|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
মানবতার এক অনন্য নজির
30 September 2017, Saturday
বাংলাদেশকে বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দাবি করা হলেও এখনও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে দেশটির উত্তরণ ঘটেনি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১১ অনুযায়ী চরম দারিদ্র্যসীমা ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে ২৫ ও ৪০ ভাগ।
দারিদ্র্যসীমার এ হারকে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ ভাগের নিচে নামিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ লক্ষ্যটি অর্জিত হলে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে উপমহাদেশের প্রভাবশালী দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সামনে।
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়ে ফসলহানির ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রায় ৪৬ বছরের মধ্যে দেশটিকে ১৯৭৪, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে তিনটি বড় ধরনের বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ তিনটি বন্যায় দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বছর এ দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় দেশটির ওপর আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষ, গবাদি পশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং ২০০৭ সালে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে জান, মাল ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
উপরোক্ত প্রতিটি দুর্যোগের সময় দেখা গেছে এ দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী বিপন্ন মানুষের সেবায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে দুর্ভোগ লাঘবে সহায়তা করেছেন।
১৯৮৮ ও ১৯৯৮-এর বন্যায় যখন দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের বাড়িঘর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল তখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বন্যাকবলিত মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়ার জন্য রুটি বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের জলযানে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছেন।
এমনকি বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক যারা নিজেরাই দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জড়িত, এসব দুর্যোগে এরাও নিজেদের সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী একযোগে বিপন্ন ও দুর্গতদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য পৌঁছে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গেরিলা যোদ্ধাদের দেশের মানুষজন নিজেদের জীবন ও সম্পদকে তুচ্ছ করে আশ্রয়, খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। এ সহায়তার কারণে গেরিলাদের চোরাগোপ্তা হামলার পর দখলদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহায়ক দোসররা আশ্রয়দাতা পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যকে হত্যাসহ তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তারপরও এ দেশের মানুষ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চরম আত্মত্যাগের মানসে সহায়তা প্রদানে কখনও দ্বিধান্বিত হয়নি।
২.
মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ দেশটির স্বাধীনতা লাভের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আরাকানে বসবাসরত মুসলিমরা রোহিঙ্গা নামে অভিহিত। তারা সেখানে বংশপরম্পরায় হাজার বছরের অধিক সময় ধরে বসবাস করছে। মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো তারা জন্মগতভাবে মিয়ানমারের নাগরিক।
মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর দেশটির প্রথম ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বিবেচনায় সব ধরনের অধিকার ভোগ করার সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় সামরিক শাসক নে উইন ক্ষমতাসীন হলে।
তিনি অভিনব নাগরিকত্ব আইন দ্বারা ১৮২৩ সালের আগে থেকে যারা বংশপরম্পরায় মিয়ানমারের নাগরিক শুধু তাদেরই নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রোহিঙ্গাদের এক বড় অংশকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি জ্ঞাপনে অনীহা ব্যক্ত করেন।
নে উইনের এ ঘোষণার পর ১৯৬২ সালে রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে শরণার্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আগমন শুরু হয়, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত থাকে।
বিভিন্ন সময়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৯ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তির অধীন স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গার আরাকানে প্রত্যাবর্তন ঘটলেও আগত আশ্রয়প্রার্থীর বিপুল অংশ এখনও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানে অবস্থান করছে।
১৯৬২ থেকে ২০১৬ অবধি যেসব রোহিঙ্গা আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য হয়েছে সে তুলনায় ২০১৭ সালে অর্থাৎ চলতি বছরে আগত আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। এখনও প্রতিদিন অসহায় ও বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমন অব্যাহত রয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা ২৫ আগস্ট ২০১৭ তারিখে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামক একটি সশস্ত্র সংগঠন তাদের সেনা ও পুলিশ চৌকির ওপর হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনা সংঘটিত করেছে- এমন অভিযোগ তুলে সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চরম অত্যাচার শুরু করে।
আরাকানে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গারা নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ অভিমুখে পাড়ি জমায়।
রোহিঙ্গাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, আরাকানে আরসা নামক কোনো সশস্ত্র সংগঠনের কার্যকলাপ নেই। আরসার বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের দমনে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দেয়া হলে মিয়ানমার সরকার রাজি হয়নি।
বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় মনে হচ্ছে, আরসা কর্তৃক পুলিশ ও সেনা চৌকিতে আক্রমণের ঘটনা আরাকান থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়নের অজুহাতমাত্র এবং এটা দেশটির সেনাবাহিনী ও সরকারের সৃষ্ট কল্পকাহিনী।
২০১৬ সালে অনুরূপ অত্যাচার ও নিষ্পেষণের কারণে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে আমাদের সীমান্তরক্ষীদের বাধার মুখে তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এবারও ২৫ আগস্ট-পরবর্তী রোহিঙ্গাদের আগমনের ঢল নামলে প্রথমদিকে তারা এ দেশের সীমান্তরক্ষী কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু পরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা তুলে নেয়া হয়।
এ বছর রোহিঙ্গাদের প্রবেশের আগেই এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষাধিক। এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার মধ্যে শুধু ২৫ হাজার নিবন্ধিত; যারা জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় দুটি শিবিরে বসবাস করছে। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে বসবাসরত সাধারণ মানুষের সহায়তায় টিকে আছে।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী আবেগপ্রবণ, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন এবং অপরের দুঃখ-বেদনায় সহানুভূতিশীল। এবার যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিজেদের মাতৃভূমি ও ঘরবাড়ির মায়া ত্যাগ করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সামান্য অর্থ-সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের দুঃখ-বেদনায় মর্মাহত ও ব্যথিত।
অকস্মাৎ এ বিপুলসংখ্যক প্রবেশকারীর আশ্রয় ও খাদ্যের জোগান দেয়া এককভাবে সরকারের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় সাধারণ মানুষের সহায়তায় গঠিত এক হাজারের বেশি সেচ্ছাসেবী দল নিজেদের উদ্যোগে খাদ্য, বস্ত্র, অর্থের ব্যবস্থা করে তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছে। এসব স্বেচ্ছাসেবীর সাহায্য ও সহযোগিতার কারণে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে রোহিঙ্গারা।
এ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন পর্যায়ে বন্যার কবলে পড়েছে। বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। এদের খাদ্য সহায়তা ও পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছে এবং এ কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে।
নিজ দেশের মানুষ যখন বিপদের সম্মুখীন তখন এ দেশের মানুষ যেমন তাদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, অনুরূপ বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়াতে কোনোরূপ দ্বিধার মধ্যে পড়েননি তারা।
এমন নজির পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ বারবার বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রতিটি পরীক্ষায়ই তারা অতীতে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন, এবারও যে তাতে ব্যর্থ হবেন না তা এখনই স্পষ্ট।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন