|
শাহ আবদুল হান্নান
shah_abdul_hannan@yahoo.com |
|
পারিবারিক নির্যাতন সারা বিশ্বেই সমস্যা
21 December 2017, Thursday
নারীর মর্যাদা রক্ষায় আগ্রহী আমার এক ভাতিজি, যে আমেরিকায় পিএইচডি করার শেষ পর্যায়ে রয়েছে, আমাকে এক চিঠিতে লিখেছে- আপনি কি জানেন, বাংলাদেশের গ্রামের এবং শহরের ইমাম সাহেবরা কি যৌতুক, স্ত্রীকে প্রহার, এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার জন্য ট্রেনিং পেয়েছেন বা তাদের এ জন্য কি উদ্বুদ্ধ করা হয়? এ সবের ফলে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নারীরা খুব কষ্ট পাচ্ছেন।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের ওয়াজ-মাহফিলে ও খুৎবায় সাধারণত নারীদের স্বামীদেরকে মানতে, খেদমত ও সম্মান করতে বলা হয়। কিন্তু পুরুষকে তাদের স্ত্রীদের সম্মান করতে কমই বলা হয়। কোনো কোনো সময় নিজে শুনেছি, কিছু ওয়াজকারী পুরুষদের স্ত্রীর প্রতি ভালো ব্যবহার করতে বলেন। নিশ্চয়ই এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু ভালো ব্যবহার করা ও দয়ালু হওয়া কাউকে ‘সম্মান করা’ থেকে আলাদা। আমার কাছে মনে হয়, যতক্ষণ না স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক মর্যাদাবোধ সৃষ্টি হবে, ততদিন রাগের মাথায় স্ত্রীদের আঘাত করার প্রবণতা স্বামীর থেকে যাবে। কেননা, স্বামী সাধারণত শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং কোনো না কোনোভাবে নিজেকে উৎকৃষ্ট মনে করে। সুতরাং পুরুষরা বাড়ির কর্তা হিসেবে যেমন ছেলেমেয়েদের শারীরিকভাবে শাস্তি দিতে পারে, তেমনি স্ত্রীকেও ‘শারীরিকভাবে শাসন’ করতে পারে বলে মনে করে।
অধিকাংশ, বিশেষ করে মুসলিম সমাজে নারী ও শিশুদের তাদের শারীরিক দুর্বলতার কারণে এক করে দেখার প্রবণতা রয়েছে। তথাপি আমি মনে করি- নারীকে শিশুর সাথে এক করে দেখা সঙ্গত নয়। তাকে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতোই মনে করতে হবে যে, নারীরও পরিপূর্ণভাবে গঠিত মস্তিষ্ক ও অনুভূতি রয়েছে। তারও একই ধরনের সম্মান পাওয়ার রয়েছে অধিকার। আমি এসব উল্লেখ করছি, কেননা, ওই সব এখানে এক বন্ধুর সাথে আলোচনায় এসেছে।’
উত্তরে অত্যন্ত সংক্ষেপে লিখেছি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মসজিদ মিশন- এসব সংগঠন মসজিদের ইমামদের ট্রেনিং দিয়ে থাকে। তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামে এমন কিছু আছে বলে জানি না যে, স্ত্রীকে মারা একটি নিন্দনীয় কাজ এবং একটি অপরাধ। তবে ইমাম সাহেবরা এসিড নিক্ষেপ ও যৌতুকের বিরুদ্ধে কখনো কখনো বলে থাকেন। এ কথা সঠিক যে, তারা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান অথবা নারীর প্রতি সম্মান করার কথা কদাচিৎ বলে থাকেন। তারা প্রকৃতপক্ষে এসব শব্দের পার্থক্যের তাৎপর্য বুঝে বলেন বলে আমার মনে হয় না। যারা নিয়মিত আলোচনা করেন, তাদের কেউ কেউ নারীদের প্রতি অত্যন্ত সম্মানসূচক আলোচনা করে থাকেন। আমার কোনো সন্দেহ নেই, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আগামী দিনে মুসলিম নারীর অবস্থার আরো দ্রুত পরিবর্তন হবে।’
এর উত্তরে আমার ভাতিজি একটি দীর্ঘ চিঠি দেয়। এর সারসংক্ষেপ হলো : ‘মনে পড়ে, অল্প বয়সে আমি পত্রিকা পড়ার সময় দেখতাম প্রত্যেক দিন স্ত্রীকে প্রহার করার ঘটনা। আমাদের প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের মধ্যেও আমি এসব গৃহবিবাদের (domestic abuse) কথা শুনতাম। পাশ্চাত্যে এর মূল কারণ মদ এবং মাদকজাতীয় দ্রব্য। কিন্তু ইসলামে এসব হারাম। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে এগুলো হবে কেন? আমার মনে হয় ইমামদের খুব ভালো করে শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে হয়তো ফল হতে পারে। কোনো মাওলানাকে বলতে শুনি না, যেসব নারীর শিক্ষার জন্য তাদের মা-বাবা অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন, ওই সব নারীও যুগের প্রেক্ষাপটে বেশি সময় ধরে অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এখন যদি তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে চান তাহলে তাদের স্বামীদের উচিত ঘরের কাজে তাদের সাহায্য করা এবং স্ত্রীদেরকে তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে সুযোগ করে দেয়া। আমার মনে হয়, আলেমদের যদি সুযোগ থাকত তাহলে বেশির ভাগ বিষয়ে নারীরা হয়তো পড়াশোনারই সুযোগ পেত না। কেননা, আলেমদের অধিকাংশই মনে করেন, মেয়েদের কাজ হচ্ছে শুধু ঘর-সংসার করা। যদি একজন মহিলা পদার্থবিদ্যা পড়ে পদার্থবিদ হন, যে কাজে হয়তো তাকে ল্যাবরেটরিতে অনেক সময় দিতে হয়, তাহলে তার স্বামীর চা কে বানাবে?
চাচা, আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি, যদিও অন্য কোথাও বলব না যে নারী হিসেবে আমি আমেরিকায় আমার নিজের দেশ থেকে অনেক বেশি সম্মান পাই। চাচা, আপনার কাছে আমার কিছু দুঃখ প্রকাশ করছি।’
এর উত্তরে বিস্তারিত লিখেছি। তাতে নারীদের সমস্যার অনেক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি লিখেছি- ‘স্নেহের ভাতিজি, আমি তোমার সঙ্গে একমত যে, পাশ্চাত্যের তুলনায় মুসলিম বিশ্বে মদ ও মাদকদ্রব্যের সমস্যা কম হওয়ার কারণে এখানে স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন (wife abuse) হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কুরআনেও এর কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই। কিছু লোক অবশ্য তাদের আচরণকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার জন্য কোনো কোনো আয়াতের অপব্যাখ্যা করে। এটি অবশ্য একটি ভিন্ন বিষয়, যার ওপর তুমি ড. আব্দুল হামিদ আবু সুলেমানের বই ‘Marital Discord’ পড়ে দেখতে পারো।
আগেও আমি বলেছি, আমার মনে হয়- অন্তত প্রকাশ্যে পাশ্চাত্যে নারীদের অধিক সম্মান করা হয়। কিন্তু আম্মু! আমি নিশ্চিত নই যে, এ সম্মান প্রদানে তারা কতটুকু আন্তরিক। আমি পড়ে থাকি এবং শুনে থাকি, সেসব দেশের নারীরা ধর্ষণের ভয়ে সবসময় আতঙ্কিত থাকে। এ ব্যাপারে আমি তোমার কাছে সত্য জানতে চাই।
আমার মনে হয় মুসলিম বিশ্বে মানবাধিকার এবং সহনশীলতার ব্যাপারে গভীর (serious) সমস্যা আছে। এটি হওয়ার কারণ হলো, এখানে নানা কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিকড় গাড়তে পারেনি। এমনকি, পাশ্চাত্যও কিছু ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ওপর একনায়কত্বকে পছন্দ (favour) করেছে। আমি বিশ্বাস করি, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের অগ্রগতি হবে। তাহলে সব সংখ্যালঘু এবং অসুবিধাগ্রস্তরা সুবিধা পাবে।
আম্মু! আমি মনে করি, পুরুষরা আরো বহুদিন এরকমই থাকবে। তারা তাদের স্ত্রীদের কাছে চা এবং খাবার চাইবে। জানি না, কিভাবে এর পরিবর্তন হবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটা চিরদিন চলতে পারে না। আমি বুঝি না, যেখানে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাষ্ট্রীয় এবং নবীজীবনের সব দায়িত্বের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ঘরের কাজ করতেন, সেখানে আমরা পুরুষরা কেন ঘরের কাজে সহায়তা করব না?’
Domestic Violence বা পারিবারিক নির্যাতন বা স্ত্রী নির্যাতনের সমস্যাটি বিশ্বজনীন একটি সমস্যা। আমাদের এ বিষয়ে গভীর নজর দিতে হবে এবং এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন