ঈদুল ফিতর আবার এসেছিল, যেভাবে প্রতি বছর আসে। যথানিয়মে চলেও গেছে। দুনিয়ায় যত কিছুই ঘটুক, যত প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাক না কেন, যুদ্ধ, গণহত্যা, ধ্বংসতাণ্ডব, প্লাবন, মহামারী, জলোচ্ছ্বাস, প্রচণ্ড ঝড়, ভূমিকম্প কিংবা মহাদুর্ঘটনা, আসমানে ঠিকই শাওয়ালের একফালি চিকন চাঁদ উঠবে। তাই ঈদও অনিবার্য।
তবে এবার যতই শপিং আর খাবারের আয়োজন থাকুক, যত উৎসব-আনন্দ করা হোক ঘটা করে, দেশের পার্বত্য জনপদে ভূমিধসের শিকার পরিবারগুলো কিংবা ইরাক-ইয়েমেনের যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ অথবা লন্ডনের ভস্মীভূত বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের জীবনে নিশ্চয়ই ঈদের দিনেও হাসির বদলে কান্না।
এবারের ঈদে আরেকবার প্রকট হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির বিভাজন ও বৈপরীত্য। সরকারপ্রধানসহ ক্ষমতাসীন মহলের সাফ কথা, দেশবাসী শান্তি-স্বস্তিতে ও পরম আনন্দের সাথে ঈদ উদযাপন করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ বিরোধী দলের অভিমতÑ দেশের মানুষের মনে শান্তি নেই। তাই ঈদ কাটছে নিরানন্দে।
আসলে এ দুই মতের দুটোই কম-বেশি সত্য। যে যার দৃষ্টিতে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেছেন। বাস্তবতা হলো, কেউ যত দুঃখ-কষ্টে থাকুক না কেন, পথঘাটে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিত জন যদি প্রশ্ন করেন, ‘কেমন আছেন?’ জবাব আসে প্রায় সব ক্ষেত্রে, ‘ভালো আছি।’ তবে এই এ ‘ভালো’ যে আসল ‘ভালো’ নয়, তা হয়তো প্রশ্নকারীও জানেন। এমনকি অনেক সময়ে জবাবদাতার চেহারা, হাবভাব ও পরিচ্ছদ থেকেও আন্দাজ করা যায়, উনি তেমন ভালো নেই। প্রকৃতপক্ষে এমন প্রশ্ন ও উত্তরÑ দুটোই সৌজন্য ও সামাজিকতার প্রকাশ। ঈদের দৃশ্যমান হাসি-আনন্দও এর দৃষ্টান্ত। মানুষ শত দুঃখের মাঝেও একটু স্বস্তি বোধ করতে চায়। অন্তত সন্তানসন্ততিসহ পরিজনের দিকে তাকিয়ে এবং বিশেষত সামাজিকতার স্বার্থে ঈদের আনন্দ-আয়োজন করতে হয় সাধ্যমতো।
তবে দেশের যা অবস্থা, সমাজের যে হালহকিকত, তাতে বলা চলেÑ বাংলাদেশের মানুষ পরম শান্তি ও চরম স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে না। মনে আনন্দ না থাকলেও মুখে খুশি খুশিভাব ফুটাতে হয় নানা কারণে। সরকার মানুষের মুখ দেখেই তৃপ্ত; বিরোধী দল জনগণের মনের খবর জানতে চায়। এর ভিত্তিতে তারা নিজ নিজ রাজনীতির সপক্ষে উপসংহার টানেন।
উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের ১৭ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু এবার ঈদের আনন্দে বিষাদের ছায়া ফেলেছে। তারা প্রধানত গাজীপুরে কর্মরত গার্মেন্ট শ্রমজীবী। নি¤œবিত্ত মানুষ কম পয়সায় বাড়ি যেতে মালবোঝাই ট্রাকে চেপেছিল। তাদের জীবন যে মালের চেয়েও কম মূল্যের, তা প্রমাণিত হলো আবারো। ট্রাকড্রাইভার ঝিমাচ্ছিল বলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে মঙ্গা এলাকার ১৭ জন মানুষ। এ প্রেক্ষাপটে দাবি উঠেছে ‘উত্তরের দরিদ্র মানুষের জন্য চাই বিশেষ ট্রেন।’
দেশের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল, নির্বিত্ত মানুষের ভাগ্যে ঈদের আনন্দও জোটে না। শুধু তাদের কপাল মন্দ নয়, দেশটারই পোড়া কপাল। তারা ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার পথে বাস-ট্রাক-লঞ্চ দুর্ঘটনায় কিংবা ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে প্রাণ হারায়; মারা যায় জাকাত প্রার্থীদের প্রচণ্ড ভিড়ে চাপাচাপিতে। নজরুলের যুগে গরিব মানুষ বলতে সাধারণত কৃষকদের বুঝানো হতো। সেই ব্রিটিশ আমলে এ দেশে কলকারখানা ছিল খুব কম; গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি তো ছিলই না। নজরুল কবিতায় জবাব চেয়েছেন, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা, ক্ষুধায় আসেনি নিঁদ;/ আধমরা সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
‘ঈদুল ফিতর’ কথাটার ‘ফিতর’ শব্দটি ‘বিজয়’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ বিজয় ষড়রিপুর ওপর বিজয়, তথা নফস বা প্রবৃত্তির পরাজয়। আর প্রবৃত্তি যে শয়তানের কুমন্ত্রণার পরিণাম, তা বলাই বাহুল্য। কথা হলো মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামষ্টিক সুখ, শান্তি, স্বস্তি ও কল্যাণের শত্রু যে ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য- সেগুলোকে আমরা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কি আসলেই দমাতে বা ত্যাগ করতে পেরেছি? যদি রোজার শেষে আবার এ রিপুগুলোর তাড়নায় আমরা অসৎ কাজ ও অন্যায় অনাচার করতে থাকি, তাহলে বলা যায়- সেই রোজাদার বিজয়ী নন, পরাজিত। তখন ঈদুল ফিতর তাদের জীবনে অর্থহীন প্রমাণিত হবে। আমরা নিশ্চয়ই তা চাই না।
মধ্যযুগে, এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও ঈদ উৎসব এ দেশের সমাজ জীবনে এতটা ব্যাপক, জমজমাট ও প্রভাবশালী ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন লেখক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এর পেছনে একাধিক কারণ ছিল বলে তিনি মনে করেন। তিনি এবার এক নিবন্ধে লিখেছেন, গোটা উনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে, তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগরজীবন, গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নব রূপায়ণ ঘটেছে, তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে। ঈদ উৎসব জাতীয় মর্যাদা লাভের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ঈদ এখন জাতিগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নির্মাণের নব প্রকাশ। বাংলাদেশের আধুনিক বাঙালি মুসলমানের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সমন্বিত করার এক নতুন প্রকাশও আমরা লক্ষ করি ঈদ উৎসবের নব বিন্যাসের মধ্যে।
‘সাম্প্রদায়িক’ কথাটা বর্তমানে নেতিবাচক বা নিন্দাসূচক অর্থেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। অথচ মূলে এ শব্দের অর্থ ‘সম্প্রদায় সম্পর্কিত।’ এবার ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে এক আলোচনা সভায় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার তার উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটির গঠনের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়, যা কিছু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সম্প্রদায় সম্পর্কীয়, তা সবই সাম্প্রদায়িক। কাজেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে শব্দটি মোটেই নিন্দার্থক নয়। যতীন সরকারের মতে, এ কারণে ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ অনুষ্ঠান বলা মানে, নিন্দা করা নয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা এ অনুষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের ধর্মের অনুশাসনরূপেই পালন করে থাকে। এতে নিন্দার কিছু নেই।” ‘প্রগতিশীল’রা অহরহ ধর্মকর্মকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে প্রতিপক্ষের তীব্র সমালোচনা করে থাকেন। সে মহলের একজন অগ্রণী ব্যক্তি হয়ে যতীন বাবু বলেছেন, যেকোনো মানুষকে যেকোনো ধর্মীয় দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন এবং অনুরূপ আচার-অনুষ্ঠান পালনের অধিকার দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, মন্দিরের সামনে গরু কোরবানি দিলে কিংবা মসজিদের সামনে দিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে মূর্তি নিয়ে গেলে তা হবে নিন্দার্থে ‘সাম্প্রদায়িক।’
‘ঈ’কার কী দোষ করেছে?
কথায় বলে ‘নাই কাজ তো খই ভাজ।’ তাই কেউ কেউ এবার ‘ঈদ’-কে ‘ইদ’ লেখার জন্য প্রচারণায় নেমেছেন। কিন্তু সাথে সাথে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ায়। ‘বিদেশী শব্দ বাংলায় লিখতে হবে ই-কার দিয়ে’- এ নিয়ম সব ক্ষেত্রে খাটে না কিংবা এটা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ‘ঈদ’ শুধু দীর্ঘকাল ধরে সবার মাঝে প্রচলিতই নয়; উচ্চারণের দিক দিয়েও ‘ঈদ’ শুদ্ধ, ‘ইদ’ সম্পূর্ণ ভুল। শব্দটা এ কারণেই ইংরেজিতেও ঊরফ লেখা হয়, যা থেকে ‘ঈদ’-এর সঠিক হওয়াই প্রমাণিত।
বাংলাদেশে বাংলা বানানের ‘মা-বাপ’ হিসেবে গণ্য বাংলা একাডেমি ‘ইদ’ বানানের পক্ষে। তবে তাদের কথাকে অনেকেই উড়িয়ে দেন এ যুক্তিতে যে, প্রতিষ্ঠানটির ঘোষিত নিয়মমাফিক ‘একাডেমি’ বানান শুদ্ধ এবং ‘একাডেমী’ বানান ভুল। কিন্তু বহু বছর ধরে তারা নিজেদের নামই লিখেছেন ‘একাডেমী; তাহলে অন্যকে আর কী শেখাবেন? ফেসবুকে ক্ষুব্ধ দুই ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া হলো, “আগে ‘একাডেমি’ শব্দের বাংলা বের করুন। তারপর ঈদকে ‘ইদ’ করুন। ঈ এবং ঈ-কারের ওপর বাংলা একাডেমি এত ক্ষ্যাপে কেন, বুঝতেছি না!”
লেখক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ঈদের সঙ্গে বানানের সম্পর্ক নেই। এ শব্দের বানান হবে দীর্ঘ ই-কার। তা হ্রস্ব ই-কার হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে বিতর্ক নেই।
ঈদ অর্থনীতির গুরুত্ব
দুই ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম। যারা রমজান মাসজুড়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ত্যাগ স্বীকার করে না, তারা শাওয়ালের পয়লা দিনে ঈদুল ফিতরের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করে না। তাদের দৃশ্যমান আনন্দ মূলত মেকি ও অগভীর। তেমনি কোরবানির তাৎপর্য উপলব্ধি ছাড়া যত বড় আর দামি পশুই জবাই করা হোক, তাতে পেটের দাবি পূরণ হতে পারে, ঈমানের দাবি নয়।
এ তো গেল ঈদের ধর্মীয় বা আত্মিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের কথা। ঈদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও ব্যাপক। আর ইদানীং এর যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব, সেটা জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। আয়-ব্যয়, ক্রয়-বিক্রয় মিলে ঈদ এখন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠার মহা উপলক্ষ। এটাও ঠিক, এই উপলক্ষের আড়ালে অনেক ক্ষেত্রে ঈদের মহান ও পবিত্র লক্ষ্য গৌণ হয়ে পড়ে।
যা হোক, দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতি গবেষক, রাজস্ব বোর্ডের সাবেক প্রধান এবং সরকারের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের অভিমত প্রসঙ্গক্রমে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, সাড়ে ১৫ কোটি মানুষের দেশে যেখানে মাথাপিছু জিডিপি ৮৭৫ মার্কিন ডলার, সে দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনে লাখ-কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয় শুধু নতুন পোশাক ও বিশেষ খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ে, এক-অষ্টমাংশ মানুষের স্বজনদের সাথে যোগ দিতে যাতায়াতে, গরিব ও অসহায়দের মধ্যে জাকাত বিতরণে এবং বেতনের সমপরিমাণ বোনাস বিতরণে। বাজারে একসাথে নগদ টাকার এত চাহিদা বাড়ে যে, গ্রাহকের দাবি মেটাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কলমার্কেট থেকে কঠিন সুদে টাকা জোগাড়ে নামতে হয়; কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নগদ নতুন নোটের খাজাঞ্চিখানার দুয়ার খুলে দিতে হয়। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা প্রত্যাবাসন করেন প্রায় দেড় গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অন্য সাধারণ মাসগুলোর তুলনায়, সেবা ও রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর এ সময় কর্মতৎপরতা চোখে পড়ার মতো, সেখানে ইনফরমাল আর্নিং বেড়ে যায় নানা উপায়ে, এমনকি ফরমাল বকশিশের পরিমাণও যৎসামান্য নয়।’ ঈদের প্রাক্কালে ব্যাংকিং খাতে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ার পাশাপাশি কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তারল্য সঙ্কটে পড়ে যায় আর্থিক খাত, জাল নোট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।’ তবে কথা হলো, সব সমস্যা ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে উৎসব উদযাপনের উৎসাহ।
বাংলাদেশের ঈদ, ভারতের লাভ
বাংলাদেশকে নিয়ে আর কোনো দেশের না হোক, পাশের পড়শির পোয়াবারো। ভারতে এখন উগ্র হিন্দুত্বের তাণ্ডবে মুসলমানদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এবার ঈদের মওসুমেও হরিয়ানায় একজন মুসলিমকে গরু ইস্যুতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গরুকেও কেউ এভাবে মেরে ফেলে না। তাই সে দেশে মুসলমানের উদ্বেগ-আতঙ্কের কাছে ঈদের উৎসব ও আনন্দ হয়েছে ম্লান। তবে এ দেশ, মানে বাংলাদেশের ঈদ ভারতের বেনিয়া ব্যবসায়ীদের জন্য বিরাট খোশখবর। এতে আমাদের জাতিগত লাভ-ক্ষতি কেউ খতিয়ে না দেখে কেবল মার্কেটিং মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়।
বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের বলয়ভুক্ত বুদ্ধিজীবী হয়েও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সুলেখক প্রফেসর মোহীত উল আলম সত্যটি তুলে ধরেছেন। সহকর্মীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ঈদে কলকাতায় শপিংয়ের জন্য দেড় থেকে দুই লাখ লোক দেশ ছেড়েছে। কলকাতায় নাকি কাপড়চোপড় সস্তা। ভারতে আমেরিকার ট্যুরিস্টদের পরে বাংলাদেশীদের অবস্থান। কিন্তু আমেরিকান ট্যুরিস্টরা ভারতে আসে কেনাকাটার জন্য নয়, দেশ দেখতে। অন্য দিকে কলকাতার বিগ বাজার বা দিল্লির কেরলবাগে দেখবেন, বাংলাদেশী ক্রেতা গিজগিজ করছে। ফেসবুকে নানা পোস্টের মধ্যে একটি ট্রেন্ড হলো, এ বলে অন্যদের হেদায়েত করা যে, ভারতবিদ্বেষী বহু লোক ভারতীয় জিনিস না হলে কেনে না। যা হোক, ঈদের বোনাসের একটি বড় অংশ ভারতে চলে যাচ্ছে, সে কথা শুনবে কোন জন?’
মোট কথা এবারও বাংলাদেশের ঈদুল ফিতরে ভারতের প্রচুর লাভ হলো। পোশাকপণ্যের দাম চড়া হলেও ‘ভারতীয়দের দখলে ঈদবাজার’ শিরোনাম পত্রিকার। ভারতের টিভি সিরিয়ালের নাটক আর বলিউডের সিনেমার দাপটে এ দেশের ফ্যাশন মার্কেটেও রুচির বদল ঘটে। তাই ‘পাখি’ ড্রেসের পর এখন ‘চম্পা চামেলির’ চাহিদা ব্যাপক। আর বহুলালোচিত ‘বাহুবলি’র বলপ্রয়োগ ছাড়াই ঈদবাজার এই জ্বরে কাঁপছিল। সব মিলিয়ে ভারতের ‘দুনো লাভ’ : ক) ভারতীয় পোশাক এ দেশের কিশোরী ও তরুণীদের গায়ে চড়িয়ে তার অর্থনীতির বাজার বেড়েছে। খ) ভারতীয় নায়িকা-অভিনেত্রীদের ফ্যাশনের প্রভাব ছড়িয়ে সে দেশের সংস্কৃতি এ দেশের মেয়েদের মনে আসন আরো গেড়েছে। সে দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান অবাধে দেখা যায় এ দেশের ঘরে ঘরে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমাদের কোনো চ্যানেল ওই দেশে দেখানোর কোনো সুযোগ দেয়া হয় না। ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজে পরকীয়া এবং পারিবারিক অশান্তিসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। অপর দিকে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতবিদ্বেষী নয়, তবুও তাদের অনুষ্ঠান ভারতে দেখানো হয় না। এ দিকে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের প্রভাব বাংলাদেশে বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকের ফ্যাশনেও। অতএব ঈদবাজারেও যে এই প্রভাব ব্যাপক, তা বলা বাহুল্য। বিরাট দেশটি তিন দিকে ঘিরে রাখা ছোট্ট বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ উভয় বাণিজ্যেই ভারতের রমরমা অবস্থা। বৈধ বাণিজ্যে পাহাড়সম ঘাটতি ভারতের অনুকূলে; সেই সাথে বাংলাদেশী পণ্য বৈধপথে সীমান্তের ওপারে যেতে নয়াদিল্লির নানা বাধা। অবৈধ বাণিজ্য বা চোরাচালানেও লাভের কোটি কোটি টাকা তাদের পকেটে যায়। বেশির ভাগ মুনাফা তাদের হলেও মৃত্যুর শিকার হতে হয় শুধু আমাদের। সীমান্তে গুলি করে, পিটিয়ে, বোমা মেরে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার কথা সবার জানা।
ঈদুল ফিতর : বলিউড স্টাইল
পত্রিকায় উঠেছে, বলিউডের তিন খান শাহরুখ, সালমান আর আমিরের পরিবারের ঈদ উদযাপনের কৌতূহলোদ্দীপক কথা। এদের একজন ৫১ বছর বয়সেও অবিবাহিত। অন্য দুইজনের স্ত্রীর নামে প্রতীয়মান, তারা হিন্দুঘরের মেয়ে। তবে এই দুইজনের একজন মাকে নিয়ে হজ করেছেন এবং পাকিস্তানের একজন ইসলাম প্রচারক এই নায়কের সাথে আলাপের ভিত্তিতে তার প্রশংসা করেছেন।
এই তিন খানের একজন সাল্লু মিয়া, মানে সালমান খান প্রসঙ্গে পত্রিকায় জানানো হয়েছে, তিনি রোজা রাখেন। এ মাসে সাধ্যমতো অভাবীদের সাহায্য করেন। বিশেষ করে চিকিৎসায় সাহায্যের জন্য কেউ এলে তাকে খালি হাতে ফিরতে দেন না। সালমান শৈশবে রোজার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। নিজেই বলেছেন, একটি ঘটনার কথা। রোজা রেখে সাঁতার কাটার সময়ে তার মুখে পানি ঢুকে গিয়েছিল। সালমান পেট থেকে সে পানি বের করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
এখন সালমানের ঈদ উদযাপনের ধরন হলো, তিনি তার অভিনীত ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার দিন হিসেবে প্রতি বছর বেছে নেন ঈদুল ফিতরকে। ঈদের সন্ধ্যায় প্রতি বছর ফোটান আতশবাজি। সালমান মুসলমানের ঈদের মতো হিন্দুর দীপাবলি ও গণপতি উৎসবও পালন করেন। ‘একবার গণপতি ও ঈদ একই দিনে পড়েছিল। এই দিন সালমান সকালে নামাজ পড়েন; বিকেলে বাড়িতে ভজনের ব্যবস্থা করেন। তার কথায়, ‘উৎসব ভালোবাসি, এ ক্ষেত্রে ধর্ম দেখি না।’
শাহরুখ খানের বাড়িতেই হয় ঈদের জামাত। মৌলভি সাহেব এসে নামাজ পড়িয়ে যান। এ দিন শাহরুখ ও সন্তান আব্রাম পাঠানদের পোশাক পড়েন। বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে আগত তাদের বাপদাদারা। শাহরুখ ও সালমানরা দিলীপ কুমারের (মোহাম্মদ ইউসুফ খান) মতো পাঠান বা পশতুন জনগোষ্ঠীর লোক।
আর আমির খান ছেলেকে ঈদে দেন মাত্র দুই টাকা। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পেলে স্বভাব নষ্ট হবেÑ এটাই তার যুক্তি। নিজেও দুই টাকা ঈদে পেতেন।
পাদটীকা : ক) ঈদ না ইদ বানান সঠিক, এ নিয়ে কারো কারো বেহুদা বিতর্ক প্রসঙ্গে ফেসবুকে এক তরুণীর মন্তব্য : সবাই ব্যাপারটাকে খারাপভাবে নিলেও আমি অধম ঠিকই খুশি হইছি। কারণ আমার জামাই বলছে, ‘ঈদ’ এবং ‘ইদ’ উপলক্ষে আমাকে আলাদা আলাদাভাবে সেলামি দেয়া হবে।
খ) প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর একদিন মার্কেটে যাচ্ছে মেয়ে। মাকে তার জিজ্ঞাসা : আম্মা, কী ব্যাপার? ঈদে শপিংয়ের জন্য এত কম টাকা দিলে যে! মায়ের সাফ জবাব : টাকা ঠিকই দিয়েছি। আসলে তোমার ঈদ বাজেটের ওপর ভ্যাট বসানো হয়েছে।
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন