গণতন্ত্রের সাথে সুশাসনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া অপরিহার্য। সুশাসন দেশের প্রতিটি পর্যায়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। যেকোনো দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অনুপস্থিতি দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটায়।
আমাদের এ দেশটি সৃষ্টি-পরবর্তী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের শীর্ষ ও উচ্চপদে জ্যেষ্ঠতা, সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও পদায়ন হতো। এখন থেকে দেড় দশকের কিছু আগে জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের কারণ ছাড়া জ্যেষ্ঠতা অতিক্রম করে পরবর্তী জ্যেষ্ঠকে মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দফতরের শীর্ষ ও উচ্চপদে পদোন্নতি দেয়া বা পদায়ন করা হয়েছে, এরূপ একটি নজিরও নেই। সে সময় জ্যেষ্ঠকে অতিক্রম করার প্রশ্ন দেখা দিলে নথিতে যথাযথ কারণ উল্লেখ করে তা অনুমোদনের জন্য সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের বরাবর পাঠানো হতো এবং সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদিত হলেই অতিক্রান্তের বিষয়টি কার্যকর করা হতো। সাধারণত দেখা যেত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ ও অসদাচরণের দায়ে বিভাগীয় শাস্তি না পেলে অতিক্রান্তের প্রশ্ন উঠত না। যেকোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দফতরে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অসদাচরণের কারণে অতিক্রান্ত হলে এর প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দফতরটির কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হতো না, বরং তারা অনেকটা স্বস্তিবোধ করতেন।
বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে শীর্ষ ও উচ্চপদে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অধিকতর বিবেচ্য। এরূপ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অসততা ও দুর্নীতির মাত্রা যতই ব্যাপক হোক না কেন, তা তার জ্যেষ্ঠকে অতিক্রান্ত করে শীর্ষ বা উচ্চপদে পদোন্নতি বা পদায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাঁড়ায় না। যেকোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দফতরের শীর্ষ ও উচ্চপদে কর্মরত কর্মকর্তাদের দেশের ভেতরে ও বাইরে যেকোনো বিষয়ে বিদেশীদের সাথে কথা বলতে হলে তাদের শুদ্ধভাবে ইংরেজিতে কথা বলার যোগ্যতা থাকা দরকার। কিন্তু এ যোগ্যতার অভাবে অনেক সময় দেখা যায়, বিদেশে সেমিনারে অংশ নেয়ার সময় লিখিত বক্তব্যের বাইরে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হলে, তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। তা ছাড়া বিদেশীদের সাথে আলোচনার সময়ও ইংরেজি ভাষায় সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে ফলপ্রসূ আলোচনা করতে না পারায় দেশের স্বার্থের হানি ঘটাসহ সমস্যা সুরাহার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
আমাদের দেশে যারা ইংরেজি লেখা ও বলার ক্ষেত্রে পারদর্শী তাদের দেখা যায় নিজের মাতৃভাষা বাংলায়ও সমভাবে দক্ষ ও পারদর্শী। বাংলাদেশ আমলে বিগত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি অবধি যারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দফতরের শীর্ষ ও উচ্চপদে ছিলেন, তাদের সবাই ইংরেজি ও বাংলায় সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তারা নথিতে উভয় ভাষায় তাদের যে মতামত ও বক্তব্য লিখতেন তাতে উভয় ভাষার ক্ষেত্রে বাক্যের গঠন ও বানানের ভুল এবং বিশেষত বাংলার ক্ষেত্রে সাধু চলিতের মিশ্রণ বিরল ঘটনা ছিল। কিন্তু বর্তমানের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন সরকারের শীর্ষ ও উচ্চপদে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে সবারই শুদ্ধভাবে ইংরেজি ও বাংলা লিখতে ও বলতে সক্ষম এমন দাবি করার অবকাশ আছে কি? বর্তমানে কিছু কিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা এতই বেদনাদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জক, কোনো ধরনের আইন, বিধি, নীতি ও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেই জ্যেষ্ঠতা, সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়গুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে একমাত্র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে বিবেচনায় নিয়ে শীর্ষ ও উচ্চপদে পদায়ন ও পদোন্নতি কার্যকর করা হচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে বিভাগের শীর্ষ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রায় ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে একজন বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তাকে এভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, তারা কেউ জানেন না, এর কারণ কী এবং তাদের অপরাধ কী? এ কর্মকর্তার ব্যাপারে আরো যা জানা যায়, তা হলো- তিনি নিজ বিভাগের প্রারম্ভিক পদে যোগদানের সময় সরকারি কর্ম কমিশন আয়োজিত প্রচলিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পরিবর্তে সামরিক ফরমান বলে শিথিল করা নিয়োগবিধির আওতায় মন্ত্রণালয়ের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হাসিলে সমর্থ হয়েছিলেন। সে সময় মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই কাক্সিক্ষত নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করেছিলেন। এ ধরনের উৎকোচ দেয়ার মাধ্যমে যারা নিয়োগ হাসিল করে থাকেন, তাদের দেখা যায় চাকরিতে যোগদান-পরবর্তী প্রথম লক্ষ্য থাকে কত দ্রুত উৎকোচ সংশ্লেষে ব্যয়িত অর্থ অবৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে আহরণ করা যায়। এরূপ কর্মকর্তা যাদের চাকরিতে প্রবেশ দুর্নীতির মধ্য দিয়ে, তারা চাকরিজীবনে দুর্নীতিমুক্ত থাকবেন এমনটি আশা করা আকাশ-কুসুম কল্পনা বৈ কিছু নয়।
আমাদের দেশের পুঁজিবাজার ও ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত। দেশের পুঁজিবাজার ও ব্যাংকগুলো স্বচ্ছতার সাথে দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজ করতে পারলে তা আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করে। আমাদের পুঁজিবাজার বিগত দুই দশকে দু’টি বড় ধরনের ধসের সম্মুখীন হয়েছে। এ দু’টি ধসের সাথে যারা সম্পৃক্ত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষ্ক্রিয়তায় এদের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। এদের কারণে যে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন, তাদের দুর্দশা লাঘবে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা আশাব্যঞ্জক নয়। দু’টি ধস-পরবর্তী পুঁজিবাজার এখনো স্থিতিশীল নয়। এখনো বিভিন্ন ধরনের কারসাজির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের তেমন একটা নজরদারি নেই।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের কিছু চেয়ারম্যান ও সদস্যের সহায়তায় হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব বড় দুর্র্নীতি ও আত্মসাতের সাথে যেসব ব্যবসায়ী এবং পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা জড়িত তারা সবাই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে তাদের দু-একজন ছাড়া অবশিষ্টদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের অসততা ছাড়াও অদক্ষতা ও অযোগ্যতা এতই অসহনীয় যে, তা কোনোভাবেই আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয়।
আমাদের দেশে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া আছে। কিন্তু বিগত দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে দলীয় সরকারের অধীনে যে সব নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে এগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়ে দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে অধিক সচেষ্ট ছিল। এমনকি বর্তমানে যে নির্বাচন কমিশন কর্মরত সেটিও এরূপ অপবাদ থেকে মুক্ত নয়। সুতরাং নির্বাচন কমিশন যে দলীয় সরকার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত সেটির স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকলে তা কখনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে সুশাসন নিশ্চিতকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলে গণতন্ত্রের অবদান অপরিসীম। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলে তাদের পক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এবং দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর অবস্থান নেয়া সম্ভব। কিন্তু অস্বচ্ছ ও কলুষিত নির্বাচনের মাধ্যমে যখন কোনো দল বিজয় হাসিল করে তখন দেখা যায় অবৈধ পন্থায় বিজয় হাসিলের জন্য যাদের সহায়তা নেয়া হয় তাদের অনিয়ম, বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপ এরূপ দলীয় সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে সুশাসনের অনুপস্থিতি ও দুর্নীতির বিস্তৃতি এ প্রশ্নে দেশের সচেতন জনমানুষের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।
আমাদের দেশটির প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠী একই সমরূপতাসম্পন্ন। এরূপ সমরূপ জাতি নিয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো দেশ নেই। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুবই আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। তারা যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে সম্মিলিত প্রয়াসে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের রাষ্ট্্রটি সৃষ্টি-পরবর্তী যতটুকু অর্জন এর পেছনে মূল অবদান এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষসহ প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের। এ চারটি শ্রেণী সম্মিলিতভাবে আমাদের দেশের ভাগ্যোন্নয়নে অনন্য অবদান রেখে চললেও আমরা এখনো তাদের যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থ। কোনো এক সময় আমাদের জনসংখ্যা বর্তমান জনসংখ্যার অর্ধেক থাকলেও সে সময় আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দু’বেলা পেট ভরে আহারের সংস্থান হতো না। এখন সে অবস্থা না থাকলেও গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অনুপস্থিতি ও দুর্নীতি আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, অগ্রযাত্রা ও সম্ভাবনার চাকাকে থামিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন, যা প্রকারান্তরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট যেসব কনিষ্ঠ, অসৎ, অদক্ষ ও অযোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের কবল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে সুশাসনের বাধা পেরিয়ে সামনে চলার পথ প্রশস্ত করবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন