কিছু দিন আগে নরওয়েতে ন্যাটোর যৌথ যুদ্ধমহড়ায় একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জের ধরে তুরস্ক ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং দেশটির সরকার ও বিরোধী দল সবাই এক হয়ে এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের অভিযোগ, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই সামরিক জোটের পক্ষ থেকে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক এবং তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের অবমাননা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি তুরস্ক ন্যাটো ত্যাগ করতে যাচ্ছে? কিংবা এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযুক্ত সময় কি এটাই?
প্রায় সাত দশক পুরনো উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা বা ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ ও অন্যরা নরওয়েতে সংঘটিত ওই অঘটনের ব্যাপারে তুরস্কের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তবে এতে তুরস্কের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাফ কথা, শুধু মাফ চাইলেই হবে না। শুধু আমি নিজে নই, তুরস্ক রাষ্ট্রকে টার্গেট করে এই কেলেঙ্কারি ঘটানো হয়েছে। ঘটনাস্থল নরওয়ের স্ট্যাভাঙ্গার নামক স্থানে অবস্থিত ন্যাটোর জয়েন্ট ওয়্যারফেয়ার সেন্টার। এবার নভেম্বরের মাঝামাঝি এটা ঘটেছে।
তুরস্কের প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা, ‘সাবাহ’র কলামে বলা হয়েছে, একটি অদৃশ্য হস্ত ন্যাটোর মতো পাশ্চাত্যভিত্তিক সংস্থাগুলো থেকে তুরস্ককে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে আঙ্কারার এই ফাঁদে পা রাখা ঠিক হবে না।
বাস্তবতা হলো, কিছু দিন ধরে পশ্চিমা দুনিয়ার সরকারগুলো তুরস্কবিরোধী মানসিকতা তৈরির কাজে মদদ দিয়েছে। এর পরিণামে এবার ন্যাটোর মহড়ায় অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যায় তুরস্কের বিরুদ্ধে। ন্যাটো ও নরওয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও তুরস্কের উদ্বেগ কমেনি। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক-ন্যাটো সম্পর্ক গত কয়েক বছরে কোথায় পৌঁছেছে, তা উপলব্ধি করা যায়। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সংঘটিত তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে ন্যাটোর দৃষ্টিভঙ্গি তুরস্কের মনঃপূত নয়। তদুপরি সে অভ্যুত্থানের হোতা হিসেবে অভিযুক্ত, ফতেহউল্লেহ গুলেনের লোকজনকে তুরস্ক সরকারের হাতে তুলে না দেয়ার ঘটনা ন্যাটোর প্রতি আঙ্কারার আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। এ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আগের মতো উষ্ণ নয়। এ বিষয়ও ন্যাটোর প্রতি তুর্কি মনোভাবের ওপর পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে।
গত কয়েক বছরে তুরস্কের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, কুর্দিদের পিকেকে’র মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং গুলেনপন্থী ‘জঙ্গি’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুরস্ক অন্যদের পাশে পায়নি। এ দিকে রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তুরস্ক কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশ্চাত্যের মিডিয়া প্রচারণা চালিয়েছে, এই পদক্ষেপ ন্যাটোর চেতনার সাথে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ।’ পাশ্চাত্যে বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে কিছু মহল তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ‘একনায়ক’রূপে চিহ্নিত করে ন্যাটো থেকে তুরস্ককে বিদায় করে দেয়ার দাবিতে প্রপাগান্ডায় ব্যস্ত। এমন এক প্রেক্ষাপটে কামাল আতাতুর্ক (তুরস্কের ‘জাতির পিতা’) এবং তুরস্কের বর্তমান নেতা এরদোগানকে ন্যাটোর দুশমন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ন্যাটো জোটে তুরস্কের আর থাকা সমীচীন কি না।
