|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
রোহিঙ্গা সমীকরণ এবং সু কি ও মোদি
12 September 2017, Tuesday
বর্তমান মিয়ানমারের সাবেক নাম বার্মা। অনুরূপ বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান। একদা আরাকান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। এখন এটি বার্মার একটি প্রদেশ। আরাকান নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এবং মূল ভূখণ্ড বার্মা থেকে পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন। অতীতে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে আরাকান বিস্তৃত ছিল। পরে আরাকান পার্বত্য জেলা এবং দক্ষিণের বেশির ভাগ অঞ্চল আরাকান থেকে পৃথক করায় বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪২০০ বর্গমাইল। বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক এবং বর্তমানে প্রদেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন আর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও দুই লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বর্মি নাগরিক রয়েছে। বার্মার ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। বার্মার ৭০ লাখ মুসলমানদের বিরাট অংশ আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধদের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, বর্তমানে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনদের দিয়ে অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং নিবন্ধনহীন শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার জেলায় যে দু’টি শরণার্থীশিবির পরিচালনা করছে, এ দু’টিতে নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার। মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের আগের সেনাসমর্থিত থিন সেনের সরকারের সময় রোহিঙ্গা শব্দটির ওপর নিষেধাঙ্গা আরোপ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়টি বাঙালি নামে অভিহিত হবে মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। এ ধরনের নির্দেশ একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও থিন সেনরা এগুলোর থোড়াই তোয়াক্কা করেন। আজ তারা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য যে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নিগৃহীত ও উৎপীড়ন করছে তা ইতিহাসে বিরল। বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত সম্প্রদায়।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার কথা। মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু জন-অধ্যুষিত ভারতবর্ষের লাখ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তনের পর বলা হতো, জীব হত্যা মহাপাপ। বর্তমানে ধর্মনিষ্ঠ বৌদ্ধরা নিরামিষভোজী হলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বেশির ভাগ মানুষ উপাদেয় খাদ্য হিসেবে পরম তৃপ্তির সাথে জীবের গোশত ভক্ষণ করছেন। যে নৃশংসতায় আরাকানে বার্মার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে, তাতে এদের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলার অবকাশ আছে কি না, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয় এবং তারা চটগ্রাম থেকে দেশান্তরী হয়ে মিয়ানমারে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় এক হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করে আসছে। ১৭৮৫ সালে বার্মার রাজা বোদাপাউপিয়া আরাকান দখল করলে সেখান থেকে ব্যাপক হারে রাখাইন বা মগ ও রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামে দেশান্তরী হয়।
বোদাপাউপিয়ার বাহিনী আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্দয়ভাবে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন করে এবং সে সময় জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে অনেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বার্মা ব্রিটিশদের দখলে এলে দীর্ঘ দিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নির্বাসনে থাকা রোহিঙ্গারা আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে প্রবেশ করে। বার্মা ব্রিটিশদের অধীনে আসার পর এটিকে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হতো। ১৯৩৭ সালে বার্মাকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে পৃথক করা হয়। সে সময় রোহিঙ্গারা আধিপত্যবাদের শিকড় থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বার্মাকে ভারতবর্ষ হতে পৃথক করার পর ১৯৩৮ সালে আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম মারাত্মক দাঙ্গা হয় এবং সে দাঙ্গা এখনো বারবার ঘটছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বার্মার উগ্র জাতীয়তাবাদীরা জাপানিদের বার্মা দখল করাকে সমর্থন করে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে লিপ্ত হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা ফের দখল করলে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে আসার সুযোগ ঘটে। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় বার্মার নেতা ছিলেন অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সান। তিনি এক আদেশ বলে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অং সানকে হত্যার পর অচিরেই উনু তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং তার শাসনামলেও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে। কিন্তু সামরিক শাসক নেউইন ক্ষমতাসীন হলে ফের রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের উৎখাতের জন্য গণহত্যা চলতে থাকে। জেনারেল নেউইন রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। সে সময় থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হওয়া শুরু হয় এবং ১৯৭৮ সালে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আগমন ঘটে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে দেশান্তরী হওয়ার বিষয়টি জাতিসঙ্ঘ ও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সহানভূতি অর্জনে সক্ষম হয় এবং জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় তাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন শুরু হয়, কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই ধারা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এলেও জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে, তাদের ফেরত নিতে বাধ্য করা এবং ফের যেন মিয়ানমারে অত্যাচার ও নিপীড়ন না হয় এবং কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন না ঘটে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্তমানে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। মিয়ানমারে তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার- কোনোটিই নেই। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। বাংলাদেশ সাময়িক দুর্ঘটনায় ও স্বল্পকালের জন্য রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিরাপত্তাহীনতার কারণে ও উৎপীড়নের ভয়ে অবৈধভাবে যে বিপুল রোহিঙ্গার শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটেছে, তাদের নগণ্য সংখ্যক মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করেছে।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ভ্রাতৃপ্রতিম রোহিঙ্গাদের সমস্যার ব্যাপারে অবহিত এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এমন অনেক রোহিঙ্গা আছেন, যারা ৫০ ও ৬০-এর দশকে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। তাদের অনেকে সেখানকার নাগরিকত্বও লাভ করেছেন। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বৈধভাবে তাদের পক্ষে অন্য কোনো রাষ্ট্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম অবৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
বাংলাদেশের কিছু অসাধু রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ অর্থে বশীভূত হয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদান ও বিদেশ গমনে সহায়তা করে আসছেন। এমন অনেক অবৈধ রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা দীর্ঘ দিন ধরে এ দেশে বসবাসের কারণে এ দেশের বাঙালিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। তাদের আরাকানের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রত্যাবর্তন অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের সংবিধানে যেকোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা ১৮২৩ সাল থেকে বার্মায় বসবাস করে আসছে, তারা বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত।
কিন্তু রহস্যজনকভাবে এ সংজ্ঞায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভ্ক্তু করা হয়নি। এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রধান সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) অভিমত, রোহিঙ্গাদের অধিকারবঞ্চিত করে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হলে মিয়ানমারে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যুক্তি নেই? আরএসও’র নেতারা জোর দিয়ে বলেন, ‘জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত কোনো রাষ্ট্রের নিজ দেশের নাগরিকদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অভিহিত করে তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে কাউকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। জাতিসঙ্ঘের উচিত এ ধরনের দ্বৈতনীতি অবলম্বনকারী দেশকে জাতিসঙ্ঘের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা।’ মিয়ানমারের কথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি রহস্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের উৎপীড়ন ও নিপীড়ন বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
তার ভয়, তিনি রোহিঙ্গাদের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত অধিকারের প্রতি সমর্থন জানালে ব্যাপক হারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভোটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। তার এমন আচরণ তিনি আদৌ গণতন্ত্রের পক্ষে কি না এবং তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত হয়েছে, সে প্রশ্নে প্রচণ্ড বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দিয়ে রাখাইন রাজ্যের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চৌকি আক্রান্ত হয়ে কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা ব্যাপক হারে নিরীহ ও বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ রোহিঙ্গাদের নিধন শুরু করে; যা এখনো চলছে। নিধনের পাশাপাশি তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের মূল্যবান সামগ্রী লুটপাট করে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই নৃশংস অত্যাচার ও নিপীড়নের সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান পাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নৃশংসতা ও হত্যার জোর প্রতিবাদ উঠেছে। বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার জন্য উঠলে চীনের ভেটোর কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক যে অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হচ্ছে এটিকে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যা বলে অভিহিত করছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড বিষয়ে যেসব মুসলিম রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তারা হলো- তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। সার্কভুক্ত ক্ষুদ্র মুসলিম রাষ্ট্র মালদ্বীপ রোহিঙ্গা নিধন ও তাদের প্রতি অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদে মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। রুশ অধীনস্থ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ায় মিয়ানমারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ হয় তাতে পাঁচ লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রেও ছোট-বড় বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে এ অঞ্চলের দু’টি প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন ও ভারত সম্পূর্ণ অবহিত হলেও উভয় রাষ্ট্র এ বিষয়ে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। মিয়ানমারের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটা লাঘব করার প্রয়াসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরকালে রোহিঙ্গা সঙ্কট ‘সহিংস বিদ্রোহ’ আখ্যা দিয়ে দেশটিকে কাছে টেনে নেয়ার সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। অপর দিকে, চীনের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সূত্রে বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে- বাংলাদেশ নিজেকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করলে দেশটি বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক পন্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। তারা এ অঞ্চলে তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য সশস্ত্র পন্থা অবলম্বনের ফন্দিফিকির আঁটছে।
অতীতের বৈধ-অবৈধ পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে এবার নারকীয় নৃশংসতার পর যে হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে তাতে অচিরেই এ সংখ্যা রেকর্ড ভঙ্গ করবে, এমনটিই অনুভূত হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। তাই বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘ দিন এ বিপুল শরণার্থীর বোঝা বহন সম্ভব নয়। আর মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে উদ্যোগী না হলে সেখানের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যে ধাবিত হবে তা রোধ করা বোধকরি সেখানকার সেনা সরকারের পক্ষে দুরূহ হবে।
বাংলাদেশে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। এখানে দু-একটি বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলেও তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা আর দাঙ্গা এক নয়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ইতিহাসকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকারে পরিণত করছে তা কোনো সভ্য দেশের পরিচায়ক নয়। বিশ্বে মিয়ানমার নিজেকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দেখতে চাইলে তাকে অবশ্যই রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় রোহিঙ্গাদের চূড়ান্ত পদক্ষেপের পথে ঠেলে দেয়ার দায় মিয়ানমারের শাসনভার যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা কি এড়াতে পারবেন?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন