|
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com |
|
ট্রাম্পের তলোয়ার-নৃত্য ও ইরান যুদ্ধের কাতারি জিম্মি
24 June 2017, Saturday
আরব নেতাদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তলোয়ার–নৃতে্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পযুদ্ধের ময়দানে এবং বক্সিংয়ের রিংয়ে শেষ পর্যন্ত যে দাঁড়িয়ে থাকে, জয় তার। কাবু হওয়ার বদলে আরব ময়দানে কাতার বরং আরও মাজা সোজা করে দাঁড়ানো। কাতারের আমিরের পরিণতি মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির মতো হওয়ার যে হুমকি সৌদি-আমেরিকান পাবলিক রিলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট সালমান আল-আনসারি দিয়েছিলেন, তা অসার বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিপদের দিনে যে দুটি জিনিসের খুব দরকার হয়, সেই টাকা ও বন্ধু কাতারের আছে। অবরুদ্ধ কাতারকে বন্দর খুলে ও খাদ্য পাঠিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান। তুরস্ক কাতারে সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছে।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরব বিচ্ছেদকে মধ্যপ্রাচ্যের ট্রাম্পিকরণ বলে সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উসকানির অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। রাশিয়াও কাতারের পক্ষে আছে। রাশিয়া সফরে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হামাসকে বৈধ রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে পুনরায় স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনও ট্রাম্পকে আরবদের মধ্যে মধ্যস্থতার কথা বলেছেন। পেন্টাগন কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির জন্য পুনরায় ধন্যবাদ জানিয়েছে।
আরবদের গৃহবিবাদে খুশিতে বাকবাকুম কেবল ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আরব দেশগুলো (পড়তে হবে স্বৈরতান্ত্রিক সুন্নি দেশগুলো) ইসরায়েলকে আর শত্রু ভাবছে না। ইসরায়েলের সঙ্গে জেনারেল ও বাদশাহদের বন্ধুত্ব ইরান-কাতার-তুর্কি জোটের প্রতি আরব জনতার সহানুভূতিই বাড়াবে। সুতরাং কূটনৈতিক ও জনমত, দুদিকেই সৌদি নেতৃত্বাধীন জিসিসি জোটের দাপটের ফল বুমেরাংই হয়েছে। ওদিকে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতিতে চলার ফসল তুলছে কিন্তু কাতারই।
বিচলিত বরং সৌদি আরবই। ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানো সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ সালমান মনে হয় অশান্ত। বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানিদের ‘আরবের দাস’ বলা থেকে বোঝা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে দাঁড় করানো যাচ্ছে না। উল্টো সৌদি নেতৃত্বাধীন ইরানবিরোধী মুসলিম ন্যাটো জোটের সেনাপতিত্ব থেকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান রাহেল শরিফকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন সে দেশের সংসদের উচ্চকক্ষের (সিনেট) সভাপতি। লিবিয়ায় গাদ্দাফি-পুত্র সাইফের মুক্তির ঘটনাও সৌদি-মার্কিন-ইসরায়েলি সমীকরণের বাইরেই ঘটেছে।
ইরান ও কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগটাও ঘুরে যাচ্ছে সৌদি-আমেরিকার দিকে। কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা আর তেহরানের পার্লামেন্ট ও ইমাম খোমেনির মাজারে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা যে একসূত্রেই গাঁথা, তা উপলব্ধি করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি আমেরিকার দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালানো এবং সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার শক্ত দলিল ও প্রমাণ ইরানের হাতে আছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ানসহ প্রধান গণমাধ্যমে অভিযোগ ওঠে, সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোয় সৌদি ভূমিকার প্রমাণ লুকাতে চাইছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। গত ডিসেম্বরে জার্মানিতে ফাঁস হওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনেও একই অভিযোগ ছিল। সুতরাং নিজ দেশে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম মার্কিন বিমানঘাঁটি করতে দেওয়া কাতারের ‘অপরাধ’ অন্য।
সবচেয়ে বড় তেল মজুত এবং তরল গ্যাসভান্ডারের মালিক কাতারের দশা আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী। তাদের টাকা আছে, আধুনিকতা আছে আর আছে আল-জাজিরার মতো বৈশ্বিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম। মুসলিম ব্রাদারহুডের মাধ্যমে কাতার আরব জগতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছিল। মিসরে সেই চেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও হামাস ও হিজবুল্লাহ টিকে আছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা কাতারের রাজপরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ। হামাসের প্রধান নেতা খালেদ মিশালও কাতারের আশ্রয়ে কদিন আগেও ছিলেন। আরবের ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের ইরান বিষয়ে কাতার সৌদি-আমেরিকান জোটের লাইনে না থাকাই কাতারের বড় ‘অপরাধ’।
যত দিন ইরান থাকবে, তত দিন আরবের স্বৈরশাহি, সামরিক একনায়ক ও যুদ্ধবাজ শাসকশ্রেণি ও তাঁদের পরম মিত্র ইসরায়েল নিরাপদ বোধ করবে না। সেরের ওপর সোয়া সের হয়েছে হামাস-হিজবুল্লাহর প্রতিরোধী মুক্তিসংগ্রাম এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক ইসলাম। সৌদি আরব ও আমেরিকার স্পনসারড ওয়াহাবিবাদ এবং তুরস্ক থেকে বহিষ্কৃত গুলেনের রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক ইসলামের বিরোধ এখানেই: একটি সাম্রাজ্যবাদ ও তেলকুবেরদের হাতিয়ার অন্যটি তৃণমূলের কণ্ঠস্বর হওয়ার অভিলাষী। কাতার ও ব্রাদারহুডকেও ধোয়া তুলসীপাতা বলার কারণ নেই। কাতারই কয়েক বছর আগে প্রথম সিরিয়ায় আরব জোটের সেনা অভিযান চালানোর প্রস্তাব তুলেছিল। আমেরিকা চাইছে ইসরায়েলকে আরব জোটে ঢুকিয়ে দিয়ে আরব-ইসরায়েল যৌথ শক্তি দিয়েই ইরানকে কাবু করা। যেহেতু ইরানের সঙ্গে ওবামার করা পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসা আমেরিকার জন্য লাভজনক নয়, সেহেতু ইসরায়েলি বুদ্ধি আর আরব সম্পদ দিয়ে একই সঙ্গে আরব জনতা ও ইরান রাষ্ট্রকে ছত্রভঙ্গ করাই মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ পশ্চিমাদের কবজায় রাখার উপায়। ইরান-কাতার-রাশিয়া মিলে নতুন আরেকটা ওপেক গঠনের চেষ্টা অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দিতে চায় আমেরিকা।
যাহোক, এ অবস্থায় যার কোনো ক্ষতি নেই, তিনি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সৌদি আরবের ডাকা আরব আমেরিকান ইসলামি সম্মেলনে ইরানকে রুখে দেওয়ার যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন, তা বৃথা যায়নি। মুসলিমবিদ্বেষী বক্তৃতা করা ট্রাম্প, মার্কিন দেশে মুসলমানদের সফর-নিষেধাজ্ঞা দানকারী ট্রাম্প সাহেবই সৌদি দুনিয়ার ‘নেতা’ হিসেবে হাজির হয়েছেন। গত ২১-২২ মে রিয়াদে ট্রাম্প ৫৪টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে বক্তৃতার বেশে সবক দেন। তাঁর আহ্বানের পরপরই শুধু কাতারের বিরুদ্ধেই নয়, সৌদি আরব, বাহরাইনসহ আরবের শিয়া ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়ন বেড়েছে।
কারও ঘর পোড়ে, কেউ আলুপোড়া খায়। রিয়াদ সফরে সৌদি আরবের সঙ্গে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় (১০৫ বিলিয়ন ডলার) অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন ট্রাম্প। এর প্রতীক হয়ে থাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বাদশাহ সালমানের তলোয়ার-নৃত্য। ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও কৌশলবিদ লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার কথা। তুর্কি ওসমানিয়া শাসন উচ্ছেদ করে সৌদি শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিসম। আরবের দুর্ভাগ্যের সেটাই সূত্রপাত। বাদশাহ-ট্রাম্পের তলোয়ার-নৃত্য নতুন বিপর্যয়ের প্রতীক। ইসরায়েল ইতিমধ্যে ৩৬ ঘণ্টার সামরিক মহড়া করেছে, যার উদ্দেশ্য সম্ভাব্য গাজা আগ্রাসনের প্রস্তুতি। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সামরিক মুখপাত্র টুইট করে বলেন, ‘যা ঘটছে, তা ওই তলোয়ার-নৃত্যের প্রাথমিক ফল।’
কাতার তথা ইরানের বিরুদ্ধে আরব ঐক্য আরব জনগণ ও বিশ্ব শান্তির বিপক্ষে। এ ধরনের ঐক্য দেখা গিয়েছিল ইরাক আগ্রাসনের সময়। অথচ অন্য একধরনের আরব ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা আরবসহ মুসলিম জনতা প্রত্যাশা করে। ঠিক ৫০ বছর আগে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সেটা দেখা গিয়েছিল। সেই ঐক্যেও সৌদি আরব তো ছিলই না, বরং তার ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। ছয় দিনের সময় যুদ্ধ নামে পরিচিত সেই যুদ্ধে আরবের ত্রাতা বলে খ্যাত মিসরের গামাল আবদেল নাসের পরাস্ত হন। অল্পকাল পর তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনের আশাও নির্বাপিত হয়। জন্ম হয় পিএলওর। আরবজুড়ে সামরিক ও রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন আরও পোক্ত হয়। সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটে। ইসরায়েল আরও আগ্রাসী হয়, দখল করে নেয় পূর্ব জেরুজালেমসহ সিরিয়া, মিসর ও জর্ডানের বিস্তৃত এলাকা।
নাসেরের পতনে যারা খুশি হয়েছিল, সাদ্দামের পতনে যারা উৎসব করেছিল, ইরানের পতনের জন্য তারাই আবার জোট বেঁধে মরিয়া হয়েছে। ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়। প্রথমবার যে ঘটনা ট্র্যাজিক হয়, দ্বিতীয়বার তা নাকি পরিহাস হয়ে ওঠে। প্রথম আরব ঐক্যের পরাজয় ছিল ট্র্যাজিক। দ্বিতীয়বার ইরাক ধ্বংস আরব ও মুসলিম দুনিয়াকে পরিহাস করেছিল। এবার সম্ভবত ট্র্যাজিকমেডি দেখতে যাচ্ছে শান্তিকামী বিশ্ব। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইসলামি দুনিয়ার শীর্ষ বাদশাহের তলোয়ার-নৃত্য ট্র্যাজিকমেডিই বটে।
কাতার আরব জগতের পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১১ সালে কাতারের অর্থায়নে ফ্রান্স, ইতালি, তিউনিসিয়া মিলে নির্মিত এবং আন্তোনিও বান্দারেসা ও ফ্রিদা পিন্টো অভিনীত ব্ল্যাক গোল্ড চলচ্চিত্রে। ব্ল্যাকগোল্ড বা তেলের খনি পাওয়ার পর কাতার কীভাবে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার সংগ্রাম করেছে, এই ছবি সেই কথাই বলে। সেই চলচ্চিত্রের তরুণ নায়ক বুঝতে পেরেছিল, সনাতন আরব ঐতিহ্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও আধুনিকতার ভারসাম্য রক্ষাতেই আরবের সোনালি ভবিষ্যৎ। সেদিনের চলচ্চিত্রের গল্পটাই যেন আবার ঘটে চলছে বৈশ্বিক রাজনৈতিক মঞ্চে।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন