হাসান ফেরদৌসি - ১৪

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০৬:৪৭ দুপুর

২০

সকালে হৈ চৈ পড়ে গেল। হাসান কোথায় গেল, কিভাবে গেল, কে ছাড়ল? জিজ্ঞেস করতে সবাই ছুটে গেল ফেরদৌসির কাছে, আসলে তারা তাকে এক নজর দেখতে চায়, তার সাথে কথা বলতে চায়, তার কণ্ঠ শুনতে চায়। কারণ তার সান্নিধ্যে তারা রোমাঞ্চিত হয়, ফুলক অনুভব করে, তার কণ্ঠ তাদের কর্ণকুহরে শত সঙ্গিতের ঝংকার তুলে। কিন্তু ফেরদৌসি রাত্রে শুয়ার পর আর উঠেনি। কি আছে তার ভাগ্যে, হাসান কি চিরতরে চলে গেল, সে কি আর আসবে না। তার জীবনের একমাত্র অবলম্বনটি কি সে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলল- এ একটি চিন্তাই তাকে বিছানার সাথে আটার মত জড়িয়ে দিয়েছে। সে আপাদ মস্তক উড়নায় ঢেকে বিছানায় লেপটে পড়ে আছে, কারো সাথে কথা বলল না। মা বললেন, আমি ছেড়েছি, আমিই ওকে তার দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। সে থাকলে আমাদেরও বিপদ তোমাদেরও সমস্যা। কি দরকার আমার ফাউ ঝামেলা পোহানোর, তাই আপদ বিদেয় করে দিয়েছি। সবাই খুব খুশি হল। তারা ভাবল, মা শত্রু ভেবে হাসানকে তাড়িয়ে দিয়েছে। পটেটো আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, খুব ভাল করেছেন আম্মা, খুব সুন্দর কাজ করেছেন। থানা পুলিশের ঝামেলা করার চেয়ে এটাই ভাল হয়েছে। বাপরে বাপ, এমন বিচ্ছু কেউ নিজের ঘরে পোষে নাকি। এখন আমরা নির্বিঘ্নে ফেরদৌসিকে বিয়ে দিতে পারব। তারপর সে অন্যদেরকে এই খুশীর সংবাদ জানানোর জন্য জামালপুর রওয়ানা হয়ে গেল।

ফেরদৌসি তাদের কথা শুনছে আর তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামছে, বালিশ ভিজে যাচ্ছে। সবাই খুশি হলেও মহিউদ্দি খুশি হতে পারেনি। কারণ সে জানে হাসান একটা সিংহ। আর এই সিংহের থাবা যে খেয়েছে সেই বুঝতে পারে এটা কি চিড়িয়াখানার সিংহ নাকি আফ্রিকার সিংহ। এখন এই সিংহ বাইরে থাকলে তার উদ্দেশ্য হাসিল হওয়া সুদুর পরাহত। কারণ হাসান কখনোই ফেরদৌসির উপর তার অধিকার ছাড়বে না। কাজেই ফেরদৌসিকে পেতে হলে এই সিংহকে খাচায় ঢুকাতে হবে, জেলে পোরতে হবে কিন্তু সেই সুযোগ তো ভেস্তে গেল, সিংহ তো জঙ্গলে চলে গেল। কাজেই সে পরিকল্পনা আটতে থাকে। রাতে ফেরদৌসিকে বধূ বেশে দেখার পর সে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, তাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন আর সে নিজের মধ্যে নেই, ফেরদৌসির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ফেরদৌসির রুপের বিষ তার কোষে কোষে পশে গিয়ে সে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ফেরদৌসির রুপের নেশা তার রক্ত কণিকায় মাদকের উম্মাদনা সৃষ্টি করেছে, ফেরদৌসির রুপের আগুন তার তনুমন ঝলসে দিয়েছে। এখন তার জীবনের লক্ষ একটাই, শুধু ফেরদৌসি, একমাত্র ফেরদৌসি। ফেরদৌসি শুধু তার হবে অন্য কারো নয়, প্রয়োজনে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দিবে। তাই সে গ্যাংদের সংগঠিত করে নিজের দল গঠন করার দিকে মনোযোগ দিল।

পুরাতন গ্যাং পার্টি ভেঙ্গে গেছে, আলবার্ট ছোট ছোট দু’টি বাচ্চা রেখে মারা গেছে। গ্যাংরা সবাই বিয়ে শাদি করে উপার্জনের ধান্ধায় বাড়ি ঘর ছেড়েছে। এখন পরবর্তী প্রজন্ম মাঠে নেমেছে। তারা যদিও এখনো পূর্নাঙ্গ গ্যাং পার্টিতে রূপান্তরিত হয়নি, তবে ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হচ্ছে। আলামতে বুঝা যাচ্ছে বর্তমান গ্যাং লিডার হবে মহিউদ্দি। কারণ নেতৃত্বের যোগ্যতা তার আছে, তবে সেই নেতৃত্ব হবে ভয়ঙ্কর। কারণ সে উগ্র, বদমেজাজি, লোভী, স্বার্থপর, চরিত্রহীন, অন্যায় প্রবন নীচ প্রকৃতির ছেলে। ফকির বংশের বখাটে প্রকৃতির ছেলেদের সাথেই তার সখ্যতা। যেসব ছেলে ভদ্র সভ্য মার্জিত, লেখাপড়ায় মনোযোগী- তারা তাকে দেখতে পারে না, তার সাথে মিশে না, তাকে দুষ্ট সঙ্গ মনে করে। এজন্য ভাল ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলে। মহিউদ্দি তার অভীষ্ট লক্ষে পৌছার জন্য সবাইকে সংগঠিত করতে তৎপর হল। ভাল ছেলেরা যখন স্কুল কলেজে যায় বা রাস্তা ঘাটে দেখা হয়- তখন সে মোলায়েম সুরে ডাক দেয়, কাছে যায়, হাত ধরাধরি করে হাটে। তাদের সাথে মিষ্ট ভাষায় ভদ্রভাবে কথা বলে, হাঁসি কৌতুক করে।

সবশেষে বলে, ‘আচ্ছা এটা কী করে সম্ভব বল তো, ঘটনা তো জানই উবায়দুল্লাহ চাচার কামলা ছেলেটা ফেরদৌসিকে বিয়ে করতে চায়। চিন্তা কর, বাপ দাদার নাম নাই, মাথা গুজার ঠাই নাই, একটা বেওয়ারিশ রাস্তার কুকুর আমাদের ফকির বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে চায়, তাও আবার ফেরদৌসির মত সুন্দরি মেয়েকে। এই ভিক্ষুকটা চাচিকে যাদু করেছে, এখন সেও তার কাছে বিয়ে দিতে চায় কিন্তু আমরা তো এটা মেনে নিতে পারি না, এটা আমাদের বংশের কলঙ্ক, এর প্রতিবাদ করা দরকার না? তখন ভদ্র ছেলেরা ঘটনা জানা সত্ত্বেও ভদ্রতার খাতিরে বা চক্ষু লজ্বায় হয়ত গলা টেনে বলে, হাঁ ঠিকই তো। এভাবে সে ভাল ছেলেদের মন দুর্বল করতে থাকে আর তার সমর্থক বানানোর চেষ্টা করতে থাকে। তাছাড়া তার একান্ত বিদূষকদের সাথে সে সব সময় পরামর্শ করে- কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে। সবশেষে তাদেরকে সে শিখিয়ে দেয়, অন্য ছেলেদেরকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করবে, কোন কৌশলে কথা বলবে।

বাড়ির পূর্ব পাশের দোকানের পিছনে প্রতি রাতে তারা তাসের আসর জমায়। বাড়ির সব বখাটে ছেলেরা সেখানে গিয়ে হাজির হয়। তখন মহিউদ্দি বাজার থেকে কোন দিন ছোলা মুড়ি পিয়াজু, কোনদিন জিলাপী, কখনো মুড়ি চানাচুর ইত্যাদি এনে খাওয়ায়। লক্ষে পৌঁছাতে সে অঢেল পয়সা ঢালতে থাকে, ধুম ধারাক্বা খাওয়া চলতে থাকে। তখন তার মোসাহেবরা তারই শিখিয়ে দেয়া কৌশল অনুসারে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলে, মগের মুল্লুকের কিস্যা শুনেছিস, কামলা নাকি ফেরদৌসিকে বিয়ে করবে। তখন সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। একজন বলে ‘শুনলাম কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জন্যও নাকি বিয়ের আলাপ হচ্ছে। তখন অন্যজন বলে, ‘শত আলাপ হলেও লাভ নেই, আমাদের মধ্যে যোগ্য ছেলে থাকতে ফেরদৌসির মত সুন্দরি মেয়েকে আমরা বাইরে যেতে দিব না। তখন একজন হয়ত জিজ্ঞেস করে, তুই কার কথা বলছিস, মহিউদ্দি ভাইয়ের কথা’? তখন বিদূষকরা সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে, ‘ঠিক ঠিক তুই ঠিক কথা বলেছিস, মহিউদ্দি ভাই গ্যাং লিডার, সে আমাদের নেতা, ফকির বাড়ির নেতা, গোটা এলাকার নেতা, কাজেই ফেরদৌসির জন্য সেই যোগ্য পাত্র।

তখন মহিউদ্দি চেহারায় কৃত্রিম লাজুক ভাব টেনে মুচকি হেসে বলে, ‘আরে দুঃ, তোরা কি বাজে বকবাজি করছিস’। মোসাহেবরা কৃত্তিম ভঙ্গিতে খেকিয়ে উঠে, বাজে বকোয়াজ বলছ কি, তোমাকে এ বিয়ে করতেই হবে, এত ভাল মেয়ে আমরা বাইরে যেতে দিব না। এক বিদূষক বলে ‘আরে ওর কথা শুনছিস কেন, তার কোন মতামত চলবে না, আমরা জোর করে ওর বিয়ে দিব। মহিউদ্দির কোন অভিবাবক নাই শুধু মা আছে, কাজেই কোন মোসাহেব বলে, আরে চাচিকে বুঝালে তিনি আমাদের কথা ফেলতে পারবেন না, এ বিয়ে হবেই, এই তোমরা সবাই কি বল? তখন বাকী ছেলেরা হুজুগে মেতে সবাই সম্মতি দেয়, ঠিক ঠিক, ফেরদৌসির জন্য মহিউদ্দি ভাইই যোগ্য। সহসা মহিউদ্দির টিকটিকির মত বুকটা জাহাজের পাটাতনের মত চওড়া হয়ে যায়। সেখানে দুরন্ত কামনার ঝড় উঠে, অন্তহীন আবেগে উচ্ছাস তাড়িত হয়ে সে উঠে গিয়ে দোকানে সিগারেট ধরায়। মুখ ভর্তি ধোয়া ছাড়ে, কুসুমদাম রচিত মালার ন্যায় সেই ধুম্রবৃত্তে ভেসে উঠে ফেরদৌসির লালগোলাপ মুখাবয়ব। চাঁদে, নক্ষত্রের দিপালিতে, আকাশ মণ্ডলে, ডানে বামে সর্বত্র সে দেখতে পায় ফেরদৌসি, শুধু ফেরদৌসি। কাজেই ফেরদৌসি তার, একমাত্র তার।

বিয়ে উপলক্ষে ফেরদৌসির বোনেরা ও বোনের জামাইরা একে একে সবাই এসে গেছে। বিয়ের বাজার সওদা ও কিনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। বাড়িটাতে বিয়ের আমেজ মৌ মৌ করে, শুধু যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই অবস্থা। কারণ ফেরদৌসি শয্যা গ্রহণ করেছে, অশ্রুই তার সম্বল। মা তার মেয়েদের সামনে ও জামাইদের সামনে কাতর হয়ে পড়ে, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিকভাবে তাদের সাথে কাতর মিনতি করে, চোখের জল ফেলে। তাদেরকে বুঝায় ‘তোদের বাপ হাসান আসার সময়ই ওদের দু’জনের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্যার সময় ফেরদৌসিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনার পর তোদের বাপ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ওদের বিয়ে দিবে, মৃত্যুর সময় অসিয়্যত করে গেছে। কাজেই ওকে আমি অন্যত্র বিয়ে দিতে দিব না। তাহলে ওদের দু’জনের জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা দু’জন একে অন্যকে পসন্দ করে। ফেরদৌসি যেমন আমার মেয়ে হাসানও আমার ছেলে। আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলে মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দিব না। আমি ভাল করেই জানি ওরা একে অন্যকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।

কিন্তু তারা মায়ের কথা কানেও তুলে না, গায়েও মাখে না। কারণ এ পরিবারের কর্তা হল ফেরদৌসির বড়াপা ওরফে মাজেদা ও নূরানী, সেই সুবাদে ইঞ্জিনিয়ার ও পটেটো। আর এ লোকগুলি হাসানকে সহ্যই করতে পারে না। তার সাথে ফেরদৌসির বিয়ে হবে- এটা মেনে নেয়া তাদের সহ্যের অতীত। বিশেষত প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এটাই পটেটোর মোক্ষম সুযোগ। সে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। তারা মাকে পাগল ঠাওরায়, কথা বলার সুযোগ দেয় না। তিনি কিছু বলতে চাইলেই তারা ঝংকার দিয়ে উঠে, আরে আপনি তো একটা আস্ত পাগল, পাগল না হলে কি কেউ নিজের মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদ দিয়ে একটা রাস্তার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়। আপনি যান, ফেরদৌসির বিয়ের ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না, যা করার আমরাই করব। এভাবে তারা মাকে অপমান করে, নির্বাক করে দেয়। অবশেষে মা কোন উপায়ন্তর না দেখে পাশের ঘরের এক ভাতিজাকে গোপনে বললেন, বাবা তুমি একটু কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার ছোট ভাইকে বলবে ‘খুব বিপদ, সে যেন আজই আসে।

ফেরদৌসির এই মামা উচ্চ শিক্ষিত, সরকারি চাকুরে, পরদিন বিকালে তিনি এলেন। মা ভাইকে নিয়ে বসলেন, তিনি হাসানের ইতিহাস জানতেন। এরপরেও মা তার ইতিহাস বললেন, বন্যার সময় ফেরদৌসিকে বাচানো, স্বামীর মৃত্যুর সময় ওদের বিয়ের অসিয়্যত করে যাওয়া ইত্যাদি সব ঘটনা বর্ণনার পর ভাইয়ের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন ‘তুই ওদেরকে বাঁচা, ওরা একে অন্যকে পসন্দ করে, একজনকে ছাড়া আরেক জন বাচবে না। আমি ওদের মা, আমি সব জানি সব দেখেছি, ওরা এক মুহুর্ত একে অন্যকে না দেখে থাকতে পারে না। ছোট বেলা থেকেই এক সাথে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন ওদেরকে পৃথক করা মানে একটা মানুষকে দুই টুকরা করে ফেলা। কাজেই তুই যেভাবে পারিস ঐ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে এদের দু’জনের বিয়ের ব্যবস্থা করে দে’ ইত্যাদি বলে মা কাঁদতে লাগলেন। ভাই শান্তনা দিয়ে বললেন, কেঁদো না দেখি আমি কি করা যায়।

তারপর মাগরিব পড়ে তিনি ভাগ্নি ও ভাগ্নি জামাইদের নিয়ে বসলেন। তিনি হাসানের সব কিছু বর্ণনা করে সর্বশেষে বললেন, দুলাভাই ওদের বিয়ের অসিয়্যত করে গেছেন। আর মৃতের অসিয়্যত ভঙ্গ করলে এর পরিনাম কখনো ভাল হয় না। কাজেই ঐ বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে এদের দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ইঞ্জিনিয়ার লোকটা ছিল ভয়ঙ্কর দাম্ভিক আর স্বেচ্চাচারি প্রকৃতির। সে কাউকে মানত না। মামা শ্বশুর ছিল বয়সে তার ছোট, বেচারাকে সে কোন পাত্তাই দিত না, এমনকি মতের অমিল হলে অপমান করত। সে মামা শ্বশুরকে বলল, আপনি তো তৈয়ার সালনে (ব্যঞ্জন) বাগড়া দিতে এসেছেন। আপনি জানেন যে আপনার দুলাভাই বেঁচে নাই, তখন আপনি কি কোনদিন পরিবারটার খোঁজখবর নিতে এসেছেন- তারা কোথায় থাকে কি খায়, কেমনে চলে? নাকি ফেরদৌসির জন্য কোন বিয়ে দেখেছেন, কোন পাত্র এনেছেন? কিছুই করেন নি। অথচ আমরা কষ্টেশিষ্টে একটা ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি, বিয়ে দিব। ঠিক তখনি আপনি এলেন, এখানে বিয়ে দেয়া যাবে না একটা রাস্তার ফকিরের কাছে বিয়ে দিতে হবে’ বলে তারা সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। মামা লজ্বায় লাল হয়ে গেলেন।

ফেরদৌসির সমবয়সী মামার এক মেয়ে আছে। তাই মাজেদা খোঁচা দিয়ে বলল, আচ্ছা মামা, তোমার নিজের মেয়ে হলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাত্র বাদ দিয়ে একটা বেওয়ারিশ রাস্তার কুকুরের সাথে বিয়ে দিতে? পটেটো বলল, আরে ফেরদৌসি তো ওনার নিজের মেয়ে না, উনি ভাল করেই জানেন যে, ওনার মেয়েকে কোন দিন ভার্সিটি শিক্ষকের সাথে বিয়ে দিতে পারবেন না। অথচ এমন পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে তো উনার মেয়ের চেয়ে ফেরদৌসি ভাগ্যবান হয়ে গেল। আর এটা তিনি কি করে মেনে নিবেন, এজন্যই বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছেন। আজ উনার মেয়ের জন্য যদি ভার্সিটি শিক্ষকের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা হত আর আমরা ভাঙ্গানি দিতে যেতাম তাহলে সাথে সাথে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে আমরা এখনো তা করিনি। সে আরো অপমান জনক কথা বলতে লাগল আর হাসতে লাগল। সবাই হাসতে হাসতে মামাকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করল। বেচারা লজ্বায় অপমানে কেঁদে ফেললেন। তারপর আর একটা কথাও না বলে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন, বোনের সাথে পর্যন্ত দেখা করলেন না।

এবার ফেরদৌসি বিছানায় লম্বালম্বি হয়ে পড়ল। তার চোখের পানিও নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন উপায়, সব চেষ্টা তো ব্যর্থ হল, মা তো কিছুই করতে পারলেন না। তার একটি কথাই শুধু মনে হতে লাগল, সেদিন যদি হাসানের সাথে চলে যেত তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে ঐ ব্যক্তির সাথে বিয়ে ছাড়া আর কোন উপায় নাই। অগত্যা হয় এ বিয়েতে সম্মতি দিতে হবে না হয় আত্মহত্যা করতে হবে। যখনি তার মনে হয় সে অন্য লোকের বউ হয়েছে তখনি ঘৃনায় তার গা রি রি করে উঠে। সে সিদ্ধান্ত নেয় যদি এ লোকের সাথেই তার বিয়ে হয় তাহলে আত্মহত্যা করবে। মায়ের প্রতি তার ক্ষোভ জন্মে, সেদিন তিনি তাকে হাসানের সাথে যেতে দেননি, আবার এদিক দিয়েও কিছু করতে পারলেন না। সে মাকে গালাগাল করে আর কাঁদে, কেন আমাকে তুমি মেরে ফেললে, কেন জীবন্ত আগুনে নিক্ষেপ করলে। কেন ওর সাথে যেতে দিলে না, এখনো কোন একটা ব্যবস্থা কর নইলে কিন্তু আমি মরব। মা শুধু চোখ মোছেন।

আজ বুধবার, একদিন পর বিয়ে। সে মাকে বলল, আম্মা চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। মা বললেন, রাখ বাড়ির কয়েকজন মাতাব্বর ধরে দেখি কী করা যায়। যদি কোন উপায় না হয় তখন অন্য চিন্তা। ফেরদৌসিও স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, সে আজ দিনটা দেখবে। যদি কোন গতি হয় তো ভাল অন্যথায় বৃহস্পতিবার দিনে বা রাতে যে কোন সুযোগে পালিয়ে যাবে। তারপর হাসানের খোঁজে তার এলাকায় চলে যাবে।

হাসান তার বন্ধু আসাদের বাড়িতে আছে। আসাদের সেবা শুশ্রূষা ও ঠিকমত ঔষধপথ্য খেয়ে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার হাটু একদম ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু এই দুই দিনে সে বুঝতে পেরেছে ফেরদৌসিকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা সম্ভব না। গত দুইদিন তাকে না দেখে যেন তার আত্মা কলিজা শুকিয়ে গেছে। তার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যে, ফেরদৌসিকে ছাড়া দেশে গেলে তার শোকেই সে মরে যাবে। এছাড়া তার অনুপস্থিতিতে যদি ওরা ফেরদৌসিকে ঐ লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে তো মৃত্যু ছাড়া তার আর কোন গত্যন্তর থাকবে না। কাজেই মরতে যদি হয় তাহলে দেশে গিয়ে শোকে দুঃখে ধোকে ধোকে মরার চেয়ে এখানে ফেরদৌসির সামনেই মরবে। সে দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দেয়। কিন্তু কি করবে, উপায় কি- চিন্তা করে কুল কিনারা পাচ্ছে না। একবার ভাবে ফেরদৌসির কাছেই চলে যাব। কিন্তু আবার চিন্তা করে এখন গেলেই মারমারি হবে, এমনকি খুনাখুনিও হতে পারে। সেদিন হাঁটুতে বাড়ি মারার কারণে অবশ্যি সে মহিউদ্দিকে মেরে ফেলত যদি না তার হাত পা বাঁধা থাকত। কাজেই এখন গেলে তো পটেটো ও মহিউদ্দির দল তাকে আক্রমণ করবে আর সেও সিংহের মত থাবা মারবে তখন খুন হয়াটা স্বাভাবিক। তারপর হয়ত তাকে ফাটকে যেতে হবে আর ফেরদৌসির জীবনটা নষ্ট হবে। তখন এই বদনামে তাদের পরিবারটাও ধ্বংস হয়ে যাবে। কাজেই কি করা যায়- সে অনেক চিন্তা ভাবনা করল। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিল এবং এই সিদ্ধান্তের উপরই স্থির থাকল।

বুধবার সকালে সে চিন্তা করল যা করার আজই করতে হবে। কারণ একদিন পর শুক্রবারে ফেরদৌসির বিয়ের তারিখ। সকালে খাওয়া দাওয়ার পর সে আসাদকে বলল, তুই আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছিস, তোর ক্লাস কামাই হচ্ছে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, তুই চলে যা। আমি এখন সুস্থ, বিকাল নাগাদ আমিও চলে যাব ইংশাল্লাহ। আসাদ বলল ‘তোর যাওয়ার দরকার নাই, আপাতত কয়েকদিন থাক। আম আগামি সপ্তাহে আসছি, তারপর চিন্তা ভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। হাসান বলল, না আমার থাকার সুযোগ নাই, বিকাল নাগাদ চলে যাব। তারপর আসাদ আরো সাধাসাধি করল এবং কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিল।

মাগরিবের পর হাসান বাড়ি থেকে বের হল। একটা রিকশা নিয়ে হাজারিপাড়া বাজারের কাছাকাছি গিয়ে রিকশা থেকে নেমে মাঠের আল ধরে হাঁটতে লাগল। কারণ বাজারে গেলে কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে। সে কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে ফেরদৌসিদের জঙ্গল বরাবর সোজা দক্ষিণে হাঁটতে লাগল, ক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ফেরদৌসিদের বাড়িটা দক্ষিণ মুখি পিছনে জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝে পায়ে চলা পথ। হাসান জঙ্গলের পথ ধরে সোজা রান্না ঘরের পিছনে গিয়ে একটা কাঁঠাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল কিন্তু ফেরদৌসির কোন খুঁজ নাই।

তার ভাগ্নে ভাগ্নিরা রান্না ঘরে খাওয়া দাওয়া করছে, উঠানে দৌড়াদৌড়ি করছে, আনন্দ করছে। বাড়িটাতে বিয়ের আমেজ, উৎসব মুখর পরিবেশ। এদিকে মশার কামড়ে হাসান নর্তকি নাচ নাচতে লাগল। ঘণ্টা খানেক পর সব শান্ত হয়ে এল। পোলাপান খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে পড়েছে, বোনেরা খেতে বসেছে। তখন ফেরদৌসি একটা জগ হাতে কলপাড়ে এল। হাসানের আত্মাটা ধক করে উঠল, সে একটু অগ্রসর হয়ে হাতছানি দিল। ফেরদৌসি ভুত দেখার ভয়ে চমকে উঠে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল, তার হাত থেকে জগ পড়ে গেল। কিন্তু ভাগ্যিস যে কেউ শুনতে পায়নি, কারণ উঠানে কেউ ছিল না। হাসান আরো এগিয়ে গিয়ে হাতে ডাকল। এবার সে চিনতে পেরে পাখির মত উড়ে গিয়ে তার হাত ধরল। হাসান বলল, ‘চল’ ব্যস কেউ আর কোন কথা বলল না। একে অন্যের হাত ধরাধরি করে জঙ্গলের পথ ধরে উত্তর দিকে দৌড়াতে লাগল।

বিষয়: সাহিত্য

৯১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File