ন্যাটোর ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ মহলের অভিযোগ, ন্যাটো তুরস্কের জাতীয় স্বার্থকে নির্লজ্জভাবে অবহেলা করে আসছে। তাদের ধারণা, ১৯৬০ সালে জেনারেল জামাল মুরসেলের সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের সময় থেকে তুরস্কের সব অভ্যুত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য জোট ন্যাটোর হাত ছিল। অতএব, এই জোটকে বিশ্বাস করা যায় না। এমনকি আঙ্কারার প্রতি ‘প্রকাশ্য বৈরী’ ন্যাটো ত্যাগ করার জন্য তুর্কি সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
অপর দিকে যারা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের দৃষ্টিতে ন্যাটো ত্যাগ করা ঠিক হবে না। এর কোনো কোনো সদস্যদেশ প্রায়ই তুরস্কের সমালোচনা করলে জোট হিসেবে ন্যাটো ছেড়ে আসা উচিত নয়। অন্য দিকে, ন্যাটো থেকে তুরস্ককে বের করে দেয়া সম্ভব হবে না। কারণ, জোর করে ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্রকে বহিষ্কারের বিধান নেই।
যা হোক, এরদোগান বলেছেন, ‘পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা অন্যায় করছে।’ তুরস্কের মিত্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর বন্ধুত্ব কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে তার প্রশ্ন রয়েছে। তিনি চান তুরস্কের সাথে অন্যদের সম্পর্ক হোক ন্যায়নীতিভিত্তিক। ‘এরদোগান আসলে পশ্চিমা দেশগুলোকে গালি দিয়ে মুখ খারাপ করতে চান না’ বলে তুর্কি দৈনিক সাবাহ মন্তব্য করেছে। তিনি চান, পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ হোক। এরদোগান পাশ্চাত্যকে পুরোপুরি পরিত্যাগের পক্ষপাতী নন। বাস্তবে জাতীয় স্বার্থে ন্যাটোর ভূমিকার নিন্দা মানে ন্যাটোর সদস্যপদ ত্যাগ করার ইচ্ছা নয়।
একজন ভাষ্যকার বলেছেন, ইইউ এবং ন্যাটো দুটোই আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেখানে তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থ যথাসাধ্য আদায়ে তৎপর। তুরস্ক নিছক আবেগবশত এসব সংস্থায় শামিল হয়নি। তাই জনগণের মাঝে প্রচারণা চালিয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সুরাহা করা যাবে না। কোনো কোনো মহল চায়, তুরস্ক ইইউ এবং ন্যাটোর মুখের ওপর নিজের দুয়ার বন্ধ করে দিক। কার্যত এই ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
বিশ্ব কোন দিকে যাচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা দরকার। দেশ ও জাতির স্বার্থকে দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতে বিবেচনা এবং যুক্তিসঙ্গত হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কী রূপ নেবে, তা স্পষ্ট হওয়ার আগে কোনো একটি পক্ষে শামিল হয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না। বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতিতে ন্যাটো কিংবা ইইউর উপযোগিতা তুলে ধরে একটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, However worn out, multilateral organizations such as the European Union and NATO remain strategically important during this period of uncertianty (যতই ক্ষয়ে যাক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর ন্যাটোর মতো বহুপক্ষীয় সংস্থা অনিশ্চয়তার বর্তমান সময়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।)
তুরস্ক বর্তমান কালের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উত্তেজনা ও সঙ্কটের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। তাই দেশটি নিজেকে বিচ্ছিন্ন না করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে যথাসম্ভব সক্রিয় ভূমিকা পালন করা আবশ্যক। জাতীয় স্বার্থে এবং মুসলিম বিশ্বের স্বার্থেও বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরালো করতে হবে আঙ্কারাকে। পাশ্চাত্যের সাথে কৌশলে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা দরকার। তাদের উসকানিমূলক বিরূপ প্রচারণায় আঙ্কারা বিভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে নিজেরই ক্ষতি হবে।
ন্যাটোর স্ববিরোধী নীতি ও তুরস্কের ক্ষোভ
তুর্কি ভাষ্যকার বুরহানেদ্দিন দুরান লিখেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব পালনের প্রথম বছর ফুরিয়ে আসছে। এ দিকে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আগের মতোই চাপের মুখে রয়ে গেছে। কুর্দিদের পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) মিলিশিয়ার প্রতি মার্কিন সমর্থন, গুলেনপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপকে (ফেটো) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারে ব্যর্থতা, প্রতিরক্ষা ইস্যুতে তুরস্কের সাথে সহযোগিতা করায় ওয়াশিংটনের অনীহা, (পরমাণু ইস্যুতে) ইরানসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে নিউ ইয়র্কে চলমান মামলা প্রভৃতি এই দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তুরস্ক আর যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে এটা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের দরুন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ কথাটা এখানে প্রায় অর্থহীন। রাশিয়ার সোচিতে ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আঙ্কারার সাথে ওয়াশিংটনের বন্ধন মেরামত করার একটা চেষ্টা চালিয়েছেন। এ জন্য তিনি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে বললেন, কুর্দি জঙ্গিদের অস্ত্র জোগানোর মতো অর্থহীন কাজ তিনি বন্ধ করে দিচ্ছেন। তবে পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিরা কুর্দিদের এই গ্রুপের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। এ অবস্থায় তুরস্ক হয়েছে বিভ্রান্ত।
যুক্তরাষ্ট্রে হোয়াইট হাউজ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পেন্টাগনের মাঝে কিছু মতভেদ রয়েছে; যা বোঝা কষ্টকর নয়। ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ইস্যুগুলোর সুরাহা করতে না পারায় যে ব্যাপক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে, এই মতভেদ তারই ইঙ্গিত দেয়। তবে অনেকেই মনে করেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সত্ত্বেও আঙ্কারার সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করার জন্য হোয়াইট হাউজের প্রয়াসকে তুরস্ক স্বাগত জানিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান পেন্টাগনের উপরি উক্ত বক্তব্যকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি এটা স্পষ্ট করে দিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, শুধু প্রেসিডেন্ট বা হোয়াইট হাউজের ভূমিকা। এরদোগান বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ফোনালাপে আমরা দু’জন সম্প্রতি প্রথমবারের মতো একই ধরনের চিন্তা করেছি দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে। কুর্দি মিলিশিয়া ও গুলেনপন্থীদের সন্ত্রাসসহ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি তার সাথে। কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের এই সংলাপ চলবে।
এ দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাশিয়া আর ইরানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। টিলারসনের এই বক্তব্য প্রদান করাকে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্ব জাহির করার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবেও গণ্য করা যায়। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রভাবশালী কন্যা ইভাঙ্কার ভূমিকার সামনে ম্লান হয়ে পড়েছেন। ইভাঙ্কাকে আমেরিকার ‘ডি ফ্যাক্টো সেক্রেটারি অব স্টেট’ বা আসল পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করা হচ্ছে।
যা হোক, রেক্স টিলারসন উইলসন সেন্টারে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনটি পয়েন্ট তুলে ধরলেন যেগুলো পরস্পর সম্পর্কিত। এগুলো হচ্ছে, ইউরো-মার্কিন মৈত্রীর ভবিষ্যৎ, রুশ হুমকির উত্থান এবং ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদের ‘সুফল’। ইউরোপে যারা ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত এই সংস্থার জন্য তাদের প্রদেয় আর্থিক অনুদানের পরিমাণ বাড়াতে ট্রাম্প প্রশাসন আহ্বান জানিয়েছে। এটাকে টিলারসন বলেছেন নতুন অঙ্গীকার এবং ন্যাটো জোটের পুনরায় সংজ্ঞায়ন। তিনি রাশিয়ার দিক থেকে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বলেন, আমেরিকা ও ইউরোপ চায় রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে; কিন্তু রাশিয়ানরা চেষ্টা করেছে ইউরোপ আর আমেরিকার মাঝে বিভেদের ফাঁক তৈরি করার জন্য। সাইবার হামলা এবং এর সাথে নির্বাচনে নাক গলাতে মিথ্যা প্রপাগান্ডার মাধ্যমে এটা করা হয়েছে বলে টিলারসন উল্লেখ করেন। তিনি ইরানকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায় সায় দিতে ইউরোপের প্রতি আহ্বান জানান।
তুরস্ক প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে রেক্স টিলারসন বলেছেন, ‘ন্যাটোর মিত্র হিসেবে তুরস্ককে বলেছি, তার সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্রদের সাথে অভিন্ন প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে যেন অগ্রাধিকার দেয়া হয়।’ তুরস্কের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের ‘অপরিহার্যতা’ বোঝাতে গিয়ে টিলারসন মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব তুলে ধরে বলেন, পাশ্চাত্যের জাতিগুলোর সম্প্রদায়ের (অর্থাৎ ন্যাটো) সদস্য হয়ে তুরস্ক যত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুফল পাবে, তা ইরান ও রাশিয়া তুরস্ককে দিতে পারবে না।
টিলারসন ন্যাটোতে থাকা যে ‘লাভজনক’, সেটা তুরস্ককে মনে করিয়ে দিলেন। এটা কিছু মার্কিন মিডিয়ার মনোভাবের চেয়ে বেশি যুক্তিসঙ্গত। এসব মিডিয়ার সোজা কথা, ‘ন্যাটো থেকে লাথি মেরে তুরস্ককে বের করে দিতে হবে।’ অপর দিকে চতুর টিলারসন তুরস্ক-আমেরিকা সম্পর্কের লাভ তুলে ধরলেও লোকসানটা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। সে লোকসান হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পলিসির জন্য দেয়া মাশুল। টিলারসন ইউরোপ থেকে আরো বেশি অর্থ চাচ্ছেন ন্যাটোর জন্য। কিন্তু ন্যাটো বছরের পর বছর তুরস্কের নিরাপত্তার মতো গুরুত্ববহ বিষয়কে অবহেলা করে এসেছে, এ ব্যাপারে তিনি চোখ বুজে আছেন। তুরস্ক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে। অথচ কথিত ‘অভিন্ন প্রতিরক্ষা’র মূলনীতি বাস্তবায়নে ন্যাটো জোট অস্বীকৃতি জানিয়ে এ লড়াইয়ের বিরাট ক্ষতি করেছে। আর কুর্দি ওয়াইপিজি কিংবা গুলেনপন্থী ‘ফেটো’ ইস্যুর দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, এসব ক্ষেত্রে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই ন্যাটোর স্বার্থহানি করেছে। এখন ন্যাটোর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে কথিত মার্কিন স্বার্থ প্রণোদিত এই জোটের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, এ প্রশ্ন দেখা দেয়। তদুপরি ন্যাটোকে কেন্দ্র করে এক দিকে পাশ্চাত্যে তুরস্কবিরোধী মনোভাব এবং অপর দিকে তুরস্কে পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব জন্ম নিয়েছে।
‘শীতলযুদ্ধ’ শেষ হওয়ায় এখনই তুরস্ক সবচেয়ে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। তাই তুরস্ক দেশটির নিরাপত্তা সমস্যার সুরাহার জন্য ন্যাটোর চিন্তাভাবনা থাকা জরুরি। সিরিয়া ও ইরাক থেকে আগত গোলযোগ ও সন্ত্রাসের জোয়ারের মুখে আঙ্কারাকে একা ফেলে তার স্বঘোষিত মিত্ররা সরে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, আরো বেশি তুর্কি নাগরিক বিশ্বাস করছেন, প্রতিরোধমূলক ও গতানুগতিক নিরাপত্তা- এ উভয় ক্ষেত্রেই ন্যাটো তুরস্কের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তা ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার কুর্দিদের পিকেকে এবং গুলেনপন্থী ফেটো (FETO) উগ্রপন্থীদের আশ্রয় দিয়ে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছে। এমন এক সময় এসব করা হচ্ছে, যখন খোদ যুক্তরাষ্ট্র ফতেহউল্লেহ গুলেন এবং কুর্দিদের জঙ্গি সংগঠন ওয়াইপিজিকে আশ্রয় বা সমর্থন জোগাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন বলা যায়, ন্যাটোর ‘পুনঃসংজ্ঞায়ন’-এর সঠিক পন্থা হলো, ন্যাটোর সদস্যপদ ধরে রাখার উপকারিতা ‘স্মরণ করানো’র বদলে এর সব সদস্যের নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ সমুন্নত করা। এ দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দিতে হবে আমেরিকাকেই।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন