|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হলে প্রার্থীও দলীয় হওয়া উচিত
18 January 2018, Thursday
আমাদের দেশে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তির পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলেও কোনো একজন ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চাইলে তিনি আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত অযোগ্যতার অধীন না হলে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বারিত নয়। অতীতে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার অধীন নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতো না এবং দলীয় পরিচয়ে কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতেন না। এমনকি দলীয় প্রতীক ব্যবহারও বারিত ছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী স্থানীয় শাসনব্যবস্থার অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়ন প্রদান এবং দলীয় প্রতীক ব্যবহার আইনসম্মত করা হয়। এ সিদ্ধান্তটি কার্যকর-পরবর্তী স্থানীয় শাসনব্যবস্থার অধীন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ প্রার্থীরা দল থেকে মনোনয়নপ্রাপ্তির পর দলীয় প্রতীক ব্যবহারে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দলের তৃণমূলের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। এ ব্যবস্থাটি অনুসৃত হওয়ার কারণে দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন ব্যক্তির দলীয় মনোনয়ন লাভের সুযোগ থাকে না। আমাদের নির্বাচনী আইনে তৃণমূলের সুপারিশসংক্রান্ত বিধানের প্রবর্তন করা হলেও তা যে সঠিকভাবে অনুসৃত হয় এমনটি জোর দিয়ে বলা যবে না।
যে কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যপদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মী ও যোগ্য প্রার্থীর পরিবর্তে মৃত সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্য যেমনÑ স্ত্রী, ছেলে, কন্যা প্রভৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। একজন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলে তিনি যেদিন রাষ্ট্রপতিরূপে কার্যভার গ্রহণ করেন সেদিন থেকে সংসদে তার আসন শূন্য হয়। বিগত এক দশকে দুজন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া-পরবর্তী দেখা গেল শূন্য আসনে উভয়ের ছেলে মনোনয়ন লাভ-পবরর্তী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠান-পূর্ববর্তী এটি এককভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নামে অভিহিত হতো এবং তখন মেয়রের সংখ্যা ছিল একজন। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভাজন করা-পরবর্তী উভয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের প্রশ্ন দেখা দিলে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুজন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলেও উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে উভয় দল থেকে মেয়র পদে যে দুজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তারা কেউই মনোনয়ন লাভ-পূর্ববর্তী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হওয়া-পরবর্তীও তিনি দলটিতে যোগ দিয়ে প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। তিনি একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক ও ব্যবসায়ী নেতা ছিলেন। এরূপ জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক ও ব্যবসায়ী নেতার পক্ষে দলীয় ব্যাপক সমর্থন ছাড়া কখনো নিজস্ব ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে মেয়র পদে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তাকে মনোনয়ন দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, এরূপ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে চমক সৃষ্টি করা হয়েছে এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী বিধায় তিনি নির্বাচিত হলে সার্বিকভাবে সিটি করপোরেশনের কার্যকলাপে গতি আসবে। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়া-পবরর্তী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়ক ও পয়ঃনিষ্কাশন সংস্কার এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রমের সূচনা করেন। তার গৃহীত কার্যক্রম সমাপ্ত হওয়ার আগে তিনি পরলোকগমন করলে এগুলোর বাস্তবায়ন আকস্মিক বাধাগ্রস্ত হয়। সে বাধা যাতে সহজে অতিক্রম করে তার গৃহীত পন্থায় পুনঃঅগ্রসর হওয়া যায় এ বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে পুনঃচমক দেওয়ার মানসে এমন একজনকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে, যিনি জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক না হলেও তার মতোই ব্যবসাীয় নেতা এবং অনেকটা সমভাবমূর্তির অধিকারী।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুটি দলকে বোঝায়। উভয় দল একাধিকবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। উভয় দলে অগণিত ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মী রয়েছেন। এসব নেতাকর্মী দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়িত না হয়ে দলের সঙ্গে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করার প্রয়াস নেওয়া হলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ ধরনের অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একজন ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীকে হতাশায় নিমজ্জিত করে। আর এভাবে দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মী হতাশায় নিমজ্জিত হলে দলসহ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন একজন ব্যক্তি যতই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী হন না কেন, তার পক্ষে দলীয় সমর্থন ছাড়া নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া খুবই দুরূহ। বিগত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। এ নির্বাচনটিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিদলীয় মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটকক্ষে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি, অপরদিকে বিজয়ী মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মেরে ভোটবাক্স ভর্তির ঘটনার বিষয়গুলো নগরবাসী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে অবলোকনের সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের দেশের অতীত নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী ব্যক্তি নিজগুণ ও যোগ্যতায় কখনো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে বিজয় লাভে সমর্থ হননি। এর পেছনে মূল যে কারণ তা হলোÑ একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তি দলীয় সমর্থনবিহীন হলে কোনো ধরনের দলীয় নেতাকর্মীর তার নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের কথা নয়। তা ছাড়া একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তির মধ্যে সচরাচর নৈতিকতা ও নীতিবোধ প্রবল থাকে। এ ধরনের নৈতিকতা ও নীতিবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে অর্থ ব্যয়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে কর্মী নিয়োগ সম্ভব হয় না বিধায় স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য উৎসাহী কর্মীর সংখ্যা হাতেগোনা দু-একজন। দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তি দল দুটি থেকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া-পরবর্তী নতুন দল গঠনপূর্বক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলে তারা কেউই তাদের তুলনায় দলীয় নিম্নতম গুণাবলি ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে বিজয় লাভে সমর্থন হননি।
বিগত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ফলাফল যে ভিন্নতর হতো দেশের অধিকাংশ নির্বাচন বিশ্লেষকের অভিমত এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ ক্ষীণ। একজন ব্যক্তি নিজেকে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী ভেবে থাকলে এবং সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়া সত্ত্বেও কোনো রাজনৈতিক দল তাকে অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস নিলে তা তার জন্য কখনো গৌরবের কারণ হয়ে দেখা দেয় না বরং এ ধরনের বিজয় তার ভাবমূর্তিকে মলিন করে দেয়।
একটি কলুষিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজয় পরলোকগত মেয়রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নাকি অনুজ্জ্বল করেছিল সেটি নির্ধারণের দায়ভার ভবিষ্যতের ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। পরলোকগত মেয়রের মতো অনুরূপ ভাবমূর্তির অধিকারী ব্যক্তিকে যদি একই পন্থা অবলম্বনে নির্বাচনে বিজয়ী করার সমব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাতে দেশের সচেতন নগরবাসী সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এ ধরনের আস্থা হারানো গণতন্ত্রের জন্য কখনো শুভ নয়। আর তাই পরিবেশ বা পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, দলীয় ত্যাগী ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী ছাড়া অপর কেউ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য দল কর্তৃক বিবেচিত হবেন এটি প্রত্যাশিত হওয়া উচিত নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন