টাকা পাচারের সঙ্গে মানব পাচারও চলছে।
বাংলাদেশি আদম পাচারের নতুন করিডর এখন লিবিয়া। ওবামা, ক্যামেরন ও সারকোজিকে ধন্যবাদ, লিবিয়াকে তাঁরা কতই না বদলে দিয়েছেন। ২০০৭-এ জরুরি অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও ধন্যবাদ, সেই আমলে ধনী ব্যক্তিদের চাপে রাখার ফজিলতে মুদ্রা পাচার বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হতে পেরেছে। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও ধন্যবাদ, এমন অবস্থা করেছেন, যাতে তলার শ্রেণির আদম আর ওপরের শ্রেণির দৌলত ‘অপ্রতিরোধ্য’ গতিতে পাচার হতে পারে।
ইউরোপের পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো কথা কমই বলা হয়। তারা আমাদের সাবেক ‘মালিক’ ও শাসক। আমাদের সম্পর্কে ভালো কথা তাদের মনে আসবে কেন? লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট খবর ছেপেছে, সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাককে পেছনে ফেলে বর্তমানে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী পাঠাচ্ছে আমাদের এই সোনার বাংলা। দুবাই-তুরস্ক ট্রানজিট দিয়ে এদের লিবিয়ার ‘দাস ক্যাম্পে’ জড়ো করা হচ্ছে। তারপর পাসপোর্ট-টাসপোর্ট সব কেড়ে নেওয়ার পর এরা হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব নাগরিক। বিশ্ব নাগরিকের আবার দেশের পাসপোর্ট লাগে নাকি? এরা এমনই সর্বহারা, যাদের জয় করার আছে সারা বিশ্ব।
গাদ্দাফি থাকলে তিনি এসব করতে দিতেন না। বাংলাদেশি শ্রমিক ও ঊর্ধ্বতন পেশাজীবীরা তাঁর আমলে লিবিয়ায় খুবই কদর পেতেন। তা হলেও লিবিয়া একটা আফ্রিকান দেশ। লিবিয়ার শ্রমিক হওয়ার চেয়ে ইউরোপে শরণার্থী হওয়া ইজ্জতের বিষয়। ন্যাটোর বিমান গাদ্দাফিকে মেরে লিবিয়ায় জঙ্গলের আইন কায়েম না করলে সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তান-ইয়েমেনের মানুষগুলো কীভাবেই বা মুক্ত হতো? কেমন করে তারা হেঁটে কিংবা সাঁতরে বনেদি সভ্যতার উপকূলে গিয়ে পৌঁছাত? সম্ভবত এমন মহৎ কাজে ওবামা থাকবেন বলেই তাঁকে আগাম নোবেল পুরস্কারটি দেওয়া হয়।
যাহোক, এমন সংবাদ ছাপানোর পেছনে লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর কী মতলব, তা নিয়ে তদন্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) নামের যে সংস্থা বাংলাদেশ থেকে ১ বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। হয়তো দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের কোনো নতুন চক্রান্ত। ভাবমূর্তির প্রতি আমরা খুবই যত্নবান। তাই ভাবমূর্তি পাংচার করার ঘটনাকে হেলাফেলা করা যাবে না। যে হারে উন্নয়ন হচ্ছে, একদিন আমরাও আমাদের ভাবমূর্তির শত্রুদের পানামার নরিয়েগার মতো ধরে আনতে পারব নিশ্চয়! ঢাকার যে এজেন্সি এ বছরের ৪ মাসে ২ হাজার ৮৩১ জন বঙ্গসন্তানকে পাচার করায় জড়িত বলে ওই খবরে জানানো হয়েছে, তাদেরও বারো আনা ফাঁকির একটা সোনার মেডেল দেওয়াই যায়! পুরস্কারের নাম হবে জনসংখ্যা ও বেকারের সংখ্যা কমানোর অবদানস্বরূপ...ইত্যাদি ইত্যাদি। মেডেলটা পরিয়ে দিতে পারেন দেশের কোনো শীর্ষ কালোটাকার মালিক।
এখন আমাদের একজন ঝানু গবেষক দরকার। সেই মহাত্মন প্রমাণ করে দেবেন, যুগপৎ টাকা ও আদম পাচার উন্নয়নেরই অংশ। বেশি টাকা পাঠালে দেশের অর্থনীতি বেশি তরল হবে, তখন আরও বেশি মানুষ বিদেশে আশ্রয় খুঁজবে। এতে দেশের জনসংখ্যাও কমবে। জনসংখ্যা কমলে মাথাপিছু আয়ও বেশি দেখানো যাবে। এভাবেই ২০৩০ সালের আগেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে পড়ব।
অবৈধ পুঁজি পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বের পয়লা সারিতে। দেশের অর্থনীতির ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশের চালক। এটা ইউএনডিপির দেওয়া ২০১৪ সালের হিসাব। ২০১৬ সালে টাকার অঙ্ক ও অনুপাত বেড়েছে বৈ কমেনি। জিএফআই বলেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। খুব বেশি টাকা নয়, গত বছরের বাজেটের মাত্র দ্বিগুণ। এদিকে ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেছেন, দেশে দুর্নীতির জয় হয়েছে। ওদিকে মন্ত্রিসভায় ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের নীতি পাস হয়েছে। আমজনতার এদিক-ওদিক না দেখে বিটিভি দেখাই ভালো, তাহলে আর পিলে চমকানোর ভয় থাকে না।
অর্থ পাচার ও দুর্নীতিতে আমাদের থেকেও জবর উন্নত হলো আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অন আফ্রিকার সম্মেলন হয়ে গেল। সেই সভায় জানানো হয়, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ফি বছর বিদেশে পাচার হয় পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমমানের সম্পদ। এটা আফ্রিকায় যাওয়া ‘বিদেশি সাহায্যে’র দ্বিগুণ। আফ্রিকার মানুষ গরিব হলেও ধনীরা আসলেই ধনী। গোটা আফ্রিকার ধনীরা মিলে যতটা পাচার করেছে, আমরা একাই ২০১৩ সালে করেছি তার ৫ ভাগের ১ ভাগ। এই হিসাবটাও আংশিক। কারণ, ইউএনডিপি, জিএফআই নিজেরাই বলেছে, প্রকৃত পরিমাণ আরও অনেক বেশি হওয়াই সম্ভব। উন্নত দেশ থেকে আমাদের দেশেও যত বিদেশি সাহায্য আসে, পাচার হয়ে তাদের দেশে যায় তার প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ। এভাবে গরিব দেশের গরিবেরা স্বদেশি বড়লোক বানাতে যেমন, তেমনি ধনী দেশের ধনীদেরও সাহায্য করে।
ব্যাপারগুলো যেহেতু বন্ধ হচ্ছে না, সেহেতু এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপায় খোঁজাই ভালো। বন্যার সঙ্গে তো মানিয়ে নিচ্ছি, ঢাকার দুই-আড়াই কোটি মানুষ তো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ব্যয়বহুল ও বাস-অযোগ্য শহরে দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছে! সুতরাং দেশের মধ্যে কালোটাকা উৎপাদন, বিদেশে তা সাদা করার রপ্তানি চ্যানেল এবং প্রবাসে ‘সেকেন্ড হোম’ বানানোর কর্মসূচির সঙ্গেও মানিয়ে নিতে আমাদের অসুবিধা হবে না। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে হরিলুট যেমন উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আদম ও টাকা পাচারও তা-ই। এগুলোকে অর্জন হিসেবে দেখালে অসুবিধা কী? একটা বিজ্ঞাপনের ভাষার কথা মনে পড়ে, ‘দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলুন, দুনিয়া বদলে যাবে।’ ইতিবাচক চোখে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব, এসব আসলে অর্জনের মাইলফলক। বালক বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সড়কের মাইলফলক গুনতে গুনতে ইংরেজিতে গুনতে শিখে গিয়েছিলেন। অর্জনের মাইলফলক গুনতে গুনতে আমাদের শিশুরাও দুর্নীতির শুভংকরের গণিতটা শিখে ফেলতে পারবে।
ইউএনডিপির ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ই টাকা পাচার বেড়ে যায়। জরুরি অবস্থার সময় সেটাই ঘটেছিল। অতএব অস্থিরতাও টিকিয়ে রাখা চাই। তার জন্য অবিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা, দক্ষিণ এশিয়ার নিম্নতম মজুরি; কোনো বছর রানা প্লাজা, কোনো বছর হাওর-ভাসা; জঙ্গিবাদ, রাজনৈতিক হানাহানি চালিয়ে যেতে হবে। এসবের মধ্যেও তো আমাদের একজন বিশ্বের শীর্ষ বিলিয়নিয়ারদের ক্লাবে নাম লেখালেন। অনেকের ধনসম্পদও বেড়েছে তুমুল গতিতে। গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ মজুতের পরিমাণ বেড়েছিল ১০ শতাংশ। পানামা পেপারসেও কতজনের নাম এসেছিল। দেশে অস্থিরতা শুরু হলেই যাঁরা বিমানবন্দরের দিকে দৌড় দেন, তাঁদের জন্য সেকেন্ড হোম নয়, বিদেশে এক্কেবারে ফার্স্ট হোমের ব্যবস্থা করা চাই। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘টাকা নিয়ে পালানোর’ হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। তবে বিদেশের আইনের শাসন আমাদের মতো ‘উন্নত’ না হওয়ায় সমস্যা হতে পারে।
আমাদের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র দুর্যোগপ্রিয়। হানাহানি, খরা-বন্যা, আর্সেনিক, কয়লাপ্রেম, জলবায়ু পরিবর্তন, আইলা-সিডর, নদীভাঙন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু তৈরি হবে বলে একদল বিশেষজ্ঞ আওয়াজ দিয়েছেন। রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন তো যাবেই, প্রতিবছর অনেক শিশুরও মৃত্যু ঘটবে বলে জানিয়েছে গ্রিনপিস। এভাবে চললে দেশটা টিকবে না। ব্যাপারটা সম্ভবত কেউ কেউ বুঝে গেছেন। তাই টাকা বানানো ও পাচারের গতি বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটাও বুঝে গেছেন, টাকা ও পরিবার দেশে রাখা অনিরাপদ।
রাজনীতিবিদেরা হরহামেশাই একে অন্যকে দেশ বিক্রির অভিযোগ করেন। স্বাধীন দেশ আসলে একেবারে বিক্রি করা যায় না। খাবলা খাবলা করে সেটা করতে হয়। অর্থনীতিকে রক্তশূন্য করে দামি নাগরিকত্ব কেনা ও ভিনদেশে টাকা পাচারের এই ব্যবসাই হলো ‘দেশ বিক্রির’ আসল ব্যবসা। তাঁরা যখন অর্থনীতিকে রানা প্লাজা বানিয়ে ফেলছেন, তখন মেহনতি মানুষ দেশে ও বিদেশে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে চলেছেন। কুবের ভাইরা যখন এক পা বিদেশে রাখছেন, তখন কৃষকেরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন। বাংলাদেশ টিকলে এসব মাটি কামড়ানো আর গতর খাটানো মানুষের জন্যই টিকবে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ সেই ‘চোরেরা’ এখন অর্থ পাচারের সোনার খনি পেয়ে গেছে। সেই খনিটা আর সুড়ঙ্গপদ্ধতির নয়, সরাসরি উন্মুক্ত কয়লাখনির মতো খোলা এই দেশ। জয়ীদের অভিনন্দন। জো জিতা ওহি সিকান্দার।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন