আমাদের দেশকে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত করার ঘোষণা মাঝে মধ্যে শোনা যায়। অতীতে এটা শোনা না গেলেও সাম্প্রতিককালে সরকার উন্নয়নের ওপর দৃশ্যত যত জোর দিচ্ছে, ততই সিঙ্গাপুরের মতো ‘রোল মডেল’ হওয়ার আকাক্সক্ষা কারো কারো বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ বাস্তবে সিঙ্গাপুরের পর্যায়ে পৌঁছাতে যতই সময় লাগুক, বাংলাদেশের বহু তরুণ ও যুবক গত কয়েক বছরে সেখানে পৌঁছে গেছেন। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এই মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে, ভাগ্যান্বেষণে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছেন।
কিছু দিন আগে একজন বাংলাদেশী তার সিঙ্গাপুরে সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি সেখানে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার প্রয়োজনে ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন। যাওয়ার পথে ট্যাক্সি অনেক সময় নিচ্ছিল। ঘুর পথে গিয়ে ট্যাক্সিচালক চালাকি করছে বিদেশী যাত্রীর কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়ের মতলবে- এমনটাই বাংলাদেশের ওই নাগরিকের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল। তার গন্তব্যে পৌঁছে চালককে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘পথ তো এত দীর্ঘ নয়, জানি। তবু কেন আমাকে এত রাস্তা ঘোরালে?’ সে জানাল, আমি যদি আগের মতো সোজা পথে যেতে চাইতাম, তাহলে পুলিশ আমাকে বড় ধরনের শাস্তি দিত। কারণ রোডটা এখন ‘ওয়ানওয়ে’। বাংলাদেশী মানুষটি বুঝতে পারলেন, তার সময় ও অর্থ নষ্ট করার অভিপ্রায়ে নয়, ট্রাফিক রুল মানার জন্যই ট্যাক্সিচালককে অনেক ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। সিঙ্গাপুরের মানুষ আইন মানার ব্যাপারে অভ্যস্ত।
সম্প্রতি একজনের ভ্রমণকাহিনী পড়লাম। তিনি সিঙ্গাপুর গিয়েছেন আগেই। এবার গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু ‘বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত’ রাষ্ট্রের যে দিকটি খারাপ লেগেছে, তা হলো- সিঙ্গাপুরে টিকিট কাটতে কিংবা ট্রেনে-বাসে উঠতে গিয়ে মানুষ যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়ায়। অথচ আমেরিকায় এতটা শৃঙ্খলা নেই। যা হোক একটি এশীয় দেশ সভ্যতাদর্পী পাশ্চাত্যের চেয়ে কোনো বিষয়ে এগিয়ে থাকা কম কথা নয়।
সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক প্রভূত উন্নতির পাশাপাশি সেখানকার পরিচ্ছন্নতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার চিত্রও যে কারো দৃষ্টি কেড়ে নেয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তো সিঙ্গাপুর এ দিক দিয়ে অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় সফলতা অর্জন করেছে। কারণ আমাদের দেশে জনগণ সাধারণত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে মোটেও সচেতন নয়। রাস্তাঘাটসহ পাবলিক প্লেস দেখলেই তা বোঝা যায়। তিলোত্তমা রাজধানীতেও অবাধে প্রকাশ্য স্থানে যত্রতত্র যখন তখন মূত্রত্যাগের মতো নোংরা ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে ফুটপাথ, পার্ক, উদ্যান, লেক পর্যন্ত রেহাই পায় না। এমনকি, প্রকাশ্যে জাতীয় গোরস্থানের গা ঘেঁষে ‘জলবিয়োগ’ করার দৃশ্যও দেখা যায়। আর কফ-থুথু, পানের পিক ও সর্দি ফেলার কথা কী বলব। এটা তো পরিষ্কার ফুটপাথ, জনাকীর্ণ স্থান, ভবনের সিঁড়ি ও দেয়ালসহ অনেক জায়গায়ই অহরহ দেখা যায়। তদুপরি, বাংলাদেশে অনিয়মই নিয়ম। বিশৃঙ্খলা আমাদের স্বভাবের মজ্জাগত। এ দেশে শুধু জাকাতের কাপড়ের জন্য দরিদ্র-অশিক্ষিত মানুষকেই নয়, জীবনের নানা ক্ষেত্রে সচ্ছল ও শিক্ষিত মানুষদেরও লাইনে দাঁড় করানো কঠিন কাজ। এই প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুরের নিয়মবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জনজীবন আমাদের জন্য বিস্ময়কর বৈকি। তবে গবেষণা করে দেখা দরকার, নিছক আইনের কড়াকড়ি না আরো কিছু কারণে সিঙ্গাপুর নিয়ম-শৃঙ্খলায় এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
সিঙ্গাপুরের বাস্তবতা হলো, নগররাষ্ট্রটি প্রকৃতির সম্পদ থেকে বঞ্চিত। এটা তার দুর্ভাগ্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার গুণে, জ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থের সম্মিলনে অন্যান্য সম্পদ অর্জন করে সিঙ্গাপুর প্রকৃতিবঞ্চনার আপাত দুর্ভগ্যের সৌভাগ্যে রূপান্তর ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৃতির দানে সমৃদ্ধ। কিন্তু আমরা অবহেলা, অপচয় ও অদূরদর্শিতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশের শুধু ক্ষতি নয়, এটাকে ব্যাপকভাবে বিপন্ন করছি।
এবার একটি ইংরেজি পত্রিকায় সিঙ্গাপুরের বিস্ময়কর উত্থানের বিষয়ে একটি নিবন্ধে বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঙ্গনে এর নজিরবিহীন সাফল্য ও অগ্রগতির বিষয়ে লেখা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সিঙ্গাপুরের চালচিত্র আদর্শস্থানীয় না হলেও বাংলাদেশ প্রধানত শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ অর্থনীতি এবং সেইসাথে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ও পরিবেশসমেত সামাজিক ক্ষেত্রে এই ছোট্ট দেশটি থেকে বড় শিক্ষা নিতে পারে।
সিঙ্গাপুর ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এখানেই তার বহুলালোচিত আজাদ হিন্দ ফৌজের (আইএনএ) সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল জাপানের দখলে। কয়েক বছর পরে সিঙ্গাপুর এবং সংলগ্ন মালয়েশিয়া ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটি ফেডারেশনের আওতায়। তবে বিরোধ সৃষ্টি হলে ’৬৫ সালে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর থেকে বহিষ্কৃত হয়। এটাই তার জন্য ‘শাপেবর’ হয়েছে। ডেইলি স্টারে সিনজেন্টা বাংলাদেশ-এর এমডি সাজ্জাদুল হাসান তার লেখার শুরুতেই বলেছেন, It was one of history's rare instances when a country's independence was declared with tears and broken hearts and not with joy (এটা ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্তগুলোর একটি যে, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অশ্রু বিসর্জন করে এবং ভাঙা মন নিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল। আনন্দের সাথে এই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়নি) সিঙ্গাপুর প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে। সেদিনের সিঙ্গাপুরকে আজকের ঈর্ষণীয় অবস্থানে উন্নীত করার পেছনে সর্বাধিক অবদান এই রাষ্ট্রের স্থপতি লি কুয়ান ইউর। চীনা বংশোদ্ভূত লি পেয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এস রাজারত্নমের মতো দূরদর্শী সহকর্মীদের। লির নেতৃত্বেই সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায় যোগ দিয়েছিল। বাস্তবতা হলো- মালয়েশিয়ায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী মালয়ী জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সিঙ্গাপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে অমুসলিম চীনা জনগোষ্ঠী। সিঙ্গাপুরের অভিযোগ ছিল, মালয়েশিয়ার সংবিধানে মালয়ী জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়ায় চীনারা বঞ্চিত হবে। এই বিরোধের পরিণামে ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা পর্যন্ত ঘটে যায় যার ফলে বহু নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকে নিজের ‘ঐতিহ্যের প্রতি হুমকি’ মনে করে এবং পার্লামেন্টে সিঙ্গাপুরকে ফেডারেশন থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিঙ্গাপুর আলাদা হওয়ার পর কিন্তু লি কুয়ান ইউ স্থানীয় মালয়ী জনগোষ্ঠীকে প্রতিহিংসার টার্গেট করেননি, বরং সিঙ্গাপুরের চারটি সরকারি ভাষার একটি হলো মালয়ী ভাষা। অন্য তিনটি হচ্ছে- ইংরেজি, চীনা (ম্যান্ডারিন) এবং তামিল।
লি কুয়ান ইউ ছিলেন গতিশীল, দূরদর্শী, ক্যারিশমেটিক- সর্বোপরি দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের প্রতীক। তিনি সম্পদবিহীন সিঙ্গাপুরকে সম্পদসমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তার রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার দরুন। তিনি নিছক দলনেতা কিংবা চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে নিজেকে ভাবেননি। চীনা, মালয়ী ও তামিল- এই তিনটি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সিঙ্গাপুরে ধর্মকেন্দ্রিক, ভাষাভিত্তিক বা নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদকে উসকে না দিয়ে তিনি জাতীয় ঐক্য গড়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্ব সবার আস্থাভাজন ছিল বিধায় পৃথক ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের অনুসারী চীনা, মালয়ী এবং ভারতীয় বা তামিল জনগোষ্ঠীকে তিনি এক সূত্রে গ্রথিত করে একটি নতুন জাতি গড়তে সক্ষম হয়েছেন।
২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউএনডিপি। এতে জানানো হয়েছে, মানব উন্নয়ন সূচকের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুর পৃথিবীতে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে। এ দিক দিয়ে দেশটি ১০০-এর মধ্যে পেয়েছে ৯২-এর বেশি নম্বর। আইএমএফের ডাটা থেকে দেখা যায়, বিশ্বে মাথাপিছু জিডিপির দিক দিয়ে সিঙ্গাপুরের অবস্থান তৃতীয়। এর পরিমাণ ৮৭ হাজার ৮৫৫ ডলার। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার সময়ে সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৫০০ ডলার। অর্থাৎ তা বেড়ে ১৭৫ গুণেরও বেশি হয়েছে। ‘ওয়েলথ ইনসাইট’র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে; ক্ষুদ্র সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের ‘মিলিয়নেয়ার’ বলা যায়, এমন বিত্তবানের সংখ্যা দেড় লাখ। আগামী বছরের মধ্যেই সিঙ্গাপুরে আরো ৩০ হাজার ব্যক্তি মিলিয়নেয়ারদের তালিকায় শামিল হবেন। অর্থাৎ সেখানে প্রতি ৩৬ জনের মধ্যে একজন মিলিয়নেয়ার আছেন। সিঙ্গাপুরের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে উদ্যোক্তার বিপুল সংখ্যার জন্য। বর্তমান বিশ্বের ‘সর্বাধিক উন্নত ও শক্তিশালী’ হিসেবে গণ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে এত বেশি উদ্যোক্তা নেই।
সিঙ্গাপুরের মানুষ দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে স্বাধীন হয়েছিল। আর এখন সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম সেরা Financial Hub হওয়ায় সেখানকার নাগরিকদের যেন ‘আনন্দের শেষ নেই’। ‘ফিন্যানশিয়াল হাব’ মানে, অর্থনৈতিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। সিঙ্গাপুরের জাতীয় নেতৃত্বের অক্লান্ত প্রয়াস ও নিষ্ঠার বলে স্বাধীনতার মাত্র সাত বছরের মাথায় বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পাদপীঠ হয়ে ওঠে সিঙ্গাপুর। তখনই দেখা গেছে, মার্কিন ও জাপানি বিনিয়োগকারীরা সিঙ্গাপুরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন বিপুল সংখ্যায়। ওই সময়ে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশের বেশি হতে থাকে।
সিঙ্গাপুর আজকের পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পেছনে দু’টি কারণ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভৌগোলিকভাবে সিঙ্গাপুরের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সর্বপ্রধান সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটে এর অবস্থান। এটি হলো টোকিও-সিউল-হংকং-সিঙ্গাপুর-কলম্বো-এডেন-সুয়েজখাল হয়ে ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপ; এরপর আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্ক। এখন সিঙ্গাপুর বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে কর্মব্যস্ত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। বিমান যোগাযোগের দিক দিয়েও বিশ্বের যে ক’টি বিমানবন্দরের নাম আসবে সবার আগে, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি তার মধ্যে একটি।
সিঙ্গাপুরের অভাবনীয় অগ্রগতির আরেক কারণ, দেশটির মূল স্থপতি এবং ‘জাতির পিতা’তুল্য ব্যক্তিত্ব লি কুয়ান ইউ স্বপ্নদ্রষ্টা ও কর্মোদ্যোগী ছিলেন, তবে যোগ্য সহকর্মী ছাড়া তার স্বপ্ন হয়তো সফল করা সম্ভব হতো না। সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে লির সাথে যে দু’জন অসাধারণ নেতাকে স্মরণ করতে হয়, তারা হলেন এস রাজারত্নম এবং গোহ কেং সুঈ। লি তাদের দূরে না ঠেলে, ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছিলেন।
সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বলতে শুধু ‘অর্থ’ই বোঝায় না। দেশী-বিদেশী অজস্র উদ্যোক্তা সিঙ্গাপুরকে বিনিয়োগের সর্বাধিক উপযুক্ত স্থান মনে করেন প্রথমত, নিরাপত্তা এবং দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিহীনতার কারণে। যে সব দেশ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য, বড় বড় আমলাদের ঘুষের তাণ্ডব, রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্দশার শিকার, সেখানে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট তো হবেই না, বরং দেশী উদ্যোক্তারাও অন্য দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খোঁজেন। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হতে কত দিন লাগবে, তা দুই দেশের বর্তমান অবস্থার তুলনা করলে স্পষ্ট হবে।
শুধু অর্থনীতি নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতির অগ্রগতির জন্য সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব অপরিহার্য। এই নেতৃত্বের চিন্তাভাবনা হবে গোষ্ঠী নয়, দেশবাসীর স্বার্থে; তার কর্মপ্রয়াস আবর্তিত হবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের বৃত্তে। পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়, আগামী কয়েক দশকে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দিকে এই নেতার নজর থাকা চাই। তার থাকতে হবে রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টি এবং পরমত সহিষ্ণুতা, নিঃস্বার্থপরতা, উদারতার মতো মানবিক গুণ।
আলোর পাশে অন্ধকার
সিঙ্গাপুরের অনেক ভালো দিকের সাথে কিছু মন্দ দিকও রয়েছে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং এগুলো পরিহার করা উচিত গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই। বিশেষ কোনো দেশ বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে কিংবা প্রেক্ষাপটে যতটা উন্নতি করতে পারে, তা পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে অন্যান্য দেশের পক্ষে করা হয়তো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই সিঙ্গাপুরের ভালোমন্দ নির্বিচারে কিংবা অন্ধ অনুসরণ নয়, তার সাফল্যের মূলনীতিগুলো অনুধাবন করে স্বদেশের বাস্তবতার আলোকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কার্যকর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থান ছাড়া প্রবৃদ্ধি যেমন কাম্য নয়, তেমনি সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন অর্থহীন।
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো, ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন এবং সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বল্পসময়েই শিল্প-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-উৎপাদন, তথা অর্থনীতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উত্থান। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষুদ্র নগর- রাষ্ট্রটি আধুনিক বিশ্বের রোল মডেল। তবে এর বিপরীতে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর গণতন্ত্রের বিচারে অনেক ক্ষেত্রেই তীব্র সমালোচনার টার্গেট হয়েছে যৌক্তিক কারণেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার যেমন প্রশংসা আছে, তেমনি নিন্দাও কম নয়। বিভিন্ন মহল অভিযোগ করে আসছেন, সিঙ্গাপুরে ক. নির্বাচিত সরকারের নামে কার্যত এক দলের শাসন চলছে, যাতে বরাবর ‘জাতির জনক’ লি চুয়ান ইউর পরিবারের কর্তৃত্ব থাকে। খ. বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তথা কার্যকর গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধক খাড়া করে রাখা হয়েছে। গ. ভিন্নমত দলন ও মৌলিক অধিকার হরণসহ নানাভাবে নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা অব্যাহত রয়েছে।
অভিযোগগুলো গুরুতর এবং সিঙ্গাপুরের ইমেজ কিছু না কিছু এতে ক্ষুণœ হয়ে থাকে। তবে ক্ষুদ্র দেশটির সরকার বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এসব আপত্তি ও বিরোধিতাকে গুরুত্বহীন মনে করে। দেশটি প্রধানত অর্থনীতি এবং এর সাথে সামাজিক কিছু ক্ষেত্রে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, রাজনীতির দিক দিয়ে, গণতন্ত্রের বিবেচনায় সিঙ্গাপুর রোল মডেল হওয়া দূরের কথা, সংসদে একনাগাড়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের Brute Majority শাসন চলছে অবাধে।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত নয় বিশেষ কোনো দেশের প্রতি অন্ধ অনুরাগ বা বিরাগ পোষণ করা। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র, ইনসাফ, ইসলামি আদর্শ, মানবাধিকার, শান্তিশৃঙ্খলা, বৈষম্যহীনতা, নীতিনৈতিকতা, মানবিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোনো দেশই প্রকৃতপক্ষে রোল মডেল বলে বড় গলায় নিজেকে দাবি করতে পারে না। আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রাষ্ট্রই তার বিঘোষিত নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পূরণ করছে না কিংবা এতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই সবার রোল বা ভূমিকাই আজ কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ।
যদি সুশাসনকে এড়িয়ে ‘উন্নয়ন’কে মুখ্য করে তোলা হয়, তাহলে অর্থনীতির হয়তো প্রবৃদ্ধি হবে; কিন্তু রাজনীতি ও সমাজনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশের মান বৃদ্ধি ঘটবে না। তখন দেখা যাবে, সরকার নির্বাচিত হলেও গণতান্ত্রিক নয় এবং জিডিপির সাথে সমাজে বৈষম্যও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের নামে দলতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্র এবং সমৃদ্ধির নামে শোষণ চায় না। কথিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী কোনো মহলের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে দেয়া যায় না। নিকট অতীতে দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ড দীর্ঘ সামরিক শাসন তথা নাগরিক অধিকারহীনতার মধ্যেও অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত রেখেছিল। তাই বলে কি জিডিপি আর প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নেশায় আমরাও গণতন্ত্রের বদলে স্বেচ্ছাচার আর কুশাসনকে বেছে নেবো? নিশ্চয়ই নয়।
পাদটীকা : সিঙ্গাপুরের নির্বিচার অনুকরণ নয়, সুবিবেচনাপূর্ণ অনুসরণই কাম্য। সে দেশে আইনের কড়াকড়ি যেমন অনেক সুফল দিয়েছে, তেমনি কখনো বা আইনের বাড়াবাড়ি প্রশাসনকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর সর্বশেষ নজির সিঙ্গাপুরের একটি বিচারের ঘটনা।
এএফপি সিঙ্গাপুর থেকে জানিয়েছে, জাতিসঙ্ঘ সিঙ্গাপুর সরকারকে অনুরোধ করেছে একজন মালয়েশীয় নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার জন্য। এ ক্ষেত্রে বিশ্বসংস্থার যুক্তি হলো, মাদক চোরাচালানের জন্য অভিযুক্ত লোকটির আপিল মালয়েশিয়ার আদালতে শুনানির অপেক্ষায়। পত্রিকার খবরে জানা যায়, প্রভাকরণ শ্রীবিজয়ান নামের তামিল বংশোদ্ভূত এই লোক ২২ গ্রামের মতো হেরোইন পাচারের দায়ে সিঙ্গাপুরের আদালত তাকে সর্বোচ্চ দণ্ড দিয়েছে। অপর দিকে, লোকটি বরাবর নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে আসছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা তার পরিবারের সূত্রে জানিয়েছে, গত শুক্রবার তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা।
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন