|
মাসুম খলিলী
mrkmmb@gmail.com |
|
খালেদ মেশালের মাগরেব সফর ও জেরুসালেম ইস্যু
14 January 2018, Sunday
জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে আমেরিকান স্বীকৃতি এবং এ ব্যাপারে ইসরাইল দেশটির সংসদে এই পবিত্র নগরীটির উপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য যে আইন প্রণয়ন করছে তার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে তাৎপর্যপূর্ণ নতুন মেরুকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওআইসি সর্বসম্মতভাবে পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মাগরেব অঞ্চলেও (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মোরিতানিয়া) ফাতাহ-হামাস নির্বিশেষে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাৎপর্যপূর্ণ সংহতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
হামাস নেতৃবৃন্দ জেরুসালেম ইস্যুতে মুসলিম দেশ এবং সহানুভুতিশীল অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে হামাসের কিংবদন্তিতুল্য নেতা খালেদ মেশাল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। তিনি গত মে মাসে হামাসের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব ইসমাইল হানিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়ার আট মাস পর আবার দৃশ্যপটে চলে এসেছেন। জেরুসালেম ইস্যুকে কেন্দ্র করে মেশাল ডিসেম্বরের শেষে মোরিতানিয়া এবং মরক্কোতে এক সরকারি সফর করে সেখানকার সরকার বিরোধি দল নির্বিশেষে সবার সাথে আলোচনা করেছেন।
খালেদ মেশাল রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্ট (তিউসৌল) -এর জাতীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ২১ ডিসেম্বর মোরিতানিয়া সফর শুরু করেন। তিনি ২৩ ডিসেম্বর সেখানকার শাসক দলের নেতা সিডি ওল্ড শেখ আবদাল্লাহ এবং মোরিতানিয়া ইউনিয়ন অব রিপাবলিক (ইউপিআর) নেতাদের সাথে আলোচনা করেন।
মেশাল গত ২৪ ডিসেম্বরে তিউসৌলের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলেন যে, বিরোধী দল তিউসৌলের আমন্ত্রণে তিনি যখন মোরিতানিয়া পৌঁছেন তখন তাকে প্রেসিডেন্ট’র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয়। মোরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট এই সফরটি অনুমোদন করেন।
২৫ শে ডিসেম্বরে, মেশাল মোরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওল্ড আবদেল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে মোরিতানিয়ার জনসাধারণ ও সরকারি যোগাযোগের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মেশাল ২০১০ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজকে ধন্যবাদ জানান এবং এ ব্যাপারে হানিয়ার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানান।
হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সদস্য ও আরব ও ইসলামিক সম্পর্কের প্রধান ইজাতাত আল-রিশক এ প্রসঙ্গে বলেন, "মেশালের মোরিতানিয়া ও মরক্কো সফর আরব ও মুসলিম দেশ এবং বিশ্বের বাকি অংশের সাথে হামাসের যোগাযোগ স্থাপনের অংশ। হামাস নেতৃবৃন্দ তুরস্ক, কাতার, ইরান, মালয়েশিয়া, লেবানন, সুদান এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেছেন এবং আগামী দিনগুলোতে তারা এ সফর চালিয়ে যাবেন। মোরিতানিয়া ও মরক্কোর সফর হামাসের সরকার ও জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হবার বিশেষ সুযোগ। যদিও হামাসের সাথে তারা আগে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিল। "
রিশক উল্লেখ করেছেন, হামাস এর মরক্কো এবং মোরিতানিয়া সফর এই ইঙ্গিত করে যে, ফিলিস্তিন [ইস্যু] সরকারি দল এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক চেতনাতে দৃঢ়ভাবে উপস্থিত রয়েছে। হামাস নেতা মেশালের দেশটির সব রাজনৈতিক পক্ষ এবং মিডিয়ার সাথে বৈঠকে এটি দেখা যায় যে সবাই ফিলিস্তিনকে ভালোবাসে এবং তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও এর জন্য কাজ করছে।”
মোরিতানিয়ার রাজনৈতিক গবেষক ও কাতারের হামাদ বিন খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক নীতি ও ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মুখতার আল-শানকিতি বলেন, "মেশালের সফরটি নোয়াখোচ এর ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং মোরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট ও বিরোধী দল উভয় ফিলিস্তিনি কজ ও জেরুসালেমের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত হামাস উপলব্ধি করে যে, বর্তমান মোরিতানীয় শাসনের একটি সুবিধা হল তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং [মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড] ট্রাম্পের জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে ঘোষণার বিরুদ্ধে আবস্থান গ্রহণ করেছে।
১৯৯৯ সালে ইসরাইল এবং মোরিতানিয়া পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে ইসরাইল ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে জানুয়ারী ২০০৯ পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ চালানোর পর এ সম্পর্ক আর থাকেনি। সেই সময় দেশটির সরকার তেল আবিব থেকে কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং সেখানকার ইসরাইলী দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। মার্চ ২০১০ সালে, মোরিতানিয়া ঘোষণা করে যে দেশটি ইসরাইলের সাথে সম্পূর্ণভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করছে।
শানকিতি আরও বলেন, "যদিও মোরিতানিয়ায় হামাসের অফিস স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে রয়েছে তবে এখানে বেশ কিছু আঞ্চলিক বিবেচ্য বিষয়ও রয়েছে। মোরিতানিয়া কাতারের কাছাকাছি হলে এক্ষেত্রে অগ্রগতি হতে পারে। দোহা হামাসের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর উপসাগরীয় সঙ্কটে মোরিতানিয়া সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছাকাছি থাকে এবং কাতার থেকে দূরে সরে যায়।”
৭ জুন, মোরিতানিয়া সৌদি নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীতে যোগদান করে এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থন এবং আরব দেশে বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ ছড়িয়ে দেয়ার যে অভিযোগ রিয়াদ উত্থাপন করে তার সাথে সুর মিলিয়ে কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার পর সে অবস্থার বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসে। হামাসকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়েও এর প্রকাশ ঘটে।
খালেদ মেশাল ২৬ ডিসেম্বর মোরিতানিয়া থেকে জাস্টিজ এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টির আমন্ত্রণে মরক্কো যান। দুই দিনের সফরে তিনি মরক্কোর প্রধানমন্ত্রীর সাদুদ্দিন উসমানি, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব ও সংসদীয় দল এবং মডারনিটি পার্টি, ইশতিকলাল, সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন অব পপুলার ফোর্সেস পার্টি এবং ইউনিটি এন্ড রিফর্ম পার্টি নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন।
মেশাল ফিলিস্তিনের ইস্যুকে সমর্থন দেয়ার জন্য মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ট মোহাম্মদকে এবং দেশটির সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং অন্যদের অভিনন্দন জানান।
মরক্কোর বাদশাহ ১৯৭৫ সালে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) প্রতিষ্ঠিত জেরুসালেম কমিটির প্রধান। ১৯৭৯ সালে মরক্কো জেরুসালেমকে সমর্থন করার জন্য অনুদান সংগ্রহে বায়তুলমাল আল-কুদস প্রতিষ্ঠা করেন। মরক্কো সরকার ট্রাম্পের জেরুসালেম ঘোষণার বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপের অংশ হিসাবে ৬ ডিসেম্বর মার্কিন চার্জ দ্যা এফেয়ার্সকে রাবাত তলব করেন। ১২ ডিসেম্বর মরক্কোর সংসদ এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে এবং জেরুসালেমের উপর ইহুদিবাদী বৈধতা নাকচ করে দেয়। আর সেইসাথে ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলের নিপীড়নেরও অবসান দাবি করে।
মরক্কান আল-মাসেজ পত্রিকার সম্পাদক আজিজ আল-আলাতাতিরি বলেন যে, “যদিও মরক্কোর রাজনৈতিক সার্কেল মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোদ্ধা হামাসকে স্বাগত জানায় না কিন্তু মেশালকে সমাজতান্ত্রিক, উদার ও কমিউনিস্ট পার্টির স্বাগত জানানোর বিষয়টি মরক্কানকে বিস্মিত করেছে। কারণ এই দলগুলো হামাসকে ফিলিস্তিনি সমস্যার শান্তিপূর্ণ পন্থা লঙ্ঘন করার জন্য অভিযুক্ত করেছিল।”
তিনি আরও বলেন, "এখনো, এই সফরটির মানে এটি বলা যাবে না যে হামাসের জন্য রাবাতে একটি অফিস খোলা হবে। এই পদক্ষেপটি প্রয়োজনীয় মনে নাও হতে পারে কারণ হামাসের সাথে মরক্কোর ইসলামি দলগুলোর তাত্ত্বিক সম্পর্ক এবং সমন্বয় রয়েছে। তারা এই ধরনের দায়িত্ব পালন করে।”
জেরুজালেমের সঙ্গে মরক্কোর সংহতির ঘটনার একই সাথে হলো মেশালের সফর। মেশাল মরক্কোর দলগুলোকে হামাস-ফাতাহ সমন্বয়ের উন্নয়নগুলোর ব্যাপারে অবহিত করেছেন। তিনি আরব বসন্তের সাথে মরক্কোর "স্মার্ট" ডিলিংয়েরও প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যে, মরক্কোর বাদশাহ একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বজায় রাখার জন্য দূরদর্শি এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
মরক্কোর বাদশাহ মোহাম্মদের উপর সৌদি আরব আমিরাত ও মিসরের পক্ষ থেকে তখনকার ক্ষমতাসীন ইসলামিস্টদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারকে বরখাস্ত করার জন্য চাপ দেয়া হয়। কিন্তু এ চাপের কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি। পরবর্তী নির্বাচনেও সেই ইসলামী দলই আবার নির্বাচিত হয়।
ইসলামী দলগুলোর উপর মরক্কান গবেষক ইয়াহিয়া আলেম বলেন, "মরক্কোর প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এবং বাদশাহর আশীর্বাদে মেশালের এই সফর ফিলিস্তিনিদের কজ এবং জেরুজালেম ঘোষণা প্রসঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক বার্তা প্রদান করে। মরক্কো জেরুসালেমকে বরাবরই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং মরক্কোর বাদশাহ ১৯৭৫ সাল থেকে ওআইসির জেরুসালেম কমিটির প্রধান পদে আছেন।”
জেরুসালেম কমিটি নগরীটির আরব ও ইসলামী চরিত্রকে পরিবর্তন করার জন্য ইসরাইলি প্রচেষ্টাকে বাধা দিতে কাজ করে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহায়ন এবং শিশু, যুব ও নারী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করে।
আলেম আরো বলেন, " কিন্তু মেশালের সফরের প্রধান তাৎপর্য হল যে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হামাসের প্রতি মরক্কোর বাদশাহর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলিতে তার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বৈধতা ছাড়াও এই আন্দোলন ইসরাইলকে প্রতিরোধ করার জন্য বৈধতা লাভ করছে। "
পশ্চিম তীরের এন-নাজাহ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবদুল সাত্তার কাসেম বলেন, "আরব মাগরেবের সাথে হামাসের দুর্বল সম্পর্কের পরও মেশালের মরক্কো এবং মোরিতানিয়া সফর ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল।" এই সফরের সময় হামাসের জন্য জেরুসালেম নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়।
গাজার উম্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত শিক্ষার রাজনীতি বিজ্ঞান ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান ড. আদনান আবু আমের উল্লেখ করেন, মরক্কো ফিলিস্তিনিদের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি। সম্ভবত মোরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং মরক্কোর প্রধানমন্ত্রীর সাথে মেশালের সাক্ষাৎ হামাসের অফিসিয়াল অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। হামাসের নেতা এখন না থাকলেও মেশালের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক দুরদৃষ্টির প্রশংসা করেছেন দু’দেশের নেতৃবৃন্দ। মেশাল নিজেকে হামাস নেতৃত্ব থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করেননি এবং আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফোরামে তিনি রয়েছেন। যার ফলে হামাস মেশালের নেটওয়ার্ক থেকে উপকৃত হবেন যা তিনি বছরের পর বছর ধরে নির্মাণ করেছেন।”
মধ্যপ্রাচ্যের মাগরেব অঞ্চলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে এই উন্নয়ন জেরুসালেমের ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিশিয়ার সরকার আগে থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে জোরালোভাবে সমর্থন করে এসেছে। ওআইসির বিশেষ সম্মেলনে আলজেরিয়াও জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছে। এটি ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে জেরুসালেম ইস্যুতে যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে সেটিকে আরো সামনে এগিয়ে নিতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন