|
শাহ আবদুল হান্নান
shah_abdul_hannan@yahoo.com |
|
যে সঙ্ঘাতের সীমান্ত নেই
24 May 2018, Thursday
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বব্যাপী একটি সঙ্ঘাত চলছে। এ সঙ্ঘাত পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে ইসলামি সভ্যতার। এ সঙ্ঘাত সম্পর্কে আমরা ঠিক সচেতন ছিলাম না। এ কথা সত্য, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইসলামি সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল নানাপর্যায়ে, বিশ্বাসে; জীবনব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব বা পার্থক্য ছিল এবং নানা ধরনের সঙ্ঘাতও হয়েছে উভয়ের মধ্যে। মুসলিম শাসকেরা অনেক খ্রিষ্টান দেশ অতীতে দখল করেছেন। ইতিহাসে দেখা যায়- তারা ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর দখল করেছিলেন। এসব দেশে খ্রিষ্টান ও ইহুদি জনগোষ্ঠী ছিল। পরবর্তীকালে তুর্কি খিলাফত পূর্ব ইউরোপের অনেক অংশ দখল করেছে।
এ দিকে ক্রুসেডের সময় আমরা দেখেছি, খ্রিষ্টশক্তিরা মিসরের একটি অংশ, ফিলিস্তিনের একটি অংশ এবং সিরিয়া দখল করেছে। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় বা খ্রিষ্টান শাসকেরা পুরো বিশ্বকে দখল করেছেন। তারা গোটা এশিয়া ও আফ্রিকা দখল করে নিয়েছেন, যার বেশির ভাগই ছিল মুসলিম দেশ।
সুতরাং, একটা পার্থক্য, দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত সব সময়ই ছিল। কিন্তু দীর্ঘ দিন পর্যন্ত কোনো তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়নি যে, দুটোর মধ্যে একটি সঙ্ঘাত আছে। সঙ্ঘাত হতে পারে তা অস্পষ্ট ছিল বা স্পষ্টকরণ করা হয়নি। তবে পরিস্থিতি সব সময় যে সঙ্ঘাতের ছিল তা নয়। অনেক সময় এটা ছিল পারস্পরিক প্রতিযোগিতার। এমনকি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কও ছিল বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এটাকে একটি সার্বিক ও সঙ্ঘাতের রূপ হিসেবে হান্টিংটন উপস্থাপন করেন তার ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বইয়ের তত্ত্বে। তার এ তত্ত্ব মানুষকে নতুনভাবে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিয়ে গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইসলামি সভ্যতা, কোনোটাই তো এক রূপ নয়। পাশ্চাত্য সভ্যতারও বিভিন্ন ধরন আছে; তবে গুণগতভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বে¡ও সার্বিক একটা সাযুজ্য আছে। সেটা অনেকটা বস্তুবাদ ও সেকুলারিজম। এতে সামাজিক জীবন স্রষ্টার নির্দেশনার অধীন হবে না; রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি ধর্মীয় নীতির অধীন থাকবে না। এ ধরনের সেকুলারিজম ও আধুনিক সভ্যতা দুনিয়ার বুকে একটি বস্তুবাদের রূপ ধারণ করেছে। বেশি উপার্জন, বেশি ভোগ, বেশি এনজয়মেন্ট, এ সভ্যতার পেছনে কাজ করছে। এটা ভিন্ন বিষয় যে, তারা ভালোও অনেক কিছু করে থাকে। তা সত্ত্বেও বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে সার্বিকভাবে একটা ঐক্য আছে। অন্য দিকে, ইসলামি সভ্যতার মধ্যেও কিছু পার্থক্য আছে। তা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে এর মধ্যে একটা ঐক্য রয়েছে- তা ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মরক্কো বা তুরস্ক যা-ই হোক না কেন; তাদের বিশ্বাস মূলত একই রকমের। তাদের সংস্কৃতিতে বিরাট সামঞ্জস্য রয়েছে। তাদের প্রীতিবোধ একধরনের, তারা কুরআন-সুন্নাহকে অনুসরণ করে।
এখন সঙ্ঘাতের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছি। এ সঙ্ঘাত এমন, যার কোনো সীমান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ হচ্ছে, এ দুই সভ্যতার সঙ্ঘাত এখন চলছে প্রতটি গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায়, শহরে। এমনিভাবে প্রতিটি অফিসে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে এক দিকে রয়েছে পাশ্চাত্য কৃষ্টি কালচারের নানাবিধ চর্চা। এর মাধ্যমে আমরা পাশ্চাত্যের কালচারকে গ্রহণ করি এবং এর ফলে আমাদের বিনোদনও তাদের মতো হয়ে যায়। আমাদের সিনেমা তাদের মতো হয়ে যায়। আমাদের মিডিয়া হয়ে যায় তাদের মতো। আমাদের নাটক ও সাহিত্য যৌনতাভিত্তিক হয়ে যায়। এ কালচারের সঙ্ঘাত আজ টেলিভিশনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তারা এটাকে ঢোকাতে চেষ্টা করছেন আর আমরা এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। শুধু প্রতিরোধই করছি না, যেসব মুসলিম এখন ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তারা পাশ্চাত্য কালচারের ভেতরে সেখানেও ইসলামি কালচারে সুপিরিয়র। আমাদের পরিবারব্যবস্থা শক্তিশালী। আমরা বাবা-মাকে সম্মান করি এবং শিশুদের প্রতি বেশি বেশি খেয়াল রাখি। আমাদের মধ্যে অবৈধ যৌনতা অপছন্দনীয় এবং নিষিদ্ধ। আমরা পরিবারব্যবস্থা রক্ষা করি, অপর দিকে পাশ্চাত্যও নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং পাশ্চাত্য সভ্যতা কিছুটা চাপের মধ্যে পড়ছে। তারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু আমরাই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তা নয়; তারাও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন। এটা সত্য, পাশ্চাত্যের অনেকেই ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল। অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছেন। এটাকেও একটা চ্যালেঞ্জ বলে তারা মনে করেন। তাই তারা রাজনৈতিকভাবে মুসলিম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তার করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে তারা বেশি আধিপত্য করার চেষ্টা করছেন। তারা নানাভাবে তাদের পক্ষের লোক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। ইন্টেলেকচুয়ালদের তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা চেষ্টা করছেন প্রাধান্য ধরে রাখতে।
বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার সম্পদ লুট করে তারা তাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলেছেন। গত দু শ’ বছরে তারা এসব অপহরণ করেছেন। এখন তারা ওই প্রাধান্য বজায় রাখতে চান। এর মাধ্যমে তারা বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে গ্লোবালাইজেশনের নামে একটা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করছেন।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন