সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে সদর রাস্তায় পত্রিকার হকার থেকে সেদিনের একটি পত্রিকা কিনতে গেলাম। ফুটপাথে তার পসরা দেখে মনে হলো- এটা পত্রিকা নয়, ফুলের দোকান। রকমারি ফুলের আড়ালে দোকানির চেহারা ঢাকা পড়ছিল। দিনটি ‘ভালোবাসা দিবস’। তাই লাভের লোভে ফুলের এত সমারোহ। সম্ভবত গত বছর দেখেছি, পাড়ার ফুচকা বিক্রেতাও এ দিনটিতে ফুল সাজিয়ে বসেছে পথের ধারে। বলছি ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা। সারা বছরের মধ্যে এই দিনেই পুষ্পবণিকেরা সবচেয়ে বেশি মুনাফা করে থাকেন। দেশে কোটি কোটি টাকার বিকিকিনি চলে নানা বর্ণ ও গন্ধের ফুলের। জাতি হিসেবে আমরা ধনে না হলেও মনের দিক দিয়ে ধনী- এমন ধারণা হতে পারে রাজধানী থেকে মফস্বল পর্যন্ত অজস্র ফুলের সম্ভারে ভালোবাসা দিবস উদযাপন দেখে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজে ভালোবাসার বিস্তার নয়, বিকৃতি ঘটছে। কারণ, আসলে আমরা ফুলের সুবাস ও সৌন্দর্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। তাই ফুলের কলির চেয়ে কীট ও কাঁটাই আমাদের জীবনে নানাভাবে বড় হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভালোবাসা দিবস’ জাতির জন্য কোনো গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করার বদলে এক ধরনের ফ্যাশন, উন্মাদনা ও আনুষ্ঠানিকতাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসার নামে সমাজে অপরিণত বয়সীদের দৃষ্টিকটু ও আবেগসর্বস্ব অতি ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম পর্যবসিত হচ্ছে পরকীয়ায়। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বিশেষ দিনে বিশেষ ধরনের পোশাক আর বর্ণিল পুষ্পের পণ্যবাণিজ্য যেমন রমরমা, তেমনি সারা বছর প্রেমের নামে প্রতারণা, পরকীয়া, নির্যাতন, এমনকি প্রাণে নিধনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। ‘ভালোবাসা’ তার প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে নিছক অগভীর অনুভূতি, বেপরোয়া অশোভনতা ও আদিম জৈবিকতায় রূপ নিয়েছে।
প্রেমের নামে প্রতারণা যতই ঘটুক, পরকীয়ার সংক্রমণ যতই হোক, স্বীকার করতে হবে- অসংখ্য তরুণ-তরুণী শুধু নয়, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী-পুরুষ পর্যন্ত অজস্র মানুষ ভালোবাসার দুর্মর উন্মাদনায় অস্থির। প্রেমের টানে তারা সময়ের একটা বড় অংশ এবং বিপুল অর্থ, মেধা ও শক্তি ব্যয় করছে। প্রেমের টানে ঘর ছাড়ছে, অন্যকে খুন করছে, নিজেকে হত্যা করছে, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও হুঁশ নেই। কারণ যেকোনো ব্যাপারে সীমা ছাড়িয়ে আগ্রহ থেকে আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছলে এবং উৎসাহ উন্মাদনার রূপ পেলে, তখন ক্ষান্ত হওয়া কঠিন বা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। Love (লাভ) করতে গিয়ে আসলে কার কতটা লাভ হচ্ছে, তা হিসাব করা জরুরি। প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে গেলে ‘লোকসান’ দিতে হবে- সেটা মনে করিয়ে দিতেই Love-এর একটা অর্থ করা হয়েছে, Loss Of Valuable Energy.
‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ বৃহত্তর সিলেটের লোকশিল্পী ও গীতিকার শাহ আবদুল করিমের এই গানের সেই বসন্ত বাতাস পয়লা ফাল্গুন মনকে উতলা করার পরদিনই ভালোবাসা দিবসে প্রেমের উন্মাদনা অনেক বেড়ে যায়। দিবসটা পালন করা অত্যাধুনিক ফ্যাশন মনে হলেও এর গোড়ায় আছে প্রাচীনকালের কুসংস্কার ও কুপ্রথা। এরপর ধর্মের প্রভাবেই এটাকে শোভন রূপ দেয়ার প্রয়াস চলেছিল। ভালোবাসা দিবসের উৎস ও ইতিবৃত্তের বয়ান দিতে গিয়ে ধর্মভীরু ও ধর্মহীন, উভয় মহলের লেখক-গবেষকই এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন। পুরনো যুগের এই অন্ধ কুসংস্কারকে আধুনিক তরুণ-তরুণীরা গুরুত্ব দিচ্ছে অজ্ঞতার দরুন। আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়ার দাবিদার মানুষেরা জানেন না, ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসের সাথে জড়িত এক দিকে ধর্মের নামে শাসকের নিষ্ঠুরতা; অন্য দিকে নিপীড়িত ধর্মগুরুর আত্মত্যাগ।
ভালোবাসাকে ভাসা ভাসা অর্থে, সঙ্কীর্ণ কিংবা খণ্ডিত অর্থে গ্রহণ করার মানে হলো, এটা ফ্যাশন বা ফালতু কাজ এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণা কিংবা অসৎ কামনা পূরণের অভিসন্ধি। ‘মানুষ মানুষের জন্য; / জীবন জীবনের জন্য; / ও বন্ধু, মানুষ একটু ভালোবাসা কি পেতে পারে না?’ প্রখ্যাত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার এই গানে যে মহান মানবতার কথা বলা হয়েছে, অতটা বৃহত্তর ভালোবাসা না হোক, অন্তত নিজ পরিবার, পরিজন ও পরিসরে প্রকৃত ভালোবাসা বা প্রীতির প্রসার ঘটানো যায় সহজেই। আর এটা আমাদের সবার কর্তব্যও।
বাংলাদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’-এর প্রবর্তক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মিডিয়াব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান। বর্তমান সরকারের রোষানলে পড়ে কয়েক মাস কারাভোগ করে বেরিয়ে এসেছেন সম্প্রতি। রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে যারা তার অন্য কোনো বক্তব্য বা মতামত গ্রহণ করতে চান না, তারাও তার প্রবর্তিত ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনে উন্মুখ। শফিক রেহমান এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ভালোবাসা মানে কেবল তরুণ-তরুণী বা প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির ভালোবাসা নয়। এটা নয় শুধু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিদ্যমান প্রেম। এই ভালোবাসাকে বৃহত্তর অর্থে নিয়ে মা-বাবা, ভাইবোন, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বন্ধু-স্বজনের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত করতে হবে।
কিন্তু কার্যত প্রেম-ভালোবাসা এবং ভালোবাসা দিবসের নামে কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই দেখছি। কেউ এই দিবসের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নেয় না; তেমনি ভালোবাসা যে স্রেফ প্রণয় নয়, তা অনুধাবনের ইচ্ছাটুকুও অনেকের নেই। বরং অনেকেই মনে করছে, ‘ভালোবাসা’ মানে নেহায়েত একটি নবীন যুগলের প্রণয়, যেখানে দৈহিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আর সেটার ধর্মীয় বা নৈতিক বৈধতা না থাকুক, তা ‘নিরাপদ’ হলেই হলো। এটা এইডস রোধে ‘নিরাপদ’ সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ বিতরণের মতো। ‘ভালোবাসা’কে অতীব সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা মূলত মনের সঙ্কীর্ণতাই তুলে ধরে। পরিবার ও সমাজের বাস্তবতা উপলব্ধি করলে প্রেমিক-প্রেমিকারাও এ কথা স্বীকার করে নেবে। ভালোবাসা বা প্রেম মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটা নিখাদ হলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জীবনে বিপদ, বিশৃঙ্খলা, অনাচার বা অনিয়ম ডেকে আনতে পারে না। তাই জোর দিয়ে বলতে হয়, প্রেমের নামে প্রতারণা কিংবা পরকীয়া, নগ্নতা বা নোংরামিকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। পারিবারিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সুস্থিতির স্বার্থে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
প্রচলিত ভালোবাসার উন্মাদনায় নিমজ্জিত হওয়ার আগে কিছু বাণী ও বচনের দিকে খেয়াল করা প্রয়োজন। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি আলফ্রেড টেনিসন বলেছিলেন, ‘ভালোবাসার জন্য স্বার্থত্যাগ করা হয়। তখন আর ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকে না।’ রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস- দুটোই যেন অচল। একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথমেই আছে ‘ভালবাসি ভালবাসি’। সেই রবিঠাকুর অনেকের কাছে প্রেমের ঠাকুর। তিনি পর্যন্ত বলেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ; কিন্তু বেদনা থাকে সারা জীবন।’ এ জন্যই একটি জনপ্রিয় গানের কলি হচ্ছে, ‘প্রেমের অপর নাম বেদনা/ সে কথা তুমি কি বোঝ না?’ প্রসঙ্গক্রমে একাধিক উক্তি প্রণিধানযোগ্য। যেমন প্রেম হলো স্বার্থসিদ্ধির চরম অভিব্যক্তি; প্রেমে পড়লে বোকা হয়ে ওঠে বুদ্ধিমান, কিন্তু বুদ্ধিমান হয়ে যায় বোকা ইত্যাদি।
ভালোবাসা, না ভালো ব্যবসায়?
ফুল ছাড়া প্রেম-ভালোবাসা, বিশেষ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এই দিবসে ফুল অত্যন্ত লাভজনক পণ্য হয়ে উঠলেও ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাসের নিগূঢ় অর্থ আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না। প্রেমের নামে ভালোবাসার ধুয়ায় লাখো কোটি ফুল বিক্রি ও বিনিময় হচ্ছে। হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। কিন্তু আমাদের ক’জনের মনে ফুলের পবিত্র সৌন্দর্য ও নির্মল সুবাস প্রভাব ফেলতে পারছে? ফুল নিষ্কলঙ্ক; অথচ ফুল দিয়ে যে প্রেম করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই কলঙ্কে পরিণত হচ্ছে। এর নির্মল সুগন্ধ মনকে প্রফুল্ল করে। কিন্তু ক’জন সে সুবাস নিয়ে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে?
বিশ্বায়নের সুবাদে ‘বিপুলা এ পৃথ্বি’ হয়ে গেছে global village বা বিশ্বগ্রাম। সেই সুবাদে কোনো কোনো পরাশক্তি গাঁয়ের মোড়ল হতে চায় গায়ের জোরে। একই সময়ে, মুক্তবাণিজ্য ভালো-মন্দ সব কিছুর পণ্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পাশ্চাত্য আরো অনেক দিবসের সাথে ‘ভালোবাসা দিবস’ আমাদের দেশে রফতানি করার জের ধরে ফুলের সৌন্দর্যের চেয়ে পণ্যমূল্য এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তের সূচনাকারী পয়লা ফাল্গুন আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস। ফলে যুগলবন্দী দিন দু’টি প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলদের আনন্দ ও উৎসব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পুষ্পনির্ভর এমন দু’টি দিবস পরপর থাকা ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য হয়েছে সোনায় সোহাগা। তবে প্রশ্ন হলো, সে অনুপাতে গাঁয়ের ফুলচাষিরা লাভবান হচ্ছেন কতটা? এ দিকে অবস্থা এমন যে, পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস হয়ে উঠেছে ‘পুষ্প দিবস’-এর সমার্থক।
চার দিকে হরেক আকার প্রকার, বর্ণ ও গন্ধের ফুলের ছড়াছড়ি দেখে কেউ কেউ টিপ্পনি কেটেছেন- ‘ভালোবাসা দিবস একটা ভালো বাসার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও ফুলের বাজারে ভালো ব্যবসার গ্যারান্টি দিচ্ছে।’ এ উপলক্ষে প্রিয়জনের আদরের চেয়ে ফুলের কদর কম নয়। দিবসের তোড়জোড়ে মানুষে মানুষে, পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা না বাড়লেও ফুলের ব্যবসা দিন দিন ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
‘বাঙালির পুষ্পপ্রীতি ও পুষ্পবাণিজ্য’ শীর্ষক এক নিবন্ধে জানানো হয়েছে, এখন দেশে ফুলের মধ্যে রজনীগন্ধার বিশেষ জনপ্রিয়তা। এর মূলে আছেন এ দেশের স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত সেই প্রেমিক জেনারেল। লেখক আরো বলেছেন, বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ মানুষ ফুল ব্যবসায় জড়িত। ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে বাড়ছে ফুলের উৎপাদন- সম্প্রসারিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ফুল চাষের এলাকা। যশোরের গদখালীতে ৩৩ বছর আগে যে ফুল চাষ শুরু হয়েছিল, তা আজ যশোর ডিঙিয়ে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ ২৪ জেলার ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু গোলাপ, গাঁদা বা রজনীগন্ধা নয়; গ্লাডিওলাস, করোনেশন, কসমস, অর্কিডসমেত বিভিন্ন প্রকার বিদেশী ফুলের চাষ হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
জানা গেছে, ২০১৩-১৪ সালে দেশে ফুলের উৎপাদন হয়েছিল ৫০ হাজার টন, যার দাম ৭০০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে ফুল উৎপন্ন বেড়ে হয়েছে ৬০ হাজার টন। এর অর্থমূল্য ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশের ফুল যাচ্ছে বিদেশে। যেমন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গোলাপ রফতানি হয়েছে সুদূর সুইডেনে।
আমাদের দেশে ফুল চাষের পাইওনিয়ার বা পথপ্রদর্শক বলা যায় যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীকে। আশির দশকে এখানকার গ্রামেই সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ শুরু হয়। গদখালীর ফুল রাজধানীর বাজারে বিরাট অংশজুড়ে থাকে। সেখানে রকমারি পুষ্পপণ্যের প্রসার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বোঝা যায় একটি খবর থেকে। বসন্তের প্রথম দিন আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে এবার আগেই গদখালী থেকে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়েছে ৫ কোটি টাকার ফুল। এর মধ্যে গোলাপ, গ্লাডিওলাস ও জারবেরা ফুলই বেশি। ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে ৫ হাজার গোলাপ গদখালী হাটে আনার সাথে সাথেই ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে। একজন চাষি জানান, এবার চার দিনে তিনি বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকার ফুল। তিনি ৭ বিঘা জমিতে তিন ধরনের ফুলের চাষ করেছিলেন। চলতি বছরে কেবল যশোরেই সাড়ে ৬০০ হেক্টর বা ১৬০০ একরের বেশি জমিতে ফুলের আবাদ হয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের দিবসগুলোতে গদখালীতে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
প্রীতির বন্ধন ও পিরিতির দহন
অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারিতে Love বা ভালোবাসার পরপর কয়েকটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষ করার বিষয় হলো, বিশেষ করে আধুনিক পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজে Love বলতে প্রধানত প্রণয়ের মতো রোমান্টিক সম্পর্ক, এমনকি অনেক সময়ে Sex বা যৌন সম্পর্ক বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্যের উল্লিখিত বিখ্যাত অভিধানে Love-এর যে সংজ্ঞা প্রথমেই দেয়া হয়েছে, সেটা রোমাঞ্চ নয়। এটাকে Affection বা প্রীতি হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে, Strong feeling of deep affection for somebody/something, specially a member of your family or a friend. এরপর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সন্তানের জন্য মায়ের প্রীতি ও ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমকে। ‘প্রীতি’ আর ‘পিরিতি’ একই অর্থবোধক হওয়ার কথা থাকলেও ‘প্রীতি’ বলতে আমরা নিষ্কলুষতার ছাপ পাই। অপর দিকে ‘পিরিতি’ কথাটায় কেমন যেন কেলেঙ্কারির গন্ধ। যা হোক, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুলপ্রচলিত অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে Love -এর অন্যান্য অর্থ হিসেবে রোমাঞ্চ, বিনোদন, পছন্দ করা প্রভৃতির উল্লেখ শেষে জানানো হয়েছে, ব্রিটেনে কথ্য ইংরেজিতে প্রিয়ভাজন কাউকে Love বলে সম্বোধনের রীতি রয়েছে।
কলকাতার সংসদ বাংলা অভিধানকে অতীত থেকে বিবেচনা করা হয় একটি আদর্শ বা মডেল অভিধানরূপে। এতে ‘ভালোবাসার’ বহু অর্থ তুলে ধরা হয়েছে এবং সেগুলোর মাত্র একটি হলো প্রণয়। অন্যান্য অর্থের মধ্যে রয়েছে অনুরাগ, প্রীতি, আকর্ষণ, আসক্তি, পছন্দ, স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রভৃতি।
ষাটের দশকে রেডিওতে একটা প্রেমের গান ঘন ঘন শোনা যেত, ‘আগুন জ্বালাইস না আমার গায় গো আগুন জ্বালাইস না আমার গায়, জ্বালাইলে যে জ্বলবে আগুন, নিভানো যে ভীষণ দায়।’
এখন দেশের উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে অসংখ্য ঘর পিরিতির আগুনে পুড়ছে। কিন্তু প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠছে না। কথিত ভালোবাসার উন্মত্ততা জ্বালিয়ে দিচ্ছে অসংখ্য পরিবারের সুখ-শান্তি ও মান-মর্যাদা। এই সর্বনাশা আগুন হত্যা ও আত্মহনন পর্যন্ত গড়াচ্ছে। আর পরকীয়া ও পাশবিকতার কথা তো বলাই বাহুল্য। ভালোবাসা দিবসের প্রাক্কালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। যেমন, চট্টগ্রামে মডেলকন্যা প্রেমে প্রতারিত হয়ে নিজের জীবন দিয়েছে। আর গোপালগঞ্জে কথিত প্রেমিক স্কুলছাত্রীকে বিবস্ত্র করে নিজের চরিত্রের নগ্ন স্বরূপ উন্মোচিত করে দিয়েছে। এমন অঘটন মহানগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটছে প্রতিনিয়ত। তবে সব খবর আসে না খবরের কাগজে।
মানুষের জীবন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। জাতীয় জীবনে নানা সঙ্কট। সমাজে নেই শান্তি-শৃঙ্খলা। অসংখ্য পরিবারে আর্থিক- মানসিক টানাপড়েন। নাগরিকজীবনে দুর্ভোগ ও অস্থিরতা বাড়ছে। চার দিকে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও সহিংসতার তাণ্ডব। এর মাঝে বসন্ত নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং ভালোবাসার ভড়ং বেমানান বৈকি। প্রখ্যাত ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই ‘কিসের ভ্যালেন্টাইন’ ছড়ায় লিখেছেন, ‘সারা জীবন ছ্যাঁক খেয়ে যার মেজাজ টোয়েন্টি নাইন,/ তার কাছে হায় কিসের ফাগুন, কিসের ভ্যালেন্টাইন!/ ফাগুন মাসে আগুন জ্বলে কোকিল করে রাও,/ জনমদুখী মানুষটারে ক্যামনে খোঁটা দাও!’
বলা হয়- ‘পৃথিবীতে স্বর্গীয় যে ক’টি জিনিস আছে, তার একটি হলো ফুল।’ আমাদের অনেকে এই স্বর্গীয় জিনিসটার অপব্যবহারে এমন কাণ্ড ঘটাই, যার পরিণামে নরকের অশান্তি নেমে আসতে পারে। ফুলের সুবাসে জীবন ভরে ওঠে। যখন মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিজেকে পশু বা ইতর প্রাণী থেকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করে, তখন সত্য শোভন জীবনাচার মানুষের ভূষণ হয়ে ওঠে এবং সীমালঙ্ঘন তথা অন্যায় প্রভৃতি থেকে মানুষ দূরে থাকে। এর বিপরীতে অনাচার-অনৈতিকতার প্রতি মানুষ আসক্ত এবং আবেগসর্বস্ব অশালীনতায় মত্ত হলে হাজারো ফুলের সুবাসও কার্যত দুর্গন্ধ ছড়াবে।
পুনশ্চ : ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে পত্রপত্রিকায় অনেক কার্টুন ও চুটকি ছাপা হয়েছে। তার যৎকিঞ্চিৎ- ক. আধুনিকা এক তরুণী রাস্তায় দেখতে পেল একজন ভিক্ষুককে। তার গায়ে ছেঁড়া জামা, কাঁধে তালি মারা ঝোলা। সে ভিক্ষার থালা বাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি বলল, আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়। ভিক্ষুকটি জবাবে বলল, ‘চেনা চেনা তো লাগবেই। আমি তোমার পুরনো প্রেমিক। ভালোবাসা দিবসে তোমাকে গিফট দিতে গিয়ে আজ আমার এই দশা। ‘স্মর্তব্য সেই গানটি : ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানী।’
খ. ‘প্রেম মানেই ছাগলামি’ শিরোনামে একটি পত্রিকার কার্টুনে দেখা যায়- প্রেমিকা তরুণীকে একটা ছাগল লাল গোলাপ দিতে এসেছে। ছাগলরূপী প্রেমিক বলছে, ‘প্রেমে পড়লে মানুষ নাকি পাগল হয়ে যায়। আমি হয়ে গেছি ছাগল।’
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন