গত ২৯ মার্চ বুধবার ছিল ‘আমাদের সময়’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বহুদিন পর তাদের সুধী সমাবেশে গিয়েছিলাম। ইদানীং যে কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান হলে নামিদামি ব্যক্তির ছড়াছড়ি। আমাদের সময়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও তেমনই হয়েছিল। ’৯৬, ’৯৭-এর দিকে একদিন আজকের কাগজের সম্পাদক কর্নেল শাহেদ চৌধুরীর দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ থেকে শুরু করে ৮-১০ জন মন্ত্রীসহ অনেক জ্ঞানীগুণীকে দেখেছিলাম। নির্বাসনে থাকতে ভারতে অনেক বড় বড় দাওয়াতে গেছি। ব্যক্তিগত দাওয়াতে এক-দুজনের বেশি মন্ত্রী দেখিনি। এখন আমাদের দেশের মতো সেখানেও মন্ত্রীদের হাট লাগে কিনা জানি না। তবে আমাদের সময়ের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে জ্ঞানী-গুণী-মেধাবী, মন্ত্রী, মেয়র, শিল্পী, সাহিত্যিক অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এম মোর্শেদ খান, আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জয়নুল আবেদীন, আব্দুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ আরও অনেকে। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছিলেন। বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, তবে মুখটা খুব মলিন ঠেকছিল। মন্ত্রী এলে বিকাল ৫টা কয়েক মিনিটে কেক কাটা হয়। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের, উপধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, কামাল লোহানী, কবি হেলাল হাফিজ, ইউনিক গ্রুপের এমডি এবং আমাদের সময়ের প্রাণ মোহা. নূর আলী, আমাদের সময়ের অন্যতম পরিচালক আমান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম আমান উল্লাহ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সন্তোষ শর্মাসহ আরও অনেকে।

সম্পাদকীয় পাতা যারা দেখাশোনা করেন, তাদের কেউ একজন সভাকক্ষে নিয়ে যান। সেখানে মোহা. নূর আলী, তার পাশে আমান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম আমান উল্লাহ ছিলেন। মোহা. নূর আলী এমনিই সদা হাসি অপূর্ব মানুষ। এম আমান উল্লাহকেও দেখলাম খুব তৎপর এবং আন্তরিক। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপ্যায়নের প্রতিযোগিতা লেগেছিল। তবে মোহা. নূর আলী ছোট্ট খুটিতে চমৎকার আইসক্রিম খাইয়েছিলেন। ওটা মাটির খুটি হলে আরও অসাধারণ হতো। কিন্তু খুটিটি মাটির ছিল না, ছিল প্লাস্টিকের। দেখতে ছোট্ট মাটির পাতিলের মতো। প্রায় ৮-১০ বছর আইসক্রিম খাই না। আমার দুই মেয়ে কুঁড়ি-কুশি ঘুমের মধ্যেও আইসক্রিম খায়। আইসক্রিম খেতে খেতে তাই ওদের কথা বড় বেশি মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম ফেরার পথে দু-এক খুটি আইসক্রিম নিয়ে আসব। কিন্তু আসার সময় মনে ছিল না। তাই আনা হয়নি। মিষ্টি ছিল অসাধারণ। কফি খেয়েছি দুবার। একসময় কামাল লোহানী এসেছিলেন। তাকে চেয়ার ছেড়ে দিলাম। প্রবীণ সাংবাদিক বসতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু যখন তাকে বলেছিলাম, আমার চেয়ারে আপনি বসলে খুশি হব। তখন বসেছিলেন। আমি তার পাশে বসেছিলাম। তার পাশের চেয়ারে মোহা. নূূর আলী ছিলেন। মোহা. নূর আলী এক চেয়ার সরে বসে চুপ করে হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আপনি অন্য কাউকে চেয়ার ছেড়ে দেন? এখন কেউ কাউকে চেয়ার ছাড়ে এটা প্রথম দেখলাম।’ বলেছিলাম, এটা প্রবীণত্বের সম্মান, বংশপরিচয়। একসময় আমান গ্রুপের চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ বলেছিলেন, ‘মনে হয় আমায় চিনতে পারেননি।’ সত্যিই তাকে চিনতে পারিনি। একদিনের দেখা, চিনি কী করে? পরম সুহৃদ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ জলিল মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। চার-পাঁচবার তার ব্যাংকে গেছি। অসম্ভব যতœ করতেন। একবারও না খেয়ে ফিরতে দিতেন না। ’৭৫-এ আমরা একসঙ্গে গভর্নর হয়েছিলাম। তিনি নওগাঁর, আমি টাঙ্গাইলের আর একসময় যুবকের অহঙ্কার আওয়ামী লীগের অন্যতম যোগ্য নেতা আমির হোসেন আমু বরিশালের। সেই আব্দুল জলিল মারা গেলে তার ব্যাংকে একবার গেছি। তখন চেয়ারম্যান ছিলেন আমান গ্রুপের চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ। আমরা রাজনীতি করা মানুষ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্বস্তি পাই না। কিন্তু তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে কোনো অস্বস্তি লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছিল। আমি যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন আব্দুল জলিলের দুই মেয়ে গিয়েছিল। যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিল তার বাবা, সেই ব্যাংকে মেয়ে দুটোকে কেন যেন খুবই অসহায় মনে হয়েছিল। জানি না ওরা এখন কেমন আছে। তবে এটা জানি এমনই হয়। বঙ্গবন্ধু থাকতে আমরা ছিলাম এক রকম, বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে হয়েছি আরেক রকম। সেই একবারই আমান উল্লাহকে দেখেছিলাম বলে খেয়াল ছিল না। তবে এরপর দেখলে মনে পড়বে, খেয়াল থাকবে। কোনো অসুবিধা হবে না।

সেদিন সারা দিনে আরও দু-চারবার কেক কাটা হয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যখন কেক কাটেন তখন সভাকক্ষ থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন কামাল লোহানীর হাত ধরেছিলাম। ভদ্রলোক এখন খুব একটা দেখতে পান না। উঁচু-নিচুতে হাঁটতে সমস্যা হয়। কাউকে সঙ্গে নিলে ছাড়ি না বা ছাড়তে পারি না। তেমনটাই হয়েছিল কামাল লোহানীর ব্যাপারে। ৫০-৬০ গজ যেতে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছিলাম। তবু তাকে ছাড়িনি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েকবার ডাকছিলেন, কাদের ভাই আসুন। কিন্তু প্রবীণ লোক, ফেলে যাই কী করে। মন্ত্রী অপেক্ষায় ছিলেন। কেকের কাছাকাছি গেলে কাটার জন্য বেশ কয়েকজনের হাতে প্লাস্টিকের ছুরি দেওয়া হয়। একটি আবদুল মঈন খান, দ্বিতীয়টি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তৃতীয়টি জিএম কাদের, চতুর্থটি আমার হাতে। আমার ডানে জিএম কাদের, কামাল লোহানী বামে ছিলেন আমাদের সময়ের প্রাণ বা প্রধান কর্ণধার মোহা. নূর আলী। তাই তাকে ছুরি দিয়ে তার হাত ধরেছিলাম। নানা রঙবেরঙের লোকে ছিল জায়গাটা ভরা। বিরাট আঙিনা। নামও আম্রকানন। আমি মুর্শিদাবাদের ভাগিরথির তীরে পলাশীর আম্রকাননের কথা জানতাম। তেজগাঁওয়ে যে এমন চমৎকার খোলামেলা আম্রকানন আছে, জানা ছিল না। তাই সত্য কথা বলতে কী, আমাদের সময়ের চমৎকার জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বেশ ভালোই লেগেছে। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বেরিয়েছিলাম।

আমাদের দলের সব থেকে প্রবীণ নেতা মির্জাপুরের এনামুল হক খানের ছেলে ইমরানুল হক খান (জন) অনুষ্ঠানে ছিল। সে খান মোহাম্মদ ইকবালের পদ্মা পলি কটন লি., তেজগাঁওয়ে চাকরি করে। আমায় মামা বলে ডাকে। বেরোতে বেরোতেই বলছিল, ‘মামা, আমি এখানেই চাকরি করি।’ মাগরিবের আগে আগে নিয়ে গিয়েছিল তার অফিসে। গিয়ে দেখি খান মোহাম্মদ ইকবালের ছোট ভাই খান মোহাম্মদ আমীর (বিল্টু খান)। বিল্টু খান আমায় বড় ভাই বলে ডাকেন। মনে হয় তিনিই আমার থেকে এক-দুই বছরের বড় হবেন। তবুও বড় ভাই বলে ডাকেন। তাতে আর কী করা যাবে। আমার থেকে ১০-১৫ বছরের বড় বহু মানুষ যারা আমায় বাবা বলে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এত গভীর যে, তাদের সন্তান না মেনে পারি না। তুমি বলে সম্বোধন করি। ঘাটাইলের অ্যাডভোকেট আকবরের বাবা মাদবর খাঁ আমার থেকে ২০-২২ বছরের বড়। আমার ছেলে। যেখানেই দেখা হয় জন্মদাতা বাবাকেও মনে হয় মানুষ ওভাবে হাঁটু গেড়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে না, যেটা সে করে। শুধু এক মাদবর খাঁ নয়, আরও কতশ আমার থেকে ১৫-২০ বছরের বড় ছেলেমেয়ে কে হিসাব রাখে। সেদিন বিল্টু খানের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছিল। ভেবেছিলাম এবার আমাদের সময়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে সম্পূর্ণ একটি লেখা লিখব। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধু কবি সাযযাদ কাদির বাবর, আমরা একই পাড়ায় জন্মেছি, বড় হয়েছি, কত পথ চলেছি। সেই পথচলা কত গাড় স্মৃতি মুহূর্তে সব খানখান হয়ে গেছে। গত পরশু বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৩৪ মিনিটে ফোন ধরতে ধরতেই কেটে যায়। ৮টা ৩৫ মিনিটে আমি ফোন করি। স্বাভাবিকভাবেই সে বলে, ‘আমি হৃদরোগ হাসপাতালে অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমানের কাছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি। তুমি দেখো।’ সঙ্গে সঙ্গে তুহিনকে পাঠিয়েছিলাম। সে গিয়ে ভালোভাবে নাশতা খাইয়েছিল। ডাক্তারকে বলেছিল। কিন্তু বন্ধু আমার নেই। আর কথা হবে না। আর কষ্ট হলে এটা-ওটা বলবে না। এক পরম হিতৈষীকে হারালাম। তাই বাবর আর মৌলভীবাজারের নাসিরপুর বাগানবাড়িতে সাত জঙ্গি ও শিববাড়ী আতিয়া মহলে দুই জঙ্গি নিহত ও কুমিল্লা নির্বাচনের দিন কোটবাড়ী এলাকায় কোনো জঙ্গির আস্তানা ঘিরে রাখা এবং পরে পরিত্যক্ত বাড়িতে জঙ্গি না পেয়ে কয়েকটি গ্রেনেড পাওয়ার পুলিশি ভাষ্যে বড় উতালা হয়ে আছি। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। দুঃখ-বেদনায় বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে চাচ্ছে। আর বাঁচবই বা ক’দিন, কার ভয়ে ব্যথা বুকে চেপে রাখব? তাই দু’কথা না লিখে পারছি না। বিবেকের দারুণ কষাঘাতে লিখছি।

প্রধানমন্ত্রী, আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমি একজন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ভালবাসতাম। বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে আমি ভালবাসা শিখেছি, দেশমাতৃকাকে চিনেছি। বঙ্গবন্ধুর জন্য, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। সে কারণে জনগণের নেত্রী হিসেবে আপনাকেও ভালবাসি। আপনার মানসম্মান জীবন নিরাপদ নির্বিঘœœ সম্মানের হোক সেটা কায়মনে চাই, অন্যদেরও চাই। আমার পরম শত্রুও অকারণ কোথাও লাঞ্ছিত-অপমানিত-অপদস্ত হোক এটা চাই না। আমি যখন যুদ্ধ করেছি, তখন ৫০ বছরের লোককে বৃদ্ধ মনে হতো। আমি তো ৭০ পার করে এলাম। আর এক-দুই মাস পর ৭১-এ পা ফেলব। যার মধ্যে ছিল আমার প্রাণ সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরে চলে গেছেন। যিনি ছিলেন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, আমার জীবন সেই মাকে হারিয়েছি তাও এক যুগ। কাকে ট্যাক্সো দিয়ে নিজের অন্তরকে কলুষিত করে আরও বাঁচার চেষ্টা করব? তাই প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বলছি, জঙ্গি দমনে পুলিশ, র‌্যাব, প্যারা কমান্ডোকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই সরকারপ্রধান হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা ভালো কাজ করলে তাদের কাজের স্বীকৃতি দেবেন। সেখানে কারো কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কাজ ঠিক কিনা বিচার-বিবেচনা করতে হবে না?

প্রধানমন্ত্রী, সারা জীবন মায়ের মতো বড় বোন হিসেবে আপনাকে জেনেছি এবং মেনেছি। তাই বয়সের দিক থেকেও আপনার চেয়ে দু-একদিনের ছোট হলে গর্বিত হতাম। আমি স্তাবকের দলের নই। আপনার সঙ্গে মতবিরোধ থাকার পরও যেখানে যতবার দেখা হয়েছে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছি। কতজন কত কথা বলছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সম্মান করা কোনো রাজনীতি নয়। তাতে ক্ষতি হয়। বলেছি, সে হোক। মাকে মা বলতে না পারলে, তাকে যথাযথ সম্মান না করা গেলে তেমন রাজনীতি আমি করতে চাই না। পরিবারের সবচেয়ে অপদার্থ ছিলাম আমি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার ছিল ভীষণ দুঃচিন্তা। অপদার্থের খাতায় নাম ছিল এক নম্বরে। পরম দয়াময় প্রভু আমাকে আজ কোথায় এনেছেন। তার পরও যদি তার প্রতি কৃতজ্ঞ না থাকি, হাশরের ময়দানে কী জবাব দেব? তাই সহ্য করতে না পেরে আপনাকে বলছি, গতকাল আপনি ভারতে গেছেন। ফিরে এসে আমাদের পাবেন কী? ’৭৫-এর আগস্টে আপনি বোন রেহানাকে নিয়ে জার্মানে গিয়েছিলেন। আর বাবা-মা, ভাইদের পাননি। বড় দুঃখে কথাটি বলছি। কারণ দিল্লিতে আপনাকে দেখেছি, রাসেলের জন্য কেমন ছটফট করতেন। রমা বলেছিল, রাসেলকে যখন গুলি করছিল সে তখন দেয়ালের পাশে কাঁচুমাচু হয়েছিল। বলেছিল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমি রাজনীতি করব না, বাবা-মার পরিচয় দেব না।’ কিন্তু ঘাতকরা তাকে ছাড়েনি। আজ যখন জঙ্গি বলে মৌলভীবাজারের নাসিরপুর বাগানবাড়ির লোকমান (৪৫), শিরিন আক্তার (৩৫), মোছাম্মত আমেনা খাতুন (১৪), সুমাইয়া আক্তার (১২), মরিয়ম (১০), ফাতেমা (৭) ও সাত মাসের খাদিজাকে জঙ্গি বলে হত্যা করা হয়েছে। এটাও কি মেনে নেব একজন পুরুষ ও ছয়জন নারী তারা সবাই জঙ্গি। এভাবে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে পৃথিবীর কোনো পুরুষ জঙ্গি হয়? গতকাল এক সভায় ভুলে দুই-আড়াই বছর বলেছিলাম, আসলে ছয়-সাত মাসের শিশু। সাত মাসের শিশু জঙ্গি হয়? পৃথিবীর কোথাও এমন মা আছে, ছয় মাসের শিশু দুধের বোঁটা থেকে ফেলে অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে নাড়াচাড়া করে? আপনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও জয়ের জন্য রান্না করেন, পুতুলকে হাতে তুলে খাওয়ান। জয়-পুতুল দুজনই এখন সন্তানের বাবা-মা। তার পরও সন্তান হিসেবে আপনার কাছে ওরা শিশু। আপনি ছয়-সাত মাসের জয়-পুতুলকে বুকে থেকে ফেলে অমন কাজ কখনো করতে পারতেন? যে যাই বলুক, জীবন গেলেও আপনাকে দিয়ে কেউ অমন কাজ করাতে পারত না। জঙ্গি আছে, প্রকৃত জঙ্গি নির্মূল করুন। তাই বলে ১২ বছর থেকে সাত মাসের মেয়েদের জঙ্গি বলে কেউ চালিয়ে দেবেন, এটা কেউ মানবে না। দয়া করে ওই সব ব্যর্থ কর্তাদের লাগাম টানুন। আমার তিন ছেলেমেয়ে। তাদের ত্যাগ করে দুনিয়ার বাদশাহিও তো আমি কবুল করব না। আমার সাদামাটা স্ত্রী, সন্তানের বিনিময়ে দুনিয়ার বাদশাহিরও আমার কাছে কোনো মানে নেই। বড় দুঃখে, বড় বেদনায় আপনার কাছে বিচার চাইছি। একজন পুরুষ, একজন নারী আর পাঁচটি শিশুকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার করুন। ওই অভিযানে নিহত সবাই যে জঙ্গি, এটা তাদের প্রমাণ করতে বলুন। কী কী অস্ত্র ছিল তাদের হাতে আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না কেন? জিজ্ঞেস করুন। বিশ্বস্ততা রাষ্ট্রের সব থেকে বড় সম্পদ। সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। দুষ্টরা আপনাকে চারদিক থেকে চেপে ধরেছে। দয়া করে খোলা মনে ব্যাপারগুলো বিবেচনা করুন। সব কাজে হাততালি চলে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ নভেম্বর নাগরপুর যুদ্ধে পাকুল্লাচরের শামসু পেটের বাঁ দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে একেবারে হানাদারের বাংকারের সামনে পড়েছিল। তাকে উদ্ধার করতে সারা দিন আমরা ১৭-১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা তারচেয়ে বেশি গুরুতর আহত হয়েছিলাম। কিন্তু তবু তাকে উদ্ধার করেছিলাম। বাগানবাড়ির সাত জঙ্গির ছয়জনই নারী। আমি গতকাল এক সভায় বলেছিলাম, আড়াই বছরের শিশুকে, শিশুটি আড়াই বছরের ছিল না, ছিল ছয়-সাত মাসের। তাকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সাতজন আর্মির জীবন যেত তাও ভালো ছিল। মানবতা রক্ষায় আমরা গর্ব করতে পারতাম। আজ বলব ১২ বছর থেকে সাত মাসের শিশুদের আমার জীবন দিয়েও যদি বাঁচাতে পারতাম, সেটাই হতো জীবনের সার্থকতা। করজোড়ে আপনার কাছে প্রার্থনা, এসব চাটুকারের চাটুকারিতা বিশ্বাস করে আপনি আমাদের জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেবেন না। নিশ্চিত হোন, যথাযথ সন্ত্রাসী হলে আমাদের সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করুন। কিন্তু মাসুম শিশুদের অন্যায়ভাবে হত্যার দায়ে রাষ্ট্রকে অন্যায় বোঝার ভারে ভারী করবেন না। জাতি আপনার কাছে মানবতা সভ্যতা এবং ন্যায়সঙ্গত আচরণ আশা করে।

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, রাজনীতিক ও কলাম লেখক