‘ট্রাম্প ইন, ওবামা আউট’ পত্রিকার এমন হেডিং সাথে সাথেই সত্য হলো ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ‘ইন’ করার পরই ওবামার অনুসৃত পলিসি আউট করার কাজ শুরু করে দেয়ার মধ্য দিয়ে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথের পর ট্রাম্প প্রথমেই কোপ দিয়েছেন ওবামার গর্বের কর্মসূচি ‘ওবামাকেয়ার’-এর ওপর। যদি ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ (সকালেই বুঝা যায়, দিনটি কেমন যাবে) প্রবাদ সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়- চার বছরে ট্রাম্প অনেক কিছু বদলে দেবেন। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও বিচ্যুতি কতটা বদলাবে, কে জানে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার সাথে সাথে যেভাবে একের পর এক ফরমান জারি করছেন, তাতে এই ক্ষ্যাপাটে ও ঝগড়াটে মানুষটিকে গতানুগতিকভাবে আনপ্রেডিক্টেবল বলার উপায় নেই। কারণ তিনি যেসব তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে চমক এবং সমালোচকদের ধমক লাগাচ্ছেন, সেগুলো তার পূর্বঘোষিত আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। নির্বাচনী প্রচারণায় বিঘোষিত তার যেসব সম্ভাব্য কর্মকাণ্ড উদ্ভট, অযৌক্তিক ও অন্যায্য হিসেবে নিন্দিত হয়েছে, তিনি কারো তোয়াক্কা না করে সেসব কথাকেই অবিলম্বে কাজে পরিণত করছেন। ফলে যতই সমালোচিত হন না কেন, তার বিপুল সমর্থক গোষ্ঠীর কাছে অঙ্গীকার পূরণকারী হিসেবে তার ওপর আস্থা বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি।
যা আশা করা হয়নি, তিনি তা করেই নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছেন। এর মধ্যে বিশ্ব মুসলিমের জন্য দুঃসংবাদও আছে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদ্যবিগত প্রেসিডেন্ট ওবামার পারফরম্যান্স আর যা-ই হোক, তিনি এমন এক কাজ করলেন শেষলগ্নে, যা তাকে বিশ্ব মুসলিমের কাছে স্মরণীয় করে রাখত। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ত্যাগের আগ মুহূর্তে ওবামা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের জন্য বরাদ্দের ২২ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় করার নির্দেশ দিয়ে যান। ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে এই আদেশে ওবামা সই করেন। কিন্তু সর্বশেষ খবর হলো, ট্রাম্প আদেশটি বাতিল করে দিয়েছেন। এতে তার ইহুদিতোষণ আর মুসলিম পেষণের মনোভাবই প্রমাণিত হলো।
এত দিন সবাই জানতেন, উন্নত গণতন্ত্রের মডেলতুল্য আমেরিকায় ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।’ অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় এসে আগের সরকারের বড় বড় সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ সাধারণত বাতিল করে না। বিশেষ করে জনকল্যাণকর ও জাতীয় স্বার্থানুকূল সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন নতুন সরকারও অব্যাহত রাখে। কিন্তু এবার অঘটনঘটনপটীয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প গদিতে বসে ক্ষমতার দণ্ড ঘোরাচ্ছেন অন্যভাবে। ফলে হাকিমের সাথে সাথে হুকুম নড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মোটেও দেরি না করে শুরুতেই তিনি বড় ধাক্কা দিলেন, ‘ওবামাকেয়ার’ বাতিল করে। ওবামার আমলে জনগণের কল্যাণে গৃহীত সবচেয়ে বড় পদক্ষেপগুলোর অন্যতম এটি। প্রখ্যাত ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, ‘ওবামাকেয়ার’ কর্মসূচি বাতিল হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা এত বেশি বিঘিœত হবে যে, বছরে ৩৬ হাজার মানুষ মারা যাবে।
আমেরিকাকে ‘গ্রেট’ করার অঙ্গীকার করে ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ‘গ্রেট’ হিসেবে পরিচিত দেশটিকে আরো ‘গ্রেট’ করার এই ঘোষণাকে দুনিয়ার বহু দেশ এবং শান্তিকামী মানুষ একপ্রকার ‘থ্রেট’ বা হুমকি হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্প আগামী চার বছর তো প্রেসিডেন্ট থাকছেনই, পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হলে, আবার জিতে আরো চার বছর থাকতে পারেন বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্ট। বিশেষ করে গত সিকি শতকে একক পরাশক্তি বা বিশ্বের স্বঘোষিত মোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লিবিয়া নিয়ে কী কেলেঙ্কারি করেছে, বিশ্ববাসী এর সাক্ষী। ক্ষমতায় যাওয়ার আগ থেকেই চরম উদ্বেগ ও ভীতি সঞ্চারকারী ট্রাম্প ক্ষমতায় গিয়ে আগামী কয়েক বছরে দেশকে কোথায় নেবেন আর দুনিয়ার কী দশা ঘটাবেন, তা কেবল আল্লাহই জানেন।
ট্রাম্প পাশের দেশ মেক্সিকো কিংবা দূরের দেশ চীন, কারো মুখের দিকে তাকিয়ে পথ চলতে চান না। মেক্সিকোর খরচেই সে দেশের সাথে দুই হাজার মাইল সীমান্তদেয়াল তোলার প্রতিজ্ঞায় তিনি অনড়। দেশটির জন্য ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দেখা দেবে তার পণ্য আমেরিকায় রফতানির ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপের ঘোষণা। তবে মেক্সিকো ট্রাম্পের দাবি না মানার ব্যাপারে অটল। এ দিকে, ক্ষোভে-দুঃখে মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন। তবে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ ট্রাম্পের বাতিল করার সম্ভাবনা নেই। মেক্সিকো স্প্যানিশভাষী হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর দেশ। এবার নির্বাচনে ট্রাম্প বেশি সোচ্চার ছিলেন হিস্পানিক, কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমানসহ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে।
ট্রাম্প (TRUMP) মানে ‘তুরুপের তাস।’ এটা যেমন বুদ্ধিমানের কৌশল, তেমনি এতে অনিশ্চয়তা বা ভাগ্যও বিজড়িত। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার নির্বাচনে ‘তুরুপের তাস’ বানিয়েছেন আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ ইস্যুকে। এটা ভোট পাওয়ার ব্যাপারে তার কাজে লেগেছে। কিন্তু আগামী চার বছর দেশ চালানোর ক্ষেত্রে তা কতটা কাজে লাগবে, সেটাই বড় কথা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এ পদের গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বিজয় ম্লান হয়ে যাবে।
TRUMP শব্দটির আরেক অর্থ হলো, চমৎকার ব্যক্তি যিনি মহৎপ্রাণ ও বদান্য, যিনি অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং যার মাঝে মানুষ সান্ত্বনা পায়। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে বক্তব্য, ভূমিকা ও ভাবমর্যাদা, তাতে তার নামের এসব অর্থের প্রতি সুবিচার হয় না মোটেও।
এ দিকে ট্রাম্প ও তার পরিবারকে হেয় করার অভিযোগে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শাস্তির খড়গ নেমে আসছে। ট্রাম্পের সন্তান ব্যারনকে বিদ্রুপ করায় জনপ্রিয় টিভি শোর চিত্রনাট্য রচয়িতা ও কমেডি লেখক কেটি রিচকে টিভি প্রোগ্রাম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানটি হলো, এনবিসি টিভির ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’। অথচ কেটি রিচ তার আলোচ্য উক্তিটি টুইট অ্যাকাউন্ট থেকে মুছে এ জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। পরদিনই বিশ্বখ্যাত পপশিল্পী ম্যাডোনার খবর। অসংখ্য মার্কিন নাগরিকের সাথে ম্যাডোনাও ট্রাম্পের বিজয়ে বিক্ষুব্ধ। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে ট্রাম্পসহ হোয়াইট হাউস ‘উড়িয়ে দেয়া’র কথা বলেছিলেন। এ জন্য টেক্সাসের একটি বেতারকেন্দ্র তার গান নিষিদ্ধ করেছে। ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদে প্রভাবিত হয়ে অথবা সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট মিডিয়া কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
টিপিপি নিয়ে টানাপড়েন : লাভ কার?
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বহুলালোচিত টিপিপি বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে নিজের কথা রেখেছেন। তার মতে, এতে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হবে। তবে সমালোচকদের মতে, এর ফলে শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক লোকসানও দিতে হবে আমেরিকাকে। কারণ, টিপিপি-তে যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে ফায়দা তুলবে তার প্রতিপক্ষ চীন। টিপিপি থেকে বেরিয়ে আসায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ক্ষতির একটি নজির তুলে ধরে রয়টার্স জানায়, দেশটির কৃষি অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান হারে রফতানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ট্রাম্প টিপিপি থেকে তার দেশকে বের করে আনায় মার্কিন চাষিদের ৬২ বিলিয়ন ডলারের বাজার হুমকিতে পড়ে গেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের যে ক’টি রাজ্যে কৃষি অর্থনীতি জোরালো, সেগুলোর সব ক’টিতে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের প্রতি এবার নির্বাচনে অনেক বেশি সমর্থন দেয়া হয়েছিল। এসব অঞ্চলের কৃষি ভূমিপূর্ণ গ্রাম এলাকায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। এখন সেই ট্রাম্প টিপিপি বাতিল করে দেয়ায় তাদের মাথায় হাত দিতে হবে।
টিপিপি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য জোট হওয়ার কথা ছিল, যদি আমেরিকা এতে শামিল থাকত। এর পুরো নাম ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয় সম্প্রতি। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল অঞ্চলে স্বীয় অর্থনৈতিক নেতৃত্ব কায়েমের লক্ষ্যে ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি গঠন করেছে। কিন্তু একটা বড় ফাঁক রয়ে যায় এবং এটা টিপিপি ত্যাগের কাজটি ট্রাম্পের জন্য সহজ করে দেয়। তা হলো, মার্কিন কংগ্রেস কখনো টিপিপি অনুমোদন করেনি।
এদিকে টিপিপিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে আমাদের বাংলাদেশের ফাঁকতালে লাভ হবে বলে প্রচারণা চলছে। মার্কিন জিএসপি-বঞ্চিত বাংলাদেশ এ বলে কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রের টিপিপি ত্যাগ করা তাকে প্রকৃতির দেয়া এক ধরনের শিক্ষা। জিএসপি সুবিধা না দিয়ে বাংলাদেশকে যারা বঞ্চিত করতে চেয়েছে, টিপিপি ছেড়ে আসায় তারাই এখন বেশ কিছুটা বঞ্চিত হতে পারে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।
জানা গেছে, টিপিপিতে আমেরিকা থাকলে ভিয়েতনাম সে দেশে শুল্কমুক্ত রফতানিসুবিধা পেত। কিন্তু বাংলাদেশকে ১৬ শতাংশ হারে বাড়তি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হতো। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের বিরাট রফতানি বাজার এবং ভিয়েতনামই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের বৃহত্তম রফতানি বাজার।
টিপিপিতে এ যাবৎ যোগ দিয়েছে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, চিলি ও পেরু। অনেকে টিপিপিতে চীনের যোগদানের বিষয়ে আগ্রহী। তবে জাপান এ ব্যাপারে শীতল মনোভাব দেখাচ্ছে। এ দিকে চীনের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য বাণিজ্য বৈরিতা প্রসঙ্গে বেইজিং বলেছে, এতে য্ক্তুরাষ্ট্র বা চীন, কারো লাভ হবে না, বরং ফায়দা তুলবে অন্যরা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের নাম ইন্দোনেশিয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টিপিপি ত্যাগ করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর জোর দিতে চান। ইন্দোনেশিয়া এখন এক দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে আসা টিপিপিতে যোগদান- দুই ব্যাপারেই আগ্রহী। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কাল্লা এটা জানিয়ে দিয়েছেন।
হবু রাজা, গবু মন্ত্রী
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে গঠিত মন্ত্রিসভা নানাভাবে অভিহিত হয়েছে। আমাদের দেশে ২০০৯ সালে গঠিত মন্ত্রিসভাকে অনেকে মশকারা করে বলতেন ‘কচিকাঁচার আসর’। সাধারণত কোনো দেশের ক্ষমতায় এসে সরকারপ্রধান এমন লোকদের মন্ত্রী করেন, যাতে মন্ত্রিসভা Cabinet of Talents হিসেবে অভিহিত হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যাপারস্যাপার আলাদা বা উল্টো। পত্রিকার খবরমাফিক, তার কেবিনেট ট্যালেন্টেড নয়, টেরিবল (Terrible) মানে ভয়ঙ্কর। গত শুক্রবার এর ব্যাখ্যা দিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে, ভয়ঙ্কর জাতীয়তাবাদী হিসেবে ট্রাম্প আবির্ভূত হয়েছেন। ১৫ সদস্যের মন্ত্রিসভায় হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর কেউ নেই যদিও তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। অথচ কুখ্যাত জেনারেল (অব:) ম্যাটিসকে প্রতিরক্ষা এবং আরেক জেনারেল (অব:) কেলিকে হোমল্যান্ডের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী বানানো হয়েছে।
অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো বিখ্যাত সংবাদপত্রের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের এই মন্ত্রিসভা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট’। আর এটা তো জানা কথা, নিকৃষ্ট মন্ত্রীরা মিলে উৎকৃষ্ট সরকার বা প্রশাসন উপহার দেয়া আকাশকুসুম কল্পনা। মার্কিন পত্রিকা ‘স্কয়ার’ সরাসরি বলেছে, দেড় শ’ বছরের মধ্যে সর্বাধিক ভয়ঙ্কর মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন ট্রাম্প। উল্লেখ্য, এবার মার্কিন ক্যাবিনেটে বেশির ভাগ সদস্য নেয়া হয়েছে ধনকুবের ব্যবসায়ী কিংবা সাবেক সামরিক আমলাদের মধ্য থেকে। তাদের শুধু অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতাই নয়, নীতিনৈতিকতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন।
ওয়াশিংটন পোস্ট ৯ জন মন্ত্রীর আমলনামা তুলে ধরে ইঙ্গিত দিয়েছে, ক্ষমতা পেয়ে তারা দেশের কী পরিণতি ঘটাবেন। যেমন, জ্বালানিমন্ত্রী রিক প্যারি : এক সময়ে তিনি জ্বালানি দফতর তুলে দিতে বলেছিলেন। আর এখন সে দফতরের শীর্ষস্থানে তিনিই অধিষ্ঠিত। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিজ্ঞানী জ্বালানিমন্ত্রী হয়ে থাকেন। ওবামা প্রশাসনেও এটা দেখা গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী টম প্রাইস : তার নৈতিকতা নিয়ে সন্দেহের কারণ, গত বছর চিকিৎসাসরঞ্জাম প্রস্তুতকারী একটি কোম্পানির শেয়ার কিনে পরে সে কোম্পানির অনুকূল আইনের প্রস্তাব করেন কংগ্রেসে। সম্প্রতি বিদেশী একটি ওষুধ কোম্পানির সাথে তিনি চুক্তি করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী বেটসি ডেভোস : ট্রাম্পের অভিষেক নিয়ে তার ভুল ভাষায় লেখা বক্তব্য সারা বিশ্বে হাসির খোরাক হয়েছে। বিত্তবান এই মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চেষ্টা করেছেন সরকারের এই শিক্ষামন্ত্রী। শ্রমমন্ত্রী অ্যান্ড্রু পুজডার : শ্রমিক অধিকারবিরোধী এই ব্যক্তি এখন শ্রমমন্ত্রী! ফাস্টফুড কোম্পানির মালিক পুজডার শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিও বাড়ানোর বিরুদ্ধে। তার কোম্পানি নাকি কর্মচারীদের ঠকায়। গৃহায়নমন্ত্রী বেন কার্সন : গৃহায়ন, তথা আবাসনের ঝানু ব্যবসায়ী ট্রাম্প এ দায়িত্ব দিলেন এমন লোককে, যিনি এ ব্যাপারে নেহায়েত অজ্ঞ। বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস : এই কোটিপতি ব্যবসায়ী তার বেশ ক’জন গৃহকর্মীর নিয়োগ ও কাজ করার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানেন না বলে খবর বেরিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রায়ান জিঙ্কে : কর্মজীবনে আর্থিক অনিয়ম করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। অথচ অনিয়ম ও অসততাসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনের দায়িত্ব তার মন্ত্রণালয়ের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন : তিনি কোনো ডিপ্লোম্যাট কিংবা ব্যুরোক্র্যাট ছিলেন না। তেলের ব্যবসায়ী হিসেবে তেলওয়ালা কয়েকটি দেশে সফরই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বিদ্যমান। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস : এই সাবেক জেনারেল যুদ্ধবাজ সন্ন্যাসীরূপে দুর্নামের অধিকারী। আরো বড় পরিচয় হলো, তিনি শুধু ‘ম্যাড’ বা পাগল নন, ম্যাড ডগ (পাগলা কুত্তা) খেতাবও অর্জন করেছেন।
এখানে নবরত্নের কাণ্ডকীর্তি ও যোগ্যতা তুলে ধরা হলো। A man is known by the company he keeps (সঙ্গী-সাথী কেমন, তা দিয়ে কাউকে চেনা যায়) ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যারা মন্ত্রণা জোগানোর দায়িত্ব পেয়েছেন, সেই মন্ত্রীরা কেমন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী স্টিভ মুচিন এবং পরিবেশমন্ত্রী স্কট প্রুইটও কম ‘খ্যাতিমান’ নন। অর্থনীতির কোনো অভিজ্ঞতা না থাকাই ট্রাম্পের অর্থমন্ত্রীর ‘বিশেষ যোগ্যতা’। তিনিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেলেন। পরিবেশমন্ত্রী প্রুইট সরকারের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার বিরুদ্ধে কয়েক দফা মামলা করেছিলেন। এখন তিনিই সংস্থাটির কর্ণধার!
মন্ত্রীদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যেমনই হোক, তাদের নিয়োগকর্তা হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তারা ‘ইতিহাসের সর্বোত্তম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।’ দেখা যাক, এসব ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ আমেরিকার জন্য কেমন ইতিহাস গড়েন। সে ইতিহাস বিশ্বের জন্য বিয়োগান্ত না হলেই মানবজাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।
সেই নস্ট্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী
নস্ট্রাদামুসের নাম অনেকেই শুনেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর ফ্রান্সে তিনি ছিলেন যুগপৎ ডাক্তার ও জ্যোতিষী। তবে তার চিকিৎসক পরিচয় ঢাকা পড়েছে ভবিষ্যদ্বক্তার পরিচিতির আড়ালে। তিনি ১৫৫৫ সালে কবিতার আকারে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কথা বলে গেছেন। দাবি করা হয়, পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়েছে তার অনেক ভবিষ্যদ্বাণী।
এবার মিডিয়ায় আবার নস্ট্রাদামুস আলোচনায় এসেছেন। তিনি নাকি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তার কিছু কথাকে ট্রাম্পের জয়ের পূর্বাভাস হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এতে ট্রাম্পের আমলে মার্কিন শাসনব্যবস্থা ভেঙে যাবে, এই সুপারপাওয়ার তার পাওয়ার হারাবে এবং ট্রাম্পের হাত ধরে আরেক মহাযুদ্ধের সূচনা হবে বলে আশঙ্কা জেগেছে। নস্ট্রাদামুসের সংশ্লিষ্ট উক্তি হচ্ছে : “খুব নির্লজ্জ, অহঙ্কারী এক বক্তা ক্ষমতাসীন হবে। সে বিতর্কের জন্ম দেবে। ‘সেতু’ যাবে ভেঙে আর আতঙ্ক সবাইকে গ্রাস করে নেবে।”
‘আমেরিকায় হতে পারে গৃহযুদ্ধ’- এই শিরোনামে ২০১৭ সালের সম্ভাব্য একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে পত্রিকায়। এতে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে ট্রাম্পের বিজয়ের একটা বড় ভূমিকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘পিউ রিসার্চ’-এর বরাতে বলা হয়েছে, এমনিতেই দেশটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট। টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সে দেশে একটি গ্রুপ সশস্ত্র বিদ্রোহে অবতীর্ণ হতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ করা হয়, আমেরিকানদের স্বদেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস লোপ পেয়েছে। মার্কিন রাজনীতিতে চলছে মেরুকরণ। রাজনীতিকদের মাঝে বাড়ছে বিভেদ। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী, উভয়েই নিজ নিজ অনুসারীদের দিন দিন করে তুলছে হিংস্র। এ দিকে, অনেকের মনে দৃঢ়মূল ধারণা তৈরি হয়েছে, এবার নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ ছাড়াও আমেরিকার সাধারণ মানুষও নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মেনে নিতে পারছে না। কারণ, তাদের মতে, এই প্রেসিডেন্ট বৈধ নন। এসব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি ঘোলাটে। এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলন দানা বাঁধলে তা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।’
এ ছাড়া বর্তমানে আমেরিকা অস্থিতিশীল ও ‘বিভক্ত রাষ্ট্র’ বলেও মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, এত দিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্যের স্বার্থে কলকাঠি নেড়ে বিশ্বের কোনো কোনো দেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছে। আবার কোনো দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রপাগান্ডা, বিজয় ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যদি ‘বিভক্ত রাষ্ট্র’ হয়ে যায়, সেটাকে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ছাড়া কী-ই বা বলা যেতে পারে?
আমাদের যা শেখার আছে
আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে গণ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি দিক দিয়ে। তেমনি দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও বড়। অনেক সমালোচনাই করা যায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের। তবে তার কাছ থেকে এখনো বাংলাদেশের মতো বহু দেশের শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে সোয়া ২০০ বছরের নিরন্তর চর্চায়। আর আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ওপর বারবার আঘাত আসায় এর ধারাবাহিকতা ছিল না এবং এ দেশে গণতন্ত্র আজো বাস্তবে দৃঢ়মূল হতে পারেনি। বিশেষ করে, গণতন্ত্রের ভিত্তিতুল্য সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পর্যন্ত আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। ক. নির্ধারিত সময়ে এবং সুনির্দিষ্ট নিয়মে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট (কংগ্রেস) নির্বাচন হয়ে থাকে। খ. নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের ওপর জনগণের এই আস্থা থাকে যে, তারা অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম। গ. পরাজিত প্রার্থী নির্বাচনের ফল মেনে নেন এবং বিজয়ীকে অভিনন্দন জানান। বিজয়ী প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সৌজন্য প্রকাশে বিলম্ব করেন না। ঘ. ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে যথাযথ নিয়মে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ঙ. জাতির বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এবং দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পিতৃপুরুষদের মর্যাদার ব্যাপারে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে। চ. দেশের স্বার্থকে সর্বোর্ধ্বে স্থান দিয়েই সব সরকার নীতিপ্রণয়ন এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
পাদটীকা : ভারতের মোদির বেশ পছন্দ আমেরিকার ট্রাম্প। দু’জনের মাঝে মিলও কম নয়। উভয়ই উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী। একটা বিশেষ মিল হলো, মোদি গুণবতী নারী, স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদমন্ত্রী বানিয়েছেন, যার ওপর শিক্ষাব্যবস্থা দেখাশোনার ভার। ট্রাম্প আরেক গুণবতী বেটসি ডেভোসকে শিক্ষামন্ত্রী করেছেন। তিনি কেমন সুশিক্ষিত, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো, ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে ভুল ইংরেজিতে মেসেজ লেখা। অনুষ্ঠানটি ‘স্মরণীয়’ বুঝাতে তিনি লিখেছেন Historical; অথচ লেখা উচিত ছিল- Historic. তার বার্তার আরো কয়েকটি ভুল সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রচুর অর্থের অধিকারী হলেও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী তিনি নন।
ট্রাম্প যে জাতিকে (সেই সাথে বিশ্বকে) ‘উচিত শিক্ষা’ দেবেন, হয়তো এরই নমুনা শিক্ষামন্ত্রীর জ্ঞানের বহর।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন