সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম’ নামে গত শতাব্দীর সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে আমি একটি বই লিখি। সম্প্রতি বইটির ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে। সেটি বর্তমানে আমার Law Economics and History বইয়ের History অংশে সংযোজিত হয়েছে। সে বইয়ে কাজাখস্তানের কথাও উল্লেখ আছে। গত ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে কাজাখস্তান যাই। আইডিবির ২৮তম এই সম্মেলন কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি মোটামুটি জানতাম কাজাখস্তান বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র্র, কানাডা, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত এরপর কাজাখস্তান। রাশিয়া ১৮৭০ থেকে ’৭৬-এর মধ্যে কাজাখস্তান দখল করে নেয়। পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালে ক্রেনোস্কির নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা রাশিয়ার জারের পতন ঘটায়। কিন্তু তাদের ক্ষমতা সংহত হওয়ার আগেই আবার বিপ্লব হয় ওই বছরই। জারের অধীনে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাজাখস্তান ছিল। এরপর কমিউনিজমের অধীনে ছিল ১৯৯১ সালের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত। তাদের কিছু তেল শিল্প ছাড়া তেমন কোনো শিল্প কারখানা নেই। সেখানে গমের উৎপাদন ভালো। অন্য সবই তারা আমদানি করে।
কাজাখস্তানে জমি অনেক, মানুষ কম। সেখানে কৃষির সম্ভাবনা খুব ভালো। সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলিম, বাকি ৩০ শতাংশ অমুসলিম রুশ। জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ কাজাখ। রাশিয়ান বসতকারী ৩০ শতাংশ আর অন্যান্য ছোট গোষ্ঠী মিলে ১০ শতাংশ।
আসতানা এয়ারলাইন্সের পুরনো এয়ারক্রাফট করে আমরা দুবাই থেকে আলমাতি যাই। প্লেনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বিমানবন্দর থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন পথে কোনো মসজিদ দেখতে পেলাম না। পরে জানতে পারলাম ওই শহরে মোট ১৫টি মসজিদ আছে। আর গোটা কাজাখস্তানে আছে দেড় হাজারের মতো মসজিদ। এ কথা আমাকে আলমাতি শহরের প্রধান ইমাম জানালেন। আলমাতি শহরের প্রধান ইমামকে তারা বলে ‘ইমামে শহর’। সেই ইমামের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো। ইয়াং ম্যান। মাথায় বিরাট পাগড়ি।
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে যেতে কাজাখস্তানে যে ইসলাম আছে, তার কিছুই দেখতে পেলাম না। এটা আমার কাউকে নিরাশ করার জন্য বলা নয়, এটাই হচ্ছে বাস্তব অবস্থাটা। ইসলাম কোথাও আছে কি না, তা বুঝার জন্য আমরা লক্ষ করি সেখানে মসজিদ আছে কি না, লোকজনের মুখে দাড়ি আছে কি না, অথবা মেয়েরা হিজাব পরে আছে কি না। যে-কেউ বাংলাদেশে এসে এসব দেখতে পাবে। এসব দেখেই তারা ইসলামি দেশ বলে আমাদের শনাক্ত করে। সেখানে আমি মেয়েদের পশ্চিমা পোশাকে দেখেছি। তবে এটা ঠিক আলমাতি শহরের অর্ধেক রাশিয়ান। ছুটির দিন থাকায় রাস্তায় কম লোক ছিল। এর মধ্যে যে কয়জন মেয়ে চোখে পড়ল তাতে বলা যায় প্রতি এক শ’ জনের মধ্যে মাত্র দু-তিনজন মেয়ের মাথায় স্কার্ফ আছে। মেয়েরা শার্ট-প্যান্ট পরা, ওড়না ছাড়া ও বুকে অতিরিক্ত কাভার ছাড়া। সেখানে আমি ওড়না, হিজাব, দাড়ি, টুপি কিংবা লম্বা কাপড়ও দেখলাম না। এর মাধ্যমে আমি সেই সোসাইটি ইসলামিক কী নন-ইসলামিক, তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বরং আমার মন বলল, এখানে ইসলাম খুব দুর্বল।
আমি যে হোটেলে ছিলাম তার নাম হোটেল রিজেন্ট আলমাতি। এখানেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশ সুন্দর হোটেল। সেখানকার জনগণের সাথে আমার আলাপ হয়। আমার একটা বইয়ে আমি লিখেছিলাম, ১৮৯৯ সালে কাজাখ পপুলেশন ৩০ শতাংশ হয়ে গেছে। এটা কমতে কমতে হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরের কাজাখ জনসংখ্যা বাড়ার কারণে হোক আর রাশিয়ানদের চলে যাওয়ার কারণেই হোক, আজকে কাজাখ ৭০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসার পর জানতে পারলাম, সেখানে মোটামুটি ২০ শতাংশ মানুষ নামাজ পড়ে। রোজা আরো বেশিসংখ্যক লোক রাখে। এটা শুনে আমার কাছে সংখ্যাটা খুব একটা খারাপ বলে মনে হলো না। এসব দেখে একজন ইসলামিস্ট হিসেবে আমার মাথা তখন ঘুরছে এই ভেবে যে, এই দেশে ইসলামের কাজ কিভাবে করা যায়? আমি প্রথম নিশ্চিত হলাম কাজাখস্তান অচিরেই ইসলামের পিলার হবে এমন কোনো আশা নেই। পঞ্চাশ-এক শ’ বছর পর গিয়ে ইতিহাসের আলোকে বলা যায় এখানে হয়তো ইসলামের প্রচার-প্রসার হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কাজাখস্তানের পক্ষে ইসলামের জন্য রোল প্লে করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ হলো কমিউনিস্টেরা গত এক শ’ বছরে সেখানে এত বেশি ডি-ইসলামাইজড করে ফেলেছে যে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের অনেক সময় লাগবে।
আমি সেই সাথে আরেকটি জিনিস ভাবছিলাম। যদি এখানে ইসলামের জন্য কাজ করতে হয় তাহলে তার জন্য কী করতে হবে? আমি ভাবছিলাম, এরপর আমি সেখানকার কিছু কাজাখ পুরুষ ও নারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে দেশের মানুষ ইসলামকে ভালোবাসে কি না। কেননা আমার মন বলল, যদি তারা ইসলামকে ভালোবাসে তাহলে ইসলামের জন্য কাজ করার ও ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু আশা আছে। আর যদি ভালো না বাসে তাহলে তো আশাই নেই। তারা মোটামুটি জানাল, তাদের প্র্যাকটিস যা-ই হোক, তারা ইসলামকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তারা তাদের আইডেন্টিটির ব্যাপারে সচেতন। তাদের বরং এ বিষয়ে অহমিকা যে রাশিয়ানরা গুড ফর নাথিং। তারা অনেক সুপিরিয়র। এ ধরনের মানসিকতা তাদের আছে। জাতীয়তা আছে। তাদের ভেতর কাজাখ ও মুসলিম ফিলিংস আছে। স্বাধীনচেতা মনোভাবও আমি তাদের মধ্যে লক্ষ করলাম। তখন আমার মনে একটা আশা জাগল, সেখানে কাজ করার অন্তত একটা ভিত্তি আছে।
আমি ডেলিগেট হিসেবে আসা অন্যান্য দেশের বন্ধুদের সাথে সেখানে কিভাবে কাজ শুরু করা যায় সে ব্যাপারে আলাপ করলাম। আমি জানি এখানে নামাজ পড়ার কথা বলে কাজ শুরু করা যাবে না। আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করে সামনে এগোতে হবে। আমার মনে কোনো সাহসই নেই যে, আমি তাদের হিজাব তো দূরের কথা নামাজের কথা বলব, তোমরা নামাজ পড়ো। তা করাও আমার কাছে কঠিন বলে মনে হলো। তবে আমার মন একটি বিষয় নিয়ে দাওয়াত শুরু করার কথা বলল। যেই কাজ করুক না কেন, অন্তত এটা বলতে পারে, তোমরা নিজেদেরকে যে মুসলিম বলো এবং ইসলাম নিয়ে গর্ব করো, তাহলে অন্ততপক্ষে কুরআন শরিফের অর্থ তোমরা পড়ে ফেলো। এতে যদি শতকরা মাত্র একজনও সাড়া দেয় তাহলেও এই এক শতাংশেরই ভিত্তি হবে, যারা বাকি ৯৯ জনকে আস্তে আস্তে ইসলামের কথা বলবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এখানে তাৎক্ষণিক ফলাফলের কোনো অবকাশই নেই। আমাদের দেশের মানুষ কত ধরনের দাবি করে বসে, কিন্তু আমরা ভাবতেই পারি না পরিস্থিতির কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কী ধরনের পরিবর্তন হয়ে যায়। মালয়েশিয়ায় মুসলিম অমুসলিমদের যে রকম সহাবস্থান দেখেছি- সেখানে মুসলিমেরা হিজাব পরছে অমুসলিমেরা ওয়েস্টার্ন পোশাক পরছে, তাতে আমি বুঝেছিলাম, জোর করে কোথাও ইসলাম করা যাবে না। এ কথাটিই কাজাখস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে জোর করে ইসলাম করার আর কোনো অবকাশ নেই। মানুষকে ডেমোক্র্যাসির অধীনে রাখতে হবে। সবাইকে স্বাধীনতা দিতে হবে। সেখানে মূল কাজ হবে শিক্ষা ও দাওয়াত। এর জন্য কারা এগিয়ে আসবে আর কারা আসবে না তার জন্য আসল বিচারক আল্লাহ তায়ালা তো আছেনই। সব কিছুর বিচার তো দুনিয়াতে হবে না। কিন্তু আমরা কেন দুনিয়াতে সব কিছুর বিচার চাই? আল্লাহ তায়ালা আখেরাত তো এ জন্যই রেখেছেন, যারা অন্যায় করবে সেখানে তাদের শাস্তি দেবেন। মালয়েশিয়া থেকে আসার পর আমার মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হলো যে, জোর করে ইসলাম করার কোনো সুযোগই নেই। আর কাজাখস্তান সফরে এসে বুঝলাম- সেখানে এর কোনো সম্ভাবনাও নেই, যদি না আল্লাহ কোনো সুযোগ সেখানে দান করেন তা ব্যতীত।
এটা আমার জীবনের একটা নতুন শিক্ষা ছিল। ইসলাম সম্পর্কে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা এই অঞ্চলে আমরা যে রকম ভাবছি, তা সব দেশের জন্য স্ট্র্র্যাটেজি না-ও হতে পারে। স্ট্র্যাটেজি আমেরিকার জন্যও এক হতে পারে না। আমরা পড়েছি, strategy and policy cannot be same. পরিস্থিতি বুঝে স্ট্র্যাটেজি এবং পলিসি পরিবর্তিত হবে। সেখানে কাজাখস্তানের পলিসি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। সেখানে বাংলাদেশের মতো পলিসি গ্রহণ করা যাবে না। সেখানে বেশ কিছু ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আছে। কিন্তু তাদের সেভাবে কাজ করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তাদের মসজিদের বাইরে কাজ করতে দেয়া হয় না। নানা ধরনের বাধা সেখানে আছে। এর থেকে উজবেকিস্তানের অবস্থা অনেক ভালো। তবে এটা একটা বিপ্লব, যে দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে কোনো একটা ইসলামি সম্মেলন হয়নি, সেখানে আল্লাহ তায়ালা নাম দিয়ে প্রথমবারের মতো আইডিবির সম্মেলন শুরু হয়েছে। তারাও আজ ওআইসির সদস্য। প্রশ্ন হলো, তাদের ভেতর কোনো-না-কোনো চেতনা কাজ না করলে তারা ওআইসিতে আসবে কেন? তার রেজাল্ট হিসেবে ২০০৩ সালের আইডিবি সম্মেলন হয়েছে আলমাতিতে এবং প্রত্যেকটি সেশন কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে শুরু হয়েছে। গত সত্তর বছর যা হয়নি তাই এবার হয়েছে। আরো লক্ষণীয় ছিল, যিনি সেই দেশের প্রেসিডেন্ট তিনিও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে বক্তৃতা শুরু করেছেন, যিনি একজন প্রাক্তন মার্কসিস্ট এবং প্রাক্তন কমিউনিস্ট। তিনি আগেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এখনো প্রেসিডেন্ট। তিনিও তার বক্তৃতায় মুসলিম উম্মাহর কথা বলেছেন। বলেছেন আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দরকার।
কাজাখস্তানের অবস্থা দেখে আমার মন খুব খারাপ ছিল। না খেতে পারছি, না দাঁড়াতে পারছি। পরিস্থিতির এতটা কল্পনা করিনি। মন অস্থির হয়ে আছে। সেখানে একটা কাজাক মেয়েকে পেলাম যে সম্পূর্ণ হিজাবে আবৃত ছিল। ভাগ্যক্রমে আমার পাশেই এসে সেই ইয়ং মেয়েটি বসল। ইনভেস্টমেন্টের ওপর সেমিনার হচ্ছিল। আমি সুযোগ পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মতো কয়টা মেয়ে হিজাব পরে। সে নিজেই মাত্র এক বছর আগে হিজাব শুরু করেছে বলে জানাল। মেয়েটি ইংরেজি জানে। তবে ভালো ইংরেজি জানে না। সে জানাল আস্তে আস্তে হচ্ছে। সে আরো জানাল- সেখানে ইসলাম নিষিদ্ধ ছিল। সে দেশে হঠাৎ করে ইসলাম আসবে না, ধীরে ধীরে হবে।
ড. গুলিরা নাজারবায়েক নামে এক মহিলার সাথে দেখা হয়। আমি আমার ঝড়পরধষ খধংি ড়ভ ওংষধস বইটির পাঁচটি কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই বইয়ের চারটা কপিই বিলি হয়ে যায়। পঞ্চম কপিটি সেখানকার এক রিসিপশনিস্ট মেয়েকে দেবো বলে ঠিক করেছিলাম, তার নাম নাজ গুল। আমি সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে চা খাচ্ছিলাম। বইটি আমার হাতে দেখে সেই মহিলা ড. গুলিরা সরাসরি বইটি চেয়েই বসলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বইটি আমি কোথায় পেয়েছি? আমি যেই বললাম, বইটি আমার লেখা, তখন তিনি বললেন বইটি আমাকে দিয়ে দিন। পঞ্চম কপিটি তাকে দিলাম। চিন্তা অনুযায়ী সেই মেয়েটিকে আর দিতে পারলাম না। সেখানে আমি বই নিয়ে যাওয়ার যে কী বেনিফিট তা বুঝতে পারি।
ইসলামের কাজে দাওয়াতের জন্য প্রচণ্ড মন থাকতে হয়। সেটা আসলে আমাদের অনেকের মধ্যে নেই। আমরা এটা বুঝতে পারি না যে, একটা শক্তিশালী বোধ ও কার্যকরী দাওয়াতি মন আমাদের নেই। আমি ইচ্ছা করে পাঁচটি কপি নিয়েছিলাম, বেশি নিলে যদি সেখানকার কাস্টমস ধরে সে ভয় আমার ছিল। যাওয়ার পথে দুবাই এয়ারপোর্টে ১২ ঘণ্টা থাকতে হয়। সেখানে এক আফ্রিকান যুবকের সাথে দেখা হয়। সে সোমালিয়ার ছেলে। ইংল্যান্ডে জন্ম হওয়ায় সোমালিয়া সম্পর্কে ভালো করে বলতে পারবে না বলে আমাকে জানাল। তার ঈমান বেশ মজবুত বলে লক্ষ করলাম। সে ইসলামকে সাংঘাতিক ভালোবাসে। কিন্তু সে ইসলামের বই পড়েনি। সাইয়্যেদ কুতুব, হাসান আল বান্নার নামও জানে না, যদিও তার জানার কথা ছিল। তাকে আমি ইসলাম, মুসলমান সম্পর্কে বললাম এবং ওয়াদা করালাম ইসলামের ওপর পড়াশোনা ও কাজ করার জন্য। তাকে অনুপ্রেরণা দিলাম খুব। সে বলল, ইনশা আল্লাহ আমি করব, আমি আপনার কাছে ওয়াদা করছি। আমি তাকে আমার বইয়ের প্রথম কপিটি দিলাম। এর জন্য আমি আবার বলি আমাদের একটা প্রচণ্ড দাওয়াতি মন থাকতে হবে। সেটা কিন্তু বাস্তবে আমাদের নেই। আমরা ইসলামের জন্য খুব কম কাজ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতকে আমার জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলেছি। ফলে দাওয়াতের জন্য আমাকে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হয় না। এটা আমার জীবনেরই একটা অংশ। আমার সাথে একটা ফাইল সব সময়ই থাকে। যেখানেই সুযোগ পাই তার ভেতর থেকে অবস্থা বুঝে কাগজপত্র বিতরণ করি। আমাদের দাওয়াতি মানসিকতা থাকতে হবে। কোনটা ভালো ম্যাটেরিয়াল, কোনটা ভালো নয় সে পার্থক্য করার বোধ আমাদের থাকতে হবে।
মস্কোতে থাকেন এমন একজন আজারবাইজানি মুসলিম ব্যাংক অফিসারও জানালেন সেখানে ইসলাম নিষিদ্ধ ছিল। অগ্রগতির জন্য সময় লাগবে। কাজাখস্তান সফরে গিয়ে আমি প্রথমে শকড হয়েছি। কাজাখস্তান যে এতটা ডি-ইসলামাইজড তা আগে বুঝিনি। কোনো মুসলিম কান্ট্রি এতটা ডি-ইসলামাইজড তা আগে দেখিনি। আমি বাংলাদেশকে ইসলামের আলোকে খারাপ মনে করি। কিন্তু কাজাখস্তানের তুলনায় বাংলাদেশকে জান্নাতুল ফেরদৌস বলতে হবে। এ জন্য পরিপ্রেক্ষিতের (পারসপেকটিভ) বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অবস্থান থেকে আমি দেখছি তা গুরুত্বপূর্ণ। কাজাখস্তান থেকে বাংলাদেশ দেখলে মনে হবে বাংলাদেশ জান্নাতুল ফেরদৌস। আর রাসূলের সময়ের মদিনা থেকে দেখলে মনে হবে এখানে condition bad, এ জন্য আমরা আমাদের জাজমেন্ট কোত্থেকে করছি তা বোঝার বোধও আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। তাই কাজাখস্তানে কয়েক পারসেন্ট মেয়ে যদি হিজাব পরে তাহলে আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারব না। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা যেন বাস্তববাদী হই। আমরা যেন বুঝতে শিখি। আমরা সব কিছুকে যেন খারাপ না বলি, আবার সব কিছুকে যেন ভালো না বলি। বাংলাদেশের সব খারাপ এটা আমাদের বলা উচিত নয়। আবার কাজাখস্তানের সব খারাপ তাও বলা ঠিক না। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদের ঈমান দেখবেন। কমিউনিস্ট ডিক্টেটরের অধীনে তারা যে তাদের ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছে তাই তো অনেক। আমরা বাইরের দিক দেখে বিচার করে অভ্যস্ত। আমি তাদের হিজাবকে দেখেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাজমেন্ট অনেক গভীর হতে হবে।
সে জন্য কাজখস্তানে ইসলামের জন্য কাজ করতে প্রত্যেক মুসলিম দেশের দূতাবাস সেখানে খোলা উচিত। আমি জানি একটা অ্যাম্বাসি খোলা যথেষ্ট খরচের ব্যাপার। কিন্তু সে খরচও খুব বেশি নয়, বড়জোর বছরে দুই কোটি টাকা। সেখানে বাংলাদেশেরও দূতাবাস খোলা উচিত। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব সেখানে দূতাবাস খুলেছে। সেই সাথে আমাদের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের বলব- তাদের সে দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাওয়া উচিত। সেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা একদম ফ্রি। তাই ব্যবসায়-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ রয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা গেলে তাদের সাথে যোগাযোগ বাড়বে। আমাদের দেশে যেমন সুফি এবং ব্যবসায়ীরা ইসলাম প্রচার করেছেন সেখানেও সে দেশের ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যবসায়ীরা দায়িত্ব নিতে পারেন। ব্যবসায়ের জন্য উন্মুক্ত বলে একজন ব্যবসায়ী সেখানে একটা অফিস খুললে সেটা সে দেশের মুসলমান জনগণের অগ্রগতিতে সহায়ক হবে। পারস্পরিক পরিচয়ের মাধ্যমেই কাজ এগোবে। সেখানে তাড়াহুড়োর কোনো অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশেও আমাদের অধৈর্য হওয়া ঠিক নয়। আমাদের কাজ বেশি করতে হবে এবং হিকমত প্রয়োগ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলেই সব খারাপ হয়ে যাবে। তার মানে এই নয়, অযোগ্যতার কারণে আমরা দেরি করি। তার জন্য যোগ্যতা বাড়িয়ে আমাদের আউটপুট বাড়ানোর দরকার।
কাজাখস্তানে পারমাণবিক প্রকল্প আছে কিন্তু তা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। টুডে অর টুমরো বিশ্বে নিউক্লিয়ার পাওয়ার থাকবে না। সে হিসেবে কাজাখস্তানে সেই পারমাণবিক প্রকল্প তাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সমস্যা নেই। সেখানে রুশ এবং কাজাখদের মধ্যে একরকম টেনশন কাজ করে। সরকারি কাজ কাজাখরা পায় কিন্তু রুশরা পায় না। প্রাইভেট সেক্টরে আবার রুশরা বেশি যোগ্য হওয়ায় বেশি সুযোগ পায়। আমার যতটুকু মনে হয়েছে- কাজাখরা রাশিয়ানদের সাথে একটা সম্পর্ক রেখেই চলতে চায়। একে তো জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ রুশ, আবার রাশিয়ার প্রতিবেশী।
সেখানে যেসব ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ আমার হয়নি। কাজাখস্তানে ইসলামের কাজ এগিয়ে নিতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন মুসলিম দেশে কাজাখ স্টুডেন্টদের স্কলারশিপ দিতে হবে। এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার অনেক সুযোগ আছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন