ধীরে ধীরে আমরা কেমন যেন আমাদের মূল শিকড় থেকে সরে যাচ্ছি। এবার কীভাবে নীরবে-নিভৃতে মুজিবনগর দিবস চলে গেল বোঝাই গেল না। কত জায়গায় কত অনুষ্ঠান হলো, কিন্তু মুজিবনগর দিবস নিয়ে কিছুই হলো না। না সরকারি, না বেসরকারি কোনো ক্ষেত্রেই তেমন কোনো গুরুত্ব পেল না মুজিবনগর দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ধীরে ধীরে ফুলেফেঁপে উঠছে। অথচ স্বাধীনতা ঢাকা থেকে আসেনি। ঢাকা ছিল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান হানাদারদের করায়ত্ত বা পদানত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং আমাদের নেতারা ঢাকা থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়ে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে স্বাধীনতার দীপ্ত শপথ নেওয়া ভুলে গেলে চলবে না। সেদিন সেখানে যদি আমাদের নেতারা দৃঢ় পায়ে দাঁড়াতে না পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ হতো না। বাংলাদেশ না হলে এখনকার এমন ঠাটবাটও হতো না। দুঃসময়ে আমাদের নেতারা বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীনতার যে অমর বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেই বৈদ্যনাথতলাকে কখনো কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সে অঞ্চলের উন্নয়ন, শিক্ষা-দীক্ষা, মান-মর্যাদার প্রতি খেয়াল করা হয়নি। স্বাধীনতায় মুজিবনগরের যে একটা মূল্য অবদান আছে, তাও কখনো মনে হয়নি। এবার তো আরও না। মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন মুজিবনগর দিবসের সঙ্গে জড়িত ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সর্বজনাব মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, মাহাবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান ও এ কেএম কামারুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন। প্রধান অতিথি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যদিও তিনি এখন শুধু কালো রঙের মুজিব কোট না পরে নানা রঙবেরঙের পরেন। তবু তিনি আমার প্রিয়। ক’দিন আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে, ‘আওয়ামী লীগে কাউয়া ঢুকেছে’ বলেছিলেন। তার সে কথা অনেকে সমর্থন করেছিলেন। মুজিবনগর দিবসে বলেছেন, ‘এখানে এই মুজিবনগরে কাউয়া ঢুকেছে বলব না। বলব, ফার্মের মুরগি ঢুকেছে। ফার্মের মুরগি বিদায় করে দেশি মুরগি ঢোকাতে হবে।’ ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রী। তাকে আগাগোড়াই ভালবাসি, সম্মান করি। কিন্তু মুজিবনগরের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও গুরুত্বের দিকে খেয়াল না করে ফার্মের মুরগিই হোক আর দেশি মুরগিই হোকÑ এমন তুলনা দেশবাসীকে বড় বেশি আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। আমিও ভীষণ মর্মাহত হয়েছি। ওই সব মূল্যহীন ছোট কথা অন্য কোনো দলীয় অনুষ্ঠানে বলতে পারতেন। যখন আমাদের সময় ছিল, যাদের নিয়ে মুজিবনগর সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ কেএম কামারুজ্জামান। তাদের কারো কারো সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবেই সেখানে গেছি। এখনো বেশ কিছু প্রবীণ নেতা আছেন, প্রধানমন্ত্রী যেতে না পারলে তাদের পাঠাতে পারতেন। রাষ্ট্রপতিও যেতে পারতেন। মুজিবনগর দিবসে বিপ্লবী সরকারকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন মাহাবুব উদ্দিন বীর বিক্রম, তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তাকে নিয়ে যাওয়া যেত। তৌফিক এলাহী বীর বিক্রমকে নেওয়া যেত। কিন্তু কেন তাদের নেওয়া হলো না? কেন কোনো সম্মান দেওয়া হলো না? দিলে দেশ বা রাষ্ট্রের কী ক্ষতি হতো? হ্যাঁ, মুজিবনগর দিবস শুধু আওয়ামী লীগের নয়, মুজিবনগর দিবস সব দলের, সব মতের, সব মানুষের। তা যদি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমন বলবেন কেন? ব্যাপারটা তো দলীয় নয়, জাতীয়। আর অমন ঐতিহাসিক স্থানের মানুষদের বা দলীয় কর্মীদের মুরগির সঙ্গে তুলনা করাটা মনে হয় যথাযথ সম্মানের নয়। তাদের দলীয় ব্যাপার, তারা যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু সেটা তাদের দলীয় অনুষ্ঠানে হওয়া উচিত, কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে নয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস কোনো দলীয় নয়। সরকার অন্যান্য দলকে মুজিবনগর দিবসে দাওয়াত করতে পারত। কেউ না গেলে সেটা বলা যেত। যারা মুজিবনগর দিবস পালন করে না, তারা বাংলাদেশ চায় নাÑ কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। মুজিবনগর দিবস পালনে সরকারের সর্বজনীন উদ্যোগ ছিল নাÑ এটাই যথার্থ সত্য। সবকিছু এমন দলীয়ভাবে বিবেচনা করলে ভবিষ্যতে জাতীয় কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন আমরা ভীষণ সমস্যায় পড়ব। সে জন্য আরও প্রসারিত দৃষ্টি ফেলতে বলছি। সবকিছু এতো হালকাভাবে নেওয়া কোনো জাতীয় নেতৃত্ব নয়। আওয়ামী লীগের নেতাদের শুধু আওয়ামী লীগের নেতা হলে চলবে না, যেহেতু তারা সরকারে, সেহেতু অনেক কিছু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, বিচার-বিবেচনা করতে হবে; যা মুজিবনগর দিবসের ক্ষেত্রে করা হয়নি। যাদের ঘিরে মুজিবনগর সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ কেএম কামারুজ্জামান যথাযথ মর্যাদা পাননি। তাদের তেমন মর্যাদা দেওয়ার চিন্তাও করা হয়নি। জানি আমার কথা সরকারের ভালো লাগে না। কিন্তু তবু একটু ভেবে দেখতে বলছি। সবার কথা সব সময় ভালো লাগার কথা নয়Ñ তবু শুনতে হয়। একটা ছোট্ট উপমা দিচ্ছিÑ
সবাই জানে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে বহু বছর ভারতে নির্বাসিত ছিলাম। অনেক নেতার সঙ্গে সে কারণে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের নেতা ফরোয়ার্ড ব্লকের যতীন চক্রবর্তী শ্রী জ্যোতি বসুর জোট সরকারের পূর্তমন্ত্রী। তার সকালে উঠে প্রথম কাজ ছিল জ্যোতি বসু সম্পর্কে একগাদা নিন্দা করা, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে জ্যোতি বসুকে তুলাধোনা করা। আমি মাঝে মাঝেই কলকাতার রাজভবনে জ্যোতি বসুর বাড়ি যেতাম। ভদ্রলোক মৃদুভাষী অমায়িক লোক ছিলেন। তিনি ঢাকার বাকরখানি খুব পছন্দ করতেন। আমি মাঝেসাজে নিয়ে যেতাম। বাকরখানি পেয়ে খুব খুশি হতেন। জ্যোতি বসুর স্ত্রী কমলা বসু টাঙ্গাইলে আমাদের পাড়ায় বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলে পড়তেন। সে সময় তার বাবা ছিলেন মুনসেফ। তাই আমাকে পেলে আপনজন পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন। একদিন গল্প করতে করতে জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনার সরকারের সমালোচনা করেন আপনি কিছু বলেন না? মৃদু হেসে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘বাঘা সিদ্দিকী, ওই একজনই দু’কথা বলে বলে আমরা এত দিন ক্ষমতায় আছি। জোট করব, কারো সমালোচনা সহ্য করব না, তা কি হয়?’ ব্যাপারটার কেন যেন এখানে বড় বেশি অভাব দেখি। সত্য সমালোচনা, রাস্তা দেখানো মনে না করে, শত্রুতা মনে করা ভালো নয়। এ যে কত বড় ভয়ঙ্কর অশুভ লক্ষণ, তা কাকে কীভাবে বোঝাব?
বাল্যবন্ধু কবি সায্যাদ কাদিরের আকস্মিক মৃত্যুযন্ত্রণায় তখনো হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত ছিল। তারই মধ্যে এক সকালে পত্রিকার পাতায় চোখ পড়ে, ‘ভরণপোষণের দাবিতে ফরিদপুর আমলি আদালতে ছেলের বিরুদ্ধে মায়ের মামলা।’ আমি এক প্রবীণ আইনবিদের ছেলে। সারা জীবন ফৌজদারি, দেওয়ানি মামলা দেখেছি, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর খোরপোশের বা ভরণপোষণের মামলা, কিন্তু সন্তানের বিরুদ্ধে মা-বাবার খোরপোশের মামলার কথা জানা ছিল না। সেটাই জানলাম শেষ বয়সে। মা-বাবার কাছ থেকে হেবা দলিল করে জমিজমা নিয়ে ছেলে, ছেলের বউ মা-বাবাকে গৃহহারা করেছে। তারা হয়তো জানে না, মা-বাবা যখন তখন হেবা প- করতে পারেন। ছেলের ঘরে জায়গা না হওয়ায় সে এখন মেয়ে রহিমার ঘরে আছে। ঘটনাটি আমায় দারুণ নাড়া দেওয়ায় গত বৃহস্পতিবার বাবর রোডের বাড়ি থেকে সকাল ৭টায় রওনা হয়ে মধুখালীর রায়পুর ইউনিয়নের ব্যাসদী গ্রামে পাঁচু সরদার ও তার স্ত্রী জহুরা বেগমের বাড়ি গিয়েছিলাম। আগের দিন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে ফোন করেছিলাম। ফরিদপুর সার্কিট হাউসে একটু জায়গা এবং খাবারের ব্যবস্থা হবে কিনা। মনে হয় এ পর্যন্ত কোনো মহিলা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়নি। ফরিদপুরের মহিলা জেলা প্রশাসকই প্রথম। ছেলের কাছে মায়ের ভরণপোষণের মামলার কথা জেনে আমি ফরিদপুরে আসছি এটা শুনে ফরিদপুরের ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়া বলেছিলেন, ‘আসুন স্যার, কোনো অসুবিধা হবে না। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তাদের সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছি। কিন্তু তারা বাড়ি ছেড়ে আসতে চান না।’ ডিসির কথা ভালো লেগেছিল। গিয়েছিলাম ব্যাসদী। যিনি ফরিদপুর থেকে খবরটা দিয়েছিলেন সেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সোহেল ও চ্যানেল ২৪-এর ক্যামেরাম্যান রুবেল ফরিদপুর যশোর মোড় থেকে আমাদের গাড়িতে উঠেছিল। আরও কিছু সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মী ঘটনাস্থলে ছিল। তাদের আগ্রহ দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। প্রায় সবটুকু পাকা রাস্তা। পাঁচু সরদারের বাড়ির কাছে সামান্য একটু কাঁচা। তাও পাকা রাস্তার মতো পরিপাটি সমতল। সামান্য বৃষ্টি হওয়ায় চারপাশে গাছপালা যেমন চিকচিক করছিল, রাস্তাও ছিল ঝকঝকে-তকতকে। গাড়ি থেকে নেমে কলাবাগানের ভেতর দিয়ে প্রায় ২০০ গজ জহুরা বেগমের মেয়ের বাড়ি। সেখানেই তিনি কয়েক মাস আছেন। মেয়ে ও মেয়ের জামাই ছোট দুই সন্তান মা-বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে রেখে বাইরে চাকরি করছে। পাঁচু সরদার বাড়ি ছিলেন না। তিনি মধুখালী গিয়েছিলেন। পরে তার সঙ্গেও দেখা হয়। পাঁচু সরদার একেবারেই ভেঙে পড়েছেন।
যতটা শঙ্কা নিয়ে গিয়েছিলাম, ঘটনাস্থলে গিয়ে তেমনটা মনে হয়নি। কারণ কেউ অভুক্ত নেই। খাওয়া-পরার অভাব বা মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই এমন না। বিষয়টি প্রতারণা-বঞ্চনা। পাঁচু সরদার ও জহুরা বেগম ছোট ছেলে সেলিমকে শেষ সম্বল লিখে দেন। তার পরও তাদের বাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখে তারা প্রথম প্রথম চিনতে পারছিলেন না। জহুরা বেগম অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎই কেন যেন বলেছিলাম, আপনি এ দেশের শ্রেষ্ঠ নেতাকে চেনেন? যেভাবেই হোক মহিলাটি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর?’ বলেছিলাম, হ্যাঁ। আমি তার ছেলে। আপনার কথা শুনে এসেছি। গ্রামের লোকরা বিচার করে আপনার ছেলেকে প্রতিদিন আপনাদের ভরণপোষণের জন্য ১০০ টাকা দিতে বলেছিল। আপনার পেটের ছেলে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর ছেলে, দেশের ছেলে হিসেবে কথা দিয়ে গেলাম, যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন প্রতি মাসে আপনাদের ৩ হাজার টাকা দিয়ে যাব। আপনি আপনার ছেলেকে বদদোয়া নয়, দোয়া করবেন। কোনো মা-বাবা সন্তানকে দোয়া না করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হোন। আমার কথা শুনে জহুরা বেগম জারজার হয়ে কেঁদে এক মহামূল্যবান কথা বলেছেন, ‘আমি খাওয়া-পরার জন্য ছেলের নামে ভরণপোষণের মামলা করিনি। আমি মামলা করেছি মা-বাবার সঙ্গে এ রকম এক ছেলের দুর্ব্যবহারে আরও দশ ছেলে খারাপ হোক, সেটা যাতে না হয় সে জন্যে মামলা করেছি।’ খুশি হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলাম, আপনি আপনার মামলা চালিয়ে যান এবং জয়ী হোন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আপত্তি উত্তম মা হিসেবে সন্তানের কল্যাণ কামনা। আমার মায়ের মৃত্যুর সময় হাসপাতালের বেডে তার দুই পা আমার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। পা ধরে শত শতবার কালেমা উচ্চারণ করেছিলাম। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তার কানে কানে বলতে পারিনি।
শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গামছা, টাঙ্গাইলের চমচম নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের দেওয়ার জন্য। সবকিছু দিয়ে পাশেই তার নিজের বাড়িতে যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করলে বড় কাতর হয়ে জহুরা বেগম বলেছিলেন, ‘বাবা, স্বামীর ভিটা ও বাড়িতে চার-পাঁচ মাস যাই নাই।’ তার হুতাশ আমার বুকে বড় বিঁধেছিল। তিনি যাননি, আমি গিয়েছিলাম। শত শত শিশু, সাংবাদিকে জায়গাটা ছিল কোলাহলে ভরা। গিয়ে দেখলাম চমৎকার দু-তিনটি ঘর। সেলিমের বউ বাড়িতেই ছিল। সেলিমের বউ পরিচয় দিয়ে সে রা রা করে উঠছিল। যে ঘরে সেলিমের বাবা-মা থাকত সে ঘর দেখিয়ে বলছিল, ‘ওই ঘরের বেড়া ছাড়া সব আমাদের।’ তারপর কত কথা যে বলছিল, ‘শ্বশুর-শাশুড়িকে না খাইয়ে সে খায় না, গোসল করিয়ে দেয়, মাথায় তেল দিয়ে দেয়’ আরও কত কী। গলার জোর এ দেশের অনেক নেতানেত্রীর চাইতে বেশি। ওর মাঝেই আশপাশের লোকজন বলাবলি করছিল, ‘এতকিছু করো, চার মাস শ্বশুর-শাশুড়ি কোথায় থাকে, কী খায় একদিনের খোঁজ নিয়েছ?’ যাহোক, ওতেই বুঝে গিয়েছিলাম, ছেলের চেয়ে ছেলের বউ কত তুখোড়। বাড়ি থেকে বেরোতেই সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরেছিল। অত উৎসাহী সাংবাদিক মফস্বল শহরে খুব বেশি দেখিনি। আগ্রহ ও যোগ্যতা দুটোই বেশ প্রশংসা করার মতো ছিল। বলেছিলাম, মানুষের মানবতা মনুষ্যত্ব এগুলো যদি হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের পশুতে আর মানুষে পার্থক্য কোথায়? শুধু সে জন্যই ব্যাপারটা আমায় খুব নাড়া দিয়েছে তাই দেখতে এসেছি। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। আমার বাবার ছিল ১৫ ছেলেমেয়ে। তার ১০ জন এখনো বেঁচে আছি। আমার যদি আরও দু-একটি সন্তান থাকত, তাদের লালন-পালন করতাম না? নিশ্চয়ই করতাম। তাই সেলিম তার মা-বাবাকে বইতে না পারলেও এখন থেকে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দায়িত্ব আমার, আমাদের। ভিড়ের মধ্যে অনেক শিশু কিলবিল করছিল। যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, কোথায় পড়ো, কোন কাসে? কেউ থ্রি, কেউ ফোর, কেউ ফাইভ-সিক্স। একটি মেয়ে চৈতী, সে সেভেনে পড়ে। তাকে কাছে টেনে বুকে চেপেছিলাম অনেকক্ষণ। মুস্তাফিজুর রহমান আনু নামে আমার এক বন্ধুর চৈতী-মিতা দুই মেয়ে। চৈতী নাম শুনে আমার তাকে সেই বন্ধুর মেয়েই মনে হয়েছিল। আসার সময় বলে এসেছি, আমার কুশিমণি যেমন চকচকে জামা পরে, তোমার জন্যও তেমনি চকচকে প্রিন্সেস ড্রেস পাঠাব।
চলে আসতে যাচ্ছিলাম। ভালো জামাকাপড় পরার চেয়ে উদাম গায়ের মানুষ বুঝি বেশি ভালো হয়। সেখানে অনেক মানুষই খালি গায়ে ছিলেন। একজন কাছে এসে বলছিলেন, ‘একটু পানি খেয়ে যান।’ কাঁচা পানি আমি খাই না প্রায় ৪৫ বছর। কাঁচা পানি খেলেই পেটে ব্যথা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধে গারো পাহাড়ে থাকার সময় থেকে কাঁচা পানি খাওয়া ছেড়েছি। ভদ্রলোক শামসু শেখ দৌড়ে গিয়ে তার ছেলে সজীবকে ডাবগাছে তুলে দেন। সে গাছ থেকে কয়েকটি ডাব ফেলে দেয়। তারই বাইরের বাড়িতে বসে ডাবের পানি খেয়ে বড় তৃপ্ত হয়েছি। এ সময় ইমদাদুল হক মিলনের কালের কণ্ঠের সাংবাদিক নির্মলেন্দু চক্রবর্তী শংকর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। যেই বলেছিলাম, ’৯০-এ টুঙ্গীপাড়া থেকে ফেরার পথে ভাঙ্গার রাস্তায় একজন এমনি করে প্রায় ৭০-৮০টা ডাব খাইয়েছিল। শংকর সঙ্গে সঙেঙ্গ বলছিল, ‘সেই ভদ্রলোক মারা গেছে। কথাটি শুনে বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠেছিল। শংকর একসময়ের ছাত্রলীগের পোড় খাওয়া কর্মী ছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সরকারি কর্তৃপক্ষকে বলেছিল, কাদেরিয়া বাহিনীর কাউকে সে চেনে না। কাদের সিদ্দিকীকে জীবনে দেখেনি।
দুপুর ২টায় এসেছিলাম সার্কিট হাউসে। ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়া সার্কিট হাউসেই ছিলেন। জীবনে মহিলা ডিসি এই প্রথম দেখা। এর আগে এসপির স্ত্রী জজ, জজের স্ত্রী ডাক্তার দেখেছি। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী ডিসি দেখিনি। উম্মে সালমা ফরিদপুরের ডিসি, তার স্বামী মোখলেছুর রহমান সরকার গোপালগঞ্জের। জানি না সিনিয়র কে। শুনেছি, বিসিএসে তারা এক নম্বর আগে পিছে। ফরিদপুর অনেক পুরনো জেলা, গোপালগঞ্জ নতুন। তবে প্রধানমন্ত্রীর জেলা হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্বের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডিসির জন্য মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইলের মানুষ কথা উঠেছিল শাড়ি নিয়ে। কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলাম। নিশ্চয়ই পরে শাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সঙ্গে না থাকায় বিব্রত হয়েছিলাম। মহিলা ডিসির ‘আমার শাড়ি কই’ এমন বলায় সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, মহিলার পছন্দের শাড়ি ও রও জেনে নিও। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আমি স্যারের সঙ্গে জোকস করেছি।’
যাহোক, জহুরা বেগমের ভরণপোষণের মামলার কল্যাণে ফরিদপুর গিয়ে বেশ ভালো লেগেছে। ফেরার পথে বিএনপির নেতা চানের স্ত্রী মাচ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নর্গিস খন্দকারের হাতে মিষ্টি দিয়ে এসেছি। ফরিদপুরে বিজন থাকে। ছেলেবেলায় টাঙ্গাইলে আমাদের পাড়ায় বড় হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমার সঙ্গে অংশ নিতে পারেনি বলে ওর বড় কষ্ট ছিল। তাই ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামে সবার আগে মেঘালয়ের তুরায় গিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরলে ১২ বছর ধানম-ির বাড়ি দেখাশোনা করেছে। বিজনের বিয়েতে প্রধানমন্ত্রী নিজে গিয়েছিলেন আশীর্বাদ বা দোয়া করতে। এখন কেউ খবর রাখে না। এমনই হয়, কে কার খবর রাখে? খবর পত্রিকার মিজানুর রহমান মিজান শুধু বঙ্গবন্ধুর ছবি ছেপে সেই দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর কথা দেশবাসীর মনে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কে খোঁজ নেয় সেই মিজানুর রহমান মিজানের? এমন কত মানুষ। কাপাসিয়ার খালেদ খুররম। কার কথা কে মনে করে? সময় পেরিয়ে গেলে কেউ কাউকে মনে রাখে না। কিন্তু একসময় বাঙালি এমন ছিল না, ছেলের কাছে ভরণপোষণের জন্য মা-বাবার কোর্টে যেতে হতো না, তার প্রমাণ জয়দেবপুরের রফিকুল ইসলাম।
জয়দেবপুরের রফিকুল ইসলাম তার জমিজমা বিক্রি করে ক্যানসারে আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে ১৪ এপ্রিল ভারতে গিয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসক রোগী দেখে কোনো আশা নেই বলে টাকা-পয়সা নষ্ট না করে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। হতাশ পিতা পুত্র আসাদকে নিয়ে ভাঙা বুকে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে ছেলে মারা যায়। বেনাপোল সীমান্তে ছেলের লাশের পাশে কাঁদতে কাঁদতে বাবাও মারা যায়। সন্তানের জন্য পিতা-মাতা এমনই হয়। জয়দেবপুরের পিতা সন্তানের ব্যথায় প্রাণ দেয়, আর ফরিদপুরের সন্তান অসহায় পিতা-মাতাকে গৃহহারা করেÑ এই কি আমাদের মানবতা, মনুষ্যত্ব! এখানে কি রাষ্ট্র ও সমাজের কোনো দায়দায়িত্ব নেই? মানুষের যদি মনুষ্যত্বই না থাকে, জীবজন্তু আর মানুষে তফাত কী? এখানেই তো মানুষ আর অমানুষের ভেদ। আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি একবারও কি ভেবে দেখা উচিত নয়?
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন