ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সম্পর্কে দ্বিধা আছে, যা মূলত ধর্মহীনতা এবং এর ব্যাখ্যা আমি নিচে দিয়েছি। সর্বত্র মুসলমানরা চায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার; ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। ইসলামি বিদ্বজ্জন রশিদ ঘানুসি জোর দিয়েছেন গণতন্ত্রের ওপর, ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর নয়। ইসলামি দলগুলোর বাইরের দলগুলোকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দল বলা উচিত নয়। এগুলোর বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক দল। ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো মুসলিম দেশে গণতন্ত্রকে সহ্য করে না। কোনো দোষ ছাড়া ড. মুরসিকে উৎখাত করা হয়েছে মিসরে, যদিও তিনি শক্তি প্রয়োগ করেননি বিরোধীদের বিরুদ্ধে।
আঠারো শতকে পাশ্চাত্যে ‘মুক্তবুদ্ধি’র আন্দোলন শুরু হয় এবং এর প্রভাবে আধুনিক সেকুলার মতবাদ পাশ্চাত্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শিক্ষা থেকে ধর্ম আলাদা করা হলো। এভাবে যে স্কুলব্যবস্থা গড়ে উঠল, তাতে মানুষ নিতান্ত স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠল। তারা ভোগবাদী হয়ে পড়ল। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। যে ধর্মের দ্বারা কোনো কাজ হয় না, তার প্রতি সম্মানও কমে গেল। নীতিবোধের যে শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য, তাও লোপ পেল। নীতিহীনতা ও স্বার্থপরতা নিয়ে মানুষ গড়ে উঠল। এই স্কুলে জেনারেলরা গড়ে উঠলেন, পলিটিশিয়ান ও চিন্তাবিদেরা তৈরি হলেন। তাদের মনের গভীরে এই মনোভাব স্থায়ী হলো যে, জনসমাজের জন্য ধর্মের প্রয়োজন নেই; চাই সেটা পার্লামেন্ট, মার্কেট, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংক যা-ই হোক না কেন। এই যে এক ধরনের ব্যক্তিগত মনমানসিকতা গড়ে উঠল, এর ভিত্তিতে তাদের সামাজিক আচরণ তৈরি হলো।
এর ফলে সব ক্ষেত্রে তার প্রভাব কার্যকর হলো। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডারউইনিজম প্রবেশ করল। অর্থাৎ Survival of the Fittest-কে মূলমন্ত্র করে নেয়া হলো। অর্থাৎ কেবল ‘যোগ্যতম’ই টিকে থাকবে। এর মানে, যারা যোগ্যতম নয় তারা ধ্বংস হোক, এতে কিছু আসে-যায় না। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকে আমরা বাধা দেবো কেন? ‘এভাবেই কোনো জাতি যদি এ উপমহাদেশের লোক হয়ে কিংবা আফ্রিকা বা চীনের লোক হয়ে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতম প্রমাণিত না হয় বা টিকতে না পারে, তবে তারা হেরে যাবে। এখানে কোনো নীতিবোধ ও দয়ামায়ার প্রয়োজন নেই। এটাই বরং যুক্তিযুক্ত যে, যোগ্যতমকে আমরা এগিয়ে দিলাম।’ এটাই ছিল সোশ্যাল ডারউইনিজম, যা ছিল খ্রিষ্টান ধর্মের বিরোধী, ইসলামের বিরোধী।
কিন্তু পুঁজিবাদ যখন সেকুলারিজমের (যার প্রকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্ম বর্জনবাদ) সঙ্গী হলো, তখন ইউরোপে শ্রমিককে এমনভাবে শোষণ করা হলো যে, তাদের শুধু বেঁচে থাকার অবস্থায় রেখে দেয়া হলো; তাও শুধু উৎপাদনের স্বার্থে। পরে এর প্রতিক্রিয়াতেই কমিউনিজমের জন্ম হলো, সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটল। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির মতবাদ বা সেকুলারিজম আরোপের ফল হলো, অর্থনীতিতে অমানবিকতা ও নীতিহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং বলা হলো- ‘এটা হচ্ছে পজিটিভ সায়েন্স। অর্থনীতি একটি অবিমিশ্র বিজ্ঞান, এর মধ্যে নীতিবোধ থাকবে না, নীতি থাকবে না। যেমন- বাতাস বা পানির জন্য আমরা কোনো নীতি দেই না, তেমনি অর্থনীতিরও কোনো নীতি থাকবে না। এটা নিজের গতিতে চলবে।’ এগুলোর পরিণাম অর্থনৈতিক সঙ্কট। এটা হয়েছে অতি লোভ এবং অতি লোভের আকাঙ্ক্ষা থেকে এবং রিবা (সুদ) এটাকে সাহায্য করেছে। সুদ না থাকলে এটা কখনোই হতো না।
একই সাথে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানেরা দুনিয়া বিজয়ে বের হয়ে গেল। ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস প্রায় সারা দুনিয়া দখল করে নিলো। দুই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও আফ্রিকার প্রায় ১০০ শতাংশ এবং এশিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে নেয়া হলো। তা করতে গিয়ে এরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং ওইসব দেশের স্থানীয়দের সাথে পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মুক্তবুদ্ধির অনুসারীরা সারা দুনিয়া জয় করেছিল। তাদের নীতিহীনতা এই বিজয় এনে দিলো। কেননা, কোনো নীতিবাদী সমাজ এভাবে পররাজ্য আক্রমণ করতে পারে না; দখল করতে পারে না। তারা লুট করল বিশ্বকে। আফ্রিকার মতো একটি সমৃদ্ধ মহাদেশকে বিরান করে ফেলল। লোহাসহ নানা ধরনের খনিজসম্পদ, স্বর্ণ, হীরা সবই তারা লুট করে নিয়ে গেল। দক্ষিণ আমেরিকাকে স্পেনীয়রা লুট করল। ব্রিটিশরা আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাকে লুট করল, যেমন আফ্রিকাকে করা হয়েছে। লুটতরাজ ছিল এদের আসল কাজ।
পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্ভ থেকে চারটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মতবাদের জন্ম হয়েছে- ফ্যাসিজম, কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম ও সেকুলারিজম। কেবল ডেমোক্র্যাসি ছাড়া তারা ভালো কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
স্রষ্টাকে যারা কোনো স্থান দিতে রাজি নয়, তারা পরিবার ও জেন্ডার ইস্যুতে পশুর মতো হয়ে গেল। তারা মনে করল, ‘পরিবারের গুরুত্ব নেই এবং এটি হলো নারীদের দাবিয়ে রাখা একটি প্রতিষ্ঠান, তাদের দাস বানানোর জন্য।’ তারা বরং পশুর মতো থাকাই ভালো মনে করল। পরিবার গঠন করার নাকি প্রয়োজন নেই। যদি কেউ পরিবার গঠন করেও তবে এটা হবে নিছক সন্তান জন্মদানের জন্য। অর্থাৎ তা পশুর মতোই হবে। এমনও হতে পারে, একটা কমিউন হবে, সেই কমিউনে ১০০ পুরুষ ও ১০০ নারী থাকবে। কার শিশু কেউ জানবে না। সবাই মিলে শিশুদের পালন করবে। তারা এমন একটা ধারণাও নিয়ে এলো যে, তত দিন পর্যন্ত একটা পশু তার বাচ্চা লালন করে, যত দিন সে নিজের খাবার নিজে খেতে না পারে। তত দিন পর্যন্ত বাঘও পালে; কুকুরও পালন করে যত দিন বাচ্চা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। মানুষকেও তাই করতে হবে। মনোভাব এমন- ‘কেন ৩০ বছর পর্যন্ত খাটব আমি? কেন ত্যাগ স্বীকার করব? সন্তান জন্ম নিয়েছে এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সে এখন বড় হয়েছে। সে নিজেই নিজের কাজ করে বেড়াক। আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। আমার স্বার্থ কেন ত্যাগ করব? আমি কেন আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দেবো?’ সুতরাং পরিবারব্যবস্থার যে বর্তমান দুর্দশা, সেটা অনেকটা সেকুলার মতাদর্শের কারণেই।
এর সমাধান কী? আমার জানা মতে, দুইভাবে এর সমাধান হতে পারে। একটা হলো, মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে, তাঁর নির্দেশনার দিকে যাই বা নিজেদের সোপর্দ করি। তাঁকে সব সময় অবলম্বন করতে হবে। তাঁর ওপর আস্থা রেখেই জীবন যাপন করতে হবে। তাঁর কাছে আমরা সব দিক দিয়েই আবদ্ধ ও দায়বদ্ধ। তাঁকে বাদ দেয়া চলবে না কিছুতেই। এটি হলো মুসলিম হিসেবে আমাদের বক্তব্য। হিন্দু হিসেবে যদি কেউ বলেন, তাহলে বলতে হবে স্রষ্টার দিকে যাওয়া, নৈতিকতার দিকে, ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া। তাই সমাধান হিসেবে বলছি, যেভাবেই হোক, মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কোনো ভিত্তি নেই।
মুসলিম দেশে ইসলামকে ভিত্তি করতে হবে এবং অমুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে। অমুসলিমদের দেশে তাদের ধর্মকে কেন্দ্র করে, তাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে মুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে বলেই আশা করি।
এভাবে যদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তবে আশা করা যায়, ভালো মানুষ তৈরি হওয়া শুরু হবে। ভালো লোক তৈরি হলে সব ক্ষেত্রে ভালো আসবে। সব ক্ষেত্রেই ভালো লোক তৈরি হবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবার- সব ক্ষেত্রেই। কেবল থিওরি দিলে কিছুই হবে না। আর আমার কথাতেই সব কিছু বদলে যাবে না। তবে মানবতা পুনরুদ্ধারের কাজ তো শুরু করতে হবেই। এ কথাও আমরা জানি, অসম্ভব বলে কিছু নেই।
ইসলাম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নয়
এখানে উল্লেখ করতে চাই ইসমাইল আল রাজীর বই ‘তওহিদ’-এ উল্লিখিত মন্তব্যের কথা। তিনি বলেছেন, God is not against science. God is the condition of science, not an enemy of science. আল্লাহ আছেন বলেই তিনি একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন। এটি আছে বলেই বিজ্ঞানের সূত্র বের করা সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ না থাকলে কোনো শৃঙ্খলা থাকত না, কোনো বিজ্ঞানও সৃষ্টি হতো না।
আমরা বুঝতে পারি, মানবজাতি ছিল মূলত ধার্মিক, সেটাকে সেকুলাররা সেকুলারমনা করে দিয়েছে। তাদের আবার ধার্মিকমনা করতে হবে; ইসলামিমনা করতে হবে। ধার্মিক মন ও সেকুলার মনের মধ্যে পার্থক্য কী? ইসলামি মন হচ্ছে সেই মন, যা কোনো সমস্যা হলে এর সমাধান খোঁজে কুরআন ও সুন্নাহতে। তারপর অন্য দিকে। অপর দিকে সেকুলার মন চিন্তা করে না আল্লাহর কিতাবে কী আছে? সে ভাবে, আমাদের যুক্তিবাদী পণ্ডিতেরা কী বলেছেন, রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা কী বলেছেন কিংবা রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, কানাডা কী করেছে। তারা দুনিয়াকে ধার্মিক মন থেকে সেকুলার মনের দিকে নিয়ে গেল। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সমগ্র দুনিয়াকে একটি নৈতিক ছকে নিয়ে আসা; ধার্মিক মন ফিরিয়ে আনা।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন