|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
রোহিঙ্গা প্রশ্নে সব রাষ্ট্রের অবস্থান অভিন্ন হতে হবে
18 September 2017, Monday
মিয়ানমারের বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান। এক সময় আরাকান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। এখন এটি মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। আরাকান নাফ নদী দ্বারা বাংলাদেশ থেকে এবং মূল ভূখণ্ড মিয়ানমার থেকে পাহাড় দ্বারা বিচ্ছিন্ন। অতীতে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে আরাকান বিস্তৃত ছিল। পরবর্তী সময়ে আরাকান পার্বত্য জেলা এবং দক্ষিণের অধিকাংশ অঞ্চল আরাকান থেকে পৃথক করায় বর্তমানে আরাকানের আয়তন হয়েছে ১৪ হাজার ২শ’ বর্গমাইল। বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক এবং বর্তমানে প্রদেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও দু’লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বার্মান নাগরিক রয়েছে। মিয়ানমারের ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। মিয়ানমারের ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশি আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধদের দ্বারা শাসিত হয়েছে।
আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাসরত অপরাপর জাতিসত্তা থেকে আলাদা। এ জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত অধিবাসীদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক হিন্দু ব্যতীত বড় অংশটি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় দেশটির শাসক ছিলেন বর্তমান মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি’র পিতা অং সান। অং সান তার শাসনামলে এক আদেশ বলে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অং সানকে হত্যার পর সামরিক শাসক উনু তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং তার শাসনামলেও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। সামরিক শাসক নেউইন ক্ষমতাসীন হলে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের উৎখাতের নামে গণহত্যা চলতে থাকে। নেউইন রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। সে সময় থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের আগমন শুরু হয় এবং ১৯৭৮ সালে দু’লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এভাবে একপর্যায়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লাখে উন্নীত হয়। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে আলোচনা হলেও তা কখনও ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর যেভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে তাতে অনুমান করা যায়, অচিরেই রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ অতিক্রম করবে অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও ইতিপূর্বে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এক সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে ভারত নমনীয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের তার দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে এবং ভবিষ্যতে নতুনভাবে কোনো রোহিঙ্গাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হবে না- এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। রোহিঙ্গা বিষয়ে ভারতের অবস্থানের যে নাটকীয় পরিবর্তন, এর পেছনে যে কারণ তা হল, মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব হ্রাস করা। অপরদিকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের অবস্থানও সুস্পষ্ট নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নসহ তাদের দেশ ত্যাগের বিষয়টি দু’দফা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনায় উঠলে চীনের ভেটোর কারণে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়। অতঃপর তৃতীয় দফায় রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচার ও নিষ্পেষণের পরিসমাপ্তি টানা বিষয়ে আনীত প্রস্তাবটিতে চীন বিরোধিতা না করার কারণে এটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বিশ্বস্ত কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ মর্মে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশ নিজেকে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে চলার পথ অনুসরণ করলে চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক হয়, এমনভাবে রোহিঙ্গা সমস্যাটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এসব মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করা না হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এটির সমাধান করতে হবে। বলপ্রয়োগ বিষয়ে যে ধরনের সাহায্য ও সহায়তার প্রয়োজন, মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সে ধরনের সাহায্য ও সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণার্থীর ভার বহনের জন্য কোনোভাবেই সামর্থ্যবান নয়। আর তাই বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যাটির আশু সমাধান প্রয়োজন। ভারত নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু দাবি করে বিধায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে ভিন্নতর হবে, এটি প্রত্যাশিত নয়।
বর্তমানে সর্বাধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বসবাস করছে। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস রয়েছে। এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। ভারত ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বর্তমান মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সেনা সমর্থিত সু চি সরকারের মধ্যে কোনোরকম তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ১৯৭৯ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবর্তন বিষয়ক যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, সেখানেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার রাষ্ট্রটি ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পূর্বে দীর্ঘকাল যাবত বংশপরম্পরায় সেখানে বসবাস করে আসছে। তাই কোনোভাবেই দেশটির নাগরিকত্বের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।
মিয়ানমারে ১৪টি বৃহৎ জাতিসত্তা এবং ২শ’র কাছাকাছি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। এসব জাতিসত্তার একটির ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অপরটির ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা দীর্ঘদিন যাবৎ দেশটির সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে একটি ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের পরিধির মধ্যে আনার প্রয়াস চালিয়ে এলেও তা সফলতা পায়নি। এ ধরনের প্রয়াস পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রেই সফল হয়নি। মিয়ানমারে বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অন্তত ৩/৪টি পৃথক জাতিসত্তা রয়েছে, যারা সশস্ত্রপন্থায় স্বাধিকারের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত। এদের কেউ কেউ চীনের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে, আবার কেউ কেউ ভারতের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে। বাংলাদেশ কখনও রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র পন্থায় তাদের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেনি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীনতা লাভের দাবিতে সোচ্চার এমন কোনো সংগঠিত গোষ্ঠীর তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না বা তাদের মধ্যে এযাবতকাল পর্যন্ত কোনো একক নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেনি। আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অধিকার আদায় প্রশ্নে একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংগঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে তাদের মধ্য থেকে কেউ অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সম্প্রতি আরাকান রোহিঙ্গা সেলভ্যাশন আর্মি (আরসা) নামক যে সংগঠনটির নাম উদ্ধৃত করে তথাকার পুলিশ ও সেনা চৌকিতে সশস্ত্র হামলার কথা মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। বিশ্বস্ত বেশ কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সম্পূর্ণ আরাকান অঞ্চল রোহিঙ্গাশূন্য করার জন্য আরসা’র নামে মিয়ানমারের শাসকরাই এ অভিযানটি পরিচালনা করেছে। আরাকানের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে বাংলাদেশ ও ভারত ব্যতীত অপর কোনো রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে এ ধরনের সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান যে অবস্থান, তাতে রাষ্ট্রটি কোনোভাবেই এ ধরনের সশস্ত্র পন্থায় রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে না। এ অবস্থায় উদ্ভূত সমস্যা সেখানকার সেনা শাসকদের দ্বারা যে সৃষ্ট, এটির ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে।
মিয়ানমারের স্বাধীনতাপরবর্তী সামরিক শাসক নে উইনের শাসনামল থেকে পরিকল্পিতভাবে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের যে বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার ফলে রোহিঙ্গারা আজ রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবেতরভাবে শরণার্থীর জীবনযাপন করছে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘদিন যাবত এ ধরনের শরণার্থীর বোঝা বহনে রাজি হবে না। আর তাই রোহিঙ্গা সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ ভূমিকা রাখা উচিত। আরাকানে বিদ্যমান সমস্যার টেকসই সমাধান হতে পারে আরাকানের মধ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের অবাধে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য একটি নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন করা। এ ধরনের নিরাপত্তা অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা মিয়ানমার সরকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী দ্বারা তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন