পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, যে বস্তিতে অপরাধী থাকবে, সে বস্তি রাখা হবে নাপুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, যে বস্তিতে অপরাধী থাকবে, সে বস্তি রাখা হবে না
হাকিম সাহেব আর মোশতাক সাহেব একই অফিসে চাকরি করেন। মাঝেমধ্যে তাঁরা অফিসের ক্যানটিনে একসঙ্গে বসে চা খান। সময়টা নানান কথাবার্তায় ভালোই কাটে। যে টেবিলটায় বসেন, তার জানালা দিয়ে কড়াইল বস্তি দেখা যায়। সেই দৃশ্যে কোনো আরাম নেই। বস্তিটা একটা দ্বীপের মতো। এপার থেকে দেখলে মনে হয়, বাস্তবের যে রাস্তাটা মহাখালী থেকে অভিজাত গুলশানের দিকে গেছে, তার সঙ্গে যেন একেবারে বিচ্ছিন্ন। চারপাশের শান–শওকতের মধ্যে বস্তিটাকে অবাস্তব লাগতে পারে কারও কাছে।
আজও সেদিকটায় তাকাতে তাকাতে হাকিম সাহেব আপন মনে বলে উঠলেন, ‘এই বস্তিটা খুব বাজে। শহরে এসব থাকবে ক্যান?’
চা খেতে খেতে দাপ্তরিক কাগজের গোছা ওল্টাচ্ছিলেন মোশতাক সাহেব। মুখ না তুলেই হালকা চালে উত্তর দিলেন, ‘জানেন তো, বস্তি মানে কিন্তু বসতি। মানুষের থাকার জায়গা, বসবাসের স্থান। তবে আজকাল বসতি নামে আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট হয়, আর গরিবের বসতিকে আমরা বলি বস্তি। ওই যে কে যেন বলেছিল না, আমি খাই, তুই গিলস; বড়লাটে করেন আহার আর মহারানি ভিক্টোরিয়া করেন ভোজন। হা হা হা!’
হাকিম সাহেব সিরিয়াস মানুষ। হাসেন কেবল বসের কথায়। বসের কথার গরমেও হাসেন, নরমেও হাসেন। রসিকতাটা তাঁকে স্পর্শ করল না। তিনি জবাব দিলেন, ‘ওরা নোংরা। পঙ্গপালের মতো চলে। রাজধানীর এমন সুন্দর এলাকায় এসব থাকবে কেন?’
মোশতাক সাহেব এবার মনে হয় একটু সিরিয়াস। কিন্তু মুখে হাসি।
‘বস্তিতে কি কেউ সাধে থাকে? ওরাও আরামে থাকতে চায়। বুঝলেন তো, অভাবে আর নদীভাঙনে ওদের কারও জমি চলে গেছে। দেনায় পড়ে জমি ক্রোক হয়েছে কারও। হাওরে কেমন ফসল মার গেল দেখলেন না? ওখান থেকেও মানুষ আসছে বস্তিতে। দেখবেন চলেন। যাবেন?’
: না না না, কথা ঘোরাবেন না। ওখানে ক্রিমিনালরা থাকে। ইয়াবাখোর থাকে। নিজেরাও খায় আর ভদ্র ছেলেমেয়েদের কাছে বেচে। বস্তি থাকলে পরিবেশ নষ্ট হবে। বাস্তববাদী হন ভাই।
: জি, নেশাখোর সেখানে নিশ্চয়ই পাবেন। হাতে গোনা। বেশির ভাগই তো নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। মে দিবসেও ওদের ছুটি থাকে না অনেকের। সবাই নেশার বড়ি বেচলে তো ঘরে বসেই কামাই হতো, এত খাটতে হতো না, তাই না?
: এতই যদি নিরীহ হবে, ওরা কেন বখাটেগুলোকে খ্যাদায় না?
: আপনার এলাকায় মাস্তান আছে না? উল্টাপাল্টা করে না তারা? কই, আপনি তাড়াতে পেরেছেন ওদের?
ভদ্রলোক এবার থতমত খেয়ে যান। কী করবেন ভেবে না পেয়ে চায়ের টেবিলে রাখা পত্রিকাটা হাতে নেন। ৫ নম্বর পৃষ্ঠাটা খুলে ঝটাং করে মোশতাক সাহেবের মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরেন, ‘এই দ্যাখেন আইজিপি সাহেব কী বলেছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক, হু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবও ছিলেন ওখানে। দ্যাখেন, কী বলেছেন।’
কাগজটা নিয়ে পড়লেন মোশতাক সাহেব: পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, যে বস্তিতে অপরাধী থাকবে, সেই বস্তি রাখা হবে না। রাজধানীর এক কলেজে মাদক ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। আইজিপির ভাষায়, ‘যেসব বস্তিতে অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী থাকবে, সেসব বস্তি আমরা রাখব না।’
মোশতাক সাহেব পড়লেন আর মিটিমিটি হাসলেন। মুখটা তুলে বললেন, ‘বস্তিতে উনি শুধু নেশাখোর দেখলেন, ওখানকার শিশুদের দেখলেন না? উনি কি তাঁদেরও উচ্ছেদ করার কথা বলেছেন? ওখানে তো স্কুলও আছে! বস্তিবাসীরা নেশাখোরদের ভালোবাসে, এটা কে বলেছে? বখাটের জন্য মেয়েদেরও অসুবিধা হয়। ওদের ছেলেদেরও ওরা গাঁজা-হেরোইন-ইয়াবা ধরাতে চায়। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যেই থানায় অভিযোগ পড়ে। পুলিশ যদি বস্তি উচ্ছেদ না করে বখাটেদের উচ্ছেদ করত, তাহলে বস্তিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হতো।
এবার হাকিম সাহেব একটু থমকান। কী বলবেন ভেবে পান না। তারপর মনে পড়ে যুক্তিটা। তড়বড় করে বলে ফেলেন, ‘নিজেদের মধ্যে ওরা অপরাধীদের রাখে কেন? এটা ওদের কালেক্টিভ দায়, এর জন্য সব্বাইকেই শাস্তি পেতে হবে।’
: বাহ্, হাকিম সাহেব বাহ্! মুক্তিযুদ্ধের সময় কী হতো আপনার মনে নাই? কোনো গ্রামে যদি একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকত, গ্রামের কেউ যদি তাদের আশ্রয় দিত, জানতে পারলে পাকিস্তানিরা কী করত? আস্ত গ্রামটাই জ্বালিয়ে দিত। এর নাম তারা দিয়েছিল পোড়ামাটি নীতি। বস্তিগুলো বারেবারে পোড়ে কেন বলেন তো? কয়দিন আগেই তো, এই কড়াইল পুড়ল আরেকবার। তখন দেখেছেন কীভাবে ওরা মেয়ে-মদ্দা-বালবাচ্চাসহ আগুন ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? এই জানালা থেকেই তো দেখা গেছে। একাত্তর সালেও এ রকম দৃশ্য দেখা যেত। সেই দৃশ্য কারও কাছে সিনেমার দৃশ্যের মতো সুন্দর লাগত, কারও মন পুড়ত।
হাকিম সাহেবের মুখে রা নেই। তিনি তখন পত্রিকার আরেকটা খবরে মন দিয়েছেন।
কিন্তু মোশতাক সাহেব একটু রুষ্ট হয়েছেন। তিনি থামলেন না, বলে চললেন, ‘আপনি তো জমিদার নন। বস্তির জমিটার মালিকও আপনি নন। আপনি অপরাধী ধরতে পারেন, তার বিচার করবে আদালত, শাস্তি নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। আপনার এখতিয়ার তদন্ত করে অপরাধী ধরা পর্যন্ত। এর বেশি বলার বা করার অধিকার আপনাকে আইন দেয়নি। বুঝলেন হাকিম সাহেব, বস্তিতে থাকে চুনোপুঁটিরা। রাঘববোয়ালেরা সব থাকে অভিজাত এলাকায়। কই, যান, সেসব এলাকা উচ্ছেদ করেন? একজনের দায় দশজনের ওপর চাপানো অবিচার। কোনো মানুষের বসতিকে উচ্ছেদের তালিকায় ফেলতে দেখলে ভয় লাগে। এনারা কি যুক্তিবুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছেন? পুলিশ চাইলে হাতে গোনা মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে পারে না, এটা অবিশ্বাস্য!
এতক্ষণে মনে হয় পয়েন্ট পেলেন হাকিম সাহেব। তিনি মোবাইলে অনলাইনে গিয়ে আরেকটা খবর দেখালেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুলিশের কেউ যদি জড়িত পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সর্ষের ভেতর ভূত রাখা যাবে না। সর্ষে থেকে ভূত সরাতে হবে।”’
হাকিম সাহেবের মুড আগের মতোই। তর্কের ভঙ্গিতে বললেন, ‘খুব ভালো কথা। তো সেই কাজটা কে করবে?
সাধারণ মানুষ পুলিশকে ভূতমুক্ত করে দেবে? জানের মায়া সবারই আছে। সবাই বুঝে গেছে, ওপরের দিকে চোখ তুললে চোখ জ্বলে যাবে। আঙুল তুললে হাতটাই কাটা পড়বে। যোগাযোগওয়ালা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই ডাইনে-বাঁয়ে না তাকিয়ে চলি। সেখানে আপনি আশা করেন, বস্তিকে মাদকমুক্ত করার দায়িত্ব বস্তিবাসীর? তাহলে পুলিশ আছে কী করতে? বস্তি উচ্ছেদ করা কি তাদের কাজ?’
এরই মধ্যে টেবিলে এসে বসলেন আরেক কলিগ। ব্যাগ থেকে ট্যাব বের করে বললেন, ‘আরে এইটা দ্যাখেন! সেদিন আগুন লাগল না বস্তিতে? ওই দিনকার ছবি।’
ভদ্রলোক শৌখিন ফটোগ্রাফার। ট্যাবের ডিজিটাল স্ক্রিনে একের পর এক ছবিতে আঙুল ঘষে দেখাতে থাকলেন। আগুন, ধোঁয়া, পানির ছিটা, মানুষের দৌড়াদৌড়ি, কান্নারত নারীর মুখের কালো গহ্বর, পোড়া ঘরের কঙ্কাল।
একটা পোড়া টিনের বাসনে ফুলের ছবি আঁকা ছিল। ফুলটার অর্ধেকটা পুড়ে কালো, যেটুকু পোড়েনি সেটুকু লাল। সেই পোড়া থালাতেই একদলা ভাত, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। পোড়া বস্তির পোড়া ভাত, পোড়া থালায় তাকে খেতে দিয়েছে তার পোড়া মনের মা। ছবিটা দেখে দুই দর্শকের একজন বলে উঠলেন, ‘কী সুন্দর!’ আরেকজনের কথা, ‘আপনি তো পুরস্কার পেয়ে যাবেন ভাই!’
ফটোগ্রাফারের মুখ গর্বে আলোকিত হয়ে উঠল।
পুনশ্চ: ওপরে বলা সব চরিত্রই কাল্পনিক হলেও বাস্তবের সঙ্গে মিলে যাওয়া আশ্চর্য নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন