এ বছর রমজান শুরুই হলো ‘ধাক্কা’ খেয়ে। ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম দিনের তারাবি পাড়ার মসজিদে পড়ব ঠিক করেছিলাম। সেদিন এক কাজে অন্যত্র আটকা পড়ায় দীর্ঘ পথ পার হয়ে বাসায় পৌঁছলাম এশার নামাজের সময়। কিছুক্ষণ পরই খতম তারাবির পয়লা জামাত। আজ মুসল্লি হবে বেশি। এদিকে সময় হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে মসজিদে পৌঁছে দেখি, অন্ধকার। এসি লাগানো মসজিদে এ কী অবস্থা। কারেন্ট নেই। মানুষ হাঁসফাঁস করছে। জামাকাপড় ঘামে জবজবে। কেউ কেউ পানির বোতল নিয়ে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত বিলম্বে জামাত শুরু করতে হলো। বিধিবাম! তারাবির পঞ্চম রাকাতে আবার বিদ্যুৎ বাবুর পলায়ন।
আগের রাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ওয়াদা করেছিলেন, এবার রমজানের শুরু থেকে আর বিদ্যুৎ বিপর্যয় হবে না। তবে এ দেশে নাকি অধিকাংশ অঙ্গীকার করা হয় ভঙ্গের জন্য, পূরণের উদ্দেশ্যে নয়।
পত্রিকায় দেখা গেল, কর্তৃপক্ষ বলেছে- ‘রমজান মাসে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ যথাযথ থাকে, সে জন্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কারণে রোজার প্রাক্কালে দেশে লোডশেডিং হয়েছে।’ দেশবাসীকে বোকা ভাবলে এমন কত কথাই তো বলা যায়। মাহে রমজানের প্রস্তুতি আগে নেয়া হয়নি কেন? আর এটা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কেমন প্রস্তুতি যে, সারা দেশের মানুষ দুর্ভোগ পোহাবে? সবচেয়ে বড় কথা, এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতিটা কেমন, তা তো প্রথম রোজার তারাবির সময়ই টের পাওয়া গেল।
রাতের বয়ান দিয়ে এবার দিনের কথা শোনাই। রমজানের প্রথম দিবস। অফিসে যাওয়ার পথে আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশন কমপ্লেক্সের কাছে যেতেই যানবাহন থেমে গেল। দীর্ঘ সময়েও আর চাকা ঘোরেনি। এদিকে প্রচণ্ড গরমে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ যাত্রীরা কাহিল। কেউ কেউ হাতপাখার বাতাস খাওয়ার চেষ্টা করছেন। সময়ের সাথে গাড়ির সারি লম্বা হচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা ক’জন সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। কিন্তু পুলিশের বহরের কড়াকড়ি। কাউকে সামনে যেতে দেবে না। এ নিয়ে এক ছাত্রের সাথে পুলিশের বিতণ্ডা। সরকারপ্রধান অফিসে যাবেন। অতএব, এখনকার রীতিমাফিক বহুক্ষণ রাস্তা বন্ধ থাকবে। কী আর করা, নিয়তিকে মেনে আমরা ঘামে ভিজতে থাকি। এভাবেই মাহে রমজানের ধৈর্য, ত্যাগ ও সংযমের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল।
এবার মাহে রমজান এসেছে জ্যৈষ্ঠের দুঃসহ উত্তাপের মাঝে। বলাই বাহুল্য, তার সাথে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের উত্তাপ ও উচ্চচাপ, যা রোজাদারদের জন্য লোভী কিছু লোকের ‘রমজান উপহার’। রমজান শুরু হওয়ার আগেই সাগরে শুরু হয়েছিল নিম্নচাপ। তা রোজার দ্বিতীয় দিনে ঝড়ের রূপ নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে। তবুও কিছুটা স্বস্তি এ কারণে যে, রহমতের এই মাসে মহান আল্লাহর রহমতে ‘মোরা’ নামের ঘূর্ণিতাণ্ডব দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ছাড়া অন্যত্র ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেনি। কক্সবাজার জেলায় যারা ঝড়ের কবলে ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি রইল।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী রোজা শুরু হওয়ার আগের দিন জোরগলায় বললেন, ‘রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে।’ বাস্তবে প্রথম দিনই বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে খোদ রাজধানীর কোথাও কোথাও। এর আগে কেবিনেটের সিনিয়র একজন মন্ত্রী বড় গলায় বলেছিলেন, ‘রোজার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না।’ বাস্তবে ঠিকই এসব অপরিহার্য আইটেমের দাম অসৎ ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় গত শুক্রবার আরেক সিনিয়র মন্ত্রী বললেন, ‘চাল চিনির দাম বাড়িয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।’ প্রশ্ন হলো, সিন্ডিকেট বা চক্র, যাই বলুন, অর্থগৃধনু লোভী ও মুনাফালুটেরা এসব বড় বড় বিক্রেতা এত হুঙ্কারের মাঝে কিভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সাহস পেল! ওরা ক্ষমতাসীনদের আপন লোক বলেই তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ব্যবসার নামে এই রমজানেও জনগণকে শোষণ করতে পারছে।
রমজান ত্যাগ তিতিক্ষার সাথে দান খয়রাতেরও মাস। এ ছাড়া, এ মাসেই সাধারণত আরেকটা ফরজ আদায় করা হয়, যার নাম জাকাত। এটা না দিলে সম্পদ অপবিত্র হয়ে যাবে। ফিতরাও দেয়া হয় রমজানে, বিশেষত শেষের দিনগুলোতে। আর এ মাসে ফকির মিসকিনকে নগদ অর্থ, খাবার, কাপড়চোপড় ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করা হলে সওয়াব হবে অনেক বেশি।
পরিচিত কয়েকজন অভাবী মানুষ আমার কাছে সাহায্য চায়। তারা দুস্থ ভিক্ষুক। বৃহস্পতিবার অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে দেখে তাদের একজন লুঙ্গি চাইল সাহায্য হিসেবে। পরদিন জুমাশেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় দেখি, বেশ কয়েকজন ভিক্ষুক হাত পেতে আছে। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই এই দৃশ্য দেখা যায়। এটা সর্বত্র, সব জামে মসজিদেই।
বাসায় ফিরে টিভিতে শুনলাম বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রীর অদ্ভুত কথা। তাদের আমলে দেশে উন্নতির জোয়াবে দারিদ্র্য পালিয়েছে, তা বুঝাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘অভাবে ভিক্ষা করে, এমন লোক বাংলাদেশে নেই।’ তা হলে ধরে নিতে হয়, যারা ছিন্নমূল, দুস্থ, কানা, খোঁড়া হয়ে অহরহ মানুষের কাছে হাত পাতছে, তারা অভাব নয়, ভাবের ফকির। ফকির লালন বেঁচে থাকলে এমন আধ্যাত্মিকতা দর্শন করে হয়তো হতবাক হয়ে যেতেন। মাননীয় মন্ত্রীর কথার ভিত্তি থাকলে বিশ্বাস করতে হয়, দেশে যে অসংখ্য দীন-দুঃখী, একেবারে গরিব মানুষ খালিপেটে ও ছেঁড়া কাপড় গায়ে দেখা যায়, খাবার না খেয়ে এবং ভালো পোশাক না পরে থাকা এদের স্বভাব। আমাদের সরকার নিজেকে যতই গণতান্ত্রিক বলে জাহির করুক, মন্ত্রী সচিবসহ বড় বড় কর্তাদের সাধারণ জনগণের সাথে সম্পর্ক থাকলে তারা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অবস্থা জানতেন। তখন কেউ অবাস্তব হাস্যকর উক্তি করতেন না। এসি লাগানো বাড়িতে কিংবা কালো কাচে ঘেরা গাড়িতে কঠোর পাহারায় থাকলে গণমানুষের অভাব অনটন, দুঃখ-যন্ত্রণা উপলব্ধি করা অসম্ভব। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী উপরে উল্লিখিত কথাটার সাথে বোনাস ঘোষণা দিয়েছেন, ‘গ্যাসের দাম এখন একদফা তো বাড়ছেই, আগামী বছর আবার বাড়বে।’ অর্থাৎ এভাবেই সরকার তার ‘ভিশন’ বাস্তবায়নের ভীষণ কাজটি এগিয়ে নেবে।
রোজা নিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতি বছর থাকতে হয় দুশ্চিন্তায়। এর কারণ তাদের অনিবার্য ও বর্ধিত দুর্ভোগ। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মিলিয়ে এই মানুষেরাই দেশের বিপুল গরিষ্ঠজন। অথচ তারা সম্পদ ও সৌভাগ্যের বেলায় নেহায়েত লঘিষ্ঠ। তাদের আয় অনিশ্চিত, নতুবা সীমিত। ফলে রোজার প্রাক্কালে যখন জিনিসপাতির দাম অনেক বেড়ে যায়, তখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ঘাম ছুটে যায়। এবার চরম গরমে নিশ্চয়ই সে ঘামের পরিমাণ বেশি।
রোজার মাস আসার আগে টেনশন থাকে, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতির দামতো বাড়বে, তখন সংসার চলবে কিভাবে?’ রোজার কয়েক দিন না যেতে নতুন টেনশন হিসেবে যোগ হয়, ছেলেমেয়ে, বউ বাচ্চা মিলিয়ে পরিবারের জন্য নতুন জামাকাপড়, জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি কেনার ঝামেলা। রোজার অর্ধেক পার হলেই বাড়ি যাওয়ার মহাঝামেলার টেনশন। ট্রেনের টিকিটের টিকিটাও অনেক সময় দেখা যায় না। তাই আগের দিন গিয়ে রাতভর পড়ে থাকতে হয় কমলাপুরের প্লাটফর্মে। বাসের টিকিটের জন্য পকেট খালি করে দিতে হয়। লঞ্চে এত ভিড় যে, বাড়ি পৌঁছার চেয়ে দুর্ঘটনা বেশি নিশ্চিত বলে শঙ্কা জাগে।
আরেক ধরনের সমস্যায় ভুগতে হয় মানুষকে। রোজার মাসে ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এই অপকর্মে নানা কৌলশ অবলম্বন করা হয়। চিহ্নিত চাঁদাবাজদের সাথে নানা কিসিমের ধান্ধাবাজ শামিল হয়। পত্রপত্রিকায় বেশি দেখা যায় পরিবহন শ্রমিক আর পুলিশের চাঁদাবাজির খবর। যখন আইনের রক্ষকরাই তা ভক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন অন্যরাও অপরাধ ঘটানোর মহাসুযোগ পেয়ে যায়। ‘বখশিশ’ নামের চাঁদার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। বাসার বুয়া ও ক্লিনার, পত্রিকার হকার, অফিসের পিওন- অনেকেই বখশিশের হকদার। আপনি নিজের বিবেচনামতো তা দিলে ক্ষেত্র বিশেষে সমস্যায় পড়তে পারেন! তখন যাকে দিতে হবে, তার সন্তুষ্টিমাফিক হওয়া চাই বখশিশের পরিমাণ। এমন অবস্থায় নিজেই পড়েছিলাম একবার।
এখানেই শেষ নয়। পেশাদার পকেটমারেরা বসে থাকবে কেন? ঈদের বাজারে মানুষের পকেটে অতিরিক্ত টাকা থাকে। অতএব, গাঁটকাটা বাহিনী তাদের অপারেশনে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকাল পকেটমারের ইনকাম কমে গেছে। সেটা পুষিয়ে নেয়ার প্রয়াস চলে ঈদের বাজারে। ছিনতাইকারীরাও তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। শপিং করে রিকশায় ফেরার পথে কিংবা নির্জন প্রত্যুষে ঈদে বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় তারা হামলে পড়ে। আরো আছে এক ধরনের পার্টি। এই পার্টি মানে রাজনৈতিক দল নয়। বর্তমান আমলে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম চালানো কঠিন। তবে ভিন্ন ধরনের ‘পার্টি’ যথাসাধ্য তৎপর। রোজায় প্রতি দিনের ‘ইফতার পার্টি’র কথাও বলছি না। বলা হচ্ছে অজ্ঞান বা মলম পার্টির কথা। বিশেষ করে ঈদের বাজারে যাওয়া আসার সময় এবং ঈদ উপলক্ষে যানবাহনে এই তস্করদের ব্যাপারে সাবধান থাকার বিকল্প নেই।
সীমিত আয়ের মানুষের অনেকের ঈদানন্দ সীমিত হয়ে যায় আরো এক কারণে। তা হলো ঈদি বা ঈদের সালামি। অফিসে যে বোনাস পান, তা দিয়ে বাজারই সারে না, সালামির তহবিল আসবে কোত্থেকে? একটা চুটকি পড়েছিলাম- ঈদে সালামি দেয়ার ঝামেলা এড়াতে এক লোক ঈদের দিন দু’পা চেয়ারে তুলে বসে থাকতেন। শুধু তা-ই নয়। তিনি এমন ভাণ করেন যেন তার দু’পায়ে খুব ব্যথা এবং সালামের জন্য পা ছুঁলেই ব্যথায় তার প্রাণ হবে ওষ্ঠাগত। অবশ্য এত অভিনয় করেও তিনি শেষাবধি ঈদি শিকারিদের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না।
আমাদের দেশে এখনো উচ্চবিত্তের চেয়ে নি¤œবিত্ত মানুষের মাঝে ধর্মবোধ প্রবল এবং ধর্মপরায়ণতা বেশি। তাদের জীবনযাত্রায় পাশ্চাত্যের উগ্র আধুনিক ভোগবাদী সমাজের প্রভাব নেই, যা এ দেশের ধনাঢ্য শ্রেণীর বিরাট অংশের মাঝে চোখে পড়ে। এই সাধারণ মানুষ ছাপোষা চাকুরে কিংবা ‘দিনে এনে দিনে খাওয়া’। তারাই এ দেশের জনগণের মাঝে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ বিশেষ করে রাজধানীতে এই অসংখ্য মানুষের মৌলিক প্রয়োজন কোনোটাই পূরণের দিকে সরকার নজর দেয় না। তাদের থাকতে হয় বস্তিতে; খেতে হয় ফুটপাতে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার নেই সুবিধা; চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে আউটডোরে লম্বা লাইন ধরতে হয়। যাতায়াতের কোনো উপায় নেই হাঁটা ছাড়া। কারণ এখন লোকাল বাস নেই; সরকারের সৌজন্যে সব ডাইরেক্ট ও ‘সিটিং’। অত ভাড়া দেয়া মধ্যবিত্তের জন্যও কষ্টকর।
এই যে লাখ লাখ নি¤œবিত্ত নাগরিক ঢাকায় বাস করে, তাদের দুর্ভোগ মাহে রমজানেও থাকে অব্যাহত। কাঁচাবাজারে দামের যে আগুন, তার তাপে মধ্যবিত্তেরই চুল পেকে যায়; সেখানে নি¤œবিত্তের কী অবস্থা, তা বলে দিতে হয় না। ইফতারির বাজারে সাধারণ মানুষের যাওয়ার উপায় নেই। প্রায় সব আইটেমের চড়া দাম। আনারস, কলা ও শসার মতো আইটেমের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হালিমের সবচেয়ে ছোট ভাণ্ডের দাম ১০০ টাকা! বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ইফতার বক্সের জন্য কয়েক শ’ টাকা খরচ করতে হয়। এ অবস্থায় অসংখ্য দুস্থ-দরিদ্র মানুষ হয়তো শুধু পানি দিয়ে রোজা ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন।
এবার রোজার দিনে আবহাওয়ার গরমের সাথে বাজারের গরম মিলে কেমন চরম অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তার কিঞ্চিৎ প্রতিফলন এই ছড়াতে- ‘ঘামছি সকাল দুপুর রাতে/বাড়ি অফিস কারখানাতে/উপকরণ হাজার; চলুন তবে বাজার- যাক মহাশয়, টের পেয়েছেন/ অন্যরকম সাজার।’
রোজার মাসে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর লুটেরাস্বভাব ও অসংযমী আচরণ নিয়ে একটি ছড়ায় বলা হয়েছে, ‘রোজা এলেই বৃদ্ধি পায় সকল বাজারদর/দোকানিরা ফায়দা লোটে কে বা আপন পর।/ইচ্ছে মতো দর কষে দেয় বাজার থাকে চড়া/দামের কথা বলতে গেলে মেজাজ দেখায় কড়া।/ছোলা বেগুন মাছ মাংসের দাম পায় অনেক বৃদ্ধি,/দোকানিরা আচ্ছামতো করে স্বার্থসিদ্ধি।’
নিকট অতীতে দেখা গেছে, মাহে রমজান উপলক্ষে ইসলামি কুইজ, কিরাত, হামদনাত, কাসিদা, প্রতিযোগিতার ধুম। ইসলামি গানের অনেক রেকর্ড ও অ্যালবাম বের হতো এ মাসে। আর রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল এবং এ মাসে ইফতার মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন হতো ব্যাপকভাবে। গত কয়েক বছরে প্রধানত রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট বৈরী পরিস্থিতিতে এসব এখন অনেক কম। এর মধ্যে একটি খবর নজর কেড়েছে অনেকের।
একটি পত্রিকার বিনোদন পাতার খবর : “বাংলাগানের যুবরাজ আসিফ আকবর। রমজান উপলক্ষে প্রথমবারের মতো ইসলামি গান গাইলেন তিনি। গানটির শিরোনাম- ‘মুমিন হতে চাই’। ... প্রথমবার ইসলামি সঙ্গীত গাওয়া প্রসঙ্গে আসিফ জানান, ‘সঙ্গীতের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম ইসলামি সঙ্গীত গাইলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি গান। সুর আর চমৎকার শব্দচয়ন হয়েছে এতে। আল্লাহর রহমতে গানের রেকর্ডিং সফলভাবে শেষ হয়েছে। ব্যতিক্রমী সুরের এ গানটি আশা করি সবারই ভালো লাগবে।” উল্লেখ করা দরকার, গানটিতে বিশিষ্ট দু’জন শিল্পী- বালাম ও ইমরানও কণ্ঠ দিয়েছেন। রমজানের পয়লা সপ্তাহেই গানটি ইউটিউবে প্রকাশ করার কথা।
দুনিয়াজুড়ে রমজান মাস চলছে। আর প্রায় প্রতিটি দেশেই মুসলমান আছেন। তবে রমজানসংস্কৃতি সর্বত্র অভিন্ন নয়। আর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের দৈর্ঘ্যরে প্রভেদ থাকাও স্বাভাবিক। একটি পত্রিকায় দেশে দেশে রোজা পালনের ওপর মজার সব তথ্য দেয়া হয়েছে। যেমন- মিসর ও তুরস্কে কামানের গোলার শব্দ শুনে সেহরি শেষ করা এবং ইফতার শুরু করা হয়। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৫ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়। জার্মানি ও ইংল্যান্ডে এর পরিমাণ ১৯ ঘণ্টার মতো। উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশ আইসল্যান্ডে একটানা ২২ ঘণ্টা রাখতে হয় রোজা। সুইডেনে ইফতারির চার ঘণ্টা পরই সেহরির সময় হয়ে যায়। ইটালিতে সেহরিতে একটি প্রিয় আইটেম বার্গার। আর ইরানে অনেকেই দিনে অফিস আদালতে কাজ করেন এবং রাতে মসজিদে থাকেন ইতেকাফে।
পাদটীকা : রমজান ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বিদায় নিচ্ছে। এর একটি হলো শেষ রাতে মহল্লায় কাসিদা গেয়ে রোজাদারদের জাগানো। এই গানগুলো সাধারণত পুরনো ঢাকায় বেশি প্রচলিত এবং উর্দুতে রচিত। একটি কাসিদার বাণী হচ্ছে, “আল্লাহ কা বান্দে কো হাম আয়ে জাগানে কো/ হর দিলমেঁ রমজান কী পয়গাম পঁহুছায়েঙ্গে/হো জায়েগি ইয়ে দুনিয়া রমজান মুবারক কী/ আল্লাহ কা রহমত কী হাম তুফান উঠায়েঙ্গে (আমি এসেছি আল্লাহর বান্দাদের জাগাতে।/প্রত্যেকের হৃদয়ে রমজানের বাণী পৌঁছিয়ে দেবো।/ এই দুনিয়া হবে মুবারক মাস রমজানের।/আল্লাহর রহমতের ঝড় তুলব।)। আজ আমাদের ক’জনের অন্তরে রমজানের বাণী পৌঁছতে পারছে? এ মাসের রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের তাৎপর্য আমরা কি আসলেই উপলব্ধি করি?
পুনশ্চ : মাহে রমজানের প্রধান শিক্ষা হলো, ত্যাগ ও সংযমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। আমাদের সমাজে এই শিক্ষা কে কিভাবে গ্রহণ করছে, তা নয়া দিগন্তের কার্টুনে ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। এর ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিক্রেতা মাপে দিচ্ছেন কম। আর দাম নিচ্ছেন বেশি। প্রতারিত ক্রেতার চোখ উঠেছে কপালে। হাসিমুখে বিক্রেতা বলছে, ‘বাড়তি দাম দেয়া হলো আপনার ত্যাগ, আর ওজনের বেলায় হলো গিয়ে আমার সংযম।’
মনে পড়ে, আবুল মনসুর আহমদের ‘রাজনীতির বিয়াকরণ’ পুস্তিকার একটি কথা। ‘আমদানি কাহাকে বলে? যাহা আমার পকেটে আসিবে। রফতানি কাহাকে বলে? যাহা তোমার পকেট হইতে যাইবে।’
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন