|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
অর্থ ছাড়া ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার
11 December 2017, Monday
আমাদের দেশের রাজধানী শহর ঢাকার হজরত শাহজালাল র: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো পৃথিবীর অপরাপর দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে; তবে অন্যান্য দেশের ভিআইপি লাউঞ্জের সাথে আমাদের দেশের ভিআইপি লাউঞ্জের পার্থক্য হলো অন্যান্য দেশের ভিআইপি লাউঞ্জগুলো বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করে থাকে এবং এগুলো সরকারি-বেসরকারি যেকোনো ব্যক্তি ব্যবহার করতে চাইলে তাকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। আমাদের দেশের সরকারি ও বেসরকারি ভিআইপিরা কোনো ধরনের অর্থ না দিয়েই ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ লাভ করেন এবং ভিআইপি লাউঞ্জগুলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় ন্যস্ত। আমাদের দেশের যেসব ভিআইপি বিদেশ যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল র: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অর্থ পরিশোধ না করে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ নেন, তারা বিদেশের যেকোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর অর্থ দেয়া ছাড়া এ ধরনের সুযোগ লাভ করেন না। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী ভিআইপি যাত্রীদের জন্য প্রতিটি বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশের অনুরূপ বিদেশের বেশির ভাগ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জের ব্যবস্থা থাকলেও তা সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো ব্যক্তি কেবল অর্থ পরিশোধ করেই ব্যবহার করতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সচিব থেকে যুগ্ম সচিব অবধি এবং সমমর্যাদার কর্মকর্র্তারা ভিআইপি হিসেবে পরিগণিত। বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, এফবিসিসিআইয়ের ডাইরেক্টর, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভৃতি ভিআইপি হিসেবে পরিগণিত। এসব সরকারি ও বেসরকারি ভিআইপি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অর্থ না দিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী এ ধরনের একজন ভিআইপির বিদেশ যাওয়া ও বিদেশ থেকে আসার সময় তিনি ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থানকালীন তার সাথে দু’জন ব্যক্তি তাকে সেবাদানের জন্য অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের ভিআইপিদের যাওয়া-আসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুইয়ের অনেক অধিক ব্যক্তি ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থান করেন। এভাবে অতিরিক্ত ব্যক্তির অবস্থানের কারণে আমাদের ভিআইপি লাউঞ্জগুলোতে বিশেষত হজরত শাহজালাল র: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জগুলোতে প্রায়ই কোলাহল ও ভিড় লক্ষণীয়। আমাদের দেশে অবস্থানরত বিদেশী দূতাবাসে কর্মরত প্রাধিকার পাওয়া যেসব কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করেন ভিআইপি লাউঞ্জের কোলাহল ও সরগরম ভাব দেখে তাদের অনেককেই বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
এ পর্যন্ত অবসরে যাওয়া সচিবেরা অবসর পরবর্তী তিন বছর ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ লাভ করে আসছিলেন। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে সিদ্ধান্ত হয় যে, অবসরে যাওয়া সচিবেরা আজীবন ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করবেন। এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অবসরে যাওয়া সচিবদের এ সুযোগটি দেয়া হলে সচিব ও এর উচ্চ পদমর্যাদায় সরকারের অপরাপর বিভাগ থেকে যেসব কর্মকর্তা অবসর নিয়েছেন তাদেরও অনুরূপ সুবিধা দেয়ার দাবি উঠবে এবং এ দাবিকে নাকচ, উপেক্ষা বা অবজ্ঞা কোনোটিই করার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি অবসর-পরবর্তী ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের জন্য প্রাধিকার পেলেও উচ্চাদালতের অপরাপর বিচারকেরা অবসর-পরবর্তী এ বিষয়ে প্রাধিকার পাওয়া নন, যদিও তারা সচিবদের চেয়ে উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন। অবসর নেয়া সচিবদের পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সাংবিধানিক পদধারী এবং সাবেক সংসদ সদস্যদেরও আজীবন ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে, তা বাস্তবায়নের জন্য বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বর্তমানে সাবেক সচিব এবং সমমর্যাদার সাবেক কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সাংবিধানিক পদধারী এবং সাবেক সংসদ সদস্যের সংখ্যা অগণিত। এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে বর্তমানে ভিআইপি লাউঞ্জের অসহনীয় পরিবেশ আরো তীব্রতর হবে।
পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য ও উন্নত দেশে দেশের সামগ্রিক কল্যাণের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেখানে সরকারি বেসরকারি কোনো ব্যক্তিকে অর্থ ছাড়া ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে দেয়া হয় না, সেখানে আমাদের দেশে অর্থ ছাড়া ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের পরিধি বিস্তৃত করা কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
পৃথিবীর সব উন্নত দেশে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনমানুষকে সেবা দেয়া হয় তার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য মূল্য দেয়ার বিনিময়ে সেবা নিতে হয়। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। উন্নত দেশগুলোতে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার ওপর ন্যস্ত করায় এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ সরকারকে নিজস্ব তহবিল থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আর একান্তই রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ অর্থ ব্যয়ের আবশ্যকতা দেখা দিলে তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার অর্থ থেকে নির্বাহ করা হয়। আমাদের দেশে ভিআইপি লাউঞ্জের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সবকিছুই সরকারের পক্ষ থেকে পালন করতে হয় বিধায় এবং ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সরকার কোনো ধরনের অর্থ না হওয়ায় সাকুল্য ব্যয় জনগণ দেয় কর থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাখা অর্থ দিয়ে নির্বাহ করা হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশের মতো ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি নির্বিভেদে সব শ্রেণীপেশা ও পদমর্যাদায় আসীন ব্যক্তিদের জন্য মূল্য পরিশোধের প্রথা চালু করা হলে এবং এর ব্যবস্থাপনা বেসরকারি সংস্থার ওপর ন্যস্ত করা হলে এ খাত থেকে সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় সম্ভব।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশের বিমানবন্দরগুলো নিজ নিজ দেশের বিশেষ নিরাপত্তা স্থাপনা (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) হিসেবে এগুলোতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। আমাদের দেশে একজন যাত্রীর সাথে গমন ও আগমনের সময় তার যেসব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী প্রবেশমূল্য দিয়ে আগমন ও প্রস্থান লাউঞ্জে প্রবেশ করেন, তারা নির্ধারিত এলাকার সীমানা অতিক্রম করতে পারেন না। কিন্তু অনেক ভিআইপি যাত্রীর সাথে অগণিত কর্মকর্তা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ী যারা তাদের গমন ও আগমনকালীন লাউঞ্জে প্রবেশ করেন এদের অনেকে তাদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্ধারিত এলাকার সীমানা অতিক্রম করে বোর্ডিং ব্রিজের দোরগোড়া পর্যন্ত চলে যান। যেকোনো বিমানবন্দরে কোনো ধরনের তল্লাশি ছাড়া নির্ধারিত এলাকার সীমানা অতিক্রমপূর্বক বিশেষ নিরাপত্তা এলাকায় প্রবেশ বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর অপর কোনো দেশে ভিআইপিদের সাথে আসা কর্মকর্তা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের আগমন ও প্রস্থান লাউঞ্জ ছাড়া প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত বিমানবন্দরের এরূপ কোনো স্থানে যেতে দেয়া হয় না।
আমাদের দেশে বিমানযাত্রীরা স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনার সাথে জড়িত। বিষয়টি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। চোরাচালানের মাধ্যমে বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে স্বর্ণ নিয়ে আসা এবং বাংলাদেশ হতে তা ভারতে পাঠানো লাভজনক হওয়ায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাথে যোগসাজশে এ কাজটি সমাধা করে থাকে। এ যাবৎকাল পর্যন্ত অবৈধভাবে স্বর্ণ আনা-নেয়ায় জড়িত যেসব দেশী-বিদেশী যাত্রীদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই সাধারণ যাত্রী। এ ঘটনায় কোনো ভিআইপি জড়িত হওয়ার কারণে গ্রেফতারের নজির না থাকলেও অভিযোগ রয়েছে তল্লাশি ব্যতিরেকে ভিআইপিরা আগমন ও প্রস্থান করেন বিধায় তাদের কারো কারো এ ধরনের হীন কাজের সাথে জড়িত থাকার বিষয় উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমাদের দেশে সরকারি বেসরকারি ভিআইপির সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অগণিত হওয়ার কারণে এবং আমাদের দেশের ভিআইপিরা নিয়মনীতির বালাই ছাড়া অগণিত কর্মকর্তা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধায়ী সমবিভারে ভিআইপি লাউঞ্জে উপস্থিত হন বিধায় এর স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা ও মর্যাদা বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই। এভাবে এক শ্রেণীর ভিআইপির জন্য প্রবেশ মূল্য ব্যতিরেকে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা বহাল রাখা দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা উভয়ের জন্য ক্ষতিকারক। তা ছাড়া ভিআইপিদের সাথে কর্মকর্তা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধায়ীদের কোনো ধরনের মূল্য পরিশোধ ব্যতিরেকে প্রবেশ কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার পেছনে যাদের অবদান সর্বাধিক তারা হলেন বিদেশে কর্মরত শ্রমিক। আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহাকারীদের বেশির ভাগই বিদেশে কর্মরত শ্রমিক। এ সব শ্রমিকের বিদেশ গমন ও বিদেশ থেকে আসার সময় তাদের যেসব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী বিমানবন্দরে উপস্থিত হয় এরা আগমন ও প্রস্থান লাউঞ্জে প্রবেশ করতে চাইলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা হারে প্রবেশ মূল্য দিতে হয়। ভিআইপিদের আগমন ও প্রস্থানকালীন তাদের সাথে যারা বিমানবন্দরের ভেতরের প্রবেশ করেন তাদের যেখানে কোনো প্রবেশমূল্য দিতে হয় না সেখানে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য আদায় দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার আইনের দৃষ্টিতে সমতার পরিপন্থী।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারই জনগণের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করে। সরকারের যেকোনো কাজ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বাস্তবায়ন করে থাকেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তির দেশের সাধারণ জনমানুষকে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়া অপরিহার্য কর্তব্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেখানে অর্থ দেয়া ব্যতিরেকে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন না সেখানে আমাদের দেশে এ ধরনের সুবিধা অব্যাহত রেখে এর পরিধির বৃদ্ধি অযৌক্তিক, অবিবেচনাপ্রসূত এবং নীতিনৈতিকতা ও বিবেক বিবর্জিত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন