এবারের একুশের ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়েছি। এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা গত কিছু দিনে অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সংস্থার বদঅভ্যাসমাফিক খোঁড়াখুঁড়ির সাথে মেট্রোরেলের মহোৎসব মিলে সড়কগুলোর কোথাও খানাখন্দ, কোথাও এবড়োখেবড়ো ও ভাঙাচোরা, কোথাও বা দীর্ঘ গভীর পরিখা। এসব কিছুর সাথে ‘ফ্রি গিফট’ হলো, অপরিমেয় ধুলা। এমন রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু একুশের প্রভাতফেরিতে দেখা গেল, নিয়মমাফিক অনেক শিশু-কিশোরই ফুল হাতে খালি পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। তবে মিছিলের বেশির ভাগের পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল। উন্নয়নের জোয়ারে রাজধানীর পথঘাটের দুর্দশা দেখে প্রভাতফেরির আয়োজকেরা নগ্নপদে থাকার জন্য হয়তো জোরাজুরি করেননি।
পাড়া ছাড়িয়ে গেলাম সদর রাস্তায়। কিছুদূর যেতেই ফুটপাথ বন্ধ। ব্যাপার কী? সেই সাত সকালেই কয়েকটি কিশোর ফুটপাথজুড়ে ফুল বিছিয়ে রেখেছে। পাশেই মিনি শহীদ মিনার; মাত্র দু-চার ফুট উঁচু। সাথে গান বাজছে। আর কয়েক পা এগোতেই শহীদ মিনারের আরেকটি ক্ষুদ্র সংস্করণ, যার উচ্চতা তিন থেকে পাঁচ ফুট। এটা আবার ‘মেকশিফট’ অর্থাৎ স্থানান্তরযোগ্য। আজকাল এ ধরনের শহীদ মিনার ভাড়ায় আনা যায় কি না, জানি না।
মহীরুহরূপী বটবৃক্ষের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ হলো বনসাই। দেশের অনেক জায়গায় এ ধরনের শহীদ মিনার রয়েছে। স্থানাভাবের কারণে এটা করে উদ্যোক্তারা ‘ক্ষুদ্রই সুন্দর’ বলে আত্মসান্ত্বনা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। এ ধরনের স্মৃতিস্তম্ভ প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭৪ সালে। ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে দুই ফুট উঁচু শহীদ মিনারের গলায় ফুলের মালা ঝোলানো ছিল। ওটা ছিল স্থায়ীভাবে বানানো।
সেই ভোরেই ফুল বেচাকেনার ধুম। কারণ শহীদ মিনারে ফুল দিতে হয়। আমাদের পাড়ায় যে লোকটা প্রতিদিন বেগুনি-পেঁয়াজ বিক্রি করে, আজ সেও চুটিয়ে ফুল বেচায় ব্যতিব্যস্ত। এক জায়গায় দেখলাম, ফুল দোকানি তরুণটা মেয়েদের মতো ফুলের রিং পরেছে মাথায়। ক্রেতা আকর্ষণের নতুন কৌশল এটা।
দেশের অজস্র শহীদ মিনারের কথা বাদ দিলেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কথা তো বলতে হয়। অনেক বছর আগে একবার একুশের দিনে সেখানকার একটি দৃশ্যের কথা মনে আছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দেয়া হয়েছিল মিনার চত্বরে। এর বাইরে হাজার হাজার মানুষ সারি বেঁধে এসেছিলেন ফুল দিতে। শহীদ মিনারের বিরাট চত্বরে জায়গা হচ্ছিল না। ফুলের তোড়া একটার ওপর আরেকটা রেখেও কুলানো যাচ্ছিল না। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্বেচ্ছাসেবীরা বিদায় নিতেই চার দিক থেকে দলে দলে টোকাইরা বুভুক্ষুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ জন্য তারা এতক্ষণ ছিল অধীর প্রতীক্ষায়। যে শহীদ মিনারকে ‘পবিত্র’ জ্ঞানে জুতা-স্যান্ডেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সেখানে শুরু হলো যথেচ্ছ দাপাদাপি, হৈ-হুল্লোড়। টোকাইদের টানাহেঁচড়ায় মিনার চত্বরে রাখা কয়েক লাখ টাকার ফুল ছিঁড়েভিড়ে লণ্ডভণ্ড! অর্থাৎ, অশিক্ষিত টোকাইরা ভাষাশহীদদের প্রতি নিজ ইচ্ছামতো ‘শ্রদ্ধা’ দেখাল। এ জাতির শিক্ষিত নামধারী টোকাইরাও খেয়ালখুশিমতো ভুল লিখে ও বলে মাতৃভাষাকে ‘সম্মানিত’ করছে।
ভাষাসৈনিকের ‘তালিকা’ নিয়ে একটি কৌতূহলোদ্দীপক খবর উঠেছে পত্রিকায়। জানা গেছে, কয়েক বছর আগে একটি গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে ছিল কিছু ভাষাসৈনিকের নাম। আসলে এভাবে আনুষ্ঠানিক তালিকা করে, ভাষা আন্দোলনে কারা অবদান রেখেছেন, তার খতিয়ান পেশ করা জরুরি নয়। বরং এতে এমন ধারণাই হতে পারে যে, এই সরকারি তালিকায় যাদের নাম নেই, তারা ভাষা আন্দোলনে অংশ নেননি। বাস্তবে শত শত নারী-পুরুষ সেই অবিস্মরণীয় সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও ছিলেন শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিল্পী প্রমুখ পেশাজীবী। তাদের অনেকের নাম এত দিন পরে সংগ্রহ করা অসম্ভব। তাই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বারবার বানানো ও বাতিলের মতো ভাষাসৈনিকদের নিয়ে যেন কোনো প্রহসন করা না হয়। তালিকা বানিয়ে কিংবা সিরিয়াল দিয়ে নয়, সবার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা উচিত।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বাধীনতার পর ঘোষণা করা হয়েছিল ‘শোক দিবস’ হিসেবে। পরে শুরুতে একবার ঘটেছিল শোকাবহ ঘটনা। সে বছর একুশের ফুলে ফুলে যখন শহীদ মিনার ভরে উঠছে, তখন কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে দলীয় কোন্দলে একজন ছাত্রনেতা গুলিতে নিহত হন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক মহল মহান একুশের শিক্ষা কতটুকু গ্রহণ করেছে, তার প্রমাণ এই মর্মান্তিক ঘটনা।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন রাজপথের সংগ্রাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৭ সালের শেষ দিকেÑ অর্থাৎ তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অল্প কিছু দিন পরই। এই আন্দোলন প্রথম দেশব্যাপী সাড়া জাগায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এরপর ’৪৯, ’৫০ ও ’৫১ সালে অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো দিবসটি পালিত হয়েছিল। এর পরই ’৫২ সালে ঘটে ভাষার দাবিতে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। তখন ভাষা আন্দোলনের ছিল চূড়ান্ত পর্যায়। তবে এর পরও আন্দোলন অব্যাহত ছিল কম-বেশি। নানা বাধা সত্ত্বেও ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন চলেছিল। পরের বছরই পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়, যাতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাও মর্যাদা পায় উর্দুর পাশাপাশি। ভাষা সংগ্রামের মূল সুরও ছিল এটাই। এই আন্দোলনকারীরা উর্দুকে বাদ দিয়ে কেবল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেননি। তাই তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী বলার যুুক্তি নেই। তারা বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি। অথচ অবিবেচক ও স্বেচ্ছাচারী কেন্দ্রীয় শানকগোষ্ঠী উর্দুকে চাপাতে চেয়েছে বাংলাভাষী জনগণের ওপর। বাঙালির ভাষা আন্দোলনে এই স্লোগানও উঠেছিল ‘উর্দু-বাংলা ভাই ভাই, উর্দুর পাশে বাংলা চাই’। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই সংসদে বক্তৃতার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকেও গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছিলেন। বাংলা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হলেও তিনি শুধু বাঙালি সদস্যদের বাংলায় ভাষণ দেয়ার সুযোগ দিতে বলেছিলেন। তবুও তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে গৃহকর্তা রাতে বাসায় ফিরে ঘরে পা রাখতেই শিশুসন্তান খুশিতে বলে উঠল, মেরা বাবা আয়ে গা। একজন চাকরিজীবীর অভিজ্ঞতা : তার শিশুকন্যা তাকে টিভির গল্প শোনাতে গিয়ে জানাল, সে শিখেছে- আপ পেহলে মেঁ ইস্তেমাল কারে, ইস্ কি বাদ বিশওয়াশ কারে (প্রথমে ব্যবহার করে দেখুন, এরপর এতে আস্থা রাখুন)। এখন ঘরে ঘরে মেধা, অভিষেক, নম্রতা, আদৃতা, ঐশ্বর্য প্রভৃতি নামের ছড়াছড়ি। এই যে উদ্ধৃতি এবং নামকরণ, এ সব কিছু গত দুই দশকে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পরিণাম। এই আগ্রাসনের হাতিয়ার যে ভাষা, তার নাম হিন্দি। বলিউডের যৌনতাপূর্ণ ও মারদাঙ্গা ফিল্ম আর কয়েকটি ইন্ডিয়ান চ্যানেলের পরকীয়া ও কূটনামি ভরা টেলিসিরিয়ালের অপপ্রভাব এভাবেই বাঙালিয়ানাকে কলুষিত করছে। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ।
বাংলাদেশে ‘হিন্দির হামলা’ নিয়ে ধর্মভীরু মানুষই শুধু নন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মহলের অনেকেই উদ্বিগ্ন। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবার লিখেছেন, ‘পাকিস্তানিরা বাংলার সঙ্গে ফার্সি ও উর্দু মেশানোর চেষ্টা করেছিল- আমরা তার প্রতিবাদ করেছি এবং বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। উর্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েই আমরা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলাম।’ এর পরই তিনি বলছেন, ‘ভাষা হিসেবে উর্দু কিন্তু হিন্দির চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। এখন হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানিরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হিন্দি তারকাদের বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া করে এনে ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভের আয়োজন করছে।’ প্রফেসর চৌধুরী আরো বলেছেন, ‘আকাশ প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ঘরের ভেতর হিন্দি ভাষা চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।’ তিনি বলেছেন, ‘বাংলা পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রাদেশিক ভাষা মাত্র। তাই বাংলা ভাষার জন্য ভরসার জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে সে ভরসা দিতে পারছে না। এর জন্য দায়ী কে?’
আরবি হরফে লেখা উর্দুকে শাসকেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বলে ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। এখন দেবনাগরী হরফে লেখা হিন্দি সুকৌশলে সংক্রমিত করার সর্বাধিক প্রয়াস সত্ত্বেও এর মোকাবেলায় কোনো আন্দোলন দেখা যায় না। একইভাবে বলা চলে, পাকিস্তান আমলে রোমান হরফে (ইংরেজি অক্ষরে) বাংলা লেখার কিছু উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। অথচ আজ নানাভাবে বাংলা ভাষা রোমান হরফে লেখার পাঁয়তারার কোনো প্রতিবাদ দৃশ্যমান নয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন, মোবাইলফোন কোম্পানিগুলো বাংলা ভাষা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে। তারাও যেন পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানতে চাইছে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের মূলে। এসএমএসের ছদ্মাবরণে সেখানে চলছে রোমান হরফে বাংলা লেখার আত্মবিনাশী এক প্রবণতা।’
এবার যারা ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন তাদের সবাই যে সমান পরিচিত, তা নয়। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশে যারা জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন পদ-পদবি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে থাকেন, তাদের একটা বড় অংশকেই বাছাই করা হয় সরকারের দলীয় ও আদর্শিক, তথা রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে অনেক সময়ে কম যোগ্য অনেকের ভাগ্যে এসব জুটলেও বেশি যোগ্য অনেকেই থেকে যান বঞ্চিত। এ ব্যাপারে এক সময় ব্যাপক সমালোচনা ও লেখালেখি হতো। আজকাল প্রায় সর্বত্র অনিয়মই অঘোষিত নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে। তাই সবাই আগে থেকেই ধরে নেন যে, ‘ক্ষমতাসীন মহল কিংবা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের আপনজনই পদ, পদবি ও পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন। অতএব, এসব ক্ষেত্রে যদি ‘অপাত্রে দান’ ঘটে, তার প্রতিবাদ করে লাভ হবে না।’
যা হোক, এ বছর একুশে পদক বিজয়ীদের মধ্যে প্রথমেই আছে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ড. শরীফা খাতুনের নাম। তিনি ভাষাসৈনিক- এ কথা জানা ছিল অনেক আগে থেকেই। এখানে কিঞ্চিৎ স্মৃতিচারণের অবকাশ আছে। প্রফেসর শরীফা খাতুন বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ফেনী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। সরকারীকরণের আগে তখন এর নাম ছিল সরলা বালিকা বিদ্যালয়। আমার তিন বোন এই স্কুলের ছাত্রী। প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে শরীফা খাতুন ছিলেন শিক্ষার্থীদের ‘বড় আপা’। আমার বোনেরাও তার ছাত্রী। ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর) বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেয়া হয়, যারা মাস্টার্স পাস এবং বিভিন্ন স্থানে স্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। তাদের স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয় পিএইচডি অর্জনের জন্য। ওই সময়ে ফেনীর দু’জন স্কুলশিক্ষক আইইআর-এ নিয়োগ লাভ করে ডক্টরেট করতে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন। একজন শরীফা খাতুন, অপরজন ফয়জুল মহী- যিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ফেনীর জিএ একাডেমির সহকারী প্রধান শিক্ষক।
‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’-এর নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত। শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওই কলেজের মাধ্যমে ইংরেজদের উদ্যোগে বাংলা সাধু ভাষা প্রচলনের ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন। তখন কিছু পণ্ডিত-পাদ্রির যোগসাজশে বাংলা ভাষা নিয়ে যে কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘জনগণের মুখের ভাষায় দেশজ ও ফারসি শব্দের বিস্তর ব্যবহার ছিল; সেগুলো পিছিয়ে গেল; সামনে এলো তৎসম শব্দ, এমনকি সংস্কৃত শব্দও।’ ‘সাধু ভাষা’ চালু হওয়ার পেছনে যে একাধিক অসাধু কারণ ছিল, তা তুলে ধরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এর প্রথম কারণ- যে মধ্যবিত্ত বাংলার চর্চা করেছে, তারা কলকাতার অধিবাসী, ইংরেজি শিক্ষিত ও ইংরেজের অনুগ্রহ প্রত্যাশী। তারা ছিল জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। তার মতে, ‘সাধু ভাষা প্রচলনের দ্বিতীয় কারণ (ইস্ট ইন্ডিয়া) কোম্পানির সাহেবদের ফারসি বিদ্বেষ। যে স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে তারা রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছিল, ফারসি ছিল তাদের ভাষা। কোম্পানি ওই শাসকদের শত্রু ভাবত। তাই তাদের ভাষার প্রতিও বিদ্বেষ জমে উঠেছিল স্বাভাবিক নিয়মেই। ইংরেজরা তাদের নিজেদের ভাষা চালু করার উদ্যোগ নিচ্ছিল। সেই উদ্যোগের উল্টো পিঠে ছিল ফারসিকে হটিয়ে দেয়ার আবশ্যকতা। ফারসির প্রতি তাদের অনীহা সংস্কৃতের প্রতি আগ্রহকে পুষ্ট করেছে।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো উল্লেখ করেছেন, ‘সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাথেই শিক্ষিত ইংরেজদের কিছুটা ওঠাবসা ছিল; ফারসি পণ্ডিতরা ছিলেন দূরে। রামমোহন রায় চমৎকার ফারসি ভাষা জানতেন। কিন্তু তার নিজের জন্য ফারসি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংস্কৃতজ্ঞান।’ রামমোহন নানা সূত্রে ইংরেজ কোম্পানির সাথে জড়িত থাকার কথাও তিনি বলেছেন (বাংলা ভাষার মধ্যবর্তিতা’, কালের কণ্ঠ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।
নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশই ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানে না। কিন্তু ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে নিছক ভাসা ভাসা ধারণা থাকলে কিছুতেই চলে না। এই মহান সংগ্রামের আদর্শ-উদ্দেশ্য, পটভূমি ও পরিণতি, ঘটনাবলি, তাৎপর্য প্রভৃতিসমেত একটা সর্বাঙ্গীণ ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ জন্য শুধু আবেগ-উচ্ছ্বাস নয়, অনুসন্ধিৎসা ও উদ্যোগ থাকা চাই। আমরা বলছি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে এ জাতি। আবার এটাও অনস্বীকার্য, নবীন প্রজন্ম বা শিশু-কিশোর ও তরুণেরাই জাতির ভবিষ্যৎ। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের জানার পরিধির নমুনা তুলে ধরা হচ্ছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিক পত্রিকার একজন কলামিস্ট উল্লেখ করেছেন একটি ঘটনা (যা প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনা)। দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সম্প্রতি রচনা প্রতিযোগিতা হয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ’ উপলক্ষে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ডিজিটাল যুগে কেমন শিক্ষা পাচ্ছে, তার নমুনা একটি উপজেলার সে ঘটনা। ‘একুশের চেতনা’ বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ও সৃজনশীল হিসেবে পরিচিত শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিযোগিতার একজন বিচারক জানিয়েছেন, এর ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ওপর মহলের চাপ’ ছিল। এই চাপে পড়ে যাকে তৃতীয় স্থান অর্জনকারীরূপে ঘোষণা করতে হলো, সে লিখেছে, ‘২১ ফেব্রুয়ারির কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল।’ আরেকজন লিখেছে, ‘২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলা ভাষাকে হত্যা করা হয়েছে। সকালবেলায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে।’ উল্লিখিত কলামিস্টের লেখা থেকে জানা যায়, এক তরুণ লিখেছে- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন- Urdu and urdu shall be the state language of Pakistan. ওই ‘সৃজনশীল’ তরুণ আরো বলেছে, ঠিক পরদিনই খাজা নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর কথা বাংলায় অনুবাদ করে বলেছিলেন।
‘ইতিহাসবিকৃতি’র বিরুদ্ধে সোচ্চার, সরকারের আমলে সর্বত্র বেলাগাম দলীয়করণের পরিণাম কী হতে পারে, এই রচনা প্রতিযোগিতার খবর থেকে তা সামান্য হলেও আঁচ করা যায়। জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে মারা যাওয়ার চার বছর পর দুনিয়াতে এলেন কোত্থেকে কিংবা তার উক্তির বাংলা অনুবাদক উর্দুভাষী নাজিমুদ্দীন হওয়ার মতো উদ্ভট তথ্যের ভিত্তি কী- এসব প্রশ্নের জবাব সচেতন নাগরিকেরা কার কাছে চাইবেন?
সে কলামে উল্লেখ করা হয়, একই প্রতিযোগিতায় আরেক গ্রুপের রচনার বিষয় ছিল- ‘শিক্ষার গুণগত মান।’ আমাদের করিৎকর্মা মন্ত্রীর আমলে ছাত্রছাত্রীরা যে শিক্ষা পাচ্ছে, হয়তো তার গুণগত মান বোঝার জন্য একজন কলেজছাত্র এ বিষয়ে রচনার খাতায় লিখে দিয়েছে, ‘শিক্ষা খুব ভালো জিনিস, গুণও একটি ভালো জিনিস।’
জাতি হিসেবে আমাদের বিপুল ঐতিহ্য এবং অপরিমেয় ত্যাগ ও সংগ্রামসহ গৌরবজনক অনেক কিছুই আছে। এর বিপরীতে আছে অতি আবেগ-উচ্ছ্বাস, গতানুগতিকতা, মানসিক সঙ্কীর্ণতা, কলহ-কোন্দল প্রভৃতির অভিযোগ। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেয়ে অনুষ্ঠানের দিকে আমাদের বেশি মনোযোগ, একটা সিস্টেম প্রতিষ্ঠার চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ, ইতিহাসের নামে অনুসন্ধিৎসার চেয়ে গৎবাঁধা ইতিবৃত্তকে বড় করে দেখা, প্রভৃতি। আমাদের দেশে নানা ধরনের দিবস পালিত হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু কখনো বা দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তে উৎসব-উল্লাস বেশি আকর্ষণ করে। কখনো কখনো দিবসের পটভূমি ও তাৎপর্যের গভীরে না গিয়ে স্বল্প ও খণ্ডিত ধারণা নিয়েই আত্মতৃপ্তি বোধ করি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা অনেক কাজ শুরু করি, শেষ করি না।’ ভাষা আন্দোলন এবং মাতৃভাষা দিবসের আদর্শ, শিক্ষা ও করণীয়ের দিকে নজর দিলে একই অবস্থা চোখে পড়ে। ভাষা সংগ্রামের গৎবাঁধা বয়ানের পাশাপাশি কিছু নির্ধারিত আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারি অতিক্রান্ত হচ্ছে। অথচ যে ভাষার জন্য এত সংগ্রাম ও ত্যাগ, সে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজো কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং সমাজের অনেক ক্ষেত্রে বাংলা হয়ে পড়ছে কোণঠাসা। ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র- কোনো পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রত্যাশিত প্রচলন ঘটেনি। বিদেশী বা বিভাষী শক্তি নয়, আমাদেরই একটা বড় অংশ বাংলা ভাষাকে বর্জ্য ও ব্রাত্য মনে করার মতো হীনম্মন্যতায় ভুগছে। যতই ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ গাওয়া হোক না কেন, জাতি হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও আইনগত দায়িত্ব আমরা অনেকটাই ভুলে গেছি।
কাজী গোলাম মাহবুব ভাষা আন্দোলনের একজন মহানায়ক। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি। ভাষা আন্দোলনের এই সংগ্রামী সৈনিকের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ধানমন্ডি লোকের পাড়ে তার বাসার ড্রয়িংরুমে বসে তিনি এই আন্দোলনের তাৎপর্য ও শিক্ষা এবং এর আলোকে আমাদের করণীয় সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। যে বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন তা হলো- যে ভাষার জন্য এত আন্দোলন ও আত্মত্যাগ, সে বাংলাকে দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। এ জন্য মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলা এবং সবার আগে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
অথচ, বায়ান্নর ৬৫ বছর পরও বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের হার গর্ব করার মতো নয়। এমনকি জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশই ন্যূনতম সাক্ষরতা পর্যন্ত লাভ করেনি। ভুলে ভরা পাঠ্যবই স্কুলশিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়ে নিয়মিত উৎসব হচ্ছে। মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকবলিত শিক্ষাঙ্গনের ‘বড় বড় ভুল’ নিয়ে ক্ষমতাবান মহলের উৎকণ্ঠা আছে বলে কাজে প্রমাণ মেলে না।
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম শমশের আলী বলেছেন, যে বাংলা অক্ষর লেখা, পড়া ও বলার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছিলাম, সে অক্ষর এখনো দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক ব্যবহার করতে পারে না। আমরা যখন প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি, অ আ ক খ মুদ্রিত শার্ট ও গেঞ্জি পরে ঘুরে বেড়াই, তখন কেন আমাদের মনে হয় না যে, এ দেশের ৪০ শতাংশ লোকের কাছে অক্ষরগুলো শুধু ছবি মাত্র। অক্ষর পড়ার ক্ষেত্রে তারা চোখ থাকতেও অন্ধ।
পাদটীকা : ‘ভাষা বাড়া দেওয়া হয়’। দেশের একটি জেলা শহরে বাসা ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞপ্তির নমুনা এটা। জেলা পরিষদের যাত্রীছাউনির গায়ে কর্তৃপক্ষ লিখে রেখেছে ‘যাত্রী চাউনী’। পর্যটন স্পট সেন্টমার্টিন দ্বীপের একটি হোটেলের সামনে লেখা, ‘দুপুরে এখানে ল্যান্স করা যায়’। লাঞ্চকে লেখা হলো ‘ল্যান্স’। গাজীপুরে ভাড়ার বিজ্ঞপ্তির ভাষা- ‘বাসা ভাড়া হবে; ১ রুম, ১টা ভাতরুম’। এই ‘ভাতরুম’ ভাত রান্নার জন্য নয়, এটা বাথরুম। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ট্রাকের পেছনে লেখা উপদেশ : নিজে বাচুন, অন্যকে বাছান। হরন দিন। একটি জেলা সদরে কর্তৃপক্ষের কড়া হুঁশিয়ারি : ফোটকা, আতশবাজীসহ শব্দ জাতীয় সামগ্রী পুটানো নিষেধ। খোদ রাজধানীতে একটি গাড়ির গায়ে লেখা আছে, দুঁখে জারা হাসতে জানে (দুঃখে যারা হাসতে জানে)। আরেকটি যানের পেছনে দেখা গেল, ‘ব্যবহার বংস্রের পরিচয়’। সত্যিই ভাষার ব্যবহারেও মানুষের বংশের পরিচয় মিলতে পারে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন