কয়েক দিন আগে ডিম দিবসে ডিম নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে ঢাকায়। ডিম নিয়ে যে দিবস আছে, সেটাই জানা ছিল না। পরদিন পত্রিকায় ডিম নিয়ে ডাণ্ডাবাজি করে মানুষ ‘ঠাণ্ডা’ করার ‘গরম খবর’ পড়ে বুঝতে পারি, এত হাবিজাবি বিষয়ে ‘দিবস’ থাকলে ডিম সম্পর্কিত ‘ডে’ বা দিবসও থাকতে পারে। আমাদের দেশে এর আগে কখনো ‘এগ ডে’ (ডিম দিবস) পালনের কথা জানা যায়নি। যেভাবে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ‘দিবস’ নিয়ে মাতামাতির হিড়িক বাড়ছে, মনে হয় আগামী দিনে বছরের প্রতিটি দিনই কোনো-না-কোনো ‘দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হবে।
যা হোক, সপ্তাহ দুয়েক আগে রাজধানীর খামারবাড়িতে সস্তায় ডিম কেনা নিয়ে হইহাঙ্গামা, পুলিশের পিটুনি, বহু ডিম নষ্ট হওয়া, বাকি ডিম নিয়ে উদ্যোক্তাদের প্রস্থান বা পলায়ন, দূর থেকে এসেও ডিম কিনতে না পারার দুঃখ ইত্যাদি অঘটন ঘটে গেছে। তবে এসব ব্যাপারে আলোচনা, আহাজারি, কার্টুন, ছড়া, লেখালেখি, রঙ্গব্যঙ্গ, প্রভৃতি চলছেই। এ অবস্থার মধ্যে দোকানে ডিম কিনতে গিয়ে শুনি, ডিমের দাম আরো বেড়েছে।
দিবসটা ‘আণ্ডার’ পিটুনি ডাণ্ডার
ডিম দিবসে রাজধানীর ফার্মগেটের কাছে খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন চত্বরে সস্তায় ডিম কিনতে গিয়ে মানুষের হয়েছে ‘তিন অবস্থা’। অতীতে কখনো ডিম দিবস পালনের কথা শোনা যায়নি কিংবা এভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো কোনো পণ্য বিক্রির কর্মসূচিও নেয়া হয়নি। কাণ্ডজ্ঞান থাকলে উদ্যোক্তারা আগেই বুঝতে পারতেন, বাজারে ডিমের যে দাম আর জিনিসটির যত চাহিদা, তার সাথে ‘বাঙালির হুজুগ’ মিলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। বাস্তবেও তা ঘটল। পুলিশ থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি; করা সম্ভব ছিল না। অবস্থা দাঁড়ায়, ‘নিতে এসে আণ্ডা, খেতে হলো ডাণ্ডা’। এভাবে লোকজনকে আপাতত ঠাণ্ডা করা গেলেও ডিমের বাজার ঠাণ্ডা না হয়ে আরো ‘গরম’ হয়ে উঠেছে। কম দামে ডিম বেচার এই আয়োজন করেছিল সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং পোলট্রি মালিকদের সংগঠন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তারা এভাবে ডিম বিক্রি না করে বরং বাজারে ডিমের দাম কমানোর পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল। ঘোষণা করা হয়েছিল প্রতিটি ডিম তিন টাকা দরে জনপ্রতি ৫০টি করে ডিম বিক্রি হবে।
পরে বলা হলো, ৫০টি নয়- ২০টি করে ডিম কিনতে পারবেন একেকজন। জানা গেছে, উদ্যোক্তারা ভেবেছিলেন- হাজার ত্রিশেক মানুষ আসবে ডিম কিনতে। মানুষ নাকি ভিড় করেছিল অর্ধলক্ষ। সেখানে ডিম কেনার জন্য উদগ্রীব ও অস্থির মানুষের লাইন এত লম্বা ছিল, যা দেখে অনেকের মাথা ঘুরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হইচই ও ঠেলাধাক্কা অচিরেই মারামারি, ভাঙচুর, ধাওয়া, লাঠিপেটা প্রভৃতি মিলে অবর্ণনীয় হাঙ্গামায় পর্যবসিত হয়েছিল। বঞ্চিত-বিক্ষুব্ধ লোকজন মঞ্চের সাথে অজস্র ডিমও ভেঙে ফেলে। পত্রিকায় খবর দেয়া হয়েছে, অনেকে সাভার ও টঙ্গির মতো দূরবর্তী এলাকা থেকেও ছুটে এসেছিলেন। সপরিবারেও অনেকে আসেন ডিম কেনার উদ্দেশ্যে। সস্তায় ডিম পাওয়ার মিশনে ব্যর্থ হয়ে একজন পস্তাতে পস্তাতে বলছিলেন, ‘সেই সাভার থেকে এত কষ্ট করে এলাম; পুরো সময় আর পয়সাটাই নষ্ট হয়ে গেল।’
একজন পরম সৌভাগ্যবানের ছবি দেখলাম যাকে তিনজন পুলিশ পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, তিনি কয়েকটি ডিম কিনেছেন তিন টাকা করে। এগুলো ঈর্ষা করে যে-কেউ ছিনিয়ে নিতে অথবা ক্রোধের কারণে ভেঙে দিতে পারে। মিডিয়া ডিম দিবসের হাঙ্গামাটাকে বড় করে দেখেছে; কিন্তু আসল সমস্যার গায়ে হাত লাগায়নি। তা হলো, যদি ডিমের হালি ১২ টাকা করে বিক্রি করা যায়, তা হলে বাজারে হালি কেন ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা? পোলট্রি মালিকেরা ব্যবসায়ী মানুষ। অতএব, মুনাফার জ্ঞান তাদের টনটনে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ১২ টাকা দরে হাজার হাজার ডিম (ধরে নেয়া যায়, আসলে কয়েক লাখ) বিক্রি করে বিরাট অঙ্কের লোকসান দিতে ডিম দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। তা হলে, বাজারে ডিমের দাম কেন কমবে না? এখন ৯০ থেকে ১০০ টাকা ডিমের ডজন। এটা প্রথমে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ টাকায় নামিয়ে আনা কঠিন নয়। এরপর ধীরে ধীরে দাম কমানো কি অসম্ভব? মিডিয়া এ বিষয়কে গুরুত্ব দিলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ সত্যিই প্রাধান্য পেত।
ডিম নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড প্রসঙ্গে একটি জাতীয় দৈনিকের একজন পাঠকপ্রিয় কলামিস্ট লিখেছেন, ‘দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে বটে, ঘটেছে পোলট্রি শিল্পের প্রসার; তবে আট টাকার পুষ্টি তিন টাকায় পাওয়ার আশায় খোদ রাজধানীতেই যুদ্ধে নেমেছে হাজার হাজার মানুষ। ‘প্রবৃদ্ধি’ অর্থশাস্ত্রের পরিভাষা, গরিবেরা ভাষাটাই ভালো জানে না, পরিভাষা বুঝবে কিভাবে?’ এই কলামিস্ট দেশে উন্নয়নের অব্যাহত জয়ঢাক পেটানোরও সমালোচনা করেছেন।
আণ্ডা-কাহিনী ও পচা ডিম
ডিম অতি পরিচিত বস্তু। খাদ্যদ্রব্য হিসেবে এর আদর ও কদর অপরিসীম। এটা যেমন পুষ্টিকর, তেমনি সুস্বাদু। সেদ্ধ-আধাসেদ্ধ, ভাজা, রান্নাÑ নানাভাবে ডিম খাওয়া যায়। এমনকি, কাঁচা ডিমও খান বিশেষ করে যারা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করেন, তাদের অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ক্রীড়াবিদকে দেখেছি, সকালে একসাথে কয়েকটা কাঁচা ডিম খেতে। তবে সাধারণত ডিম কাঁচা খাওয়া হয় না। ডিমকে সংস্কৃত ভাষায় ‘ডিম্ব’ ও ‘অণ্ড’ বলা হয় এবং তা থেকে এসেছে ‘আণ্ডা’ শব্দটি। আমাদের দেশে কোনো কোনো অঞ্চলে ডিমকে ‘বদা’ বলেন সাধারণ মানুষ। আরবি ভাষায় ‘বয়দা’ মানে সাদা। পোলট্রি ফার্মের ডিম আসার আগে আমরা শুধু সাদা ডিমই দেখতাম। কিন্তু ফার্মের ডিমের বেশির ভাগ লালচে রঙের।
ডিম নিয়ে অনেক ছড়া, গল্প আর চুটকি চালু রয়েছে। শৈশবে স্কুলে যাওয়ার আগেই পরিচয় হতো যেসব ছড়ার সাথে, তার মধ্যে অবশ্যই থাকত- ‘হাট্টিমাটিম টিম/তারা মাঠে পাড়ে ডিম/তাদের খাড়া দুটো শিং।’ বাস্তবে এমন কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। আমার বড় মেয়ের প্রথম যখন বর্ণপরিচয় ঘটেছিল, সে সময় একদিন খাতায় লিখেছিল, ‘চড়ুই পাখি বারোটা/ডিম পাড়ে তেরোটা,/একটা ডিম নষ্ট/ চড়ুই পাখির কষ্ট।’
ডিম খুবই পুষ্টিকর, আবার ডিম নিয়ে কুসংস্কারও কম ছিল না। পরীক্ষার দিন ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিলে ফলাফল খুব খারাপ হবে- এমন বিশ্বাস এখন কেউ পোষণ করে কিনা জানি না, তবে অতীতে এই ভুয়া ধারণা ছিল অনেকের। কিন্তু মুরগি বা হাঁসের ডিম ভক্ষণের পরিণামে পরীক্ষার ফলাফলে ঘোড়ার ডিম অর্জনের শঙ্কা ছিল না আমার মায়ের মতো কারো কারো মা-বাবার। তাই স্কুলজীবনে আম্মার ভেজে দেয়া ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে পরীক্ষার হলে গেছি। এতে পরীক্ষায় খারাপ করিনি মোটেও।
ডিম নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন একজন চিত্রাভিনেতা। তিনি ’৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একপর্যায়ে তারা ঢাকার অদূরে একটি গ্রামে ক্যাম্প করেন। যে বাড়িতে ছিলেন, দেখা গেল- তাদের মুরগি আছে; ডিমও আছে। ওই মুক্তিযোদ্ধা গৃহকর্ত্রীকে বললেন ডিম দিয়ে ভাত খাওয়াতে। গ্রামের সেই অশিক্ষিত মহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘ঘরে তো ডিম নেই।’ শুনে তিনি রেগে তাকে মারতে উদ্যত হলেন। ক্ষেপে যান এমন ‘মিথ্যা’ কথা শুনে। গৃহবধূটিকে ঘরের ডিম দেখিয়ে বলা হলো, ‘এই যে ডিম, আর আপনি বলছেন ডিম নেই।’ মহিলা বললেন, আরে এইডা তো ‘আণ্ডা’।
এখন কত পোলট্রি ফার্ম, কত বিদেশী মোরগ-মুরগি আর কতই না সাদা ও লালচে ডিম। আগে এসব ছিল না। তখন কেবল দেশী মুরগির ডিমই পাওয়া যেত বাজারে। দেশের মানুষ ছিল এখনকার চেয়ে কম। ডিমের দাম ছিল আরো কম। মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সৈন্যরা এসেছিল এ দেশে। এখানে বিভিন্ন স্থানে জিনিসপত্রের দাম ভারতের চেয়ে কম দেখে তারা অবাক হয়েছিল। বিশেষ করে ডিম ছিল সে দেশের তুলনায় বেশ সস্তা। কিন্তু সে ডিম বেশি দিন সস্তা থাকেনি। অন্যান্য পণ্যের মতো ডিমের দামও নানা কারণে বেড়ে গেছে।
এখন কর্মীদের হাতে নেতার লাঞ্ছনার খবর আসে মাঝে মধ্যে। শ্রোতাদের হাতে বক্তার নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব ক্ষেত্রে গালাগালি তো থাকেই, অনেক সময় কিলঘুষি, চড়থাপ্পড়, ইটপাটকেল ছোড়া অথবা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করার নজিরও অনেক। অতীতে এমন অবস্থায় পচা ডিমই ছিল হাতিয়ার। পাশ্চাত্যসহ উন্নত দেশগুলোতে আজো এ ধরনের ঘটনায় ডিম (পচা নয়) কিংবা টমেটো নিক্ষেপ করা হয়। অপর দিকে, এই বাংলাদেশে পচা ডিমের প্রয়োজন বেশি হয় কিছু কনফেকশনারি কারখানায়।
একসময় মাথায় ডিমের ঝাঁকা তুলে ফেরি করে ডিম বেচতেন সমরেশ বসু। মুন্সীগঞ্জের এই সন্তান কলকাতার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ছিলেন। এখন বাজারে ডিমের দোকান আছে আলাদা; পাড়ার দোকানেও ডিমের নেই কমতি। স্টেশনে-টার্মিনালে সেদ্ধ ডিম বিক্রেতাও আছেন। তবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডিম বেচতে দেখা যায় খুব কমই।
প্লাস্টিক, শূকর ও বার্ড ফ্লু
এখন প্লাস্টিকের পণ্য অজস্র। কৃত্রিম কিন্তু বাহারি ও টেকসই নানা ধরনের জিনিসপত্র প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। এগুলো দেশে তৈরি করা হচ্ছে; আবার বিদেশ থেকেও আসছে। শোনা যাচ্ছে প্লাস্টিকের ডিমের কথা। উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশে, এমনকি পাশের ভারতেও এই কৃত্রিম ডিম আসল ডিমের সাথে বিক্রির মতো প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে এটা না হলেও মানুষের মনে এ ব্যাপারে উদ্বেগ কিছুটা আছে বৈকি। একসময় গুজব উঠেছিল, প্রতিবেশী দেশ থেকে কচ্ছপের ডিম আসছে বাজারে। হয়তো কোনো মহল তাদের স্বার্থে এটা ছড়িয়েছিল। একদিন বাজারে ভারতীয় ডিমের কার্টন দেখে এর গায়ের লেখাটা পড়লাম। এতে লেখা ছিল, হায়দরাবাদের একটি পোলট্রি প্রতিষ্ঠানের নাম এবং এর মালিক যে মুসলমান, সেটাও নাম পড়ে বোঝা যাচ্ছিল। এটা ঠিক, প্রথম দিকে পোলট্রির মুরগি এবং মুরগির ডিম অনেকেই খেতেন না। এর কারণ, এসব মুরগিকে কৃত্রিমভাবে বড় করা হতো এবং এ কাজে ইনজেকশনসহ ওষুধপত্রও প্রয়োগ করার খবর উঠেছিল পত্রিকায়। আর বিশেষ করে আমদানি করা ডিমে কোনো কোনো সময় কিঞ্চিত গন্ধ লাগত। হয়তো দীর্ঘ দিন বাক্সবন্দী থাকায় এমনটি হতো। বর্তমানে ডিম বিদেশ থেকে আনার কথা নয়। বরং এ দেশ থেকে ডিম রফতানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক একটি খবর দুশ্চিন্তার বিষয় নিঃসন্দেহে। তা হলো, পোলট্রি ফিড ও ফিশ ফিডের নামে মুরগির ও মাছের খামারের জন্য যেসব খাবার আমদানি হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো কোনো সময় এমন জিনিস আনা হচ্ছে যা শূকরের মাংস বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে তৈরি করা। শূকর ইসলাম ধর্মে হারাম বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। অবিলম্বে এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
প্রসঙ্গক্রমে বার্ড ফ্লুর কথা এসে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফার্মের মুরগির মল থেকে এ রোগ ছড়ায় যখন এর সংক্রমণ দেখা দেয়। তবে সব সময়ই সতর্ক থাকা দরকার এ ব্যাপারে। অথচ আমরা অহরহ দেখি, বাজারে বা দোকানে নোংরা ডিম বিক্রি হচ্ছে। মুরগির বর্জ্য লেগে থাকা ডিম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। কারণ, ডিম ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় না। খামার থেকেই এ ডিম ধুয়ে পাইকারদের কাছে সরবরাহ করা আবশ্যক। কিন্তু খুচরা বাজারে যখন আসে, তখনো ডিম থাকে ময়লা ভর্তি। বাজারে বালতিতে অনেক ডিম একসাথে ধোয়ার দৃশ্য সবার চোখে পড়ে। যেভাবে ধোয়া হয়, তাতে ডিম পুরো পরিষ্কার হয় না। অতএব, বেশি দামে সেই অপরিষ্কার ডিম কেনাই আমাদের নিয়তি।
ঘোড়ার ডিম পেয়েই সন্তুষ্ট!
ডিম পাড়ে পাখিরা (সেটা উড়তে পারুক বা না পারুক)। সরীসৃপ ও মৎস্যজাতীয় প্রাণীও ডিম পাড়ে। পশু কিংবা মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং গর্ভধারণের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। ঘোড়া একধরনের পশু, যা বিশ্বে খুবই পরিচিত। তার ডিম দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবুও ‘ঘোড়ার ডিম’ কথাটা বহুল প্রচলিত। সাধু ভাষায় এটাকে ‘অশ্বডিম্ব’ বলা হয়। ‘ঘোড়ার ডিম’ মানে, কিছুই না। কোনো কিছুর ফলাফল, প্রাপ্তিযোগ কিংবা পরিণতি শূন্য হলে ‘ঘোড়ার ডিম’ কথাটা প্রয়োগ করা হয়। ব্যক্তিজীবনে অর্থহীন ‘ঘোড়ার ডিম’ পেলে যতটা ক্ষতি হয়, জাতীয় জীবনে ‘ঘোড়ার ডিম’ পেলে ক্ষতি নিশ্চয়ই অনেক বেশি। আমরা সস্তায় ফার্মের মুরগির ডিম পাওয়ার জন্য হাজার হাজার লোক হাঙ্গামা-হুড়োহুড়ি করি; ডিম না পেয়ে করি আফসোস আহাজারি। কিন্তু জাতি হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে ছোট-বড় ঘোড়ার ডিম পাচ্ছি (এবং খাচ্ছিও)। সে ব্যাপারে তেমন বোধোদয় নেই। এই সুযোগে শোষক-প্রতারকেরা আমাদের উচ্চমূল্যে ‘ঘোড়ার ডিম খাইয়ে’ নিজেরা বিনা পয়সায় ‘মুরগির ডিম’ গিলছে।
আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি, যেখানে হাত থাকলে মাথা নেই, আর মাথা থাকলে মন নেই। অর্থাৎ ক্ষমতাবানদের মেধা নেই, আর মেধাবীদের বিরাট অংশের হৃদয়বৃত্তির অভাব। এ অবস্থায় সমাজ ভারসাম্যহীন, ব্যাধিগ্রস্ত, সর্বোপরি বিবেকশূন্য হয়ে পড়ছে। এখানে আমরা দায়িত্ব পালন করি না, নতুবা দায়িত্বসচেতন নই। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ (যারা নিরীহ, শান্তিকামী, দরিদ্র) অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। সমাজের সদস্য কিংবা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যে যা জুটছে, তা এক কথায় ‘ঘোড়ার ডিম’।
সমাজ ও রাষ্ট্রের স্তরে স্তরে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, শোষণ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা, সঙ্কীর্ণমন্যতা, অসংযম প্রভৃতির ব্যাপক সংক্রমণে বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ ও নির্বিরোধ মানুষমাত্রই শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এমন এক দুঃসহ পরিবেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, নৈতিকতা, শালীনতা প্রভৃতির আশা করা বাতুলতা মাত্র। এই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি ও সমষ্টি হিসেবে দেশের বিপুল গরিষ্ঠ গণমানুষ যা পাচ্ছে, তার অপর নাম ‘ঘোড়ার ডিম’। আর কতকাল এই ডিম খেয়ে আমাদের জীবন কাটাতে হবে?
পুনশ্চ : ক. গ্রামের এক চাষি প্রথমবারের মতো শহরে গেলেন। নাশতা করতে ঢুকলেন এক রেস্তরাঁয়। পরোটার সাথে খাওয়ার জন্য মামলেট আছে শুনে তার অর্ডার দিলেন। বয় মামলেট এনে দিলে সরল কৃষক বলে উঠলেন, ‘হায়রে গ্রামের আণ্ডা, তুই বুঝি শহরে এসে মামলেট হলি।’ গণ্ডগ্রাম থেকে শহরে এসে মানুষও ডিমের মতো বদলে যাচ্ছে নানাভাবে।
খ. রবিঠাকুরের ডিম্ব-কাহিনী। একবার কবিগুরু এক নিমন্ত্রণে খেতে গেছেন। অনেক বড় ব্যক্তিত্ব; ভোজে খাবারের আয়োজনও অনেক। এর মধ্যে সেদ্ধ ডিমও ছিল। খাওয়া শুরু হলো যথারীতি। কবির এক সঙ্গী মুখে তুলতে গিয়ে দেখেন, ডিমটা নষ্ট। কবির দিকে তাকালেন। তিনি এই বস্তুটা কিভাবে যেন ‘খেয়ে ফেললেন’! পরে ওই সঙ্গী এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় রবিঠাকুর জানান, তিনি পচা ডিম দেখে তা গলধঃকরণ না করে তার দীর্ঘ গোঁফদাড়ির ভেতর দিয়ে গলার দিকে পাচার করে দিয়েছিলেন। নষ্ট ডিমটি ঢুকেছিল কবির জোব্বার মধ্যে। কেউ এটা টের পায়নি। এ দিকে, গৃহস্বামী খুব খুশি কবিকে ডিম ‘খাওয়াতে’ পেরে।
গ. ডিম নিয়ে ছড়া আগেও লেখা হয়েছে। তবে এবার ডিম মেলায় আণ্ডা নিয়ে ডাণ্ডাবাজির পর কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন যে ছড়াটি লিখেছেন, তা সবাইকে শোনানো দরকার। ছড়াটি হলোÑ ডিম আগে না মুরগি আগে তর্ক ভালো লাগে; এখন দেখি ডিমই আগে, কিনতে লাইন লাগে। ডিমে আছে কোলস্টেরল রক্ত চাপের ঝুঁকি; তবু ডিমের চাহিদা খুব মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। পচা ডিমের মূল্য আছে অনেক অনুষ্ঠানে; নাটক কিংবা রাজনীতিকের গলাবাজির গানে। ডিমের মূল্য বুঝবে তখন রিমান্ডে যাও যদি, কিংবা ধরো ডিম দিবসে লাইনে খাও রোদই। লিলিপুটের রাজ্যে দেখো ডিম নিয়ে কী লড়াই; ডিম খেয়ে কেউ করো না আর আগের মতো বড়াই।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন