মধ্যপন্থী প্রার্থী ম্যাক্রোঁর প্রচারণায় বক্তৃতা দিতে দিতে একজন মহিলা এমপির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিঃসন্দেহে ট্র্যাজেডি। অপর দিকে, নির্বাচনে হেরে গিয়েও চরমপন্থী মহিলাপ্রার্থী লি পেনের আনন্দনৃত্য যে কমেডি, সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। এ দু’টি ঘটনা (বা অঘটন) ফ্রান্সের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জের ধরে দেশটিতে যে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে তৈরি হতে পারে, তার ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করা ঠিক হবে কি?
ফ্রান্সের নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী লি পেনকে হারিয়ে মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। চরমপন্থী পেনের পরাজয় ঘটলেও বিজয়ী ম্যাক্রোঁ অভিবাসীদের ব্যাপারে কতটা নরম হবেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সেই সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ম্যাক্রোঁর আমলে গোঁড়া সেকুলারদের মুসলিমবিদ্বেষ কি দূর হবে? এদিকে, আপাতত উগ্রজাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় যেতে না পারলেও তারা ফরাসি রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলছে।
ফ্রান্সের জাতীয় নির্বাচন এবার বিশ্বের নজর কেড়েছে যে কারণে তা হলো, দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্বেগজনক উত্থান। উদারতার প্রবক্তা হিসেবে পাশ্চাত্য বেশ গর্ব করে থাকে। অথচ সেখানেও ফ্রান্সসমেত কয়েকটি দেশে জাতীয়তাবাদের নামে বর্ণবাদী, অভিবাসীবিদ্বেষী এবং বিশেষত মুসলিম বৈরী উগ্রতা ও গোঁড়ামি রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করছে। গণতন্ত্রের অপব্যবহার করে, ভ্রান্ত মতাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করে, মিথ্যা ও অর্ধসত্য প্রচারণা চালিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা দেশবাসীর আবেগ-অনুভূতিকে বিপথে পরিচালনা করতে চায়। তারা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নেমে আরো সন্ত্রাস-সহিংসতায় লিপ্ত। এদের কর্মকাণ্ডে শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ নব্য নাৎসিবাদের অপচ্ছায়াই দেখতে পাচ্ছেন। এসব ব্যক্তি ও সংগঠন গণতন্ত্রকে (Democracy) নিছক লোকরঞ্জনবাদ বা জনতুষ্টিবাদে (Populism) পর্যবসিত করছে। দেশপ্রেম বা Patriotism-এর নামে ছড়াচ্ছে উগ্রস্বাজাত্যপ্রেম বা Jingosim। এরা ইউরোপ-এশিয়ার দেশে দেশে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের মতো সর্বজনীন বিষয়গুলো দলীয় কিংবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থে অপব্যবহার করছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তারা জাতীয়তাবাদের নামে নৃতাত্ত্বিক বা ভাষাগত কিংবা বর্ণভিত্তিক গোষ্ঠীশাসন চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। সেই সাথে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয়ে বিশেষ বিশেষ ধর্মের অন্যায় আধিপত্য কায়েমের তৎপরতাও লক্ষণীয়। কোথাও কোথাও জাতীয়তাবাদের মুখোশে নিজেদের সাম্প্রদায়িক মুখমণ্ডল আড়াল করার কোশেশ করা হচ্ছে।
৭ মে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় কিস্তিতে ‘মধ্যপন্থী’ ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রদত্ত ভোটের ৬৬ শতাংশ পেয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী মেরিন লি পেন তার প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়েছেন। বিজয়ী ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের বাম ও ডান ধারার মাঝে সম্পর্কের সেতুবন্ধ গড়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরাসি জনগণের বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠতে চাই।’ ম্যাক্রোঁ থামাতে চান দেশে গজিয়ে ওঠা রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের হুজুগ। তার মতে, এই হুজুগেই ডোনান্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। একই কারণে ব্রিটিশরা ইইউ ত্যাগের রায় দিয়েছে ‘ব্রেক্সিট’-এর মাধ্যমে।
নির্বাচনের ফলকে নিছক নিজের বিজয় নয়, জনগণ ও ফ্রান্সের বিজয় মনে করেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ইইউ’র সাথে সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ওয়াদা করেছিলেন। ম্যাক্রোঁর ভাষায়, ‘আমি ফ্রান্সের ঐক্য, ইউরোপের ঐক্য নিশ্চিত করব। যারা ফ্রান্সকে বিভক্ত করে পদানত করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাব। বিশ্ব তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।’ নিজেদের শক্তিসামর্থ্য আর নিষ্ঠাকে ভীতির কাছে বিসর্জন না দেয়ার ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন।
এবারে ফরাসি জাতীয় নির্বাচন ছিল মধ্যপন্থা বনাম চরমপন্থা, ইইউতে থাকা বনাম না থাকা, জাতীয় ঐক্য বনাম জাতীয়তাবাদী উগ্রতার লড়াই। ম্যাক্রোঁ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর ন্যাটোসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জোটে ফ্রান্সের থেকে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। লি পেন শুধু এর বিরুদ্ধেই ছিলেন না, রাশিয়ার সাথে ‘আরো ঘনিষ্ঠতা’র পক্ষেও ছিলেন। জনগণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফ্রান্সের বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে, আরো সম্পৃক্ততার পক্ষে।
ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জয়ের পাঁচটি কারণের কথা জানা গেছে। ক. মধ্য-দক্ষিণপন্থী ফ্রাঙ্কো ফিলোঁ এবং সমাজতন্ত্রী বেনো হ্যামোঁ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড় থেকে আগেই ছিটকে পড়েন। এ অবস্থায় মধ্যপন্থী ম্যাক্রোঁর ভাগ্য খুলে যায়। এর সাথে যোগ হয় তার বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল। খ. ম্যাক্রোঁ বুঝেছিলেন, সমাজতন্ত্রীরা জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছেন। তাই সোশ্যালিস্ট পার্টির নমিনেশন চাননি। তিনি দেখেছেন, স্পেন বা ইতালির মতো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে ফ্রান্সেও। তাই গত বছর ওলাঁদ সরকারের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে নতুন প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। গ. ম্যাক্রোঁ দূরদর্শী হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন আগে থেকেই। অনেক আগেই শুরু করেন ভোটারদের কাছে যাওয়া। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে তার স্বেচ্ছাসেবীরা তিন লাখ ভোটারের বাড়িতে গেছেন। ২৫ হাজার ভোটার থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে মানুষের চাহিদা উপলব্ধি করেছেন। ঘ. ম্যাক্রোঁর বার্তা ছিল জনগণের জন্য ইতিবাচক। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তরুণ ম্যাক্রোঁ সরকারের ব্যয়হ্রাসের বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী পেন তাকে ‘বড়লোকের প্রার্থী’ বললেও সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করেনি। ঙ. জনগণ নতুনের প্রত্যাশীÑ এটা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। দেশজুড়ে হতাশার মাঝে তিনি আশায় উজ্জীবিত করেছেন দেশবাসীকে। ম্যাক্রোঁর তারুণ্য ও প্রাণশক্তি মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে। এর বিপরীতে, লি পেনের ইইউ এবং অভিবাসনের বিরোধিতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখেছেন ভোটাররা।
এই পাঁচ কারণের সাথে যোগ করে বলা যায়, ম্যাক্রোঁর প্রচারণার বৈচিত্র্যের বিপরীতে পেনের প্রচার কার্যক্রম ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ম্যাক্রোঁর সমাবেশে মিউজিক আর পেনের সভায় মারামারি দেখেছেন জনগণ। পেনের উগ্রপন্থা মোকাবেলায় অনেকে নির্ভর করেছেন ম্যাক্রোঁর ওপর।
এসব মিলিয়ে নির্বাচনপূর্ব দু’সপ্তাহে জনমত জরিপে দু’বার লি পেন পিছিয়ে পড়েন ম্যাক্রোঁর তুলনায়। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, শেষ হাসি কে হাসবেন।
এবারের ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কয়েকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ নির্বাচনে যেসব রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো হচ্ছেÑ ০১. সেই নেপোলিয়নের পর গত দু’শতাধিক বছরে ম্যাক্রোঁর মতো আর কেউ এত কম বয়সে ফ্রান্সের রাষ্ট্রনায়ক হননি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর ফোরাম ‘জি-৭’-এও তিনিই সর্বকনিষ্ঠ নেতা। ০২. ফ্রান্সের বড় দু’দলের বাইরে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া অপ্রত্যাশিত মনে করা হতো এ যাবৎ। ৫৯ বছর পরে একেবারে নতুন একটি দলের নেতা হিসেবে ম্যাক্রোঁ বিজয়ী হয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। ০৩. আধুনিক গণতন্ত্রের পাদপীঠতুল্য ফ্রান্সে এবার এক-তৃতীয়াংশ ভোটারই হয় ভোট দেননি, অথবা তাদের ব্যালট পেপার নষ্ট করে ফেলেছেন। গত অর্ধশতাব্দীতে এমনটা দেখা যায়নি। ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিতির ব্যাপার না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সর্বাধুনিক, অতি উন্নত ও শিক্ষিত কোনো দেশে ৯ শতাংশ ভোটারই ব্যালট পেপার নষ্ট করে ফেলার ঘটনা বিস্ময়কর। ০৪. চরম দক্ষিণপন্থী বা উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এবার ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ফ্রান্সে অতীতে তারা এত ভোট পায়নি আর কখনো।
ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিশ্বের দুটি পুরনো পরাশক্তি ও প্রতিবেশী দেশ। উভয়ের সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক অতীতের পাশাপাশি, বর্তমানে দুই দেশেই বর্ণবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী রাজনীতির অঙ্গনে কর্তৃত্ব করতে চাইছে। ব্রিটেনে এই শক্তি জাতীয় নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও ফ্রান্সে এরা উল্লেখযোগ্য শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছে। এবারকার নির্বাচনে তারা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেও এই পরাজয় যে, মনে প্রাণে স্বীকার করেনি, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট। তাই পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই উদার গণতন্ত্রী বা বর্ণবাদবিরোধী মহলের।
এবার ফরাসি নির্বাচন কেন সে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে, মহাদেশ পেরিয়ে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল, সে প্রসঙ্গে একজন ভাষ্যকার পাশ্চাত্যের কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, ‘(ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার প্রেক্ষাপটে) যুক্তরাষ্ট্রের মতো ফ্রান্সও এখন নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা এ কথা বলেছে। বহু রাষ্ট্রেই এমনটা ঘটছে যারা ‘গণতান্ত্রিক’ হওয়ার ভান করে থাকে।... হাঙ্গেরি একজন জাতীয়তাবাদীর কবলে পড়েছে যিনি মনে করেন, অভিবাসীরা হলো, এক ধরনের বিষ। ফিনল্যান্ডে একটি নব্য ফ্যাসিবাদী দল রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার। ডাচ রাজনীতিক গির্ট বিল্ডার্স হিজাব পরা নারীদের ওপর ট্যাক্স বসাতে চান। কারণ তারা ‘মাথায় ন্যাকড়া বাঁধে।’ এই ব্যক্তি কয়েক সপ্তাহ আগে জাতীয় নির্বাচনে বিরাট সাফল্য পেয়েছেন।
অথচ দেশটি এ যাবত সহিষ্ণুতার জন্য সুপরিচিত ছিল। প্রসঙ্গক্রমে অবশ্যই বলতে হয় ব্রিটেনের ‘স্বদেশী’ উন্মাদনাগ্রস্ত ভোটারদের কথা। তারা ইউরোপীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে ট্রাম্পের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্রিটেনের জাতীয় পতাকার নাম ‘ইউনিয়ন জ্যাক’। ইউনিয়ন মানে, ঐক্য। অথচ সম্প্রতি দেশটির গণভোটে ইউরোপের ঐক্যবিরোধীরাই জিতলেন।”
পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের সুযোগে জাতীয়তাবাদের নামে বর্ণবাদী উগ্রতার পাশাপাশি প্রাচ্যেও জাতীয়তাবাদী উগ্রতায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান ঘটছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবার দাবিদার ভারতে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন, মিয়ানমারে নৃতাত্ত্বিক ‘বিশুদ্ধতা রক্ষা’র নামে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূল অভিযান, শ্রীলঙ্কায় তামিল ও মুসলিমবিদ্বেষী বৌদ্ধদের আধিপত্য প্রয়াস, প্রভৃতি এ ক্ষেত্রে নগ্ন নজির হয়ে থাকবে।
মার্কিন সাংবাদিক ও কলামিস্ট পিয়েরে ট্রিস্টাম লিখেছেন, ম্যাক্রোঁ হলেন ওবামার শ্বেতসংস্করণ। সেই ওবামা, যিনি একটা বক্তৃতা দিয়েই চার লাখ ডলার কামাতে পারেন। ম্যাক্রোঁর আছে কর্পোরেট ব্যাংকারের পটভূমি। এর সাথে রয়েছে ‘হ্যাঁ, আমরা পারি’ টাইপের মধ্যপন্থী আশাবাদ। এই প্রত্যাশাই ফ্রান্সের সামাজিক চুক্তিকে যথাযথ স্থানে প্রতিষ্ঠা করবে এবং অর্থনীতিকে পিছিয়ে পড়া থেকে উদ্ধার করবে।... ম্যাক্রোঁর দলের নাম ‘আঁ মার্শে’, যার অর্থ করলে অনেকটা দাঁড়ায় ‘অগ্রসরমান’। অবশ্য এমন নাম শুনলে বেশি মনে পড়ে যায় হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যান্ড বাজিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা। অথচ এটি বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী দেশটির একটি রাজনৈতিক দলের নাম।’
উগ্র জাতীয়তাবাদীরা হাল ছাড়েনি। তাদের টার্গেট অবশ্যই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আপাতত তারা আগামী মাসের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দেখাতে চায়, জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় তাদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। হয়তো লি পেন স্বপ্ন দেখেন, ভারতের নরেন্দ্র মোদি কিংবা আমেরিকার ট্রাম্পের মতো তিনিও দেশের কর্ণধার হবেন। সেদিন বেশি দূরে নয় বলে তাদের ধারণা। শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের নামে উগ্র স্বাদেশিকতা ও সংরক্ষণবাদ মিলিয়ে এক ধরনের বর্ণবিদ্বেষকে উসকানি দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় সত্যিকার গণতন্ত্রী, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মানবতাবাদীরা বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
ফ্রান্সের নির্বাচনী ফলাফল দৃশ্যত দেশের ভেতরে ও বাইরে স্বস্তি আনলেও আগামী দিনে ম্যাক্রোঁর পথচলা সহজ হবে না। তাই হাফিংটন পোস্ট বলেছে, ‘৩৯ বছর বয়সী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবারই প্রথম নির্বাচনে নামলেন। তাকে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি, নিরাপত্তা সঙ্কট আর রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত দেশ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। তার জন্য আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে, পার্লামেন্টের নির্বাচন। জুন মাসের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হলে ম্যাক্রোঁর নতুন সংগঠনকে ২৮৯ আসন পেতে হবে কমপক্ষে। তা না হলে, নানামুখী বাধায় তিনি ক্ষমতাহীন প্রেসিডেন্টে পরিণত হবেন। তখন বিরোধীদলীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে দেশ চালাতে হবে। সে প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সংস্কারমূলক কাজে বাগড়া দেবেন।’
হাফিংটন পোস্ট আরো লিখেছে, ‘লি পেনের প্রাপ্ত ৩৫ শতাংশ ভোট ফ্রান্সের ইতিহাসে দক্ষিণপন্থীদের পাওয়া সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোট। নিকট অতীতেও কল্পনা করা যেত না যে, ওরা এত ভোট পাবে। ম্যাক্রোঁ যদি সংস্কার এবং অর্থনৈতিক উন্নতির অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হন, আগামী নির্বাচনে লি পেন থাকবেন সুবিধাজনক অবস্থানে।’
পাদটীকা : ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা ট্র্যাজেডি হলো, ম্যাক্রোঁর পক্ষে প্রচারের সময় বক্তৃতা মঞ্চে ঢলে পড়ে মহিলা এমপি করিন অ্যাথেলের আকস্মিক মৃত্যু। তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন গত এক দশক যাবত। ৫ মে’র এক সমাবেশে প্রধান বক্তা অ্যাথেল ভাষণের সময় হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ বলেছেন, তিনি পুরো সময় পার্লামেন্টের কাজে ব্যয় করতেন, এই শোকের ঘটনার বিপরীতে অদ্ভুত উল্লাসের সংবাদও আছে।
কট্টর দক্ষিণপন্থী লি পেন নির্বাচনে হেরে গেলেও নাচের উৎসাহ হারাননি। নির্বাচনের মঞ্চে ভালো করতে না পারলেও নৃত্যের মঞ্চে তিনি ঠিকই নেচেছেন। নির্বাচন-পরবর্তীকালে পার্টির আয়োজন করেছিল তার দল। সেখানে ‘আই লাভ রক অ্যান্ড রোল’ গানের সাথে তিনি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে নাচে মেতে ওঠেন। এ সময় তিনি দলের মধ্যে গভীর রূপান্তরের আশ্বাস দিয়ে নির্বাচনী ভরাডুবির মাঝে সান্ত্বনা খুঁজেছেন।
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন