সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়া আমাকে কতটুকু মানায় নিজেও বুঝতে পারছি না। বক্তৃতা সংস্কৃতির অংশ কি না, এ সম্পর্কে আমি ভালো করে জানি না। কিন্তু বক্তৃতাকে সংস্কৃতির অংশ ধরে নিয়েই আপনাদের সামনে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
যেকোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা যেকোনো আন্দোলনের পেছনে একটি দর্শন থাকা প্রয়োজন। কোনো বড় আন্দোলন, বড় বিপ্লব বা বড় পটপরিবর্তন হয় না, যদি তাতে কোনো তত্ত্ব না থাকে। সে তত্ত্বের বিষয়েই দু-একটি কথা সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।
আমরা দেখছি, বিশ্বব্যাপী একটি নৈতিক সঙ্কট চলছে। নৈতিক অবক্ষয় চলছে। এ অবক্ষয়ের প্রমাণ হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী বর্বরতা। সেটি আফগানিস্তানে হোক, ইরাকে হোক, সিরিয়ায় হোক, কাশ্মিরে হোক কিংবা অন্য কোনো দেশে হোক। সহিংসতা, ধ্বংস, হত্যা, অত্যাচার, নানাবিধ সন্ত্রাস- কোনোটিই মানবজাতির জন্য কাম্য বা কল্যাণকর নয়। স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সন্ত্রাস মানবতার শত্রু। আমরা জানি, এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে ইসলাম এবং মানবতার। আমি মনে করি, সব ভালো লোকের, এমনকি সংস্কৃতিসেবী এবং সব সংস্কৃতিকর্মীকে এ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সংগ্রাম করতে হবে। নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে, বর্বরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং একই সাথে, বিশ্বব্যাপী যে চরম নৈতিক অবক্ষয়, তার বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম করতে হবে।
একটু আগে এ অনুষ্ঠানে একটি ছোট্ট ছেলে গান গাইল, ‘রক্তের হোলিখেলা আমি চাই না’- এটি তো একই কথা; এটা সে কতটুকু বুঝে বলেছে, জানি না। আমাদের সবাইকে এটি বুঝতে হবে। আমাদের ইসলামের উপলব্ধি খুবই সুপারফিসিয়াল বা ভাসাভাসা। একে ট্রিটমেন্ট করতে হবে, গভীর করতে হবে। না হলে আমরা একটি মানবিক সমাজ, সুন্দর সমাজ, সাংস্কৃতিকভাবে একটি উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারব না।
আজ বলতে চাই, বিশ্বব্যাপী এ নৈতিক অবক্ষয়, নৃশংসতা, বর্বরতা, টেরোরিজমের পেছনে রয়েছে মূলত দু’টি কারণ। অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমি বলব, এ ক্ষেত্রে দু’টি কারণ বড়। একটি হচ্ছে সুশিক্ষা বা সত্যিকার শিক্ষার অভাব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, অসুস্থ সংস্কৃতি। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাপী এই যে অবস্থা, এ অরাজকতা, বর্বরতা, অমানবিকতা, এই যে অত্যাচার, জুলুম এসবের পেছনে রয়েছে মূলত দু’টি বিষয়- প্রকৃত ও ভালো শিক্ষার অভাব এবং অসুস্থ সংস্কৃতি। আমি সংস্কৃতির ব্যাপারে বলব। কিন্তু শিক্ষা সম্পর্কে একটি কথা না বললে আমার কথা সম্পূর্ণ হবে না। সুশিক্ষা কাকে বলে? প্রকৃত শিক্ষা কী? ইসলামের দৃষ্টিতে বা মানবতার দৃষ্টিতে ভালো শিক্ষা বা সুশিক্ষা বলতে কী বুঝায়? কোন শিক্ষা মানুষকে উন্নত করে? আমি মনে করি, আমাদের এমন এক শিক্ষা প্রয়োজন যাতে সম্পূর্ণ প্রফেশনালিজমও থাকতে হবে। অর্থাৎ এক দিকে থাকবে পেশাদারিত্ব বা প্রফেশনালিজম, অন্য দিকে একটি নৈতিক শিক্ষা তার লাগবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, এ নৈতিক শিক্ষা ইসলামই দিতে পারে। আমি যে সুশিক্ষার কথা বললাম তার জন্য আন্দোলন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং চলছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া। বাংলাদেশেও এ রকম ইসলামিক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এগুলো নমুনা মাত্র। শিক্ষার এ আন্দোলনকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে।
সংস্কৃতির দিকে যখন তাকাই, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে সংস্কৃতি তার প্রজেকশনের যদি একটি ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে থাকে টিভি- তখন করুণ একটি চিত্র আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমার মনে হয়, অবস্থা খুব খারাপ। যখন সিনেমা দেখি, অবশ্য খুব কমই দেখি, তাতে মনে হয়েছে সিনেমা হলো অশ্লীলতা ও যৌনতার নগ্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে অসৎ বাণিজ্য করার একটি মাধ্যম। এটি তো হতে দেয়া যায় না। একই অবস্থা দেখা যায় নাটকেও। এমনকি, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও দেখছি একই অবস্থা। একজন কবি আমাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথের যে উপন্যাস সে রকম উপন্যাস আজকে লেখা হচ্ছে না। নজরুল ইসলামের যে উপন্যাস, সে রকম আজকে লেখা হচ্ছে না। সে মানবতাবোধ তাতে নেই, মানুষের কথা তাতে নেই, সে সুন্দর সমাজের কথা নেই। শরৎচন্দ্রের মতো উপন্যাস লেখা হচ্ছে না। এটি আমাদের ব্যর্থতা, সংস্কৃতির সামগ্রিক ব্যর্থতা, সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে আমার প্রশ্ন- আজকে সে মানবতাবাদী নাটক, উপন্যাস কোথায়? সে দিকেই আমাদের যেতে হবে।
মূল কথা হলো, অপসংস্কৃতি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যদি তা করতে হয় তাহলে আমাদের একটি বলিষ্ঠ ও গভীর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যে চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের সামনে আসছে, তার কয়েকটি রূপ আছে। একটি হচ্ছে তার রাজনৈতিক রূপ। তার একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে, একটি সামরিক চ্যালেঞ্জ আছে, একটি সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জও আছে। পাশ্চাত্য মূলত চাচ্ছে তাদের কালচার আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে। আমি একজন ইসলামপন্থী একজন মানবতাবাদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। একজন ইসলামপন্থীর একটি বড় কাজ হচ্ছে মানবতাকে বিরাজমান অশ্লীলতা থেকে উদ্ধার করা।
ইসলামি সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য কী? এর বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে তাওহিদ। তাকে তাওহিদপন্থী হতে হবে। ইসলামি সংস্কৃতি মানে তাকে তাওহিদকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। আরেক দিকে তাকে অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। একটি নেগেটিভ পয়েন্ট, একটি পজেটিভ।
আমাদের একটি সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য এ যে আন্দোলন, সে আন্দোলনকে সাহায্য করতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য কী? আমার মতে, সুস্থ সংস্কৃতির মূল উপাদান তিনটি। একটি হচ্ছে- সুস্থ বিশ্বাস। মুসলমানদের ক্ষেত্রে, ইসলামের ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে তাওহিদ। দুই, অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। তিন, মানবতার বাণী তাতে থাকতে হবে, মানুষের কল্যাণের বাণী তাতে থাকতে হবে। মানুষকে সমৃদ্ধ করবে, মানুষের ক্ষুধা-দুঃখ দূর করবে, এমন একটি মেসেজ বা বার্তা যে সংস্কৃতিতে থাকবে, সেটিকেই সুস্থ সংস্কৃতি মনে করব। সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশ এবং অগ্রগতি কামনা করি।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন