গত এক বছরে আমাদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিদায় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বও। তারা জনগণের কাছে আলেম হিসেবে সুপরিচিত। এমন তিনজনকে আজকের এ লেখায় কিঞ্চিৎ তুলে ধরছি। এর কারণ শুধু এটাই নয় যে, তাদের সম্পর্কে নিজের কিছু বলার আছে। বরং সমাজ ও জাতির জন্য অবদান রাখা সত্ত্বেও মূলধারার মিডিয়ায় তাদের ওপর তেমন আলোচনা হয়নি দেখে নিশ্চয়ই অনেকে বিস্মিত। এই প্রেক্ষাপটে তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করছি, যাতে আমরা নিজেদের চলার পথে প্রেরণা পেতে পারি।
যে তিনজন আলেমের কথা বলছি, তারা হলেনÑ মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও কারি মাওলানা মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। তাদের মধ্যে প্রথমজন প্রধানত সাংবাদিক, দ্বিতীয়জন সম্পাদক ও সংগঠক এবং তৃতীয়জন কারি হিসেবে সমধিক পরিচিত। অবশ্য তারা লেখক ও গ্রন্থকারের ভূমিকাও পালন করে গেছেন। মাওলানা কিসমতী ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রায় ৮০ বছর বয়সে এবং কারি ওবায়দুল্লাহ সত্তরোর্ধ্ব বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তাদের মধ্যে শেষোক্তজন সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শয্যাশায়ী ছিলেন মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে। মাওলানা কিসমতী এবং মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মৃত্যুসংবাদ পত্রপত্রিকায় কিছুটা ছাপা হয়েছে। তবে লজ্জা ও দুঃখের বিষয়, কারি ওবায়দুল্লাহর মতো সুপরিচিত কিরাতব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পরদিন এই খবর বোধ হয় দু-একটি ছাড়া কোনো পত্রিকায় পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মিডিয়া কত রাম-শ্যাম-যদু-মধু নিয়ে মাতামাতি করে, পত্রিকার পুরো পাতাজুড়ে ছবি আর দুই পৃষ্ঠাজুড়ে সাক্ষাৎকার ও লেখা ছাপা হয় পছন্দসই লোকজনের ওপর। অথচ যাদের নিজ নিজ অঙ্গনে রয়েছে বিরাট ভূমিকা আর উল্লেখযোগ্য অবদানÑ এমন অনেকের জন্য একটা লাইন ছাপতেও পত্রিকার কার্পণ্য। এটা মানসিক সঙ্কীর্ণতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতরামির নজির নিঃসন্দেহে।
এই তিনজনের মধ্যে মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ২০১৬ সালের মাঝামাঝি গত রমজান মাসে এবং কারি ওবায়দুল্লাহ গত মাসে ইন্তেকাল করেছেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনেক বই লিখেছেন, বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন। বহু সমিতি-সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়Ñ কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তার যে পরিচয় বড় হয়ে উঠেছিল, তা হলো ‘মদীনা’ সম্পাদক। অর্থাৎ, তিনি ধর্মীয় মাসিক মদীনা সম্পাদনা করেছেন। তা-ও অর্ধশতক ধরে। তিনিই এই বহুল প্রচারিত সাময়িকীর প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী। একই সাথে মদীনা পাবলিকেশন থেকে তার প্রকাশিত বইগুলো সংখ্যাধিক্যের চেয়েও গুণগতমান এবং চিন্তার জগতে চাহিদার কারণে বেশি উল্লেখযোগ্য।
আমার জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা হলো, ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত মাসিক মদীনার একটি কপি আমাকে দিয়েছিলেন একজন কমরেড। কপিটি হাতের কাছে নেই, তাই সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না, এটি ‘মদীনা’র সর্বপ্রথম সংখ্যাও হতে পারে। ষাটের দশকের সে সময়ে আমি হাইস্কুলের নিচের দিকের ছাত্র। আমাদের বাসার পাশেই আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন রুশপন্থী ছাত্র সংগঠনের জেলাপর্যায়ের এক নেতা। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জেলা প্রধান ছিলেন। পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ দিন জেলও খেটেছেন। তিনি আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী হিসেবে তার সংগ্রহে পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তক ছিল। ওই বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে মাসিক মদীনার পুরনো একটা কপি এবং শতবর্ষ আগের একটি বাংলা বিশ্বকোষ দিয়ে যান। ওই বয়সে আমি ওগুলোর গুরুত্ব বুঝিনি বলে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম না। এতটুকু মনে আছে, মদীনা পত্রিকাটি সাইজে ছিল ছোট এবং এর সম্পাদকীয়তে নাৎসি নেতা আইখম্যান প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছিল এমন একটি ঘটনা যা অনেকের জানা নেই। তা হলো, হিটলারের গণহত্যার অন্যতম সহযোগী আইখম্যান ইসরাইলি কারাগারে ফাঁসির অপেক্ষায় থাকার সময়ে শেষ ইচ্ছা হিসেবে এক কপি কুরআন শরীফ চেয়েছিলেন। কারণ তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার নতুন নাম হয়েছিল ‘আদিল’। ইসরাইল তার এই ইচ্ছা পূরণ করার কথা নয়। তাকে অচিরেই ফাঁসির রজ্জু গলায় পরতে হয়েছিল। আইখম্যান বিশ্বযুদ্ধের ১৫ বছর পরে সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে মোসাদ কর্তৃক অপহৃত হন এবং তাকে ইসরাইলে এনে বিচার করা হয়।
যা হোক, মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ‘মদীনা’র সাথে সেই ছোটবেলায় পরিচয় হয়েছিল। পত্রিকাটির সম্পাদকের নামের ব্যতিক্রমী (আসলে বিশুদ্ধ) বানান হিসেবে ‘মুহিউদ্দীন’ মনোযোগ কেড়েছিল। আর পাঠকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে এর প্রশ্নোত্তর বিভাগ। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনের নানা সমস্যার সমাধান ও জিজ্ঞাসার জবাব মিলত এ বিভাগে। স্বয়ং সম্পাদক উত্তর দিতেন।
‘মদীনা’র বিশেষ সংখ্যা বর্ধিত কলেবরে বের হতো সিরাতুন্নবী সা: উপলক্ষে। স্কুলজীবনে একবার ফেনীতে আমাদের বাসায় একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি গিয়ে আমার বড় ভাইয়ের খোঁজ নিলেন। জানালেন, তার লেখা ছাপা হয়েছে ‘মদীনা’য়। এ জন্য এর বিশেষ সংখ্যাটি তাকে পৌঁছাতে এসেছেন। ব্যাপার হলো, সাধারণত ডাকযোগে ‘মদীনা’র কপি পাঠানো হতো। মদীনা প্রেসের ওই লোকের বাড়ি ফেনী জেলায় এবং তিনি বাড়ি যাচ্ছেন বলে তাকে দিয়ে মুহিউদ্দীন খান সাহেব ‘মদীনা’র কপি পাঠিয়েছেন। ঘটনাক্রমে আমার বড় ভাই আর মাওলানা সাহেব ছিলেন সমবয়সী।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মদীনা পাবলিকেশন থেকে সেই ষাটের দশকেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছিল। আধুনিক মানসের উপযোগী এবং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, ইসলামসংক্রান্ত এমন বইপুস্তক তখন বাংলাভাষায় কমই ছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, মদীনা পাবলিকেশনের একটা বইয়ের নাম ছিল, ‘চল্লিশজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব।’
মুহিউদ্দীন খান রাজনীতির অঙ্গনে তৎপর থাকলেও তিনি মূলত বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাগবেষণার মানুষ। জাতীয়পর্যায়ের ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন তো বটেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতনামা অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের সাথেও তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ। মাওলানা মুহিউদ্দীন মোতামার আলম আল ইসলামি বা World Muslim Congress-এর একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন। এই সংগঠনটির নাম বহু বছর আর শোনা যায় না। তদানীন্তন পাকিস্তানে এর প্রধান সংগঠক মরহুম ইনামুল্লাহ খানের সম্পাদনায় করাচি থেকে বের হতো Muslim News International নামের আধুনিক ও আকর্ষণীয় মাসিক সাময়িকী। আঙ্গিক-অবয়ব এবং বিষয়-বক্তব্যের দিক দিয়ে এটি পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ম্যাগাজিনগুলোর সাথে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য রাখত।
আশির দশকের কথা। ভারতের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪-৯৯) ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি লাখ্নৌর ‘নাদওয়াতুল উলামা’ নামের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বক্তৃতা ও লিখনী দ্বারা তিনি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জাগরণ ও ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে আমৃত্যু তৎপর ছিলেন। ঢাকায় দিলকুশার বিসিআইসি মিলনায়তনে এক জমজমাট সুধী সমাবেশে মাওলানা নাদভী বক্তব্য রেখেছিলেন। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যস্ত দেখা গিয়েছিল মুহিউদ্দীন খানকে।
কয়েক বছর আগে একটি বড় আকারের বই পাই যাতে ছিল মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জীবনী, স্মৃতিচারণ, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি। বইটি পড়ে যা জেনেছি, স্মৃতি থেকে তার কিছুটা উল্লেখ করছি।
মাওলানা সাহেব দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তার শৈশব-কৈশোর, ছাত্রজীবন, কর্মজীবন, বিদেশভ্রমণ, লেখালেখি প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় মাদরাসা-ই-আলিয়াতে পড়ার সময় সাংবাদিকতা শুরু করার কথা। তখন থেকে লেখালেখি শুরু। দৈনিক আজাদের মাধ্যমে তার সাংবাদিক জীবনের সূচনা। সেই সুবাদে লেখার জন্য প্রথম সম্মানী প্রাপ্তি ছাড়াও ‘আজাদ’ খ্যাত মাওলানা আকরম খাঁর স্নেহ লাভের সুযোগ হয়েছিল।
সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো, মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ইংল্যান্ড সফরের একটি ঘটনা। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী নীরদ সি. চৌধুরী বিপুলভাবে বিতর্কিতও। নানা বিষয়ে তিক্ত সত্য উচ্চারণ এবং স্পষ্টবাদিতাই এর কারণ। তিনি বহু বছর আগেই ভারত ত্যাগ করে অক্সফোর্ড কী ক্যাম্ব্রিজ ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বাস করতেন। তার পৈতৃক নিবাস কিশোরগঞ্জ জেলায়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বাড়ি পাশের ময়মনসিংহ জেলায়। তার বাবা আনসারুদ্দীন খান ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন এবং স্কুলজীবনে ছিলেন নীরদ সি. চৌধুরীর সহপাঠী ও বন্ধু। তাদের বাল্যকালীন ঘনিষ্ঠতার কথা মুহিউদ্দীন খান জানতেন। নব্বইর দশকে তিনি ব্রিটেন সফরে গিয়ে নীরদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতের চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন। নীরদ চৌধুরী অত্যাধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষিত সেক্যুলার মানুষ। তিনি মুহিউদ্দীন খানের মতো ‘মাওলানা মৌলভী’ টাইপের মানুষকে তার বাড়িতে যে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছিলেন, তা এক স্মরণীয় ব্যাপার। তিনি মাওলানা সাহেবের পিতার স্মৃতিচারণ করেছিলেন সে দিন।
মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী
মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতীকে দীর্ঘ দিন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সরল ও নিরহঙ্কার মানুষটি বহু বছর কাটিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামে। একই অফিসে চাকরির সুবাদে তাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি; নানাভাবে জেনেছি। তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে কিসমতী সাহেব নামে সুপরিচিত ছিলেন। ‘কিসমত’ মানে, ভাগ্য। তার গ্রামের নামের মধ্যে ‘কিসমত’ শব্দটা আছে এবং এর ভিত্তিতে নামের শেষে যোগ হয়েছে ‘কিসমতী’। মাওলানা কিসমতী বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফেনী আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেছিলেন। বরাবর আমরা এর মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। ইমামতি করতেন কিসমতী ভাইয়ের ওস্তাদ এবং ওই মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ওবায়দুল হক ইসলামাবাদী। কিসমতী ভাইয়ের বাড়ি পাশেই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে।
‘কিসমতী সাহেব মওজুদ হ্যায়?’ অফিসে ফোনে এ কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলিয়ে উর্দু-বাংলা মিশিয়ে জবাব দিলাম। বললাম এক মিনিট অপেক্ষা করুন। এর মধ্যে তার রুমে গিয়ে খবর দিলাম। জিনিসপত্র ‘মওজুদ’ করা হয় জানি, কিন্তু আস্ত মানুষও যে মওজুদ থাকতে পারেন, তা এর আগে জানা ছিল না। আসলে ‘মওজুদ’ কথাটার একাধিক অর্থ হতে পারে। ঘটনাটা অনেক আগের। করাচির দৈনিক জং পত্রিকার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক বাংলাদেশ সফরে এসে মাওলানা কিসমতীর খোঁজ নিচ্ছিলেন।
এবার অন্য রকম এক ঘটনা (তবে অঘটন বলাই শ্রেয়)। ১৯৯৬ সালের এক রাতে মগবাজারের পত্রিকা অফিস থেকে ফিরছিলাম বাসায়। বেবিট্যাক্সিতে আমরা তিনজন- মাওলানা কিসমতী, ক্রীড়া সাংবাদিক মাসউদুর রহমান আর আমি। রাত সোয়া ১১টার মতো। বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বড় রাস্তায়ও লোক চলাচল কম। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে সার্ক ফোয়ারা মোড়ে বিরাট চক্কর। তাই গাড়ির গতি না কমিয়ে উপায় নেই। আমাদের বহনকারী বেবিট্যাক্সিটি গতি কমানো মাত্রই চোখের পলকে দুই যুবক লাফ দিয়ে উঠে ড্রাইভারের দুই পাশে বসে পড়ল। সাথে সাথে গাড়িটি প্রায় থেমে গেল। তখনই দেখি, আমাদের দুই পাশে দুইজন দুর্বৃত্ত ছোরা উঁচিয়ে ও পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে, কী ঘটে গেল, বুঝতে পারলাম না। তবে এরা ছিনতাইকারী, এটা বুঝতে দেরি হয়নি। এ দিকে আমার দুই সঙ্গী মাওলানা কিসমতী সাহেব আর তরুণ মাসউদ- দু’জনই ক্লান্ত দেহে ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বিপদ আঁচ করতে পেরে যেন অলৌকিক শক্তি বলে আমি দুই হাইজ্যাকারকে ধমকের সুরে বললাম, ‘তোমরা কাদের গাড়িতে উঠেছ? তোমরা কি আমাদের চিনেছ?’
ওরা সশস্ত্র, আমি নিরস্ত্র। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কী অসীম রহমত, সে দিন আমার জোরালো কথা শুনে ওরা গাড়ি থেকে নেমে সরে গেল। ড্রাইভার আবার যথারীতি চালাতে থাকে। সে জানায়, দুর্বৃত্তরা উঠেই নীরবে তার দুই হাত চেপে ধরায় সে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছিল। মাত্র দুই মিনিটে এত কিছু ঘটে গেল; অথচ আমার দুই সঙ্গী কিছুই টের পাননি। বয়োবৃদ্ধ মাওলানা সাহেব ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘মীযান সাহেব, ওরা কারা, কেন এসেছিল?’
কিসমতী সাহেব বেশ কয়েক বছর আগে পত্রিকার চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে কিছু দিন পর আবার লেখালেখি শুরু করেন। শেষ দিকে কিছু দিন অসুস্থতার পর চিরবিদায় নিলেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। বিভিন্ন দলমতের আলেমরা তাকে সম্মান করতেন। অনেকে ইসলামি বিষয়ে গবেষণার কাজে তার এবং তার লেখা বইয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। বিশেষ করে আলেম সমাজের মধ্যে তার পরিচিতি ছিল ব্যাপক।
কিসমতী ভাই ‘মখ্ফী’ (গুপ্ত) নামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। এতে তার চিন্তাচেতনা এবং বিশ্লেষণী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যেত। তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন ধীরে-সুস্থে চিন্তাভাবনা করে। এ জন্য তাকে অফিস লাইব্রেরির রেফারেন্স ফাইলের ওপর চোখ বুলাতে দেখা যেত। তিনি ছিলেন বিনয়ী ও সদালাপী।
মাওলানা কিসমতী রচিত ও অনূদিত বইয়ের সংখ্যা ত্রিশের মতো। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা’। বইটির একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে এবং পরবর্তী সংস্করণ ছিল কিছুটা বর্ধিত কলেবরে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কবল থেকে এই উপমহাদেশের মুক্তির যে সুদীর্ঘ সংগ্রাম, তাতে ধর্মীয় মহলেরও বিরাট ভূমিকা ছিল। এমনকি, স্বাধীনতা আন্দোলনের গোপন ও সশস্ত্র তৎপরতায়ও অনেক সময়ে আলেমরা দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছেন। এসব দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে দেশ ও জাতির স্বার্থে আত্মগোপন, দেশত্যাগ, জেল, দ্বীপান্তর, এমনকি মৃত্যুদণ্ডসহ নানা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। আর পরবর্তীকালের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে আলেম সমাজের অবদান তো ছিলই। তারা রাজপথে ও ময়দানে শুধু নয়, চিন্তাচেতনা ও লেখনীসহ বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনেও ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। মাওলানা কিসমতীর বইয়ে প্রচুর তথ্যসমেত এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ বেতার বহির্বিশ্ব কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছে। কিসমতী সাহেব এই কার্যক্রমের অনুষ্ঠানে সংবাদ পাঠ ও পর্যালোচনা করতেন। মৃত্যুর পর বেতারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মীরা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করেছেন।
কারি মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
ষাটের দশকে আমাদের স্কুলজীবনে রেডিও ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী মিডিয়া। তখন টেলিভিশনের সম্প্রচার ঢাকা নগরীতে সীমাবদ্ধ। রেডিওর অনুষ্ঠানমালা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। সাধারণ মানুষের জীবনে রেডিওর ভূমিকা ও প্রভাব ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। সকালে রেডিওর ধর্মীয় অনুষ্ঠান শোনা অসংখ্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা রেডিও থেকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত মানেই ছিল কারি ওবায়দুল্লাহর ওজস্বী ও প্রাণবন্ত কণ্ঠের সুললিত উচ্চারণ। কারি আরো যে ছিলেন না তা নয়। তবে তার মতো এত সুপরিচিতি ও জনপ্রিয়তা আর কেউ অর্জন করতে পারেননি।
প্রায় চার দশক ধরে রেডিও-টিভি, পার্লামেন্ট এবং জাতীয়পর্যায়ের নানা অনুষ্ঠান শুরু হতো কালামে পাক থেকে যার সুমধুর তিলাওয়াত শুনে, তার নাম কারি মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। কিন্তু গত এক দশক তার কণ্ঠ ছিল স্তব্ধ। তিনি ছিলেন বছরের পর বছর শয্যাশায়ী। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর সম্প্রতি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার অসুস্থতার এই দীর্ঘ সময়েও মিডিয়ায় তাকে নিয়ে খবর চোখে পড়েনি। কেবল দু-একটি পত্রিকায় ছোট ফিচার ছাপা হয়েছিল তার মর্মান্তিক অবস্থা জানিয়ে। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার চিকিৎসার্থে এগিয়ে এসেছেন বলে জানা যায়নি। এই অবস্থায় মানুষটি তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন।
আশির দশকে বনানীতে একটি ক্লিনিকে আমার এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক কিশোর রোগী আমার সাথে আলাপে জানায়, সে কারি ওবায়দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সে আরো বলেছিল, তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। কারি সাহেব সেখানকার এক ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে তিনি পুরান ঢাকায় ছিলেন। এখানে শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর কর্মজীবনে পরিচিত ছিলেন ঐতিহাসিক চকবাজার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে।
বাংলাদেশের অনেকেই কিরাতের ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন ও কুড়াচ্ছেন। এমনকি অল্প বয়সেই কেউ কেউ কারি হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এটা ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য অবশ্যই সুসংবাদ। এ দেশে কিরাতের ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করতে হয় কারি মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহকে। বিশ্বের প্রখ্যাত কারি আবদুল বাসেতকে (মিসর) আমরা দেখিনি। তবে আমাদের দেশের কারি ওবায়দুল্লাহকে আমরা দেখেছি এবং তার কণ্ঠে আল কুরআনের তিলাওয়াত উপভোগ করেছি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তার মতো এমন একজন মানুষের অসুস্থতার মতো মৃত্যুর সংবাদকেও এ দেশের মিডিয়া এড়িয়ে গেছে। এটাই কি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের নমুনা?
আরবি ভাষায় একটা কথা আছে- মওতুল আলেম মওতুল ইলম (আলেমের মৃত্যু মানে, ইলম বা জ্ঞানেরও মৃত্যু)। এই তিন ব্যক্তিত্বের ইন্তেকালে আমাদের জাতির যে ক্ষতি হলো, তা কত দিনে পূরণ হবে, কে জানে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন