জাকাত ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। এটি ইসলামের একটি প্রধান ইবাদত। জাকাতব্যবস্থা কায়েম করতে হলে এর বিধিবিধান, জাকাত কিসের ওপর ধার্য হয়, কত পরিমাণের ওপর ধার্য হয়, কী হারে জাকাত দিতে হয়- এসবের বিস্তারিত জ্ঞান জনগণকে দিতে হবে। ফিকাহর প্রাচীন পুস্তকসমূহে এ সম্পর্কে যেসব বিধান রয়েছে জনগণকে সে সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করা হয়নি। কাজেই জাকাত সংক্রান্ত সব বিষয়ের সঠিক জ্ঞান জনগণকে দেয়া জরুরি।। তবেই সালাত আদায় করা যেমন জনগণের জন্য সহজসাধ্য, জাকাত আদায়ও তেমনি সহজসাধ্য হবে।
কিসে জাকাত ধার্য হয়
টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, স্বর্ণ-রৌপ্য, স্বর্ণ-রৌপ্যের অলঙ্কার, অন্যান্য মূল্যবান ধাতু, ক্ষেতের ফসল, ব্যবসায়ী পণ্য, কারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য, ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি পশু এবং খনিজ সম্পদের ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ। এসব ছাড়াও মুসলিম মালিকানাধীন জমির ফসলের ওপর ওশর ফরজ। হানাফি ফকিহদের মতেও, জমি যদি খারাজি প্রমাণ পাওয়া না যায় তবে তা ওশরি বলে গণ্য হয়ে থাকে এবং এর ওপর ওশর প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য, ফসলের জাকাতকে ওশর বলা হয়।
আর এ কথা সর্বজনবিদিত, বাংলাদেশের যে ভূমি কর ধার্য করা হয় তা খারাজি নয়। বাংলাদেশের জমিও ওশরি ভূমি (দ্রষ্টব্য: সাইয়েদ মুহাম্মদ আলী, ওশরের শরিয়তি বিধান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা)।
বিভিন্ন দেশে জাকাত আইনে বছরের শেষ দিনে শিল্প কারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের স্টকের ওপর জাকাত ফরজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাঁচামালের ওপর জাকাত ধার্য করার যুক্তি হচ্ছে, স্টকে থাকা কাঁচামাল ব্যবসায়ের স্টকের বা শিল্প উৎপাদনের মতোই। অবশ্য কারখানার যন্ত্রপাতির ওপর কোনো জাকাত নেই।
জাকাতের হার
জাকাতের হার হচ্ছে- নগদ অর্থ, ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ, অলঙ্কারের মূল্য, শেয়ারের মূল্য এবং বছর শেষে শিল্পপণ্যের স্টক, ব্যবসায়ের স্টক, শিল্পের কাঁচামালের স্টক- এসবের শতকরা আড়াই ভাগ। ফসলের ওপর ওশর ধার্য হবে যদি তা সেচ দেয়া না হয়, তাহলে শতকরা ১০ ভাগ, আর সেচ দিতে হলে শতকরা পাঁচ ভাগ। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খনির উৎপাদনের ওপর, সমুদ্রে আহরিত মাছের মূল্যের ওপর শতকরা ২০ ভাগ। গরু, বাছুর, মহিষ, উট ইত্যাদির ওপরও জাকাত রয়েছে। তার হার নির্ধারণে ফিকাহর কিতাব দেখে নেয়া উত্তম।
নিসাবের পরিমাণ
নিসাব বা কত পরিমাণ সম্পদ থাকলে জাকাত দিতে হয়, এ সম্পর্কেও জনগণ পূর্ণভাবে অবহিত নয়। জাকাত বাস্তবায়নের জন্য এ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে। রৌপ্য, নগদ অর্থ, ব্যবসায়পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য। বর্তমান বাজার দরে এটা প্রায় ১০ হাজার টাকা। এ পরিমাণ সম্পদ থাকলে জাকাত ফরজ। এসব ক্ষেত্রে বছর শেষে যে পরিমাণ সম্পদ থাকবে সে সম্পূর্ণ সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে। স্বর্ণের ও স্বর্ণালঙ্কারের ক্ষেত্রে জাকাতের নিসাব হচ্ছে, সাড়ে সাত তোলা। যদি রৌপ্য, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর একত্রে থাকে, তবে নিসাব হচ্ছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য। ফসলের নিসাব হচ্ছে পাঁচ ওয়াসাক বা ২৭ মণ ফসল। তেমনিভাবে গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির নির্দিষ্ট নিসাব রয়েছে। খনিজ সম্পদের বেলায় অধিকাংশ ফকিহর মতে, কোনো নিসাব নেই।
জাকাত দেয়ার বছর কিভাবে গুনতে হবে?
কোনো সম্পদেই বছরে একবারের বেশি জাকাত নেয়া হয় না। সব ফিকাহবিদই এ ব্যাপারে একমত। ক্ষেতের ফসল, খনিজ সম্পদ, সমুদ্র থেকে পাওয়া সম্পদ ও মাছের ক্ষেত্রে সারা বছর এসব সম্পদ হাতে থাকার শর্ত নেই।
ফসল উৎপন্ন হওয়া ও আহরণের পরপরই এসব ক্ষেত্রে জাকাত দিতে হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও জাকাত আদায় করার জন্য একটি পূর্ণ বছর ঠিক করে নিতে হয়। যেমন ১ রমজান থেকে শাবানের শেষ দিন। এ ব্যাপারে ইমাম মালিক ও ইসলাম শাফেয়ির মত হচ্ছে যে, শুধু বছরের শেষের হিসাবটা ধরতে হবে। অর্থাৎ জাকাত দেয়ার জন্য বছরের শেষ দিনে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তবে বছরের শুরুতে বা মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকলেও জাকাত দিতে হবে। ইমাম আবু হানিফা ও তার সঙ্গীগণ, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ মত প্রকাশ করেছেন যে, নিসাব বছরের শুরু ও শেষে থাকলেই জাকাত দিতে হবে। বছরের মধ্যের অবস্থা গণ্য করা হবে না। এটিই অধিকাংশ ফিকাহবিদের মত। এ ব্যাপারেও জনগণকে বিশেষভাবে অবহিত করা দরকার, যেন তারা সহজে জাকাত দিতে পারে। (দ্রষ্টব্য: ইউসুফ আর কারজাভি, ইসলামে জাকাতের বিধান, পৃ: ৪০২-৪০৩)।
কত পরিমাণ দিতে হবে?
অভাবগ্রস্তকে এমন পরিমাণ জাকাত দিতে হবে, যাতে আর অভাব না থাকে। এ প্রসঙ্গে অধিকাংশ ফকিহর মতে, জাকাতের গ্রহীতাকে এক বছরের প্রয়োজন পূর্ণ করে দিতে হবে। কেউ কেউ সমগ্র জীবনের প্রয়োজন পূর্ণ করে দেয়ার কথা বলেছেন। এর অর্থ, জাকাত গ্রহীতাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ জাকাত দেয়া, যার মাধ্যমে তার কর্মসংস্থান হয় এবং প্রতি বছরই তাকে জাকাতের জন্য হাত পাততে না হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা:-এর মতে, যখন দেবেই তখন সচ্ছল বানিয়ে দাও (ইউসুফ আল কারযাভি, ইসলামে জাকাতের বিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ৩১-৩৭)। উপরে উল্লিখিত আদর্শ মোতাবেক জাকাত প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশের বিরাজমান সামাজিক পরিস্থিতিতে ধনী লোকেরা অভাবীদের অল্প পরিমাণ অর্থই প্রদান করে থাকেন। তবে প্রত্যেক ধনী ব্যক্তির উচিত কমপক্ষে কিছু অভাবী মানুষকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা।
প্রাপককে কি জানাতে হবে?
প্রাপককে দেয়ার সময় জাকাত দেয়া হচ্ছে, এটা বলা কি প্রয়োজন? অধিকাংশ ফকিহর মত হচ্ছে, তা বলার প্রয়োজন নেই। আল মুগনির লেখক ইবনে কুদামা বলেন, একজনকে ফকির মনে করে তাকে জাকাতের মাল বলে দেয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। মালিকি মাজহাবের কেউ কেউ বলেছেন, বলাটা মাকরুহ। কেননা তা বললে ফকিরের দিল ক্ষুণ্ন হয়। ইউসুফ আল কারযাভির নিজের মত হচ্ছে, উত্তম নীতি হলো জাকাতদাতা ফকিরকে জানাবেন না যে, এটি জাকাতের মাল, কেননা ওইরূপ করা গ্রহীতার জন্য মানসিক কষ্টদায়ক হতে পারে (ইউসুফ আল কারযাভি, ইসলামে জাকাতের বিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ৪২৯-৪৪৩)।
সামাজিক নিরাপত্তার প্রধান ব্যবস্থা
এ পর্যায়ে ইসলামের সবচেয়ে প্রধান ও বিখ্যাত ব্যবস্থা হচ্ছে জাকাত। জাকাত কোনো সাধারণ কর বা শুল্ক নয়। সব কাজে জাকাতকে ব্যবহার করা যায় না। জাকাত হচ্ছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি। জাকাতের মাধ্যমে ইসলাম সমাজকে দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করতে চায়। জাকাতের হকদার হচ্ছে তারা- যারা কর্মক্ষমতাহীন এবং যারা কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উপার্জনহীন অথবা যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জন করতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, জাকাত পাবে ফকির, মিসকিন, জাকাতের কর্মচারী, যাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা দরকার, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ও নিঃস্ব পথিক। আল্লাহর পথে সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজেও এ অর্থ খরচ করা যাবে (আল কুরআন, ৯:৬০)।
লেকক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন