বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ও সর্বাধিক বাকপটু প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ানদের একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি গত ৫ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেছেন। তার মৃত্যুতে পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে রাজনীতিকমহল শোক প্রকাশ করেছে। দেশে ইদানীং সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এর সম্ভাব্য পারফরম্যান্স নিয়ে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘এবার নির্বাচন কমিশনে বিএনপির দেয়া নামগুলো থেকে একজনকে নেয়া যেতে পারে।’ কাকতালীয় হোক আর যা-ই হোক, সুরঞ্জিতের অনেক ইচ্ছা বা আশা পূরণ না হলেও ইসি বা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে তা পূরণ হয়েছে। ইতোমধ্যে সবাই জেনেছেন, নবগঠিত ইসিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজনকে কমিশনার হিসেবে নেয়া হয়েছে। তিনি হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, রম্যলেখক ও সাহিত্যিক হিসেবেই যার পরিচিতি বেশি।
সার্চ কমিটি এত সার্চ করার পর শেষ পর্যন্ত জাতি যে নির্বাচন কমিশন পেল, এর সিইসি ও কমিশনারদের কেউই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সুপরিচিত নন। তাদের মধ্যে মাহবুব তালুকদারের নাম অনেকের জানা। তবে তারা তাকে চেনেন সাহিত্যিক ও রম্য কলামিস্ট হিসেবে। সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘মাহবুব তালুকদার ছাড়া অন্যদের চিনি না।’ এটাই নতুন ইসি সম্পর্কে দেশের মানুষের মোটামুটি ধারণা।
সিইসি নুরুল হুদার নামটা অনেকে স্মরণ করতে পারেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা হিসেবে। তবে জাঁদরেল আমলা বা সচিবের ইমেজ তার নেই। মাহবুব তালুকদার অনেক আগে থেকেই লিখছেন। যারা তাকে জানেন, তাদের কাছে তিনি মূলত সাহিত্যাঙ্গনের মানুষ। তিনি কী চাকরি করতেন, কোন পদে ছিলেন ইত্যাদি তার গুণগ্রাহীদের কাছে গৌণ। অনেক আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একদিন শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় একটি বাড়ির দেয়ালে ‘মাহবুব তালুকদার’ লেখা নামফলক দেখেছিলাম। সাহিত্যিক হিসেবে তার নাম আগে থেকেই জানতাম। ওই লেখা দেখে বুঝলাম, একসময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের আগে সেখানে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের একজন কর্মকর্তারূপে প্রশাসনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
ইসি গঠনের জন্য যত কমিটি গঠিত হোক আর দেশজুড়ে এ জন্য যত সার্চ চালানো হোক, শেষ পর্যন্ত এমন কয়েকজনের নাম চূড়ান্ত হলো, যাদের ব্যাপারে কারো ধারণা ছিল না যে, তারাই হতে যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রধান কিংবা কমিশনার। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির যে নিদারুণ সীমাবদ্ধতা, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সরকারপ্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অন্যথা হওয়ার উপায় নেই। তাই যাদের নিয়েই ইসি গঠিত হোক, তাকে আইনসিদ্ধ বলতে হয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং একজন সাবেক বিচারক তাদের কলামে এ দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ইসি গঠন নিয়ে যত সার্চ চলুক আর জল্পনাকল্পনা হোক, সংবিধানমতে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেকই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওপর যেসব লেখা তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো পড়ে জানা যায়, দৃশ্যত ক্ষমতাসীন দলের একজন তুখোড় নেতা হয়েও তিনি কয়েকটি দুঃখ নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। যেমন- ক. মন্ত্রিত্ব অব্যাহত না থাকার দুঃখ। খ. নিজের দলের শীর্ষনেত্রীর ‘একদম কাছের লোক’ না হতে পারার দুঃখ। গ. বর্তমান সংসদ সত্যিকার বিরোধী দলের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হওয়ার মতো পরিবেশ না থাকার দুঃখ। ঘ. নিজ এলাকার কোনো কোনো উন্নয়নমূলক কাজ বহু চেষ্টা করেও করতে না পারার দুঃখ, ইত্যাদি। এর সাথে ছিল ‘বস্তাভর্তি টাকা’ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযোগ, সমলোচনা ও সন্দেহের টার্গেট হওয়ার দুঃখ।
আমাদের দেশের কথামালার রাজনীতিতে বাকপটুতার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মন্দ অর্থে এটাকে একধরনের গলাবাজি বলা গেলেও গলাবাজ মানেই কিন্তু বাকপটু হয় না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সত্যিকার অর্থেই বাগ্মিতা ও বাকপটুত্বের অধিকারী ছিলেন, যা ছিল রসিকতা, বিদ্রুপ ও উপস্থিত বুদ্ধির সমাহার। ইংরেজি রিঃ আর যঁসড়ঁৎ বলতে যা বোঝায়, এর সাথে যোগ হতো লড়শব. আমাদের দেশে রাজনীতির যে বিভাজন, তাতে এক পক্ষের সুরঞ্জিত আর অন্য পক্ষের সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর বক্তব্যে এসব বৈশিষ্ট্য দেখা যেত। অতীতে এমন উপভোগ্য বক্তব্য রাখতেন আরেক প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান ড. আলীম আল রাজী। যারা পার্লামেন্টে ও জনসভার বাগ্মী, তাদের বচন ও ভাষণে রঞ্জিত, অরঞ্জিত, অতিরঞ্জিত- তিন ধরনের বাক্য ও বাণীই অন্তর্ভুক্ত থাকে।
সুরঞ্জিতের বাম রাজনীতি দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ধীরে ধীরে তিনি কিছুটা ডানে মোড় নিয়েছেন, যদিও প্রচলিত অর্থে ডানপন্থী হননি। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে মানুষটি জনতার রাজনীতিতে নিবেদিত হয়েছিলেন, সময়ের আবর্তনে এবং পরিস্থিতির বিবর্তনে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীক্ষায় নাম কুড়িয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতিতে। এ ধরনের রাজনীতিতে অনেক সময় নীতি গৌণ হয়ে যায় এবং ‘রাজত্ব’ মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই রাজনৈতিক অঙ্গনের পথপরিক্রমা সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, নীতিনিষ্ঠ কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক রথী-মহারথীর মতো বাবু সুরঞ্জিতও এ দিক দিয়ে ব্যতিক্রম নন।
দেশের মানুষ সুরঞ্জিতকে অপজিশনের বাকপটু এমপি হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের পার্লামেন্টে তিনি ‘পজিশনে’ চলে গেলেন, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের পার্লামেন্টে, অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত তার পরিচয় ও অবস্থান ছিল এটাই। অপজিশনের জ্বালাময়ী বক্তব্যে থাকে অনমনীয় সাহসের ছাপ। অপর দিকে, ‘পজিশনে’ গিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দেয়া হয়, তাতে সাহসের পরিবর্তে ব্যঙ্গবিদ্রুপসহকারে সরকারের ওকালতি প্রাধান্য পায়। সুরঞ্জিতও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। অতীতে প্রতিবাদী পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তার গড়ে ওঠা ইমেজ পরে ম্লান হয়ে ক্ষমতার শিবিরের একজন কাণ্ডারির পরিচয়টা বড় হয়ে উঠেছে।
অন্য অনেক রাজনীতিকের মতো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত। ১৯৭২ সালের গণপরিষদে সরকারের তীব্র সমালোচনা করে তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন বিরোধীদলীয় একমাত্র সদস্য হয়েও। ফলে সারা দেশে তার নামটি ছিল সুপরিচিত। পরিষদের অধিবেশন কিংবা সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বৈঠকের খবর পত্রিকায় থাকলেই সুরঞ্জিত কী বলেছেন, সে দিকে পাঠকের থাকত বিশেষ মনোযোগ। এরপর জিয়ার আমলে ’৭৯ সালের সংসদে বিরোধী দলের এমপি হিসেবে সুরঞ্জিত সাড়া জাগিয়েছিলেন। এই ধারা অব্যাহত ছিল এরশাদ আমলে ’৮৬ সালের পার্লামেন্টে এবং বেগম জিয়ার প্রথম আমলে ’৯১ সালের পার্লামেন্টেও।
সম্ভবত ১৯৯০ সালের কথা। সুরঞ্জিত তখনো আওয়ামী লীগে আসেননি। তবে দলটির ঘনিষ্ঠ, একটি বাম সংগঠনের নেতা তিনি। এ সময় একদিন টিভির এক অনুষ্ঠানে তিনি কোনো এক প্রসঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু প্রশংসা করেছিলেন। যেন মৌচাকে ঢিল পড়ল। সে রাতেই তার জিগাতলার বাসায় কিছু তরুণ হামলা চালায়।
নব্বইয়ের দশকে একটি পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তন প্রসঙ্গে। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রতিস্থাপন করে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস’কে দেশের সেকুলার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহল সাম্প্রদায়িকতা মনে করে থাকে। সুরঞ্জিতও এই মহলের অন্তর্ভুক্ত। তবে ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সরাসরি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটা পুনঃস্থাপন না করে ‘সকল ধর্মের সমানাধিকার’ গোছের কথাও সংবিধানে থাকতে পারে। অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশে সংবিধানে ১৯৭২-এর মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আবার সংযোজিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সেই প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে শুধু সর্বকনিষ্ঠ নন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরের একমাত্র সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত। তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন সেই সংবিধানে স্বাক্ষর না করে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সাথে দ্বিমত থাকায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তৃতা সাধারণত ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও রসিকতায় ভরা থাকত। অর্থাৎ বলা যায়, সুরঞ্জিতের কথাগুলো রসে রঞ্জিত হতো। অনেক সময় অতিরঞ্জিত হয়ে যেত, যা হতো প্রতিপক্ষের তীব্র ক্ষোভের কারণ। তার এসব কথায় মিলত সমর্থকদের তালি এবং বিরোধীদের গালি। তবে তিনি স্বভাবজাত এই বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করেননি শেষাবধি।
সুরঞ্জিত নানা বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন। জীবদ্দশায় কখনো কখনো মন্দ বিশেষণ পেলেও মৃত্যুর পর যেভাবে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে, তা অনেকাংশে অতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তার এপিএস ধরা পড়েছিল বস্তাভর্তি কালো টাকাসহ। তখন পত্রপত্রিকায় সন্দেহের আঙুল উঠেছিল সুরঞ্জিতের দিকেও। তিনি অবশ্য বরাবর এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ওই কেলেঙ্কারির পর মিডিয়া ‘কালোবিড়াল’ বলে তাকে বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। সে ঘটনায় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তাকে যখন দফতরবিহীন মন্ত্রী বানানো হলো, এবার তাকে বলা হলো ‘উজিরে খামাখা’ (অপ্রয়োজনীয় মন্ত্রী)। তবে মৃত্যুর পর সেই মিডিয়ায় উল্টো চিত্র দেখা গেছে। কোনো কলামিস্ট বললেন, তিনি ছিলেন সংসদের কবি; কেউবা বললেন, তিনি ছিলেন জাতীয় নেতা। আরেকজন তো বলেছেন, সুরঞ্জিত ভাটির শার্দুল। কিছু দিন আগে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদকে একই অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ভাটি বা হাওর অঞ্চলে শার্দুল (বাঘ) একাধিক।
প্রখ্যাত সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন ’৭০ সালের নির্বাচনে সুরঞ্জিতের বিজয় প্রসঙ্গে, তিনি ছিলেন বিরোধী দলের সবেধন নীলমণি সদস্য। মুজিব আমলের জাতীয় সংসদে সুরঞ্জিতের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে সংসদে তার প্রাঞ্জল ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা সবাইকে মুগ্ধ করে। শেষমেশ সংবিধান প্রণীত হলো; কিন্তু অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক না করায় তিনি সংবিধানের মূল দলিলে স্বাক্ষর করেননি।’ সুরঞ্জিতের মতোই বৃহত্তর সিলেটের সন্তান হাসান শাহরিয়ার বলেছেন, ‘তার স্বপ্ন ছিল- আগামী নির্বাচনের আগেই তিনি দিরাই-শাল্লা আঞ্চলিক সড়কটি উদ্বোধন করবেন। বছরের পর বছর এ রাস্তাটি নির্মাণে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও আমলাদের নাস্তানাবুদ রেখেছিলেন। শেষ অবধি ফল ছিল শূন্য।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন ‘অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী’, বলেছেন হাসান শাহরিয়ার। কিন্তু তার মন্ত্রী হওয়ার অভিলাষ পুরো হয়েও টেকসই হলো না। তিনি ক্ষোভের সাথে প্রশ্ন রাখতেন, ‘আমাকে আবার মন্ত্রী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?’ উল্লেখ্য, তার চেয়ে জুনিয়র এমপিরাও মন্ত্রী হয়েছেন এ আমলে।
হাসান শাহরিয়ার দৈনিক সমকালে গত বৃহস্পতিবার আরো লিখেছেন, সুরঞ্জিত অনুযোগের সঙ্গে বলতেন, আশা করেছিলাম হবিগঞ্জের আজমীরিগঞ্জ উপনির্বাচনে জয়লাভ করার পর মন্ত্রী হবো। কিন্তু সে আশায় ছিল গুড়ে বালি।’... তিনি ঠাট্টা করে বললেন, নেত্রীকে বলো না আমাকে মন্ত্রী করতে। আমি অধম তো, নেত্রীর কাছের লোক নই। দেখা করতে চাইলেই শুরু হবে গবেষণা- কেন দেখা করতে চাই, কী উদ্দেশ্য চাকরি, তদবির না ব্যবসার দালালি? এ পরিস্থিতিতে নেত্রীকে কি এ কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল?’
হাসান শাহরিয়ার এ প্রসঙ্গে আরো লিখেছেন, ঠিক এমনিভাবে আবদুস সামাদ আজাদ জাতীয় সংসদের লবিতে বলেছিলেন, ‘নেত্রীকে বলো না আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিতে, আল্লাহবিল্লাহ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো।’ কিন্তু এর আগেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নাম পাকা হয়ে গেছে। সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুখের কথা আমি বুকেই চেপে রেখেছি।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাত্রজীবন থেকে দীর্ঘ দিন মস্কোপন্থী বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। একই মহলের অন্য একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। স্বাধীনতার পরপরই গঠিত গণপরিষদে সুরঞ্জিতের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘গণপরিষদে চার শতাধিক সদস্য আওয়ামী লীগের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংসদ উপনেতা। মুক্তিযুদ্ধের বীরনায়কেরা রয়েছেন সেখানে। সেখানে তরুণ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার বাগ্মিতা আর যুক্তি দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। দীর্ঘ সময় ধরে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন সদস্য তার বক্তব্য প্রদানের সময় বারবার বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু স্পিকার তাকে বারবার সময় বাড়িয়ে দেন। তার বক্তব্যে বাধা না দিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনুরোধ জানান।’
এখানে বলা হয়েছে, স্পিকার সুরঞ্জিতের বক্তব্য দেয়ার সময় বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অপর দিকে, কাদের সিদ্দিকীর লেখা থেকে জানা যায়, তখন বহুবার চেষ্টা করেও সুরঞ্জিত স্পিকারের নজর কাড়তে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ’৭৩ সালের কথা। তেজগাঁও ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে পার্লামেন্টে গেছি। দর্শক গ্যালারিতে বসেছিলাম। মনে হয়, ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টায় ২০-২৫ বার শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় যা হয় তা-ই হচ্ছিল। কিভাবে যেন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়ে। তিনি উঠে মাননীয় স্পিকারকে অনুরোধ করেন, ‘একজন বিরোধী সদস্য বারবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। আপনি মেহেরবানি করে তাকে ফ্লোর দিন।’ মাননীয় স্পিকার তাকে ফ্লোর দিলে প্রায় ৩০ মিনিট পিনপতন বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমি আজ যতবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, ব্যর্থ হয়ে আমি যে বেদনা অনুভব করেছি, বেদনাকাতর আমার মলিন মুখ যেমন দেখা গেছে, আজ সংসদের নেতার আসনে যিনি বসে আছেন, তিনি যদি আমার এই আসনে বসে বারবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হতেন এবং আমি ওই নেতার আসনে বসে তার মলিন মুখ দেখতে পেতাম, তাহলে আমার মনে কী ভাবের উদয় হতো, তাই ভাবছি। ... সংসদে আমি একা বলে আমাকে সময় দেবেন না, আমাকে শুনবেন না- এ তো অভিভাবকত্ব হতে পারে না।’ সেদিন শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বঙ্গবন্ধু সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সংসদ মুগ্ধ হয়েছিল।’
কাদের সিদ্দিকীর এই লেখায় বাংলাদেশ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে পার্লামেন্ট পরিচালনার ধরন কেমন ছিল, তার একটা দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। বিরোধী দলের একমাত্র সদস্য বক্তব্য রাখার জন্য পরপর ২০-২৫ বার স্পিকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েও ব্যর্থ হন এবং অবশেষে একচ্ছত্র প্রভাবশালী সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীকে এজন্য হস্তক্ষেপ করতে হয়Ñ এটা অবিশ্বাস্য হলেও তখনকার অবস্থা এমনই ছিল।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ কেন্দ্রীয় নির্বাচন। সেই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচনও হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সুনামগঞ্জের একটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও প্রবীণ রাজনীতিক অক্ষয় কুমার দাসকে হারিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জিতেছিলেন। অক্ষয় বাবু সেই ব্রিটিশ আমলেই তৎকালীন আসামের একজন মন্ত্রী ছিলেন। নৌকার অভাবনীয় জোয়ারের মাঝে কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়ে সুরঞ্জিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, ’৭০-এর সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় একচেটিয়া বিজয় সত্ত্বেও প্রাদেশিক নির্বাচনে বগুড়ার একটি আসনে জয়লাভ করেন জামায়াতে ইসলামীর প্রবীণ নেতা মাওলানা আবদুর রহমান ফকির (দাঁড়িপাল্লা)। চট্টগ্রামের একটি আসনে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রার্থী হিসেবে একজন আলেম কিতাব মার্কা নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। ময়মনসিংহে জাতীয় পরিষদ (সংসদ)-এর একটি আসনে বহুলালোচিত রাজনীতিবিদ নূরুল আমিন এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তার পিডিপি দলের দু’জন প্রার্থী আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়েছিলেন সে নির্বাচনে। তবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানপন্থী হিসেবে জামায়াত, নেজাম, পিডিপি, মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ করে দেয় এবং এসব দলের নেতারা স্বাধীনতার পরপরই গ্রেফতার হন কিংবা আত্মগোপন বা দেশত্যাগ করেন। ফলে ১৯৭২ সালে বামপন্থী সুরঞ্জিত ছাড়া বিরোধী দলের আর কোনো সদস্য ছিলেন না নবগঠিত গণপরিষদে।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন এবং আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। তিনি যুগান্তর পত্রিকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণে বলেছেন এক মাস আগের একটি ঘটনা। তখন তিনি সুরঞ্জিতের সংসদ ভবনস্থ অফিসে যান দেখা করতে। সুরঞ্জিত বাবুকে বললেন, ‘দাদা, সরকারি একটি সেক্টর করপোরেশনের দায়িত্ব পেতে চাই। দু’বার এমপির জন্য এবং একবার জেলা পরিষদের জন্য মনোনয়ন চেয়ে পাইনি।’ জবাবে সুরঞ্জিত বাবু বললেন, নেত্রীর একদম কাছের লোক ছাড়া এ কাজটি কেউ করে দিতে পারবেন না।’
এখানে লক্ষ করার বিষয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো প্রবীণ রাজনীতিক এবং সাতবার নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য, যিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির প্রধান, তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছের লোক মনে করতেন না। অন্তত সাম্প্রতিক কালে তার এমন উপলব্ধি থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি বস্তাভর্তি টাকার অঘটনের পর থেকেই তাদের মধ্যকার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল?
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন