বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর এ দেশের মানুষ রাষ্ট্রপতিশাসিত ও সংসদীয় পদ্ধতি উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম- এ চারটি সংসদ নির্বাচন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার বহাল থাকাকালীন অনুষ্ঠিত হয়। অপরদিকে প্রথম, ষষ্ঠ ও দশম- এ তিনটি সংসদ নির্বাচন সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনটি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বিশেষ ব্যবস্থায় কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। সে অস্থায়ী সরকারটি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার আদলে গঠিত ছিল। সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। নবম সংসদ নির্বাচন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় যেসব নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়; এর প্রতিটিতে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হয়।
উপরোক্ত চিত্রটি থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হল, ক্ষমতাসীন দলের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ দেশে কখনও প্রধান বিরোধী দল বিজয় অর্জন করতে পারেনি। আর ঠিক এর বিপরীত ক্ষমতাসীন দলবহির্ভূত অন্য যে কোনো ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন পূর্ববর্তী সময়ে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন-পরবর্তী সময়ে এ বিধানটি পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এয়োদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী ৬টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদপূর্ণ করতে না পারার কারণে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। দশম সংসদটি নির্ধারিত মেয়াদপূর্ণ করায় এ নির্বাচনটি সংসদ বহাল থাকাকালীন অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠ ও দশম সংসদ নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটি নির্বাচনে কলুষতার মাত্রা এত অধিক ছিল যে, এগুলোকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা হলে সংবিধানেরই অবমাননা হয়।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলবহির্ভূত ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনে বিজিত দল পরাজয় স্বীকার করে বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানায়নি। এ চারটি নির্বাচনের দুটিতে বিএনপি এবং দুটিতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে এ চারটি নির্বাচন যে তুলনামূলক বিচারে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল সে প্রশ্নে খুব একটা বিতর্ক নেই। এ নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়া গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা, অবজ্ঞা ও অসম্মানের পরিচায়ক।
আমাদের দেশে অভিনব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারণ জনমানুষের কাছে এখনও দলীয় সরকারের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সেটিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে ৬টি বিকল্প দেয়া ছিল। সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনকালে যে দুটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল উভয়টিতেই স্বাভাবিকভাবে সর্বশেষ যে প্রধান বিচারপতি অবসরগ্রহণ করেছিলেন তার নেতৃত্বে এ ধরনের সরকার গঠন সংক্রান্ত প্রথমোক্ত বিধানটি অনুসরণ করা হয়েছিল।
অষ্টম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দল নিজ মতাদর্শের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার মানসে নেহাত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অকস্মাৎ ও অপ্রত্যাশিতভাবে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের মতামত অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭তে উন্নীত করে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে অবসরে গেলে যিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত তার পথ রুদ্ধ হয়। তাদের এ কাজটি পরিণামে যে বিতর্কের জন্ম দেয় তাতে অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনোটিই সংবিধানসম্মত ছিল না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে যে বাস্তবতা তা হল, ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এ ধরনের সরকারের ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও দেশের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে একতরফাভাবে সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবি বাস্তবায়ন করে এ ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠা করে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ, যে দলটি বিরোধী দলে থাকাকালীন এ ব্যবস্থাটির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল সে দলটিকে দেখা গেল নবম সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে পুঁজি করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবিকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক অনেকটা একতরফাভাবে এ ব্যবস্থাটির বিলোপসাধন করে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি দল ও বিরোধী দল একে অপরের ওপর আস্থাশীল। এসব দেশে দেখা যায় জাতীয় যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উভয় দলের নেতারা একই মঞ্চে আরোহণ করে দেশবাসীর সামনে তাদের একাত্মতা ব্যক্ত করে। কিন্তু আমরা সাংবিধানিকভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও এখনও সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে দেশ ও জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এ কথাটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমানে বিরোধী দলে থাকাবস্থায় বিএনপি যেমন ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়, অনুরূপ ক্ষমতায় বিএনপি আসীন থাকলে আওয়ামী লীগও তাদের অধীন নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে না।
আমাদের বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারীর কার্যভার গ্রহণের অবকাশ তখনই সৃষ্টি হয় যখন তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারান অথবা সংসদ নির্বাচনে তার দল পরাভূত হয়।
সংসদ নির্বাচন বিষয়ে বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সংসদ মেয়াদপূর্ণ করুক বা না করুক, দলীয় সরকার ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা ধারণা দেয়, জনমত যাই থাকুক না কেন, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কখনও ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হয়নি। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দেয়া স্বাভাবিক- নিশ্চিত পরাজয় জেনে প্রধান বিরোধী দল কি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে? আর আগ্রহী হয়নি বলেই দশম সংসদ নির্বাচনটি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের মতো ভোটারবিহীন ও একতরফা হয়েছে। আমরা যদি দেশকে স্থিতিশীলতা দেয়াসহ সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন প্রশ্ন- আমাদের বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠান কতটুকু সম্ভব?
এ কথাটি অনস্বীকার্য, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে তা দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য সহায়ক। অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি অথবা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দেশ ও জাতি অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে দেশের অপূরণীয় ক্ষতিসহ সম্পদ ও জীবনহানি ঘটেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো অতীতে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার কারণে দলীয় সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অক্ষম এ ধারণাটি জনমতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান ২নং ক্রমিকে। অপরদিকে রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের অবস্থান যথাক্রমে ১ ও ৩নং ক্রমিকে। প্রধান বিচারপতির অবস্থান ৪নং ক্রমিকে। এমন অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে সরকারের তিনটি অঙ্গ, যথা- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রীয় মানক্রমে সমমর্যাদাসম্পন্ন। আমাদের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী যে কোনো অযোগ্যতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হলেও যেমন তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, অনুরূপ রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের পদ যে কোনো অযোগ্যতার কারণে শূন্য হলে উভয়ের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এ তিনটি পদের মধ্যে একটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে আর তা হল- প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কে তার দায়িত্বে থাকবেন সে বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ, যদিও রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার দায়িত্বে থাকবেন, অপরদিকে স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার দায়িত্বে থাকবেন।
পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; তবে নির্বাচনকালীন দলীয় সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে শুধু দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করে। এসব দেশে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনাসহ এ কাজে সহায়তাকারী রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ওপর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অধিকতর সচেষ্ট থাকে। আমাদের দেশে কোনো দলীয় সরকার স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে নির্বাচন কমিশন কাজ করুক, সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কখনও নীতিবোধ, নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে উদ্যোগী হয়নি। দলীয় সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে অন্ততপক্ষে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কমিশনে ঠাঁই পাওয়া ব্যক্তিরা আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন হবে না।
বাংলাদেশের সমস্যা যেমন এ দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত থাকলে আমাদের সমস্যাগুলোকে অতিক্রম করে সম্ভাবনার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূলে যে কারণ সেটি হল নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অপর কারও এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও জাতি ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সংবিধানকে সমুন্নত রেখে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব অপর দু’জন সাংবিধানিক পদধারী যথা- রাষ্ট্রপতি অথবা স্পিকারের মাধ্যমে পালন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় ছুটিতে থাকবেন এবং তিনি ছুটিতে থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের সংবিধানে এ সংক্রান্ত বিধান না থাকা সত্ত্বেও অতীতে একবার ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে আইনমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে সময়কার আইনমন্ত্রী দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রিসভার বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অপর কোনো সাংবিধানিক পদধারীকে দায়িত্ব দেয়া যায়, সে নজির এ দেশে ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন? বর্তমান সংসদে বিএনপির কোনো সংসদ সদস্য না থাকায় সে ক্ষেত্রে এরূপ অন্তর্বর্তী সরকারে কি তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না? এ কথাটি সত্য, সংসদ বহাল রেখে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলে এবং সে সরকারের সদস্যসংখ্যা ১০ হলে শুধু একজন সংসদ সদস্য বহির্ভূত ব্যক্তিকে সে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া সম্ভব হবে। আর যদি মন্ত্রিসভায় সদস্য সংখ্যা ২০ হয়, সেক্ষেত্রে অনুরূপ দু’জনকে ঠাঁই দেয়া সম্ভব হবে। এ বিষয়ে দেশের জনমানুষের আকাক্সক্ষা, এরূপ অন্তর্বর্তী সরকারের পরিসর হবে ক্ষুদ্র এবং তাতে দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারি দল হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন, সেহেতু অতীতের ব্যর্থতা ও গ্লানিময়সমূহকে মুছে দিয়ে আওয়ামী লীগকেই এমন একটি সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে, যাতে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে এটি স্থায়ী রূপ পায়। আর সংসদে বিএনপির সংসদ সদস্য নেই, সরকারি দল আন্তরিক হলে ন্যূনতম ৪টি আসনে উপ-নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে এ অক্ষমতা অতিক্রম করা সম্ভব।
দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অত্যাসন্ন, এমন ভাবনায় রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যে কোনো ধরনের সংঘাত পরিহার করে চলার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি স্বস্তিদায়ক। সাধারণ মানুষ চায় এ প্রবণতাটি যেন যে কোনো ধরনের নৈরাজ্যের কারণে বাধাগ্রস্ত না হয়। আর নৈরাজ্য যেন না হয় তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সব দলের হলেও বিশেষত সরকারি দলের অধিক।
আমাদের সংবিধানের বিধানাবলী অনুযায়ী দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার পদে নিয়োগ দেয়া হলেও নিয়োগ-পরবর্তী সময়ে তারা তাদের কাজের দ্বারা যে দলীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নন, এটির প্রমাণ রাখতে পারেন। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার ইতিমধ্যে সে প্রমাণ রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আর তাই এ দু’জনের যে কোনো একজনের নেতৃত্বে বড় দুটি দলের সমসংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যবস্থা করা গেলে আশা করা যায়, দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য সেটি অনন্য উপায় হয়ে থাকবে। আর এ উদাহরণটিকে যদি স্থায়ী রূপ দেয়া যায়, তবে এ দেশ ও জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আর সংঘাত দেখতে হবে না- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা যায় অবশ্যই।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন