আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪৯

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১১ মে, ২০১৭, ০৩:৪৪:৪৪ দুপুর

হোসেন শাহ্‌ পরস্পর বিপরীত তথ্যের গোলক ধাঁধা – পাচ

হোসেন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবাদ ও জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। হয়ত এই জনশ্রুতি বা প্রবাদগুলর মধ্যেও সত্যতা লুকায়িত থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ হোসেন সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটি জনশ্রুতির উল্লেখ করা হল, আব্বাস আলী খানের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে “ এই ধরনের গল্পও তার সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে, বাল্যকালে হোসেন একজন স্থানীয় ব্রাহ্মণের আধীনে চাকুরী করতেন। এ বালক ভবিষতে এক বিরাট ব্যাক্তি হবে এরূপ আলৌকিক লক্ষণ তার মধ্যে দেখতে পেয়ে উক্ত ব্রাহ্মণ তাকে গৌড়ে নিয়ে যান। পরবর্তী কালে হোসেন বাংলার সুলতান হলে সেই ব্রাহ্মণকে মাত্র এক আনা খাজনার বিনিময়ে চাদপাড়া গ্রাম দান করেন। এইজন্য ঐ ‘চাদপাড়া গ্রাম’ পরবর্তীতে ‘একআনি চাদপাড়া গ্রাম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য বাংলার সুলতান হওয়ার পূর্বে এবং বাংলার হাবশী সুলতানের অধীনে সামান্য বেতনে চাকুরীতে যোগ দেওয়ার আগে হোসেনের জীবনের সাথে জড়িত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব স্বাক্ষ্যী হ’ল এই ‘একআনি চাদপাড়া গ্রাম’। একআনি চাদপাড়া গ্রাম’ এবং এর সাথে সুলতান হোসেনের সম্পর্ক সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার তার ‘The History of Bangal’ -এ বলেন, “-- তার (হোসেন শাহ্‌) অধিকাংশ ঘটনার কেন্দ্র হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর মহকুমার একটি গ্রাম যাকে বলা হয় –‘ একআনি চাদপাড়া’। বেশ কিছু প্রাচীন ভগ্নাবশেষ আছে এ গ্রামে। ‘জনশ্রুতি’ ও ‘শিলালিপি’ অনুযায়ী এগুলোকে হোসেন শাহ্‌ আমলের বলা হয়ে থাকে।” (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৩৬)।

যেহেতু হোসেন শাহ্‌ সম্পর্কে উপরে উল্লেখিত তথ্যগুল আমরা পাই ‘জনশ্রুতি’ ও ‘শিলালিপি’ উপরে ভিত্তি করে তাই তা একেবারে ফেলে দেওয়ার মত কোন তথ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল এক জন হিন্দু ব্রাহ্মণ, একজন আরব মুসলিম ছেলের মাঝে প্রতিভার স্বাক্ষর দেখতে পেয়ে দয়াপরবশত হয়ে তাকে ট্রেনিং দিয়ে যোগ্য ব্যাক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করা, তৎকালীন অর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবস্মত ধারনা। তৎকালে যেখানে ব্রাহ্মানরা নিন্ম বর্ণের হিন্দুদের জ্ঞান অর্জন করার অধিকারকে পর্যন্ত অস্বীকার করে ছিল। তাদেরকে অপবিত্র মনে করত, শুধু তাই নয় তাদের স্পশ করা পানি পর্যন্ত খেতে অস্বীকার করত সেই তাদেরই একজন একজন মুসলমান বালককে, যে কিনা আবার একজন মক্কার শরীফের ছেলে তাকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে যোগ্য করে তুলবে তা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু জনশ্রুতি ও শিলালিপি অনুসারে মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর মহকুমার একআনি চাদপাড়া গ্রামে জনৈক ব্রাহ্মানের আধীনে হোসেনকে ভবিষতের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে কঠোর ট্রেনিং দেওয়া হয়ে ছিল সেম্পর্কে আমরা জানতে পারি, ঐ একই লেখকের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৯ পৃষ্ঠায়, এ সম্পর্কে তিনি বলেন,“হোসেন চাদপাড়া গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মনের অধীনে রাখালের চাকুরী করেন। এ সময়ে কোন গুরুতর অপরাধে ব্রাহ্মণ তাকে বেদম বেত্রাঘাত করেন।” উল্লেখ্য মধ্যযুগে এই দেশে ছাত্রদেরকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া ছিল প্রচলিত রেওয়াজ। এখানে হোসেনের ব্রাহ্মনের অধীনে রাখালের চাকুরী গ্রহণ অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ । কেননা শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম এবং বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে হোসেন শাহ্‌ বাংলার সিংহাসনে বসে, যে হিন্দু দেবতার গুন কিত্তন করে ছিলেন তার নাম,‘ভগবান শ্রী কৃষ্ণ’, যিনি গোঁকুলে বড় হয়ে ছিলেন। তাছাড়া হিন্দুরা গরুকে গোমাতা বলে সস্মান ও পূজা করে থাকে। গরুকে হিন্দুরা কী পরিমাণ সস্মান ও ভক্তি করে থাকে তা বুঝার জন্য নীচের ছোট সংবাদটি যথেষ্ট, দৈনিক যুগান্তরের চৌথা মে, ২০১৭ এ একটি সংবাদের শিরোনামা ছিল “ ‘গরুর জন্য অ্যাম্বুলেন্স, মানুষের জন্য নেই!’ -

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী যেদিন গরুর জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করলেন, সেদিনই অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে মৃত সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হল এক দরিদ্র দিনমজুরকে।রাজ্যের এটাওয়ার সরকারি হাসপাতালে ১৫ বছরের গুরুতর অসুস্থ ছেলে পুষ্পেন্দ্রকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন উদয়বীর সিং। খবর বিবিসির। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে জানান, তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।অথচ সে দিনই 'গো-বংশ চিকিৎসা মোবাইল ভ্যান' নামে পরিসেবা চালু করে সে অনুষ্ঠানের ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দিনেশ শর্মা। এই পরিসেবার আওতায় আহত ও অসুস্থ গরুকে গোশালা বা পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছে দেবে। সঙ্গে একজন পশু চিকিৎসক এবং একজন সহকারীও থাকবেন। চালু হবে গো-সেবা বিনা শুল্কের টেলিফোন নম্বরও।(দৈনিক যুগান্তর, ০৪/০৫/২০১৭)”

উপরে উল্লেখিত তথ্যের আলোকে হোসেন শাহ্‌র মক্কার শরীফের পুত্র হওয়াতো দূরের কথা মুসলমান হওয়াটা ও প্রশ্নবিদ্ধ। বরং সে একজন ব্রাহ্মানের ছেলে হওয়াটাই মেনে নেওয়া বেশী যিক্তিযুক্ত যাকে কঠোর ট্রেনিং দেওয়া হয়ে ছিল ভবিৎষতের বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।

তা হলে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ মক্কী নামে পরিচিত বাংলার এই সুলতানের প্রকৃত পরিচয় কী?

সুলতান হোসেন শাহ্‌কে নিয়ে চিন্তা গবেষণা করেছেন এরকম ব্যাক্তিত্ব হলেন শ্রদ্ধের মাওলানা আকরাম খাঁ। তিনি তার মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে হোসেনের পরিচয় তুলে ধরেছেন একজন অজ্ঞাত কুলশীল ব্যাক্তি হিসাবে। তার ঐ গ্রন্থে তিনি বলেন, “ সুলতান হোসেন শাহ্‌ নামে পরিচিত এই ভদ্রলোকটির জাতি, ধর্ম, পূর্বাসন এবং তাহার উপাধী সম্বদ্ধে কোন ‘নির্ভরযোগ্য প্রমান’* বহু অনুসন্ধান সত্বেও আমরা এ পর্যন্ত খুঁজিয়া পাই নাই।”

(* সম্ভবত লেখক এখানে সুলতান হোসেন শাহ্‌ কতৃক সৃষ্ট প্রমানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন নাই। কেননা একজন প্রতারককে বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। এ বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।)

জামাতে ইসলামীর সাবেক আমীর আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৯ পৃষ্ঠায় সুলতান হোসেন শাহ্‌র উপরে আলোচনা করে বলেন, “ ----- এসব বিপরীত বিবরণ থেকে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হোসেন প্রকৃতপক্ষে ছিলেন অজ্ঞাত কুলশীল। একজন অজ্ঞাত কুলশীলে স্বর্থের খাতিরে সুযোগ বুঝে মুসলমান না হলেও মুসলমান বলে পরিচয় দেওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। মোটকথা ষড়যন্ত্র ও প্রতারনার মাধ্যমে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তার বংশ পরিচয় ও বাল্যজীবন সম্পর্কে নানান কল্পিত কাহিনী রচনা করা হয়।”

এখন যদি প্রশ্ন উঠে, ঐ জনৈক ব্রাহ্মণ হোসেন শাহ্‌কে কী লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য ট্রেনিং দিয়ে ছিলেন এবং কী বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে ছিলেন। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় না যে এই বিষয়ে বিশেষ কিছু লেখার আছে কেননা ইতিপূর্বে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছি যে হোসেন শাহ্‌ কিভাবে সুকৌশলে মুসলিম সমাজের আভ্যন্তরে পৌত্তলিকতার বিষ বাষ্প ঢুকিয়ে দিয়ে ছিল বিভিন্ন ভাবে। শুধু এতটুকু বলাই এখানে যথেষ্ট যে, হোসেন শাহ্‌ তার গুরুর মান রেখেছিল তার শিক্ষাকে সার্থক বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে; বাংলার হাবসী সুলতানের অধীনে সামান্য বেতনের চাকুরী দিয়ে শুরু করে প্রথমে সুলতানের প্রধান উজির এবং সর্বশেষে তার মালিক সুলতান মোজাফফর শাহ্‌কে হত্যা করে নিজেই সিংহাসনের মালিক বনে যায়। এই বিষয়টি আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম যে কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সব ইতিহাসবিদরা তাদের পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে হোসেনকে সৈয়দ বংশের একজন আরব বলে উল্লেখ করেছেন! এর সম্ভাব্য কারন হল সুচতুর ও প্রতারক হোসেন কতৃক তার বংশ পরিচয় সম্পর্কিত প্রচারনা। হোসেন শাহ্‌ যেমন তার জাড়িকৃত মুদ্রাকে (টাকা) ব্যাবহার করেছিলেন তাকে ইসলামের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে প্রচারনার জন্য; এটা অবিশ্বাস হলেও সত্য যে সে তার বংশ পরিচয়কেও জন সস্মুখে তুলে ধরার জন্য মুদ্রাকে ব্যাবহার করেছেন! সুলতান হোসেন শাহ্‌র মুদ্রায় প্রায়স এই লিখাটি দেখতে পাওয়া যায়, “সুলতান হোসেন শাহ্‌ বিন সৈয়দ আশরাফ উল হোসেনী (সৈয়দ আশরাফ-উল –হোসেনীর ছেলে সুলতান হোসেন শাহ্‌)”।** ফলে ইতিহাসবিদরা সহজেই হোসেনার তৈরি করা ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং এই তথ্যের উপরে ভিত্তি করে বলেছেন হোসেন ছিলেন একজন সৈয়দ, ফাতেমি, মক্কী এবং আরবের অধীবাসি। সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে এ কথা বলা ভুল হবে না যে, হোসেন এক ঢিলে দুই পাখী মেরেছেন, একদিকে যেমন তিনি তার জারিকৃত মুদ্রার সাহয্য নিয়ে তৎকালের লোকদের বিভ্রান্ত করে ফায়দা লুটেছেন অন্য দিকে সে ইতিহাসবিদের বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। সম্ভবত এটা ছিল তার বোনাস পাওনা। কেননা সে কালে মুদ্রার ঐতিহাসিক মুল্য সম্পর্কে লোকজন অবহিত ছিল না।!

**(https://en.wikipedia.org/wiki/Alauddin_Husain_Shah)

** Chowdhury, AM (2012). "Husain Shah". In Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A. Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second ed.). Asiatic Society of Bangladesh

চলবে ------

বিষয়: বিবিধ

৯২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File