বহুলালোচিত বিতর্কিত ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবেমাত্র শপথ নিয়েছেন। তার আমলে মার্কিননীতি কেমন দাঁড়ায়, তা নিয়ে মুসলমান ও অভিবাসীদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তবে এ ব্যাপারে আশাবাদী মানুষও আছেন। যেমন- আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘‘ট্রাম্প নির্বাচনের আগে যা বলেছেন, এর সাথে নির্বাচনের পরে যা বলছেন, এর পার্থক্য ব্যাপক। প্রথমবারের মতো তিনি পাবলিক অফিসের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বাস্তববাদিতার পরিচয় দিচ্ছেন। ট্রাম্প ‘স্বায়ত্তশাসিত’ আমেরিকার ধারণা থেকে ইতোমধ্যেই সরে এসেছেন। কারণ, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। আমেরিকার অর্থনীতি এত বিরাট যে, এটি বিশ্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’’ মন্ত্রী একটি দৈনিক পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে গত বৃহস্পতিবার পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে অর্থমন্ত্রীর এ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। এতে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ে তিনি তার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ধরে নেয়া যায়, এতে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। তিনি একবারও বলেননি যে, ‘এটা তার ব্যক্তিগত মতামত এবং সরকারি দায়িত্বের সাথে এর সম্পর্ক নেই’। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতরের শীর্ষ দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত, দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তাকে অনেক প্রশ্নই করা যায়, যেগুলো জাতীয় স্বার্থের নিরিখে জরুরি। সাক্ষাৎকারটি অনেক তথ্য দিলেও এ দিক দিয়ে অপূর্ণতাও রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন কোন সূচকে আমরা এগিয়েছি, যার কৃতিত্ব প্রধানত বেসরকারি খাতের, তথা উদ্ভাবক, উৎপাদক ও উদ্যোক্তাদের। এখানে দুর্নীতিদুষ্ট ও অনিয়মপুষ্ট আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের তেমন বাহবা পাওয়ার কিছু নেই। সার্বিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির বেহাল দশার কথা বলছেন শিল্পবাণিজ্যের অঙ্গনে যারা দীর্ঘ দিন নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছেন তারাই। তাদের হতাশা, ক্ষোভ ও উদ্বেগকে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারসাজি বলার কোনো উপায় নেই।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা যাই হোক, অর্থমন্ত্রী কিন্তু নিজেকে মোটামুটি সফল হওয়ার কৃতিত্ব দিলেন। ‘আপনার কোনো ব্যর্থতা আছে কি?’- প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘বেশি নেই ব্যর্থতা’। তবে সাক্ষাৎকারের উপসংহারে অর্থমন্ত্রী চলতি বছরের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলেছেন, নতুন বিনিয়োগ দেশে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মনে হয় বৈদেশিক বিনিয়োগের বেলায় সাড়া মিলছে। তবে আমাদের নিজেদের বিনিয়োগের ব্যাপারে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।’
অপর দিকে মন্ত্রী রেমিট্যান্সের সাম্প্রতিক ধস সত্ত্বেও চিন্তিত নন। কারণ ‘প্রবাসীরা সৌদি আরবে থেকে যাচ্ছেন। বেতন কম, তবুও তারা চলে আসছেন না।’ মন্ত্রীর এ যুক্তি গ্রহণ করা-না করা ভিন্ন ব্যাপার। তবে বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের বড় বড় পুরনো বাজারতুল্য দেশগুলো থেকে প্রবাসীরা বিষণ্নবদনে ও খালি হাতে ফিরছেন দলে দলে- এমন ছবি ও খবর পত্রিকায় বারবার চোখে পড়েছে।
সাক্ষাৎকারের প্রথম প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্তত আগামী পাঁচ বছর কখনো ৭ শতাংশের নিচে নামা ‘উচিত নয়’। তদুপরি, তিনি নিশ্চিত যে, ‘৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও অর্জিত হবে’। বেশ ভালো কথা। মন্ত্রীর সাথে আমরাও অপেক্ষায় রইলাম এ জন্য। কিন্তু কথা হলো, জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিই কি সব কিছু কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? কোটি কোটি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণসহ জীবনমান এবং নির্বিঘ্ন বিনিয়োগ ও উৎপাদন, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, সঞ্চয়ের নিরাপত্তা প্রভৃতিসমেত সার্বিক পরিবেশ কি নিরাপদ ঝুঁকিমুক্ত, নিশ্চিত ও টেকসই? গৌণ গণতন্ত্র ও মুখ্য উন্নয়নের এ যুগের বাংলাদেশ কিন্তু এ দিক দিয়ে নিরুদ্বেগ থাকতে দেয় না।
অর্থমন্ত্রী একটা তথ্য দিলেন ‘উন্নয়নের উৎসব’ ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, সে সম্পর্কে। তিনি বলেন, ৮-১০ বছর পরে উন্নয়নবাজেট কমে আসবে। তখন রক্ষণাবেক্ষণ আর মেরামতির জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ হবে।
মাননীয় মন্ত্রী এখনকার উন্নয়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও উন্নয়নের সাথে দুর্নীতি বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন। পরের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি সব সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব ছিলেন, কিন্তু এখন আর তা নন। কারণ কী?’ মন্ত্রীর সরল জবাব, ‘হ্যাঁ, সত্য যে, এখন আর দুর্নীতি নিয়ে বেশি কিছু বলি না। কারণ, এতে দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে না।’ তিনি দুর্নীতির ব্যাধির যে নিদান দিয়েছেন, তা ডিজিটাল সরকারের মন্ত্রী হিসেবে বলতে পারেন। বাস্তবে দুর্নীতির কারণ, অভাব ও স্বভাব দু’টিই। দেশের অফিস-আদালতে দুর্নীতি কমেছে না বেড়েছে, তা সবাই দেখছেন। কোনো একটা বছর টিআইবি সূচকে বাংলাদেশ ‘সেরা’ দুর্নীতিবাজ না হলেই খুশিতে কেউ বগলবাজানো উচিত নয়। মন্ত্রী আশা করছেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেড়ে যাওয়ায় দুর্নীতি কমবে। তার প্রত্যাশা পূরণ হলে আমরাও আনন্দিত হবো। কিন্তু বাস্তবে দুর্নীতির বহু কারণ ও সুযোগ আছে। মন্ত্রী সেগুলোর বিষয়ে কিছুই বলেননি।
দুর্নীতি কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী- তা দেশবাসী হাড়েহাড্ডিতে টের পাচ্ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, বেশ ক’টি সরকারি দফতর ও সংস্থার দুর্নীতি অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদককে পৃথক পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করতে হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘দুর্নীতির কারণে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা জিডিপির অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না’। গরিব এই দেশের জন্য এ টাকার পরিমাণ আসলেই বড় কি না, সেটা অর্থমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন। মানুষের মনে আছে, হলমার্ক গ্রুপের মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়ার কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে এ মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘টাকার অঙ্ক হিসাবে এটা তেমন বড় নয়’। টাকার পরিমাণ কত হলে, তাকে ‘বড়’ বলা যায়, সেটা জানতে পারলে আমরা কৃতার্থ হতাম।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারি খাতের পাট ও বস্ত্রকলগুলোর পারফরম্যান্স বাজে’। তেমনি সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর দশাও যা তা। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অনিয়ম মিলে এগুলোকে শ্বেতহস্তীতে পরিণত করেছে। বছর বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। অথচ এ অর্থ দেশের জনগণের। তাদের প্রাপ্য ও কষ্টার্জিত টাকা কেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে ঢেলে অপচয় করা হবে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঘোড়ারোগের ইতিবৃত্ত অনেক পুরনো। স্বাধীনতার পরপরই সমাজতন্ত্রের নামে ব্যাংক জাতীয়করণ হিতে বিপরীত হয়েছিল। ১৯৮১ সালের শেষ দিকে, বিএনপি আমলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতে অত্যন্ত সাহসী ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে নজির স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরে সব সরকার এহেন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক অবস্থা সন্তোষজনক নয় মোটেও এবং অচিরেই এদের লাভজনক করা দুঃসাধ্য- এটা সচেতন নাগরিক মাত্রই অবগত। কিন্তু মন্ত্রী বললেন এর বিপরীত। প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা তো খারাপ। সে ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?’ মন্ত্রী সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘না না, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা ভালো শুধু সোনালী আর বাচ্চুর ধ্বংস করে দেয়া ব্যাংকটা (বেসিক ব্যাংক) ছাড়া।’ সোনালী ব্যাংককে ডিঙিয়ে ইসলামী ব্যাংক (এবার কৌশলে সরকারের কব্জায় নেয়া) প্রথম বা সেরা হয়ে গেছে- এটাই যেন বড় আফসোস। নেটওয়ার্ক বা শাখা সংখ্যা ও সম্পদের দিক দিয়ে না হয় সোনালী প্রথম ছিল, কিন্তু ব্যাংকিং খাতের সাফল্য ও অগ্রগতির যেসব সূচক, সেগুলোর ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের পারফরম্যান্স স্বর্ণোজ্জ্বল বলে জানা যায় না। যা ঘটুক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দায়ের বোঝা সরকার টেনে যাবে- মন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট।
এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর একবার অর্থমন্ত্রী ছিলেন জনাব মুহিত; ২৭ বছরের ব্যবধানে আবার মন্ত্রী হলেন। এই দুই আমলের যে পার্থক্য তিনি নির্দেশ করেছেন, তা কৌতূহল-উদ্দীপক। তার ভাষায়, ‘এরশাদ আমলের মন্ত্রীরা উন্নয়ন সম্পর্কে তেমন সজাগ ছিলেন না। আর এখন সরকার উন্নয়নে এত জোর দিচ্ছে যে, প্রত্যেক মন্ত্রী কিছু না কিছু অর্থনীতিবিদ হয়ে গেছেন!’ এটা শুনে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীবর্গ নিশ্চয়ই পুলকিত হবেন।
অর্থমন্ত্রী মুহিতের সাহস ও সাফল্যের দু’টি বড় প্রমাণ হতে পারত বেসিক ব্যাংক আর বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমটির চেয়ারম্যানের মদদে লুটপাট আর দ্বিতীয়টির রিজার্ভের বিরাট ভাণ্ডার চুরি হওয়া। কিন্তু সরকার কোনোটার বেলায় কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। আলোচ্য সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ‘আপনি বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য এর চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সমালোচনা করেছিলেন জোর দিয়ে। তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ কেন নেননি?’ মন্ত্রী তার জবাবে এ দায়িত্ব আদালতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। কিন্তু সরকার কারণ-অকারণে এত লোককে ধরছে, মারছে, হেনস্তা করছে, বারোঘাটের পানি খাইয়ে চৌদ্দ শিকের স্বাদ দিচ্ছে- তবুও বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে কিছুই করছে না কেন? এটা জনগণের একটা বেসিক (মৌলিক) প্রশ্ন বটে।
মাননীয় মন্ত্রী বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন তার কয়েকটি Catchword-এর জন্য। যেমন- Rubbish, Bogus, Stupid প্রভৃতি। কিছু দিন ধরে তাকে আর এ কথাগুলো বলতে শোনা যায় না (না কি বললেও মিডিয়ায় আসছে না?) সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো রাবিশ-বোগাস বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিকট অতীতে ও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রভৃতি অঙ্গনের যে পরিস্থিতি, তাতে সত্যিকার রাবিশ (বর্জনীয়) ও বোগাস (ভুয়া) বিষয়, বক্তব্য, পদক্ষেপ ও প্রকল্পের যদি তালিকা করা হয়, এর বেশির ভাগ দায় বর্তাবে ক্ষমতাসীন মহলের ওপর। লক্ষণীয়, বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রী মুহিত সাহেব অকারণেও অনেক ক্ষেত্রে রাবিশ ও বোগাস বলেছেন। কিন্তু কখনো কারণ থাকলেও কেউ তার বক্তব্যকে একইভাবে হেয় করেনি। তার মতো প্রবীণজন এটা অনুধাবন করেছেন বলে সবাই মনে করে।
অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের আরেকটি অর্থহীন ‘ক্যাচওয়ার্ড’ হলো ‘দুষ্টু’। হয়তো তিনি সিরিয়াস অর্থে শব্দটা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু দুষ্টামি এবং দুষ্ট বা দুষ্টু- এ ধরনের শব্দ সাধারণত গভীর বা মারাত্মক কিছু বোঝায় না। হালকাভাবের এসব কথার সাথে এক ধরনের প্রশ্রয় দেয়ার ভাব সম্পৃক্ত। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বহু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর মহা সর্বনাশ ঘটিয়েছে। সব হারিয়ে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করে পরিবারের আহাজারির কারণ হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারির হোতারা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের উঁচুদরের ঘনিষ্ঠজন। তাদের কেউ কেউ এত প্রভাবশালী যে, মিডিয়াও এ ব্যাপারে রাখঢাক করাকে নিরাপদ ভাবে। শেয়ার কেলেঙ্কারির তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। জাঁদরেল অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে অসহায়, যার কারণ বোধগম্য। শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ তো নেয়া হলোই না, বরং অর্থমন্ত্রী ওদের ‘দুষ্টু’ বলে বিষয়টাকে হালকা করে দিলেন। পেয়ারের লোকরা কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব দেখিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিপুল অর্থ লুটে নিয়েছে, তা এখন কারো অজানা নয়।
মন্ত্রী শেয়ারবাজারের যে দুষ্টুদের কথা বলেছিলেন, শঙ্কা জেগেছে আবার ওরা বড় অঘটন ঘটাতে ঘাপটি মেরে আছে কি না। গত কিছু দিনে ঢাকার শেয়ারবাজারে অব্যাহত চাঙ্গাভাব অনেককে আকৃষ্ট করছে। ব্যাংক আমানতের ওপর ‘লাভ’ কম; বিনিয়োগে মন্দা। এই অবস্থায় শেয়ারবাজারে আগে মার খাওয়া অনেকেও আবার এদিকে ঝুঁকছেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নেতারা বলছেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান সূচক নিয়ে ভয়ের কারণ নেই এবং পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা আমাদের আছে। একই সাথে তারা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, ‘উদ্বৃত্ত অর্থের পুরোটা এখানে বিনিয়োগ করবেন না’। এক দিকে বলা হয়েছে সূচক এখন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। অন্য দিকে বলা হয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও প্রত্যেক শেয়ারের আরেক নাম ঝুঁকি।
ভারতের কাছ থেকে নিয়মমাফিক ট্রানজিট ফি নিলে তা সভ্য জাতির কাজ হবে না, বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন সিনিয়র উপদেষ্টা। আর সিনিয়র মন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেছেন, এখন ট্রানজিট বাবদ যে ফি নেয়া হচ্ছে তা কম নয়। তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘অনেক অর্থনীতিবিদই বলছেন- ভারত থেকে খুব কম ট্রানজিট ফি নেয়া হচ্ছে। যেমন- শিপিং এগ্রিমেন্ট মোতাবেক, প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ১৯২ টাকা ফি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের দিকে সবার নজর। কারণ, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে দীর্ঘ দিন। এর সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে ভারতে বাংলাদেশের পাট রফতানির ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি নামে অতিরিক্ত করের বোঝা। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকালে যথাযথ সুরাহার প্রত্যাশাই স্বাভাবিক। অর্থমন্ত্রীর ধারণা অন্যরকম। অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে নতুন কিছুই ঘটবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। এর পরই বলেছেন, ‘কী হয়, দেখা যাক।’
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বললেন, তার সাথে বিরোধ ঘটা আমার জীবনের খুবই অস্বস্তিকর এক অধ্যায়। তার সাথে সমঝোতার সব চেষ্টাই করেছি। তাকে অনেক প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ইমেরিটাস মেম্বার হবেন- এমন প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এটা মেনে নেননি। বরং স্পষ্ট করে বলে দিলেন, তিনি যাবেন আদালতে। তাকে নিয়ে আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়ি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ওই ব্যাংকের পদত্যাগী, বহুলালোচিত গভর্নর সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। মন্ত্রী বলেছেন, ‘ফায়ার আই’ প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার উদ্দেশ্যে। আমি মনে করি এটা বলা যায় যে, আমাদের সাবেক গভর্নরের (আতিউর রহমান) বেশি আগ্রহ ছিল জনসংযোগের দিকে। সম্ভবত এ কারণে ব্যাংকের নিরাপত্তার দিকটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ব্যতিক্রমী গভর্নর। এর আগে কেউ জনসংযোগের ক্ষেত্রে বেশি কিছু করেননি। তখন আমি তাকে সমর্থন জুগিয়েছি। কারণ মনে হয়েছিল, তিনি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপ ও প্রোগ্রাম জনগণের ব্যাপক মনোযোগ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে হয়তো। তবে এ বিষয়টার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে বেশি। অন্য দিকে নিরাপত্তার দিক অতটা অগ্রাধিকার পায়নি।
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত এক সময়ে অর্থোপার্জনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন সরকারি চাকরি। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সরকারি চাকরি করার স্বপ্ন ছিল না ছাত্রজীবনে। হতে চেয়েছিলাম ব্যারিস্টার। কিন্তু মনোভাব বদলে গেল ১৯৫৫ সালে জেলে গিয়ে। সেখানে উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তার সাথে আমার কথা হলো। বুঝতে পারলাম, সরকারি চাকরি করেও জনগণের সেবা করা যায়। পরে পরিস্থিতি আমাকে বদলে দিয়েছে। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলাম। কারণ, আর্থিকভাবে এটা বেশি সুবিধাজনক ছিল না। শুরু করলাম কনসালটেন্সি। ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছি। বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে। প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম। এভাবে শিগগিরই আমি জ্যাক অব অল ট্রেডস (সব কাজের কাজী) হয়ে গেলাম। আজো সেই শিক্ষার জোরে চলছি। ২০০০ সালে শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করলেন। ২০০১ থেকে তার সাথে এবং তার জন্য কাজ করছি।
এ এম এ মুহিত সুখী ও ধনী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন। তিনি মনে করেন, এ দেশের মানুষ আগের চেয়ে বেশি সুখী এবং তারা আর হতাশা, তীব্র দারিদ্র্য ও বঞ্চনায় ভোগে না। মন্ত্রীর এহেন স্বস্তি ও আশাবাদের ভিত্তি হচ্ছে ‘বিরাট একটা পরিবর্তনের বিষয় হলো, এক ধরনের শান্তি দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিএনপি শান্তি বিঘিœত করার বদলে এখন সরব হয়ে উঠছে।’
কিন্তু অর্থমন্ত্রী দেশের মূল সঙ্কটের বিষয়কে এড়িয়ে গেছেন। মূল সঙ্কট হলো, প্রকৃত অর্থে জনপ্রতিনিধত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অন্যথায় সুশাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সরকার টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু টেকসই শান্তি ছাড়া তা সম্ভব হতে পারে না।
বর্তমান সরকারের শুধু নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবীণতম মন্ত্রী হচ্ছেন এ এম এ মুহিত। যতদূর জানা যায়, সার্টিফিকেট মোতাবেক তার বয়স ৮২ বছর। প্রকৃত বয়স এর কম নয়, দু’য়েক বছর বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারে অর্থমন্ত্রী ছিলেন মাঝ বয়সে। আর শেষ বয়সে দীর্ঘ দিন একই দায়িত্বে রয়েছে সেই এরশাদের তদানীন্তন অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ, শেখ হাসিনার সরকারে। বাজেট পেশের দিক দিয়েও মুহিত রেকর্ডের অধিকারী। বয়সে তিনি ‘অশীতিপর’ হলেও উদ্যম ও তৎপরতায় তার ওপর বার্ধক্য প্রভাব ফেলতে পারেনি। বয়সে সবচেয়ে বেশি হওয়া যে সরকারি কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তার জন্য আশীর্বাদ হয়েছে, তা তিনি নিজেই বলেছেন। মুহিত ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছেন এবং বাম প্যানেল থেকে হল সংসদে নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশ্য তার বাবা অ্যাডভোকেট আবদুল হাফিজ ছিলেন দক্ষিণপন্থী মুসলিম লীগের বড় নেতা, পাকিস্তান আন্দোলনে যার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কর্মজীবনে মুহিত পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন কৃতিত্বের সাথে। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। বাস্তবে অর্থনীতি আর কূটনীতির অঙ্গন বেছে নিয়েছেন পেশার ক্ষেত্রে। কয়েক বছর আগে এ এম এ মুহিতের এক সাক্ষাৎকারে তিনি একটি ব্যতিক্রমী তথ্য দিয়েছেন। তা হলো এ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি খুব কম ঘুমান এবং মধ্যরাত অবধি পড়াশোনা করেন। আওয়ামী লীগের গত কয়েক বছরের শাসনামলে দেশে যে ক’টি পরিবার ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা প্রশাসনিক পদ-পদবির দিক দিয়ে সত্যিই সৌভাগ্যবান, তাদের একটি জনাব মুহিতের পরিবার। তিনি এ সরকারের বাকি মেয়াদে তো মন্ত্রী থাকছেনই; এরপরও বড় পদে তাকে দেখা যেতে পারে। তবে তিনি আর পার্লামেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। আগামী নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে হলে তখন তার বয়স হবে প্রায় ৮৫ বছর। ২০১৯-এর সেই নির্বাচনে সিলেটে একই আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তার ছোট ভাই ড. এম এ মোমেন। কয়েক বছর জাতিসঙ্ঘে স্থায়ী প্রতিনিধির পদে ছিলেন এবং সম্প্রতি দেশে এসে সিলেট আওয়ামী লীগের নেপথ্য কর্ণধার হিসেবে তিনি এখন তৎপর। যা হোক, একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো, অর্থমন্ত্রীর নামের সাথে কামের মিল আছে। যেমন- তার পুরোনামের প্রথমাংশ ‘আবুল মাল’, এর মানে হলো, অর্থসম্পদের অধিকারী (বা তত্ত্বাবধায়ক)। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ দেশের অর্থসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানই তো তারই কাজ।
পাদটীকা : অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। ১৯৪৫ সালের পর ওই বছরের মতো ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন’ আর হয়নি।’ (দৈনিক প্রথম আলো)
বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রীর এ কথা শুনে কেউ ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের নতুন সংজ্ঞা পেতে পারেন। কেউ ভাবতে পারেন, এটা নতুন বছরে জাতির জন্য সেরা রাজনৈতিক কৌতুক। কে কী ভাববেন, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমরা ভাবছি- আগামী সংসদ নির্বাচনটাও যদি এমন ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ হয় তা হলে জাতির কপালে অনেক ফাঁড়া আছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন