রুশ কথাসাহিত্যিক বরিস পাস্তারনাক তার ‘ডা: জিভাগো’ গ্রন্থের জন্য নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট সরকার তাকে এই পুরস্কার গ্রহণ করতে দেয়নি। উপরন্তু চাপ দিয়ে এ মর্মে বিবৃতি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয় যে, পাস্তারনাক নোবেল প্রাইজ ‘প্রত্যাখ্যান’ করছেন। অর্ধশতাব্দী পরে ২০১০ সালে চীনের মানবাধিকার সংগ্রামী, কবি লিউ জিয়াওবো নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট সরকার তাকে এই পুরস্কার গ্রহণের জন্য মুক্তি পর্যন্ত দেয়নি কারাগার থেকে, বরং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্দী অবস্থায় কাটিয়ে অসুস্থ জিয়াওবো (৬২) সম্প্রতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মারাত্মক ব্যাধির শিকার জিয়াওবোকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতিও দেয়নি বেইজিং সরকার।
চীনের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে গত চার দশকে, কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মাও সে তুং আমলের সেই দমনপীড়ন, ধর্মবিদ্বেষ, বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার হরণ, পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনজীবনে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, চরম কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসন প্রভৃতির কোনো হেরফের হয়নি। অর্থনীতি পুঁজিবাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলেও রাজনীতি ও ধর্মসহ সমাজজীবনের অন্যান্য অঙ্গন আজো মুক্ত হতে পারেনি সমাজবাদী নিগড় থেকে।
নোবেল পুরস্কারকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মাননা মনে করা হয়, কিন্তু এ পুরস্কারে ভূষিত হওয়া চীনের রাষ্ট্রশক্তির কাছে বিরাট ‘অপরাধ’ লিউ জিয়াওবোর। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের গণবিক্ষোভে অংশ নিয়ে এবং ২০০৮ সালে চীনের গণতন্ত্রকামীদের সনদে স্বাক্ষর করে তিনি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে আগে থেকেই ছিলেন ‘অপরাধী’। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন মহলের বারবার অনুরোধ-আহ্বান সত্ত্বেও জিয়াওবোকে মুক্তি না দিয়ে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায়ই তাকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হলো।
এই সনদের বক্তব্যের নিরিখে শুধু চীন নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সব দেশেরই সরকারসহ ক্ষমতাসীন মহলের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আজ যখন দেশে দেশে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী প্রহসন, দলীয় স্বেচ্ছাচার ও সংখ্যাগরিষ্ঠের জবরদস্তিকে নিয়মে পরিণত করা হচ্ছে; জাতীয়তাবাদের নামে সাম্প্রদায়িকতা ও গোষ্ঠীবিশেষের অন্যায় আধিপত্য কায়েমের পাঁয়তারা চলছে- তখন এটা আরো বেশি জরুরি হয়ে উঠছে
‘উদার অর্থনীতি’র সাথে সামঞ্জস্য রেখে ‘উদার’ রাজনীতিসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এনে চীন তার ইমেজ অনেক উন্নত করতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেসব রাষ্ট্র ও মহল তার প্রতিপক্ষ, তাদের সমালোচনার মুখ তখন বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু মতাদর্শ অনুসরণের নামে মতান্ধতা ও একগুঁয়েমির দরুন চীন সে সুযোগ আবার হাতছাড়া করেছে লিউ জিয়াওবোকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি না দিয়ে।
চীনের খ্যাতনামা ভিন্নমতাবলম্বী লিউ জিয়াওবো আমৃত্যু, কয়েক বছর ধরে সরকারের হাতে নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। অতীতে চীনের বিশেষ করে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর সময়ে ক্ষমতার অঙ্গনের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলসহ অনেকেই এমন নিগ্রহ-নিপীড়ন ভোগ করেছিলেন। তবে চীনের এসব ঘটনা তেমন প্রকাশ পায়নি কঠোর গোপনীয়তার কারণে। অপর দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়ার পূর্বসূরি) ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দীর্ঘকাল ধরে যে নির্যাতন ও হয়রানি চালানো হয়েছিল, তার অনেকটাই জানা যায়। কারণ, তাদের অনেকে দেশ ত্যাগ করে বাইরে কোনো রাষ্ট্রে (প্রধানত পাশ্চাত্য) আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। তখন মিডিয়ার কল্যাণে অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যায় এবং তাদের কেউ কেউ নিজেদের লেখায়ও সেই করুণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
চীনের আলোচিত ব্যক্তিত্ব লিউ জিয়াওবো ১৯৫৫ সালে দেশটির উত্তর-পূর্বাংশের একটি স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গণতন্ত্রকামী এবং মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক তো বটেই, একই সাথে ছিলেন কবি ও সাহিত্য সমালোচক। সমাজতান্ত্রিক ‘লাল’ চীন প্রতিষ্ঠার ঠিক অর্ধশতাব্দীর মাথায় ১৯৮৯ সালের বসন্তকালে গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন হঠাৎ চীনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বেইজিংয়ে সংঘটিত সেই নজিরবিহীন গণবিক্ষোভ সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মিসরে যেমন কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে সমবেত হয়ে সংগ্রামী জনতা আরব বসন্তের সূচনা করেছিল, তেমনি বেইজিংয়ের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে সমবেত মানুষের বিক্ষোভ বসন্তের মাঝে গ্রীষ্মের উত্তাপ সঞ্চার করেছিল ’৮৯ সালে। সেই আন্দোলনে অন্য অনেকের সাথে বিশেষ ভূমিকা ছিল লিউ জিয়াওবোর। সরকার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেই বিক্ষোভ দমিয়ে দেয়ার পর তাকে দুই বছর জেলে কাটাতে হয়। এরপর আপাতত কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও পুলিশের হাতে ঘন ঘন হয়রানি এবং বারবার গ্রেফতার হওয়ার মতো ঘটনা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। লেখালেখি আর রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে দফায় দফায় তাকে কারারুদ্ধ হতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর জিয়াওবোকে গ্রেফতার করা হয় ‘চার্টার-০৮’ নামে মানবাধিকারসংক্রান্ত দাবিপত্রে স্বাক্ষর দেয়ার অভিযোগে। এটি ছিল এমন একটি ঘোষণা, যাতে আহ্বান জানানো হয় চীনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কায়েমের জন্য। তা ছাড়া চীনে ১৯৪৯ থেকে অব্যাহত আছে একদলীয় যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, এর অবসান ঘটানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। জিয়াওবোকে গ্রেফতারের ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দেখা গেল, চীনের সাড়ে আট হাজারের বেশি নাগরিক এই চার্টার বা সনদে সই করে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এ দিকে লিউ জিয়াওকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে এবং এমনকি কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না এনেই বেইজিং নগরীর অজ্ঞাত স্থানে বন্দী রাখা হয়। এভাবেই তার বাকি জীবন কেটে যায়।
অপর দিকে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘দি নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’ সূত্রে জানা যায়, চীনের দুই হাজারেরও বেশি নাগরিক ‘চার্টার-৭৭’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সুদীর্ঘ যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে চেকোশ্লোভাকিয়ার দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবী একটি অনানুষ্ঠানিক ও মুক্ত সংগঠন গড়েছিলেন। এর স্মরণেই চীনের চার্টার-৭৭। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোটের সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালে চেকোশ্লোভাকিয়া ছিল একদলীয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। তদানীন্তন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সে দেশে ও সারা বিশ্বে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের মর্যাদা কায়েমের জন্য ব্যক্তিগতভাবে ও সামষ্টিকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে চার্টার-৭৭ প্রণীত হয়েছিল। এর অনুপ্রেরণায় ২০০৮ সালে চীনের গণতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীরা প্রণয়ন করেন ‘চার্টার-০৮’। এতে স্বাক্ষরদাতাদের প্রথম কয়েকজনের মধ্যেই ছিলেন প্রতিবাদী কবি ও কর্মী লিউ জিয়াওবো।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে লিউ জিয়াওবোকে গ্রেফতার ও বন্দী করার ঠিক আগে তার ছবি তুলেছিলেন স্ত্রী লিউ জিয়া। এতে দেখা যায়, জিয়াওবো কাঁধে একটি পুতুল নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তার এমন কিছু ছবি গোপনে চীনের বাইরে পাঠানো হয়। লিউ জিয়া বলেছেন, ছবিগুলো তার সন্তানতুল্য ‘বোবা পুতুল’, যেগুলো চীনা জনগণের বর্তমান অবস্থার প্রতীক। উল্লেখ্য, লিউ দম্পতির উভয়েই কবি ও মানবাধিকার কর্মী। ‘চার্টার-০৮’ রচনায় সহায়তা করায় লিউ জিয়াওবোকে গ্রেফতার করা হয়। তবে চীন সরকার বলেছে, তিনি ‘রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নাশকতায় লিপ্ত’ ছিলেন। তার স্ত্রীকে বেইজিংয়ের বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কবি লিউ জিয়াওবোকে শুধু আটকই করা হয়নি, সরকার তাকে ১১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল।
২০০৮ সালের সেই সনদ
চীনের সচেতন নাগরিকদের এই গুরুত্বপূর্ণ সনদে বিশ্বজনীন ও গুরুত্ববহ কয়েকটি মূলনীতি উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হচ্ছে- স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সমতা, প্রজাতন্ত্রবাদ, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন।
চার্টার-০৮ শীর্ষক এই সনদে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। যেমন- নতুন সংবিধান প্রণয়ন, ক্ষমতা পৃথকীকরণ, প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আইন পরিষদ বা পার্লামেন্ট গঠন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, জনসেবক বা সরকারি কর্মচারীদের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকারের গ্যারান্টি, ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির ভিত্তিতে প্রশাসনিক প্রধানদের নির্বাচন, গ্রাম-শহর সমতা, সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার, মত প্রকাশের সুযোগ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মগজ ধোলাই তথা সরকারের মতাদর্শে ও ক্ষমতাসীন দলের দীক্ষা দেয়ার রাজনৈতিক কারিকুলাম বাতিল, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা, আর্থিক ও কর ব্যবস্থার সংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং অতীতে রাজনৈতিক অবমাননা ও চরিত্র হননের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
গণতন্ত্রের ব্যাপারে এই সনদের বক্তব্য সবার প্রণিধানযোগ্য। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক নীতি হলো- জনগণ সার্বভৌম এবং তারাই তাদের সরকার নির্ধারণ করবে। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য- ১. রাজনৈতিক শক্তির উৎস হচ্ছে জনগণ এবং তাদের ওপরেই সরকারের বৈধতা নির্ভরশীল। ২. রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় জনগণের পছন্দের ভিত্তিতে। ৩. নিয়মিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বাছাই করা হবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রধান পদগুলোতে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের। ৪. সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মর্যাদার পাশাপাশি সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের মানবাধিকার ও স্বাধীনতাও সুরক্ষা পাবে।
চার্টার-০৮ নামের সনদটিতে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক শাসনে আইনের প্রাধান্য থাকবে এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের সাথে সরকারের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে, যদি সরকার বৈধ হয়, তবুও।
‘চার্টার-০৮’-এ চীনের গণতন্ত্রকামী বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, স্বাধীনতা হচ্ছে বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের সারবস্তু। স্বাধীনতা বলতে বোঝায়- কথা বলা, সংবাদপত্র, সমাবেশ, সংগঠন, বসবাসের স্থান নির্বাচন, ধর্মঘট ও বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা। মানবাধিকার প্রসঙ্গে এই সনদে বলা হয়, মর্যাদা ও স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অধিকার নিয়েই প্রত্যেক মানুষ পৃথিবীতে এসে থাকে। আর সরকারের দায়িত্ব হলো, নাগরিকদের মানবাধিকারকে নিরাপদ রাখা। এই সনদে উল্লেখ করা হয়েছিল, চীনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক বিপর্যয় হচ্ছে মানবাধিকারের প্রতি শাসক মহলের অবজ্ঞার প্রত্যক্ষ পরিণতি। সমতা প্রসঙ্গে বলা হয়- পেশা, জেন্ডার, ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেকের মর্যাদা ও স্বাধীনতার সমতা চাই।
২০০৮ সালের আলোচ্য সনদে করণীয় হিসেবে কয়েকটি পরামর্শ দেয়া হয়েছিল সরকারকে। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠেই আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। বিচারকদের অবশ্যই হতে হবে স্বাধীন। সাংবিধানিক সর্বোচ্চ আদালত এবং সংবিধান পর্যালোচনার বিধান থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ও আইনগত বিষয়ের সব কমিটি যত শিগগির সম্ভব বাতিল করা উচিত। এসব কমিটির মাধ্যমে বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর- এমন মামলার ব্যাপারে আদালতের বাইরে আগেভাগেই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।’
‘জনসেবকদের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ’ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়- ‘একটি দল নয়, জাতীয় সরকারের কাছেই সশস্ত্রবাহিনীর জবাবদিহিতা থাকা উচিত। সামরিক ব্যক্তিরা সংবিধানের আনুগত্যের শপথ নিতে হবে এবং নির্দলীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সশস্ত্রবাহিনীতে রাজনৈতিক সংগঠন গড়াকে নিষিদ্ধ করতে হবে। পুলিশসহ সব সরকারি কর্মকর্তাকে হতে হবে নিরপেক্ষ। সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের বর্তমান প্রবণতার অবসান ঘটাতে হবে অবশ্যই।’
মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সনদে অভিমত প্রকাশ করা হয়, “সরকার যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য ‘মানবাধিকার কমিটি’ গঠন করা উচিত। এটি সর্বোচ্চ আইন পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার অবকাশ থাকবে এবং বেআইনিভাবে গ্রেফতার, অন্তরীণ, মামলা, জেরা, শাস্তি ইত্যাদি করা যাবে না।”
চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয় আজো খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াংয়ের পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করলে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ধর্মীয় অধিকার সম্পর্কে ‘চার্টার-০৮’ উল্লেখ করেছিল, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনে সরকারি হস্তক্ষেপ থাকতে পারবে না। ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী সব আইন ও বিধান বাতিল করা উচিত।’
চীনের যেসব এলাকায় জাতীয় সংখ্যালঘুদের বাস, ‘মুক্তমনে’ সেখানকার সমস্যা নিরসনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, সব ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নতিই কাম্য হওয়া উচিত।
অতীতে ভিন্ন চিন্তা, বিশ্বাস বা বক্তব্যের কারণে অনেককেই রাজনৈতিকভাবে লাঞ্ছিত, হেয় ও অমর্যাদা করা হয়েছে। পরিজনসহ তাদের সম্মান প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়, রাষ্ট্র তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া দরকার। সব রাজনৈতিক বন্দী ও ‘বিবেকের বন্দী’র মুক্তির দাবির পাশাপাশি অতীতের অবিচার-অত্যাচারের প্রতিকারার্থে ‘ট্রুথ ইনভেস্টিগেশন কমিশন’ গঠনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
শেষ কথা : এই সনদের বক্তব্যের নিরিখে শুধু চীন নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সব দেশেরই সরকারসহ ক্ষমতাসীন মহলের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আজ যখন দেশে দেশে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী প্রহসন, দলীয় স্বেচ্ছাচার ও সংখ্যাগরিষ্ঠের জবরদস্তিকে নিয়মে পরিণত করা হচ্ছে; জাতীয়তাবাদের নামে সাম্প্রদায়িকতা ও গোষ্ঠীবিশেষের অন্যায় আধিপত্য কায়েমের পাঁয়তারা চলছে- তখন এটা আরো বেশি জরুরি হয়ে উঠছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন