|
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com |
|
হাওরের আসল ভিলেন কি প্রকৃতি?
26 April 2017, Wednesday
হাওরের সর্বনাশের আসল ভিলেন পাওয়া গেছে। লোকটার নাম প্রকৃতি। স্বভাব খারাপ। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। মানুষের জন্য ক্ষতিকর, মাছদের জন্যও। ইদানীং সে নাকি ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ নামেও কাজ করছে। তাকে ঠেকাতে টাকা লাগে। হাজার হাজার কোটি টাকা। শত শত কোটি টাকা দামের বিশেষজ্ঞা ভাড়া করা লাগে। বাঁধটাধ বানানো লাগে। শয়তান প্রকৃতিকে ‘উন্নয়ন’ দিয়েই উচিত জবাব দেওয়া হবে। এটাই তো গল্প, তাই না? এই গল্প মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও বিশেষজ্ঞদের থেকে আসছে। পাউবো আর তার পেয়ারের ঠিকাদার সিন্ডিকেট দায়ী নয়। সরকারি কর্মকর্তা ও নেতাদের দোষ ধরতে নেই। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকসহ যে কর্মকর্তারা কানাডায় গেছেন, তাঁরাও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতে পারেন, বৃষ্টি বেশি হলে কী করব? প্রবাসে গেলে দেশের কথা খুব মনে পড়ে অনেকের। প্রখ্যাত লেখক নীরদ সি চৌধুরীও একবার কানাডার অন্টারিও হ্রদ দেখতে গিয়েছিলেন। কিশোরগঞ্জের সন্তান তিনি। বিদেশি হ্রদের বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর কিশোরগঞ্জের হাওরের জন্য প্রাণ টেনেছিল। লিখেছিলেন, ‘প্রবাসে জল দেখিলে দেশের কথা মনে পড়ে।’ এ জন্যই বলি, দেশপ্রেম বাড়াতে শীর্ষ মহলের ঘনঘন বিদেশ সফর অতীব উপকারী।
হাওর নিয়ে কাজ করে হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই হাওরের বাঁধ নির্মাণকাজের সমস্যা দেখে এসে স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছিল। বলার মুখ বলেছে, শোনার কান শুনেছে। কাজ যে হয়নি, তা তো সর্বনাশ দিয়েই জানা যাচ্ছে। এখন দায় চাপানোর নন্দ ঘোষ চাই। অতএব দুর্যোগগুলোকে বলা হলো প্রাকৃতিক। যেন প্রকৃতি হলো মানববিরোধী, যেন প্রকৃতি নিজেও দুর্গত নয়, নিজেও মানুষের অত্যাচারের শিকার নয়!
প্রকৃতি মানুষের মধ্যে ঢোকেনি, মানুষই প্রকৃতির মধ্যে বসতি করেছে, তার মধ্যে ভালো-মন্দ যা করার করেছে। সেই মানুষ মনে করেছে, তারা শ্রেষ্ঠ জীব, অতএব প্রকৃতিকে পদানত করাই হলো সভ্যতার মিশন। পাঠ্যপুস্তকে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার কথা পড়ানো হয়। হ্যাঁ, লড়াই দরকার হয়, কিন্তু সেটা প্রকৃতির শক্তিকে পক্ষে রাখার জন্য, সেই শক্তিকে পরাজিত করতে গেলেই বিপদ। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমাজের অনেক মানুষ প্রকৃতি থেকে কিছু নিতে গেলে অনুমতি নেয়। এটা আমাদের কাছে প্রতীকী হলেও এর ভেতরের সত্যটা মনে রাখতে হবে। প্রকৃতিতে যা কিছু করার প্রকৃতির অনুমতি অর্থাৎ তার নিয়ম মেনেই করতে হয়। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, হাওরাঞ্চলে পানিশাসনের পরিকল্পনা প্রকৃতিকে আমলে নিয়ে করা হয়েছিল কি না।
ঝড়-বাদল-বন্যা প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রকাশ। মানুষ প্রকৃতিকে বদলাতে পারে না। খুব বেশি জ্বালানি পুড়িয়ে ভোগমুখী প্রবৃদ্ধি ঘটাতে গিয়েছিল বলেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। নদীর ঢল সমুদ্রের দিকে গড়িয়ে যাবেই। মেঘ বৃষ্টি ঝরাবেই। সেটাই প্রকৃতির কাজ। মানুষের কাজ নয় প্রকৃতির চলার পথে বাধা তৈরি করা। জলপ্রবাহের পথে রাস্তা বানাবেন, ভবন তুলবেন বা ভুল অবকাঠামো খাড়া করবেন, আর তাতে যদি নদী বিগড়ে যায়, তবে সেটা কি নদীর দোষ? ফারাক্কায়-তিস্তায় বাঁধ দেওয়ার কুফল বাঁধের আগে-পিছের সব মানুষই কমবেশি ভোগ করছে। মেঘালয়ের পাহাড়ের ঢল সুনামগঞ্জ দিয়ে ঢুকে আমাদের আট হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার নিচু ভূমি দিয়েই বয়ে যাবে। কারণ, এলাকাটা ঢালু গামলার মতো। এই বয়ে যাওয়া সহজ করার জন্যই প্রকৃতি ওই অঞ্চলে অজস্র নদী, খাল, জলাশয় ও হাওর তৈরি করেছে। হাওরাঞ্চলের সঙ্গে লাগোয়া ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে আমাদের ২০টিরও বেশি আন্তসীমান্ত নদী রয়েছে। এসব নদী ভরাট হয়ে বৃষ্টি-বর্ষার বাড়তি পানি বুকে ধরতে না পেরে উপচে দিচ্ছে। আকস্মিক বন্যা তো নতুন নয়, হাওরের ভেতরের ও বাইরের নদীগুলো বুজে আসার ঘটনা নতুন বলেই বিপর্যয় নতুন চেহারায় দেখা যাচ্ছে। নদীগুলোকে খনন করে আগের অবস্থায় না নিলে শুধু বাঁধে কাজ হওয়ার কথা নয়।
হাওর এলাকা নিয়ে হাওর মাস্টারপ্ল্যান নামে এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প আছে সরকারের। ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল নাগাদ এতে ব্যয় হচ্ছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এই টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে, তার জবাবদিহি কোথায় হবে? সংসদে আলোচনা নেই, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের তদারকি নেই। হাওরের আট জেলার এমপিরাও এলাকায় যান না বললেই চলে। আর জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন বলেই কি ভোটারদের কাছে জবাবদিহির জরুরত তাঁদের থাকবে না?
এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ নামে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় পানিশাসন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়েও যথেষ্ট কথা হওয়া দরকার। হাওর মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দুর্যোগের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডেল্টা প্ল্যানের বিষয়েও কি সেই অভিযোগ ওঠাতে হবে?
হাওরাঞ্চল আজ দুর্গত। ওদিকে উত্তরের চলনবিলেও পাকা ধান ডুবতে শুরু করেছে। সেখানেও না জানি হাওরের মতো বিপদ নেমে আসে! গত বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা হয়েছিল। সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও স্লুইসগেটগুলো এখনো মেরামত হয়নি। আগামী জুলাই নাগাদ সেগুলো ঠিক করা না হলে আবারও হাহাকার দেখতে হবে। তখনো কি আমরা প্রকৃতিকে দোষারোপ করব? ভারতের বাঁধের কারণে উত্তরে মরুকরণ ও দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। যশোর-খুলনার ভবদহ জলাবদ্ধতায় প্রতিবছর মানুষ ভোগে। রামপালে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনসহ সেখানকার নদী ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্গত হবে আরও মানুষ। ইতিমধ্যে সারা দেশের পানির স্তর ভয়ানকভাবে নেমে গেছে। জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আর্সেনিকে আক্রান্ত। গ্রামে কখনো বন্যা কখনো খরা এবং শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকছে। অঞ্চলে অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের টাইমবোমা টিকটিক করছে। শিগগির সরকারের হুঁশ ফিরবে এবং সমাধান করে ফেলবে, তেমন আশার গুড়েও যথেষ্ট পরিমাণ বালি। প্রতিটি ঘটনায় দেখা যাবে, মুষ্টিমেয় মানুষের সুবিধা ঘটাতে গিয়ে বিপদে ফেলা হচ্ছে কোটি মানুষকে। দুর্বৃত্ত পুঁজি বনাম প্রকৃতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব দিনকে দিন ঘনীভূত হচ্ছে এবং হতে থাকবে।
এ পরিস্থিতির মোকাবিলা পুরোনো দিনের রাজনীতি ও দল দিয়ে হচ্ছে না। তারা সমাধানের কাজি নয়, সমস্যা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারী। প্রতিবছর বাঁধ ও রাস্তার ভাঙাগড়া না চললে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে কী করে? উন্নয়নের জন্য মানুষ, নাকি মানুষের জন্য উন্নয়ন? নিচের রাস্তা জলে ডোবা, মাথার ওপরের উড়ালসড়কের এই উন্নয়ন আজব বাস্তবতার মধ্যে মানুষকে ফেলে রেখেছে। এ থেকে বেরোতে আমাদের নতুন ধরনের রাজনীতি দরকার। অর্থনীতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর মধ্যে সমন্বিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবি তুলবে সেই রাজনীতি। আর তাকে হতে হবে আঞ্চলিক ও মূলভিত্তিক। কেননা, এলাকার ভুক্তভোগী মানুষই যার যার মঙ্গল বিষয়ে বেশি সচেতন। কৃষকই জানেন কিসে তাঁর সুবিধা-অসুবিধা। সব উন্নয়ন প্রকল্পে তাঁদের অংশ নিশ্চিত করতেই হবে। কৃষকের বাস্তব জ্ঞানের সঙ্গে বহিরাগত বিশেষজ্ঞের জ্ঞানের সংলাপ হতে হবে। রাজধানীতে থাকা নয়, লোকালয়ে থাকা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে আনতে হবে। জান, জমিন ও জলের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে বারবার তা পেছন থেকে টেনে রাখবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও রাষ্ট্রসৃষ্ট দুর্যোগ হয়ে উঠছে আমাদের জাতীয় জীবনীর প্রধান ঘটনা। কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, ভূমির মালিকানা সবকিছুতে তা আঘাত হানছে। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সীমা ছাড়াচ্ছে। বড় শহরগুলোয় তারা কাজের জন্য ভিড় করছে। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নেই।’ সতেরো কোটি মানুষ আমরা এতই দীন-হীন হয়ে গেছি, যারা সমস্যার কারণ, তাদের কাছেই সমাধান চেয়ে চেয়ে হয়রান হচ্ছি।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন