২২ বছর বয়স। অথচ কোনো মেয়েবন্ধু নেই। চারপাশে সবাই জুটি বেঁধে আনন্দ করছে, অথচ কোনো মেয়েই তার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাচ্ছে না! কিন্তু এখন সবাই তার ছবি দেখছে। বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের মনোযোগ পেয়েছে সে। কিন্তু যা চেয়েছিল, তা পায়নি। ভালোবাসার বদলে পাচ্ছে ঘৃণা। তার আনন্দকামী জীবনটা ততক্ষণে পরিণত হয়েছে ছিন্নভিন্ন দেহে। তার অসীম ঘৃণার শিকার হয়েছে আরও ২২ জন তরুণ-তরুণী, যাদের সবচেয়ে ছোটজনের বয়স মাত্র আট!
কী ছিল আত্মঘাতী বোমারু সালমান আবেদির মনে, তা খুঁজে চলেছে পুলিশ ও সাংবাদিকেরা। তার সহপাঠীরা বলছে, মেয়েদের কাছে পাত্তা না পাওয়ার প্রতিশোধ নিতেই কনসার্টে বোমা ফাটিয়েছে আবেদি। আর তার বোন জোমানা আবেদির বিশ্বাস, আমেরিকার বোমায় নিহত শিশুদের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে আবেদি। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সাধারণ এক তরুণ হয়ে ওঠে গণবিধ্বংসী আদমবোমারু?
ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে ২২ বছর বয়সী তরুণের নারীবন্ধু বা প্রেমিকা না থাকা খুবই বিরল ঘটনা। আবেদি সেই বিরলদের একজন। তার কান একটু বড় হওয়ায় সহপাঠীরা তাকে ‘ডাম্বো’ বলে খ্যাপাত। ডাম্বো হলো ডিজনির তৈরি এক কার্টুন হাতির নাম। টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মীদের ব্যবহার করার কথাও সে বন্ধুদের জানিয়েছিল। ওই বয়সে এসব ‘বাহাদুরি’ করে ‘হিরো’ হতে চায় অনেকে। আবেদি হিরো হয়েছ ঠিকই, তবে খুব অল্পসংখ্যক সন্ত্রাসীর কাছে। বাদবাকি কোটি কোটি মানুষের কাছে সে ঘৃণিত খুনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় সে ছিল লুজার—হতভাগা।
তার এই হতাশা আবেদিকে ঠেলে দেয় নেশার দিকে। যে ধরনের গানের কনসার্টে নিজেকে আদমবোমা বানিয়েছিল, সে ধরনের রক আর র্যাপ গানেরই ভক্ত ছিল আবেদি। জার্মানিতে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল আবেদির মতো ব্যর্থ ও হতাশ তরুণদের। ব্যর্থতা তাদের ঠেলে দেয় নেশার দিকে, নেশা থেকে তারা ঢুকে পড়ে ধর্মের নামে চরম জীবনবিরোধী চিন্তাধারার ফাঁদে। এ ধরনের রূপান্তর আইএসে যোগ দেওয়া অনেকের জীবনেই দেখা গেছে।
আবেদির হতাশাপূর্ণ জীবনের বয়ান শোনা যাক তার পরিচিত তরুণদের কাছ থেকেই। ব্রিটেনের ডেইলি স্টার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাদের কথা। তাদের মন্তব্যগুলো এ রকম:
‘মেয়েদের কাছে সে ছিল একেবারেই বাতিল’
‘এটা তাকে মুষড়ে ফেলেছিল’
‘চারপাশে সবাই যখন জুটি বেঁধে আনন্দ করছে, তখন কোনো মেয়েই তার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাত না’।
‘শেষের দিকে সে সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, কারও সঙ্গে মিশত না।’
‘আমরা যে ধরনের আনন্দ করতাম, সে রকম কিছু তার জীবনে ছিল না।’
‘আরিয়ানার ভক্তদের টার্গেট করে এত বছরের সব প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিয়েছিল সে।’
পাশ্চাত্যের নারীদের প্রতি, তাদের জীবনধারার প্রতি আবেদির ঘৃণার কথা এখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
কিন্তু আবেদির বোন জোমানা আবেদির বিশ্বাস, আমেরিকার বোমায় নিহত শিশুদের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে সে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কাছে সে বলেছে, ‘আমার মনে হয়, সে সবখানে শিশুদের মরতে দেখেছে—মুসলিম শিশু—তাই চেয়েছে প্রতিশোধ নিতে। সে দেখেছে, আমেরিকা সিরিয়ার শিশুদের ওপর বোমা ফেলছে, আর চেয়েছে প্রতিশোধ নিতে।’
ব্রিটেনের প্রধান বিরোধী দলের নেতা, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী জেরেমি করবিনও মনে করেন, ম্যানচেস্টার বোমায় নিহত ব্যক্তিরা ব্রিটেনের পররাষ্ট্রনীতির খেসারত দিয়েছে। গত সপ্তাহে ইতালির সিসিলিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘ব্রিটেনে সন্ত্রাসী হামলা আমাদের ভুলেরিই পরিণতি।’
বছরের পর বছর ধরে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। নিহত হয়েছে লাখো শিশু। এসব দেখে দেখে অনেক মুসলিম তরুণের রক্তে আগুন ধরে। তারা যোগ দেয় আইএসে। তারপর আত্মঘাতী হয়ে নিজেকেসহ ধ্বংস করে আরও আরও নিরীহ মানুষের জীবন। এবং তাদের শিকারের মধ্যেও থাকছে অনেক অনেক শিশু।
শিশুরা যেন মরবেই, জঙ্গিবিরোধী গোলায় অথবা জঙ্গিবাদী বোমায়। তাহলে এটা কেমন প্রতিশোধ হলো? আত্মঘাতী বোমারুরা শুধু তথাকথিত ‘শত্রু’দেরই হত্যা করে না, তারা হত্যা করে সপক্ষের সমাজ-মর্যাদা-শান্তিকেও। একজন সন্ত্রাসী সমগ্র মুসলিম সমাজকেই বিপদে ফেলে দেয়।
কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলই বর্বর আইএসকে সৃষ্টি করেছে, যেমন করেছিল তালেবানদের। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে নামজাদা প্রতিবেদক সিম্যাস মিলনে তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসয়ের উত্থানের জ্বালানি জুগিয়ে গেছে। আল-কায়েদার সঙ্গে সিআইএর, আইএসের সঙ্গে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যোগাযোগ আর গোপন বিষয় নয়। মধ্যপ্রাচ্যে শাসক বদল, তেলের খনির নিয়ন্ত্রণ, ফিলিস্তিনে দখলদারি চালিয়ে যাওয়া আর গণতন্ত্র রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির জন্য সন্ত্রাসবাদ লাগবেই। সন্ত্রাসবাদ ছাড়া অস্ত্র বিক্রির বাজারই-বা টিকিয়ে রাখা হবে কীভাবে? আইএসের ধ্বংসযজ্ঞের সুবাদেই আজ তেলের দাম কম, জোগান বেশি আর তেল ব্যবসায়ীদের রমরমা।
যে ঘৃণার কারণে মুসলমান-অমুসলিম উভয়ই মারা যাচ্ছে, সেই ঘৃণার পেছনে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মন থাকতে পারে না। যৌনক্ষুধা কিংবা পশ্চিমাদের প্রতি বিদ্বেষ আবেদিকে গণবিধ্বংসী করে তুলতে পারে। কিন্তু যদি পৃথিবীতে যুদ্ধ না থাকে, যদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জঙ্গিবাদীদের ব্যবহার না করে, যদি মুসলমান বলে কাউকে বাতিল করা না হয়, তাহলে শুধু হতাশা থেকে কেউ অনেক নিরীহ মানুষের হত্যাকারী হয়ে উঠত?
ব্যর্থতায় কেউ চুপসে যায়, কেউ শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, কেউ আত্মহত্যা করে, কেউবা হয়ে ওঠে আদমবোমা। কে কী করবে, তা নির্ভর করে কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় সে বাস করছে, তার ওপর। আর একজন আমেরিকান তরুণ হয়তো বন্দুক নিয়ে স্কুলে বা শপিং মলে নির্বিচারে গুলি ছুড়বে। মুসলমান তরুণদের মধ্যে হতাশা থেকে জঙ্গি হয়ে ওঠার আলামত আমরা মর্মান্তিক হলি আর্টিজান ঘটনায় দেখেছি। ম্যানচেস্টারের ঘটনায়ও দেখলাম।
এ অবস্থায় তরুণেরা যেমন ঝুঁকির শিকার, তেমনি তারা নিজেরাও হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ। যুদ্ধ থামলে সন্ত্রাসবাদ থামতে পারে; কিন্তু মনের গন্ডগোল থামাব কী করে? সমাজটাকে মানবিক, সহনশীল এবং সমবায়ী করে না তুললে কখন, কোথায় কার মন ঘৃণার বারুদে ভরে উঠবে, তা আগাম বলার বা জানার উপায় থাকবে না।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন