|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা
29 August 2017, Tuesday
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অপর সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করে থাকেন। উপরোল্লিখিত উভয় পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা দেয়া হলেও তার পক্ষে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে যিনি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন তাকে ছাড়া অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতির পক্ষে এ পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। একইভাবে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে বিবেচনায় না নিয়ে অপর কাউকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হলে সে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়, যদিও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের একাধিক নজির রয়েছে। এ ধরনের লঙ্ঘন রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার কারণে হয়েছে নাকি প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষায় হয়েছে- এমন প্রশ্নের উঠলেও শেষোক্ত কারণটি যে সিদ্ধান্ত নেয়ায় মুখ্য ছিল তা দেশবাসী অনুধাবন করতে সক্ষম।
উচ্চাদালতের বিচারক চার ধরনের : প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী ও অস্থায়ী বিচারক। রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে অপর তিন শ্রেণীর বিচারক নিয়োগ করে থাকেন। এসবের প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী ও অস্থায়ী বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫ নম্বর অনুচ্ছেদে যেসব যোগ্যতার বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো যোগ্যতার উল্লেখ না থাকায় আপিল বিভাগ অথবা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে কর্মরত নন এমন কাউকে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া সাংবিধানিকভাবে বারিত নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয় উল্লেখ রয়েছে- ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং ন্যূনপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে ১০ বছর ওকালতির অভিজ্ঞতা অথবা নিম্ন আদালতে ১০ বছর বিচারিক কর্ম পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। উপরোল্লিখিত যোগ্যতা ছাড়াও অতিরিক্ত যোগ্যতা হলো- সংসদ প্রণীত কোনো আইনে উল্লিখিত যোগ্যতা। অতিরিক্ত যোগ্যতা বিষয়ে সংসদে আজ পর্যন্ত কোনো আইন প্রণীত না হওয়ায় উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রায়ই শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, বিচার বিভাগের নিম্নতম পদ সহকারী জজ। সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে একজন প্রার্থীকে মাধ্যমিক থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক অথবা স্নাতক (সম্মান) অথবা এলএলএম পর্যন্ত সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে হবে। উচ্চাদালতের বিচারকদের অতিরিক্ত যোগ্যতা বিষয়ে আইন প্রণীত না হওয়ার কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নির্ধারিত না হলেও বিচার বিভাগের নি¤œতম পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত থাকায় এর নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির উচ্চাদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে এ নিয়োগ কার্যটি সমাধা হয় বলে নিয়োগবিষয়ক সারসংক্ষেপ প্রেরণকালীন শিক্ষাগত যোগ্যতা যে সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার নিম্নের নয় এ সংক্রান্ত প্রত্যয়ন জরুরি। কিন্তু বিগত দুই যুগ ধরে এসব নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টির ওপর কোনোরূপ গুরুত্বারোপ করা হয়নি।
আমাদের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত নিয়ম হলো- উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্নরা নিম্নতম যোগ্যতাসম্পন্নদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবেন। আর তাই উচ্চাদালতের বিচারকদের অধস্তন আদালতের বিচারকদের চেয়ে উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ উন্নত বিশ্বের সব দেশে উচ্চাদালত ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের যোগ্যতা হলো যথাক্রমে- এলএলএম সর্বোচ্চ মান ও মধ্যম মান। আমাদের উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্যটি সমাধা করেন বলে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রত্যাশিত মানের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেই নিশ্চিত করতে হবে এবং এর পাশাপাশি সৎ, দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও মেধাবীরা যেনো নিয়োগ পায়, তাকেই এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
উচ্চাদালতের বিচারকেরা শপথের অধীন এবং শপথগ্রহণ ছাড়া তারা পদে আসীন হন না। উচ্চাদালতের একজন বিচারক পদ থেকে অবমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে তার স্বপঠিত শপথ থেকেও মুক্ত হয়ে যান। উচ্চাদালতের একজন বিচারককে শপথগ্রহণ করাকালীন অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয়- তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করবেন।
উচ্চাদালতের একজন বিচারক সংবিধান বা আইন অনুমোদন করে না এমন কোনো কাজ করলে, তা সংবিধান লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। এরূপ কাজকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অপরাধ গণ্যে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে। একজন বিচারকের জন্য এরূপ কাজের মধ্যে যা অন্তর্ভুক্ত তা হলো- অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করা। একজন বিচারকের পক্ষে সংবিধান বিরোধী যেকোনো কাজই এর প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহতের সমরূপ। অনুরূপভাবে একজন বিচারকের পক্ষে ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করার উপলক্ষ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা পক্ষপাতদুষ্ট।
উচ্চাদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে ’৭২ সালের সংবিধানে সংসদীয় অপসারণ প্রথা কার্যকর ছিল। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কারণ দর্শানোর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের বিধান কার্যকর করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথার প্রবর্তন করা হয়। ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা পুনঃ সংসদীয় অপসারণ প্রথা কার্যকর করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা পুনর্বহাল করা হয়।
আইনজ্ঞদের একটি অংশের অভিমত, আপিল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল পরবর্তী সংসদ যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে শূন্যতা থেকে যাচ্ছে। অপর দিকে এর সাথে দ্বিমতকারীদের অভিমত উচ্চাদালতে বাতিল হওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করায় এটি এখন সংসদে আইন প্রণয়ন ছাড়াই কার্যকর বিধানরূপে সংবিধানে ঠাঁই পেয়েছে। সংসদে শেষোক্তদের অভিমতটি গৃহীত না হলে এক দিকে যেমন এ বিতর্কের অবসান হবে না, অপর দিকে শূন্যতা থেকেই যাবে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানাবলি অবলোকনে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নির্দেশিত না হলে কাউন্সিল একজন বিচারকের অপসারণ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির এরূপ নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ অনুপস্থিত।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধান বিচারপতি এবং অপরাপর বিচারকদের মধ্যে পরবর্তী যে দু’জন কর্মে প্রবীণ তাদের সমন্বয়ে গঠিত। যে ক্ষেত্রে কাউন্সিলের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অপসারণবিষয়ক কার্যক্রম গৃহীত হয় সে ক্ষেত্রে পরবর্তী কর্মে প্রবীণ বিচারক সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠিত হয়।
সংসদীয় অপসারণ প্রথার ক্ষেত্রে সংসদে গৃহীত প্রস্তাব সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের দ্বারা অনুমোদিত হলে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণ কার্যকর করা হয়। সংসদীয় অপসারণ প্রথা কার্যকর থাকাকালীন সংসদ কর্তৃক কোনো বিচারকের অপসারণ কার্যক্রম গৃহীত হয়নি। অপর দিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা কার্যকর থাকাকালে তিনজন বিচারকের বিরুদ্ধে অপসারণ কার্যক্রম গৃহীত হলে বিষয়টি কাউন্সিলের কাছে তদন্তাধীন থাকাকালে তারা রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত স্বীয় স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করেন।
বিদেশ ভ্রমণ বা অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধান বিচারপতির তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থতার ক্ষেত্রে সচরাচর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে অস্থায়ীভাবে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দফতর থেকে রাষ্ট্র্রপতি বরাবর যে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়, তা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পৌঁছে।
বর্তমানে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অপর কোনো বিচারকের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন সুপ্রিম কোর্ট থেকে জারি করা হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পূর্ববর্তী এ প্রজ্ঞাপন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হতো। কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিরূপে দায়িত্ব পালনের সময় সরকারের এ ক্ষমতাটি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ অপর কোনো বিচারকের সরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজন দেখা দিলে ভ্রমণসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন দেশটির আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির তার এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়া অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম তাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিতে পারেন যদি যেকোনো কারণে তার কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। এ অসমর্থতা অসুস্থতাজনিত কারণ ছাড়াও অন্য যেসব কারণে হতে পারে তা হলো- সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণজনিত অভিযোগ যেমন দুর্নীতিগ্রস্ততা বা পক্ষপাতদুষ্টতা। এরূপ অসামর্থের কারণে কর্মে প্রবীণতমের কাছে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব হস্তান্তর প্রধান বিচারপতিকে পদ থেকে অপসারণের সমার্থক। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি যে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ সে প্রশ্নে কারো মধ্যে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন