|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
সংশোধনী বাতিলে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়
27 August 2017, Sunday
বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংবিধানে ১৬টি সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছে। এ সংশোধনীগুলোর মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ এ পাঁচটির বৈধতা বিষয়ে আপত্তি উত্থাপনপূর্বক মামলা দায়ের করা হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ কর্তৃক সংশোধনীগুলো অবৈধ ঘোষিত হয়। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী দ্বারা যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনকালীন সামরিক সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানী শহর ঢাকার বাইরে বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর ও সিলেটে হাইকোর্ট বিভাগের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক অপসারণে সংসদীয় অভিশংসন প্রথার প্রবর্তন করা হয়।
পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ফলে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তন করা হয়। অষ্টম সংশোধনী বাতিল আদেশ দ্বারা সংবিধানের মূল ১০০ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হওয়ায় ঢাকার বাইরে স্থাপিত ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ বিলুপ্ত হয়। অষ্টম সংশোধনী বাতিল-পরবর্তী সংসদ কর্তৃক কোনো সংশোধনী আনয়নপূর্বক বাতিল আদেশটিকে কার্যকারিতা দেয়া হয়নি, যদিও বাতিল-পরবর্তী সংবিধান নতুনভাবে মুদ্রণকালে তথায় প্রতিস্থাপিত ১০০ অনুচ্ছেদ আগেকার রূপে স্থান পায়। অষ্টম সংশোধনী প্রবর্তন ও বাতিলের সময় সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতাসীন ছিলেন। এ সংশোধনী বিষয়ে সে সময়কার বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান সংশোধনীটির বিপক্ষে ছিল। আর তাই এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়া-পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আন্দোলনের ফসল কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের শাসনামলে সংবিধান পুনঃমুদ্রণকালে অনুচ্ছেদ নং ১০০ আগেকার রূপে ফিরে আসে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল আদেশে আপিল বিভাগ সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে স্থান ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনঃস্থান পাওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা পুনর্বহাল করে। পুনর্বহাল আদেশে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অষ্টম সংশোধনী বাতিল ও মূল ১০০ অনুচ্ছেদের পুনর্বহালকে নজির হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়।
প্রণিধানযোগ্য যে, যে প্রেক্ষাপটে সংবিধান পুনঃমুদ্রণকালীন মূল অনুচ্ছেদ নং ১০০ সংসদের হস্তক্ষেপ ব্যতীত সংবিধানে পুনঃস্থাপিত হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপট তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোভাবদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় দলটির পক্ষ থেকে বাতিল আদেশটিকে কার্যকর রূপ দেয়ার জন্য সংসদ কর্তৃক কোনো কার্যক্রম গৃহীত হবে না এবং সংবিধান পুনঃমুদ্রণের মাধ্যমেও আদালত কর্তৃক পুনর্বহালকৃত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা সংবিধানে সন্নিবেশিত আকারে স্থান পাবে না। দলটির নীতিনির্ধারকদের যুক্তি পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল-পরবর্তী পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দেয়ায় আদালত কর্তৃক পুনর্বহালের আদেশ আগেকার নজির অনুসরণে সংসদের অনুমোদন ব্যতিরেকে সংবিধানে পুনঃস্থাপনের সুযোগ নেই।
আমাদের সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস হলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। কিন্তু কোন্ আদালত কী পদ্ধতিতে বাতিল কার্যটি সমাধা করবে এ বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ। অনুরূপভাবে সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে সংবিধানের অপর কোনো বিধান সাংঘর্ষিক হলে এর নিষ্পত্তি বিষয়ে সংবিধানে কোনো কিছু ব্যক্ত করা হয়নি। সংবিধানের এ সীমাবদ্ধতাটিকে অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনী প্রণয়নকালীন হাইকোর্ট বিভাগের রিট ক্ষমতা খর্বপূর্বক আইনের মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন।
সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রিটের মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধান বা আইন বাতিল ঘোষিত হলে যেসব প্রশ্নের উদয় হয় তা হল (ক) বাতিল আদেশ দ্বারা শপথের কোনোরূপ ব্যত্যয় হয় কিনা; (খ) সংসদ ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে কিনা এবং (গ) সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন সংসদের কার্যধারার অংশ কিনা।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের চারটি প্রকারভেদ থাকলেও সবার শপথ এক ও অভিন্ন। শপথ গ্রহণ করাকালীন প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতের অপর তিন ধরনের বিচারককে ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা বিষয়ে শুনানিকালীন কোনো কোনো অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছিল প্রধান বিচারপতি বা একজন বিচারক শপথ গ্রহণ করাকালীন সংবিধান বা যে কোনো আইন যে অবস্থায় থাকে তার সপঠিত শপথের মধ্যে আবদ্ধতার কারণে তার পক্ষে এ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রজাতন্ত্র বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনকালে কোনো ব্যক্তির আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে কার্য দ্বারা কোনো নাগরিক সংক্ষুব্ধ হলে তিনি সমফলপ্রদ প্রতিকার না থেকে থাকলে রিটের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারেন। এরূপ প্রতিকার প্রার্থনার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়ন কার্য ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে কিনা তা বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে কোনো বিল সংসদে উত্থাপন, এর ওপর আলোচনা এবং সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি সংসদের কার্যধারা। সংসদের এ কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ সাংবিধানিকভাবে বারিত। আইন প্রণয়নবিষয়ক সংসদের কার্যধারা যখন সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়, রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতিরেকে এটি আইনে পরিণত না হলেও সংসদ কর্তৃক অনুমোদন-পরবর্তী রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপনের পর নির্ধারিত সময় শেষে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করুন বা না করুন তা বিলটি আইন হিসেবে কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখা দেয় না। রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান বা না প্রদান নিছক আনুষ্ঠানিকতা বিধায় আইন প্রণয়ন বিষয়ে মুখ্য হল সংসদ সদস্যদের দ্বারা আইনটি অনুমোদিত হয়েছে কিনা। অনুমোদনের সামগ্রিক প্রক্রিয়া সংসদের কার্যধারা হওয়ায় রিটের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বৈধতাবিষয়ক শুনানি গ্রহণের মাধ্যমে তা বাতিলকরণ অনুচ্ছেদ নং ৭৮(১)-এ বর্ণিত বিধানের হানি ঘটায় কিনা তা দেখার বিষয়। উল্লেখ্য, দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে কার্যধারা বলতে আর্জি দাখিল হতে রায় ঘোষণা অবধি সামগ্রিক কার্যক্রমকে বোঝায়। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও কার্যধারা বলতে এজাহার দায়ের বা নালিশি দরখাস্ত দাখিল হতে রায় প্রদান পর্যন্ত সামগ্রিক কার্যক্রমকে বোঝায়। অর্থাৎ একটি মামলার শুরু থেকে শেষ হল মামলাটির কার্যধারা। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কার্যধারার মতো সংসদের কার্যধারাও ভিন্ন হওয়ার নয়।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস আইন বাতিল বলে গণ্য হবে মর্মে সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও সেখানে আদালত ও পদ্ধতির বিষয়টি অনুল্লিখিত। সমভাবে সংবিধানের কোথাও কোনো আদালতকে কোনো আইন পুনর্বহালের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। অনেকের দাবি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগকে অনুচ্ছেদ নং ১০৪-এর আওতায় উক্ত বিভাগের বিচারাধীন মামলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে উক্ত ক্ষমতাবলে পুনর্বহালের আদেশ দেয়া হলে তা আইনানুগ নয় এমন প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। দেওয়ানি আদালতসমূহ দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫১ ধারা এবং সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১-এ ধারার অধীন যে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তা কেবল সুনির্দিষ্ট বিধান বা বিধিনিষেধের অনুপস্থিতিতে অনুমোদিত। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইলে সে ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট বিধান বা বিধিনিষেধ থাকলে তা বোধকরি অনুমোদিত নয়। দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫১ ধারার অধীন প্রদত্ত ক্ষমতা যে কোনো দেওয়ানি আদালত প্রয়োগ করতে পারে; অপরদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১-এ ধারার অধীন প্রদত্ত ক্ষমতা কেবল সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ প্রয়োগ করতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগকে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের অধীন সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাসহ এর সম্মুখে বিচারাধীন সব শ্রেণীর মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর তাই এ কারণে বলা হয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১০৪ দেওয়ানি কার্যবিধির ধারা নং ১৫১ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নং ৫৬১-এ-এর সমার্থক। এ বিষয়ে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ধারা নং ৬ উপধারা (১) প্রাসঙ্গিক। উক্ত উপধারায় বলা হয়েছে, বাতিল কার্যকরকালীন কোনো কিছু অকার্যকর বা অস্তিত্ববিহীন থাকলে বাতিল আদেশ দ্বারা তা পুনর্জীবিত করা যায় না। স্পষ্টত আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলকালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা সংবিধানে অকার্যকর বা অস্তিত্ববিহীন অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় বাতিল ও এর পরিণতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধানের উপস্থিতিতে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুনর্বহাল আদেশ প্রদানের যৌক্তিকতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। উল্লেখ্য, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হলেও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট অপরাপর আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রযোজ্য, সংবিধানের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাছাড়া পঞ্চম সংশোধনী বাতিলবিষয়ক সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে একটি বাতিল বিধানকে আদালত কর্তৃক বৈধতা বা সিদ্ধতা দেয়া যায় না।
সংবিধান সংশোধন বিষয়ে বর্তমানে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১৪২-এ সংসদের যে ক্ষমতা দেয়া আছে তাতে উল্লেখ রয়েছে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অনুমোদিত হলে সংবিধানের যে কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের মাধ্যমে সংশোধিত হতে পারবে।
সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নব সন্নিবেশিত অনুচ্ছেদ নং ৭খ-এ শর্তারোপ করে অনুচ্ছেদ নং ১৪২-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংশোধনযোগ্য কতিপয় অনুচ্ছেদকে সংশোধনঅযোগ্য করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদগুলো হল প্রস্তাবনাসহ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহ।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিলকৃত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে দেখা হলে সপ্তম ভাগে অন্তর্ভুক্ত সব অনুচ্ছেদই মৌলিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এরূপ বিবেচনা অনুমোদিত হলে এ ভাগে অন্তর্ভুক্ত সব অনুচ্ছেদই সংশোধনঅযোগ্য। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের জনমানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স বৃদ্ধির আবশ্যকতা দেখা দিলে সে পথটি যেমন রুদ্ধ, অনুরূপভাবে সুপ্রিমকোর্টর বিচারকদের অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৫ এবং ৬৫ থেকে ৬৭-তে বৃদ্ধি প্রশ্নবিদ্ধ।
সংসদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত এবং পৃথিবীর কোনো দেশে এটি বিতর্কিত নয়। সংসদ জনগণের সমার্থক, পরিপূরক নয়। সংসদ সরাসরি জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান সংসদের সৃষ্টি। সৃষ্টি কখনও স্রষ্টার চেয়ে বড় হতে পারে না।
দেশের সর্বোচ্চ পদধারী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে সংসদীয় অপসারণ ব্যবস্থা বা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা যেটিই কার্যকর থাকুক না কেন, তারা সংসদ বা সংবিধান কোনোটিরই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়- নিজ বিবেক ও সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহি এমন দাবি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের আমূল পরিবর্তন ঘটানো হলেও এটি বাতিল ব্যতিরেকে পঞ্চম সংশোধনী প্রণয়ন সম্ভব হওয়ায় আদালত কর্তৃক পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল অনাবশ্যক ছিল মর্মে প্রতীয়মান হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে আদালতকে উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার অনাহুতভাবে আদালতকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেয়। যে কোনো রাজনৈতিক বিষয় আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি না হলেই আদালতকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা যায়।
পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালত কর্তৃক বাতিল বিষয়ে দেশের বড় দুটি দলের অবস্থান ভিন্নমুখী। আর তাই ক্ষমতার পটপরিবর্তনে উক্ত সংশোধনীসমূহ বাতিল ঘোষণা অবৈধ ছিল দাবিতে পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চাওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা ফলপ্রদ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল-পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো মহল কর্তৃক এটিকে যেভাবে পূর্বপরিকল্পিত বলা হচ্ছে তা ইতিপূর্বে আদালত কর্তৃক বাতিলকৃত পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে সমপ্রশ্নের জন্ম দেয়।
সংবিধানের সংশোধনঅযোগ্যতা স্থায়ী বিষয় নয়। আর তাই সংশোধন বিষয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ নং ১৪২-এ সন্নিবেশিত (১ক), (১খ), (১গ), (১ঘ) ও (২) দফাসমূহের মাধ্যমে শর্তারোপ যেমন স্থায়ী হতে পারেনি, অনুরূপভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত অনুচ্ছেদ নং ৭খ-এর মাধ্যমে শর্তারোপ যে স্থায়ীভাবে বহাল থাকবে, এর নিশ্চয়তা আছে কি?
আমাদের সংবিধানে সাংবিধানিক আদালত বা সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠনের বিধান না থাকায় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত হলে তা নিরসনে উল্লিখিত জটিলতার কারণে বিপত্তির উদ্ভব হয়। এরূপ বিপত্তি নিরসন করে ভবিষ্যতে এ সমস্যাটির সুরাহায় পৃথক এখতিয়ারসম্পন্ন সাংবিধানিক আদালত বা বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। এর পাশাপাশি সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদের অনুবলে রাজধানী শহরের বাইরে একাধিক জেলা শহরে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ স্থাপন এবং ৪৪(২) অনুচ্ছেদের অনুবলে জেলা জজ আদালতসমূহকে নিজ নিজ এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ১০২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে এর সব বা যে কোনো ক্ষমতা প্রদান বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া জরুরি।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন