মিথ্যাবাদী রাখালেরা এখন উল্টা কথা বলে। তারা বলে, না না না, বাঘ আসেনি। এদিকে বাঘ এসে গরু খেয়ে যাচ্ছে, মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। তবু রাখালেরা আমোদপুষ্ট। ঈশপের গল্পের রাখাল মিথ্যা বলার জন্য বাঘের পেটে গিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবের বাংলাদেশে মিথ্যা বলাই যেন মোক্ষম মন্ত্র। মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা গরুর দিক থেকে পড়লে রাখালকে দায়িত্বহীন মনে হবে। কিন্তু জনপদে হানা দেওয়া বাঘের দিক থেকে পড়লে? বাঘ দেখল দায়িত্বপ্রাপ্ত রাখাল শুধু মিথ্যাই বলে না, পাহারায়ও ফাঁকি দেয়। বাঘ আরও জানল, প্রহরীর বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম। যে মিথ্যা বলে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা কম এবং যার দক্ষতা-যোগ্যতা তলানিতে, তাকে বাঘের
ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এমন মওকা পেলে বাঘ তো বটেই, শিয়াল-হায়েনারাও জনপদে হামলে পড়বে।
এই গল্পের শিক্ষা হলো: মিথ্যাবাদী রাখালেরা আসলে বাঘেরই সাহায্যকারী।
এমন রাখালেরও কিছু বন্ধুবান্ধব এবং ফেসবুকের ভাষায় ‘ফলোয়ার’ থাকে। ট্র্যাজেডির মধ্যে তাঁরা শুধু নাটক দেখেন, করুণ কঠিন পরিণতিটা দেখেন না। তাঁদের নাট্যানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, যদি সবই নাটক হয়, তাহলে তার মধ্যে কোন চরিত্রে আপনি অভিনয় করছেন? যে নাটকের গণ্ডি দেশ ও রাষ্ট্র, জাতীয় জীবন যার বিষয়, মৃত্যু যার খেসারত, তার বাইরে তো কেউই থাকতে পারছি না। জীবননাটকের নাট্যকার কে, তা আমরা জানি না; কিন্তু সেই নাটকে কে কোন চরিত্রে দাঁড়ানো, তা আন্দাজ করা সম্ভব। সেটা কাজেও বোঝা যায়, কথায়ও বোঝা যায়। পত্রিকা থেকে ফেসবুক, টক শো থেকে জনসভা সেই সব উক্তির উদাহরণে ভরপুর। উক্তিগুলো
ঘৃণার। কথার যদি পোড়ানোর ক্ষমতা থাকত, তাহলে এসব ঘৃণা-বিদ্বেষের তেজস্ক্রিয়তা ইতিমধ্যে দু-একটা হিরোশিমা-নাগাসাকি
ঘটিয়ে ফেলত।
৫৭ ধারা নামে একটা আইন আছে। সেই আইন এমনই আইন, বেছে বেছে কেবল সাংবাদিক-সমালোচক আর বিরোধীদের ধরে; রাজছত্রীধরদের কিচ্ছুটি বলে না। যদি বলত, তাহলে ঘৃণাজীবীদের মুখে লবণ পড়ত। ঘৃণার লাগামটা একেবারে খুলে দিয়েছিলেন বন্ধ
হয়ে যাওয়া একটি পত্রিকার সম্পাদক। কিছু কিছু ব্লগারের বিরুদ্ধে অকাতরে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর জেরে বহু রক্ত ও বহু প্রাণ ঝরেছিল। সেই সম্পাদক নিজেও জেল-নির্যাতন ভোগ করেছেন। আমরা ভেবেছিলাম, সেই পর্ব বুঝি সেখানেই শেষ। কিন্তু তা নয়। এত এত ঘৃণার বারুদ আমাদের তরুণদের অনেকের মনে জমা ছিল, সেগুলো নিঃশেষও হয়নি, দয়া-মায়ার রসে ভিজে অদাহ্যও হয়ে ওঠেনি। বরং, নিত্যনতুন ঘৃণার হলকা বয়ে যাচ্ছে বঙ্গীয় উপত্যকায়।
ফরহাদ মজহারকে কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তা আমরা জানি না। সময়ে সেটা আমরা জানব বা কখনোই নিঃসন্দেহ হতে না পেরে যার যার চিন্তার মান অনুসারে অনুমান করে নেব। সেই আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমরা ‘অপহরণ’ বা ‘নিখোঁজের’ ঘটনা দেখেছি, আর দেখেছি যিনি এর শিকার হয়েছেন তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে ও কিছু কিছু অনলাইন পোর্টালে ঘৃণার মজলিশ। আজ এটা ফরহাদ মজহারকে নিয়ে ঘটেছে, অন্য সময় ঘটেছে অন্য কাউকে নিয়ে। সত্যটা কখনোই জানা হচ্ছে না।
অপহরণ, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের অনেক ঘটনায় রাখালদের মিথ্যাভাষণ আমরা দেখিনি কি? তাঁদের কারণে মানুষ আর সত্য-মিথ্যার ফারাক করতে পারে না। ফলে দল বা মতবাদের বায়োস্কোপের ফোকরে চোখ লাগিয়ে সত্যটা দেখতে হয়। বায়োস্কোপ দেখতে হয় বাস্তবতার দিকে পেছন ফিরে, আর শুনতে হয় বায়োস্কোপওয়ালার দেখানো নির্বাচিত ছবি এবং শুনতে হয় কেবল তারই সংলাপ। শিশুরা বায়োস্কোপ ভালোবাসে। রাখাল ও বাঘ তা দেখে হাসে।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে নিয়ে যেমন অনেকের বিদ্রূপ-পরিহাস দেখা যায়, অপহরণ-নির্যাতনের ভিকটিমকে নিয়েও ঘৃণা-বিদ্রূপের মজলিশ বসে যায়। জাহান্নামের আগুনে বসে যাঁরা নিষ্ঠুর হাসি হাসতে পারেন, তাঁদের গায়ে হয়তো তাপনিরোধক বর্ম আছে, কিন্তু সেই সুখ আমজনতা কোথায় পাবে?
সত্য কে কতটা জানবে, কীভাবে কোন ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হবে, তা চিরকালই ক্ষমতার বিষয়। উনক্ষমদের জন্য থাকে শুধু গুজব। যতই বলা হোক যে গুজবে কান পাতবেন না, গুজব ততই আকর্ষণীয় হয়ে হাতছানি দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি দেয়ালের মধ্যেও আড়ি পাতা কান বসায়, গুজব তখন কানের ফুটা থেকে চোখ পিটপিট করে। শোনা কথাতেই তখন চাক্ষুষ করার বিশ্বাস আসে। এতে বাস্তবতা ঘোলাটে হয়ে যায় আর ঘোলা পানিতে মাছ শিকার তো অনেক সোজা!
সত্য জানা তাই জরুরি। ক্ষমতার সামনে যেমন সত্য বলা সৎ বুদ্ধিজীবীর কাজ, তেমনি জনগণকে সত্য জানানোটা গণতান্ত্রিক ক্ষমতার দায়। নইলে বুদ্ধিজীবীরা জনগণের চিন্তার রাডার হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফোড়নজীবীতে পরিণত হন আর সরকার হয়ে পড়ে নিজের বানানো ‘সত্যের’ দেয়ালে আটক। তার অবস্থা হয় ওই মিথ্যাবাদী রাখালের মতো, যে নাকি অন্তিম মিথ্যার পর বাঘের শিকার হয়েছিল।
শিকার ও শিকারিতে দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তাদের এক দল যখন কাঁদে, অন্য দলের তখন হাসি পায়। এক দলের সব কথাই মিথ্যা হলে আরেক দলের সব কথাই সত্য বলে মানতে হয়। একদল মানুষ যখন অসুখী বাস্তবতায় ভুগছে, তখন অন্য একদল ভাবে, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। রাজনৈতিক দাগের এপারে-ওপারে এ দুই বাস্তবতা ও মনোভাব বিরাজ করছে। এই চরমভাবাপন্ন মানসিক জলবায়ুকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বিমেরু আচরণগত বিভ্রাটও বলা যায়। আমাদের অনেকেই এই চরমভাবাপন্ন মানসিকতায় মজে আছেন। দুটি রাজনৈতিক মেরুর মতো জাতীয় স্বভাবেও দেখা যাচ্ছে দুই বিপরীত মেরুর আবেগ: ঘৃণার উচ্ছ্বাস ও নির্বাক বিষাদ।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ ও স্বচ্ছ জ্ঞান গঠিত হতে দেয় না। তাই একদিকে সফলতার জিগির, আরেক দিকে ভয়াবহ সব ঘটনায় বেতাল লাগে অনেকের। দেশ আসলে কতটা ভালো বা মন্দ পথে, তার ভারসাম্যপূর্ণ পরিমাপ করতে ব্যর্থ হই আমরা। একটি-দুটি সাফল্যে এমন কুচকাওয়াজ শুরু হয়ে যায়, যেন বিশ্ববিজয় ঘটে গেছে। পরেই আবার কোনো না কোনো ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ি। এই অবস্থায় আত্মবিশ্বাসের ধমক আর হতাশার আহাজারি আকাশ-বাতাস ঢেকে ফেলে।
অস্বীকার করলে নিজেকেই ধোঁকা দেওয়া হবে যে জনজীবন মারাত্মক সব অঘটনে বিপর্যস্ত। জীবনের ভয় ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এই সময়ের বৈশিষ্ট্য। অনেকেই নিশ্চিত নয়, কী থেকে কী হচ্ছে। জীবন, জবান, অধিকার দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ থেকে বেরোনোর উপায়ও দূর অস্ত। এ অবস্থাও বাইপোলারিটির জন্ম দিতে পারে, গণ-অবসাদ ও সামাজিক জড়তা বা ইনারশিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সার্বক্ষণিক উদ্বেগ, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে ভয় তখন জন্ম দিতে পারে রাজনৈতিক বিকার। জঙ্গিবাদ যার একটা প্রকাশ, আরও প্রকাশ আছে।
ওদিকে যারা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে নিজেদের দুর্দান্ত শক্তিশালী মনে করছে, মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘তাদের এই উচ্চকিত মনোভাবকে বলে ম্যানিয়া বা হাইপারম্যানিয়া। এমন সময় আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক উদ্দীপনা ও আত্মবিশ্বাস বোধ করে। তখন তারা ভাবনাচিন্তা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যার পরিণতি তারা জানে না।’
এ দুই মনোভাব আসলে একই অসুখের দুই দিক। এর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে সরকারপন্থী ও বিরোধীদের আচরণে। উভয়ের মাঝখানে কাটা আছে ঘৃণার পরিখা। এই অবস্থা অন্ধকারের শক্তিকে উৎসাহী করে তোলে। তারা দেখেছে ব্লেমগেম, বিনা তদন্তে দোষারোপ। দেখেছে মিথ্যার বাহাদুরি। তারা আরও দেখেছে, কথিত ‘সচেতন’ জনগোষ্ঠী নিজেদের তৈরি করা গল্পে নিজেরাই বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসছে। দেখে দেখে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তারা দেখেছে অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং সত্যের ধামাচাপা। যে সমাজে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সত্যের দাবি কমজোরি থাকে, সেই সমাজে ঘৃণা আর অবিশ্বাসের ভাইরাস চিকুনগুনিয়ার চাইতেও দ্রুত ছড়ায়।
এ অবস্থায় জনগণ বলে কিছু আর থাকে না। থাকে এক ভয়ের জঙ্গল। সেই জঙ্গলে সবাই যার যার সম্প্রদায় আর স্বার্থের খেজুরগাছে কলসির মতো ঝুলন্ত: ঠুনকো, পায়ের তলায় মাটিবিহীন, নিশ্চল।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন