|
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com |
|
রাষ্ট্রযন্ত্র কি রক্ষাযন্ত্র হতে পেরেছে?
24 April 2017, Monday
রানা প্লাজার এক নিখোঁজ শ্রমিকের মায়ের কান্না l ছবি: ফাইল ফটোরানা প্লাজার এক নিখোঁজ শ্রমিকের মায়ের কান্না l ছবি: ফাইল ফটো
চার বছর আগে এই দিনে রানা প্লাজা থেকে ফিরে একটা কথাই মনে হয়েছিল, এই রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষকে উদ্ধারের জন্য তৈরি হয়নি, এই যন্ত্র তৈরি হয়েছে অবহেলার জন্য। ওই ঘটনায় সমাজ তার সাধ্য অনুযায়ী সব করেছে। উদ্ধারকাজে প্রাণ হারিয়েছেন এক যুবক। আহত ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক তরুণ ও তরুণী। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র ও তাকে পরিচালনাকারী কারও মনের পাষাণ ভেঙেছে বলে জানা নেই। বিজিএমইএর নেতৃত্ব ও সরকারের শ্রমমন্ত্রীকে অনুতপ্ত হতে দেখিনি; বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘ঝাঁকুনি-তত্ত্ব’ প্রচার করতে দেখেছি। অনেক নাম এখনো নিখোঁজের তালিকায়, সবার ভাগ্যে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা সমাহিত হওয়ার সুযোগ মেলেনি। অ্যাকশনএইডের একদম জলজ্যান্ত জরিপ জানাচ্ছে, রানা প্লাজায় আহত ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশ এখনো বেকার। ১২ দশমিক ৪ শতাংশ আহত শ্রমিকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রায় ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত (২৩ এপ্রিল, প্রথম আলো)।
আর কারখানার নিরাপত্তা? এত প্রাণের মূল্যে এ দিকে িকছু নজর পড়েছে। কিন্তু এরপরও চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সংস্কারে ব্যর্থ কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০-এর কাছাকাছি। যদিও ২০১৬ সালে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরিতে ব্যর্থ কারখানার সংখ্যা ছিল ১৪১। আর ২০১৫ সালে এ ধরনের কারখানা ছিল ২১টি (মার্চ ১৪, ২০১৭, বণিক বার্তা)।
তাই ১১৩৬ একটা সংখ্যাই কেবল। ২৪ এপ্রিল একটা তারিখ মাত্র। রানা প্লাজাও শুধুই একটা নাম। কিন্তু তিনটাকে এক করলেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভেতরের বাস্তবতাটা ফাঁস হয়। ওই ১১৩৫ জন নিহত শ্রমিক এবং তার চেয়েও বেশি শ্রমিকের আহত ও পঙ্গু হওয়ার ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বললে অনেকেরই দায় মওকুফ হয়। দুর্ঘটনা-তত্ত্ব অথবা ঝাঁকুনি-তত্ত্ব—কোনো তত্ত্বেই ‘অপরাধের’ স্বীকারোক্তি নেই। অতএব রানা প্লাজার হাজারের বেশি মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
এক বছর আগের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি: মোট ১১টি মামলার মধ্যে চার্জশিট হয়েছে মাত্র ৩টির। এই ৩টির বিচার শুরু হওয়ার মুখে। মোট আসামির মধ্যে সোহেল রানাসহ মাত্র ৬ জন আছেন জেলে। জামিনে আছেন ২৩ জন, পলাতক ১৩ জন। ৬ জন সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করার অনুমতি মেলেনি (নিউ এজ, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬)। আর এ বছরের খবর হলো সাতজনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ আছে। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সে ঘটনাতেও স্পষ্ট অবহেলার জন্য দায়ী মালিক শাস্তির বদলে জামিনের শান্তি উপভোগ করছেন।
রানা প্লাজা ভবনের মালিক সোহেল রানাও জেলে আরামেই আছেন। এ এক আজব ব্যাপার, বড় অপরাধীদের জন্য জেলখানার হাসপাতালে শয্যা অবারিত। সেখানে তাঁরা ঘুরতে পারেন, খেতে পারেন পছন্দের খাবার আর বাইরে ফোন দিতেও সমস্যা হয় না। তাঁর আইনজীবী গত বছর বলেছিলেন, বাইরের থেকে জেলে থাকাই তিনি তাঁর জন্য ভালো বলে মনে করেন।
অথচ মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল। রানা প্লাজার ধাক্কায় যেভাবে সমাজ জেগে উঠেছিল, যেভাবে গণমাধ্যমে প্রশ্ন ও সমালোচনার ঝড় বয়েছিল, যেভাবে বিশ্বজুড়ে হাহাকার উঠেছিল; মনে হয়েছিল এবার বুঝি পরিস্থিতি বদলাবে, এবার বুঝি টনক নড়বে। কিন্তু পরে খুঁজে দেখেছি, এই রাষ্ট্রের টনক নামক কোনো বিভাগ, পদ বা প্রতিষ্ঠান নেই। রাষ্ট্রের টনক হিসেবে যদি সরকারকেও ভাবি; বাপরে! ওটি ধরে বেশি টানাটানি বিপজ্জনক। কোনো শ্রমিকনেতা যদি এসব নিয়ে বেশি সরব থাকেন তো তাঁর গ্রেপ্তার, প্রহার বা হেনস্তা দেখতে হয়। এত মৃত্যুর পরও শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের সহানুভূতি বাড়েনি। বরং চাপ আরও বেড়েছে।
রানা প্লাজার জায়গাটি এখন একদম ফাঁকা। একটা স্মৃতিসৌধ কিছু যেন বলতে চায়। যাঁরা জীবিত ফিরেছেন এবং যেসব নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা বেঁচে আছেন, রানা প্লাজার ঘা তাঁদের জীবনে এখনো জীবন্ত।
তিনজনের কথা বলি। এঁরা আরও অনেকের মতোই ভবনে ফাটল দেখে কাজে যেত চাননি। িকন্তু বকেয়া বেতন দেবে বলে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন। বেবি আক্তারের (৩৫) স্বামী দেলওয়ার এখনো স্ত্রীর কবর শনাক্ত করতে পারেননি। তিন-তিনটি ডিএনএ তালিকা প্রকাশিত হলেও কোথাও তাঁর স্ত্রীর নাম নেই। এখনো রাতে তাঁদের তিন সন্তান মায়ের জন্য কাঁদে, বাবাকে ধরে মায়ের কথা মনে করে। ১৪ এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ। ওই রাতে দেলওয়ার ঘুমাতে পারেন না। স্ত্রীর সঙ্গে কাটানো সব পয়লা বৈশাখের স্মৃতি তাঁর মনে িভড় জমায়। ভোর পাঁচটায় তিনি চলে যান রানা প্লাজার জায়গাটায়। দুপুর পর্যন্ত সেখানে বসে থাকেন আর ডুকরে ডুকরে কাঁদেন।
মতিউর আর মিলি বাড়ির অমতে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। দুজনই একসঙ্গে কাজ নিয়েছিলেন রানা প্লাজার একটা পোশাক কারখানায়। তাঁরা কাজ করতেন একই ফ্লোরে চোখের দূরত্বে। মিলি বলছেন, ‘ভবন ধসের দিন কেন জানি না, দুজনেই বারবার কাজ থেকে চোখ তুলে দুজনকে দেখছিলাম, মনটা খুব টানছিল।’ কিছু পরেই ভবনটা ধসে পড়ে। মিলি বেঁচে যান, কিন্তু মতিউরকে আর পাওয়া গেল না। তাঁর লাশটাও না, ক্ষতিপূরণও না।
মরিয়ম কিন্তু খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। আহত অবস্থায় পড়ে ছিলেন কংক্রিটের স্তূপের নিচে। ওপর থেকে খাবারও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একটা সময় পর সেই গহ্বরে চিৎকার করে ‘সৌদাত সৌদাত’ ডাকলেও আর সাড়া আসেনি। পরে উদ্ধারকাজ শেষ হলে, জানা যায়নি কোন লাশটি সৌদাতের। লাশ পাননি মরিয়ম।তবে ডিএনএ রিপোর্টের ভিত্তিতে জুরাইনের বেওয়ারিশ কবরস্থানের ৭২ নম্বর কবরকে স্বামীর বলে ভাবতে পারছেন। (সূত্র: রানা প্লাজা বিষয়ে সদ্যপ্রকাশিত ওয়েবসাইট http://www.athousandcries.org)
এই গল্পের কোনো শেষ নেই। রানা প্লাজার অন্ধিসন্ধিতে হাজার হাজার মানুষের অসংখ্য অমানুষিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। উদ্ধারকর্মী এজাজ উদ্দিন মারা গেছেন বিদেশে চিকিৎসার সময়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিখোঁজ হওয়ার পর আরেক উদ্ধারকর্মী বাবুর লাশ পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায়। টিভিতে দেখে কৃষক ইউসুফ সাভারে এসে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। গায়ের ওপর বিম পড়ে তিনিও গুরুতর আহত হন। ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধারকর্মী দলের হিমুর মনে হয়: ‘আমি আসলে লাশের শরীর-রক্ত-মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরা করে সামনে নিয়ে বসে আছি। আমার সবচেয়ে বড় শত্রুরও যেন কখনো এই উপলব্ধি না হয়।’
চার বছর পর মনে হয়, কারও তেমন উপলব্ধি হয়নি। কিছু পরিবর্তন এসেছে বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার এখনো অনেক সংকুচিত। আরও রানা প্লাজা যে ঘটবে না, তা দিব্যি দিয়ে বলার বাস্তবতা আমরা তৈরি করতে পারিনি। এটাই সত্য এবং এটাই ভয়াবহতা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন