবন আমার আহত পাখীর মত পথের ধুলোয় লুটোবে, সাত রঙ্গে রাঙ্গা স্বপ্ন বিহঙ্গ সহসা পাখনা গুটোবে। তার কণ্ঠ ছিল সুমধুর, তার বাবার কণ্ঠও ছিল মধুময়, তারা বংশগত চারুকণ্ঠী।

সে গাইল, ‘আলোর কামনাগুলি সুর্য শিখা হয়ে আনন্দ ফুল ঝুড়ি ঝড়াত। গানের বাশরি হয়ে সুরের আকাশখানি তারার জোছনায় ভরাত। বৈশাখী মেঘে মেঘে চন্দ্র সুর্য ঢেকে আচমকা আধার জুটোবে। এমন তো কথা ছিল না------। তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে উচ্চতর হচ্ছে, সুরের মুর্ছনায় প্রকৃতি আলোড়িত হচ্ছে।

সে গাইল, ‘মনের বাসনাগুলি গন্ধ গোলাপ হয়ে অন্ধ মাতাল করে দিত। সবুজ পাতারা ওগো অবুঝ প্রথম প্রেমে আদরে কাছে ডেকে নিত, বাউড়ি উদাসী বায়ু, গোলাপেরা ঝড়ে গিয়ে এ হৃদয়ে কাঁটা ফুটোবে। এমন তো কথা ছিল না------। বড় করুন সুরে সে গেয়ে চলেছে। রাস্তার দু’পাশে বাড়ি-ঘর। নিঃশব্দ রজনির বিষাক্ত সুর তরঙ্গে হয়ত কোন শিশু ঘুম ভেঙ্গে কান্না জুড়ে দিয়েছে। তার মা বিরক্তি জানাচ্ছে, ‘কোন মরাটা আমার বাচ্চার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। গৃহকর্তা ভাবছে, হায় কোন হতভাগা এই শেষ রাতে নিজের জীবনের বিষ চলার পথে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বুড়া- বুড়ি হঠাৎ নিদ্রা ভেঙ্গে ভাবছে, না জানি কোন হতভাগিনী মায়ের সন্তান কেঁদে ফিরছে, মানব হৃদয় তোলপাড় করে যাচ্ছে, চোখে আশু নামাচ্ছে।

সে গাইল, ‘এমন তো কথা ছিল না, জীবন আমার আহত পাখীর মত পথের ধুলোয় লুটোবে, সাত রঙ্গে রাঙ্গা স্বপ্ন বিহঙ্গ সহসা পাখনা গুটোবে। তার কণ্ঠ বিষ ঢেলে যাচ্ছে, সেই বিষ ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে, বিষের তেজস্ক্রিয়তায় রাতের আধার গলে গলে পড়ে বৃক্ষপত্রে, সেখান থেকে ফোটায় ফোটায় ঝড়ে পড়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে। ব্যথাতুর প্রকৃতি নীথর মুক। সে লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

সূর্য অনেকটা উঠে গেছে, হঠাৎ বাম দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তার ক্লাসমেট আসাদ একটা আল ধরে রাস্তার দিকে হেঁটে আসছে। সে দু’দিন আগে বাড়িতে এসেছিল। রাস্তায় উঠে আসাদ অবাক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না- পা ভাঙ্গা, হাতে লাঠি, উসকু খুসকু চুল, আবার গায়ে নতুন জামাইয়ের মত জামা কাপড়। সে দৌড়ে গিয়ে হাসানকে জড়িয়ে ধরে চেঁচাল ‘কিরে তোর কি হয়েছে, তুই এখানে কেন? হাসান কোন কথা বলল না, তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। আসাদ ব্যস্ত হয়ে উঠল, ‘চল চল বাড়িতে চল, ঐ যে বাম পাশের প্রথম বাড়িটাই আমাদের। তারপর সে লাঠিটা ফেলে দিয়ে হাসানের হাত নিজের কাঁধে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। হাসান ভাঙ্গা পায়ের ভর আসাদের কাঁধে রেখে হাঁটতে হাঁটতে তার ট্র্যাজিক কাহিনী বর্ণনা করল, নিজে কাঁদল আসাদকেও কাঁদাল। আসাদ হাসানকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে মাকে ডেকে এনে পরিচয় দিয়ে বলল, ‘তুমি ওকে খেতে দাও আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। গ্রাম্য ডাক্তারের বাড়ি কাছেই। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এল, হাঁটুতে জলপট্টি বাধল, কয়েকটা ঔষধ লিখে দিয়ে বলল, ভয়ের কারণ নাই, দুয়েক দিনের মধ্যে সেরে যাবে। তারপর ডাক্তার চলে গেল।

বিষয়: সাহিত্য

৮৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File