|
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com |
|
আরব সংকট: দড়ির ওপর হাঁটছে বাংলাদেশ
08 June 2017, Thursday
কাতার ঘিরে নতুন সংকটে বাংলাদেশকে হাঁটতে হচ্ছে দড়ির ওপর দিয়ে। কোনো পক্ষে ঝুঁকে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি মাশুল আছে। বাংলাদেশকে একবার তাকাতে হচ্ছে গতানুগতিক ‘ঘনিষ্ঠ’দের সঙ্গে গতানুগতিকভাবে ঘনিষ্ঠতাই বজায় রাখতে, আবার তাকাতে হচ্ছে দেশের প্রধান শ্রমবাজার অটুট রাখার দিকেও। অবস্থাটা অনেকটা শ্যাম রাখি না কুল রাখি। কাতারকে একঘরে করার সৌদির নেতৃত্বে ছয়টি দেশের পদক্ষেপ ভাতে-পানিতে তথা রুটি-মাংসে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে বেশি দূর গড়ায় কি না, সরকারি ভাষায় তা ‘গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ’ করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় দেশীয় বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের আগ্রহ ভারসাম্যের দিকে।
কাতার পরিস্থিত দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছে। ইরান ও তুরস্ক দেশটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইরান তার বন্দর কাতারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণার পরপরই সে দেশের পার্লামেন্ট ও ইমাম খোমেনির মাজারে আইএসের নামে একযোগে বোমা হামলা হয়েছে। আইএস বা যে-ই এ ঘটনা ঘটাক, তা অবশ্যই বুমেরাং হয়েছে। ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে আইএস–তুল্য সন্ত্রাসী বলার সৌদি প্রচারণার সময় ইরান পাল্টাভাবে বলতে পারছে, দেখো, যারা আমাকে সন্ত্রাসী বলছে, তাদের লোকই আমার দেশে সন্ত্রাসী হামলা ঘটাচ্ছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী হামলার জন্য ইতিমধ্যে সৌদি আরবকেই দায়ী করে বসেছে।
ওদিকে তুরস্কের পার্লামেন্টে কাতারে সৈন্য প্রেরণের সিদ্ধান্ত পাস হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক-সিরিয়ার মধ্যে যে কৌশলগত সম্পর্ক দানা বেঁধেছে, কাতার দাঁড়িয়ে আছে তার সন্ধিক্ষণে। সৌদি চাপের কাছে কাতারের মেরুদণ্ড না বাঁকানোর অর্থ দেশটির রাশিয়া-ইরান অক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়া। তা ঘটলে মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি অক্ষ কাতারকে সেই শাস্তিই দিতে চাইবে, যা ভোগ করেছেন পানামার সাবেক শাসক ড্যানিয়েল নরিয়েগা। মিসরের ক্ষমতাচ্যুত ও কারাবন্দী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকেও এ জন্যই শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সৌদি রাজপরিবারের সদস্য এবং সৌদি-আমেরিকান পাবলিক রিলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট সালমান আল-আনসারি। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘কাতারের আমিরকে বলছি, আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, মোহাম্মদ মুরসি আপনার মতোই করেছিল এবং তারপর তাঁকে উচ্ছেদ করে বন্দী করা হয়েছিল।’ বিশাল মার্কিন ঘাঁটি লালনকারী কাতারে যুদ্ধের আশঙ্কা কম হলেও কাতারের আমির শেখ তামিম বিল হাম্মাদ আল থানির ভাগ্যবিপর্যয়ের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ ধরনের যেকোনো অস্থিতশীলতায় মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণকারী সব দেশই উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগ যেমন বাংলাদেশের, তেমনি ভারত-নেপাল-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনেরও। উপসাগরীয় এ ছয়টি দেশের শ্রমবাহিনী এসব দেশের নাগরিকদের নিয়েই গঠিত। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে কাতারের রয়েছে বিরাট আকারের বাণিজ্য সম্পর্ক। কাতার ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির অন্যতম বিনিয়োগকারী অংশীদার। আপন স্বার্থেই ভারতসহ উপমহাদেশীয় সরকারগুলো চাইবে না মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান স্থিতাবস্থা বদলে যাক। তেলের দাম বেড়ে গেলে সৌদি আরবসহ রপ্তানিকারক দেশের লাভ হলেও বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশের ক্ষতি। আরবের রাজায় রাজায় এ বিরোধে তাই উলুখাগড়াসম বাংলাদেশিদের সমূহ ক্ষতির ভয়। সেই ভয় বাংলাদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে ততটা না হলেও, মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী শ্রমিক, বিশেষ করে কাতারে অবস্থানকারী বাংলাদেশি ও দেশে তাঁদের পরিবারের মধ্যে ব্যাপক।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন তাই মনে করেন, ‘দুই পক্ষেই আমাদের স্বার্থ রয়েছে। এক পক্ষে গিয়ে অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া আমাদের পোষাবে না। বিষয়টা তো কেবল সৌদি আরব আর কাতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাহরাইন, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এবং মিসরেও বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে কাতারেই শ্রমিকেরা ভালো মজুরি পেয়ে থাকেন।’
মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে কাতারের অর্থনীতি বেশি শক্তিশালী এবং দেশটি ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক। বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র ও বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে আগামী দিনে কাতারেই শ্রমিক প্রেরণের সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন। উল্লেখ্য, বর্তমানেও তুলনামূলকভাবে কাতারই বাংলাদেশ থেকে বেশি শ্রমিক নিচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি মাসেই ১০ থেকে ১২ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাতারে যাচ্ছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তরফে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবের কথা উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সৌদি আরবে বর্তমানে ১৫-২০ লাখ এবং কাতারে ৩ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সৌদি-আমেরিকান চাপের কাছে বাংলাদেশকে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিতে হবে। আরবের এই সংকট হয়তো একসময় মিটে যাবে, কিন্তু চাপের মুখে বিপক্ষতার কথা কাতার ভুলবে না।’ সুতরাং দৃঢ়ভাবে মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চেয়ে বর্তমান অবস্থা ভিন্ন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান। তাঁর ভাষায়, ‘ওবামার সময় বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা বলে গেলেও, ট্রাম্প প্রশাসন তেমন আচরণ সহজভাবে নেবে না। সৌদি-ইসরায়েল অক্ষের মধ্যে কাতারকে ধরে রাখাই হলো মার্কিন স্বার্থ। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশও সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সদস্য হয়েছে। কাতার এই জোটের সদস্য হয়েও ভিন্নমত ধারণ করছে বলেই সংকটের উৎপত্তি।’
ড. তানজিম আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেন যে, কাতারে শুধু আমাদের শ্রমিকের স্বার্থই নেই, সম্প্রতি কাতার বাংলাদেশ ব্যাংকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গচ্ছিত রাখার চুক্তি করেছে। প্রয়োজন পড়লে তেল কেনার জন্য এখান থেকে আমরা ঋণ নিতে পারব।
সৌদি-কাতার বিভেদকে কেবল মতবিরোধ বলে মনে করেন না ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টারের পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতি পরস্পর-সম্পর্কিত। আবার এই পুরো অঞ্চল তথা এর অর্থনীতি বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কাতারে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিক যাচ্ছিল। উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় তা থমকে গেছে। এ অঞ্চলের কোনো দেশের স্থিতিশীলতায় ধাক্কা লাগলে তার প্রভাব অন্য দেশেও পড়বে। আমাদের প্রবাসীরা এই পরিস্থিতির উত্তাপ অনুভব করছেন। ড. দেলোয়ারের পরামর্শ, বাংলাদেশ যেহেতু নিরপেক্ষতার কূটনীতি বহুকাল ধরেই অনুসরণ করে আসছে, সেটাই ধরে রাখা উচিত। কিছু মৌরিতানিয়া বা মালদ্বীপের মতো দেশ চাপে পড়ে কাতারের বিপক্ষতা করছে, আমাদের সে সুযোগ নেই। যদি আরব লিগ কিংবা ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ফোরামে বহুপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা থাকতে পারি। কিন্তু দ্বিপক্ষীয়তার মধ্যে আমাদের ঢোকা ঠিক হবে না।
অতীতে বাংলাদেশের সব সরকারই সব আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের যে নীতি অনুসরণ করে এসেছে, বাংলাদেশকে তা-ই বিচক্ষণতার সঙ্গে আঁকড়ে থাকার অভিমত দিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস ইস্যুতে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তার অর্থ এই নয় যে দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতি আমরা বদলে ফেলব।
দৃশ্যত সৌদি আরব ও মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয় তথা ইরান ও ফিলিস্তিন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের যে সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি, তার সঙ্গে কাতার একমত নয়। ফিলিস্তিন ও লেবাননকে লক্ষ্য করে গত সপ্তাহেই ইসরায়েল ৩৬ ঘণ্টার আকস্মিক সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই কাতারকে একঘরে করে ইরানকে বন্ধুহীন করার আয়োজন কতটা সফল হবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটকে কাতার ও ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হলে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার নীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কেননা কাতারকে বর্জনকারী মূল দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশও এই জোটের সদস্য।
ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশ সময়ে-সময়ে অঙ্গীকার প্রকাশ করে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়ও বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন বলে মনে করে বিশ্লেষকদের একটি অংশ।
উৎসঃ prothom-alo
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন